somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

মরিতে চাহি না আমি

৩১ শে আগস্ট, ২০১৬ সকাল ১১:০৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



মরিতে চাহি না আমি এই সুন্দর ভুবনে
মানবের মাঝে আমি বাঁচিবারে চাই।

রবি ঠাকুরের এ উচ্চারণে পৃথিবীর প্রতি, মানুষের প্রতি ভালোবাসার মধ্য দিয়ে মৃত্যুকে এড়িয়ে বেঁচে থাকবার যে আর্তি প্রকাশ পেয়েছে, তা শাশ্বত মানবের আর্তি। কেউ এই পৃথিবী ছেড়ে যেতে চায় না। মায়াময়, মোহময় এ পৃথিবীর প্রতি দুর্নিবার আকর্ষণ মানুষের চিরকালীন। অমরত্ব লাভের বাসনা বিপুল। বিভিন্ন ধর্মীয় কাহিনি, পুরাণ,সাহিত্যে মানুষের অমরত্বের আকাঙ্ক্ষার কথা ছড়িয়ে আছে। কিন্তু মরণশীল মানুষ তার জন্মের প্রধান শর্তটি ভুলে যায় অবলীলায়। মৃত্যুর পরে মানুষের অমরত্বের যে ধারণা বিভিন্ন ধর্মে আছে, তাতে আছে নানা অনিশ্চয়তা, আছে নানা ভয়। ধর্ম বিশ্বাসী মানুষের মনেও তাই পরলোকে নয়, এই পৃথিবীতেই অমর হওয়ার বিপুল বাসনা। তার জন্যে মানুষের চেষ্টারও কমতি নেই। চলছে নিরন্তর গবেষণা, নিরন্তর সাধনা। কিন্তু দৈহিক ভাবে মৃত্যুকে জয় করা মানুষের পক্ষে সম্ভব হয় নি। হয়তো কোনোদিন সম্ভব হবেও না। শুনেছি যুক্তরাষ্ট্রের একদল বিজ্ঞানী গবেষণা করছেন মানুষের যৌবন ধরে রাখবার জন্যে। তারা জানিয়েছেন যে, তারা খুব শিগগিরই এমন এক ওষুধ তৈরি করছেন যা মানুষের বার্ধক্য কে ঠেকিয়ে দেবে, দীর্ঘস্থায়ী করবে যৌবন। সেই সাথে মানুষের আয়ু বাড়িয়ে দেবে দশ বছর পর্যন্ত। অমরত্ব পিয়াসী মানুষের কাছে তাই বা কম কিসে। আয়ু মাত্র দশ বছর বাড়বে। যৌবনটাতো দীর্ঘ হবে। বার্ধক্য নিয়ে বহু বছর বেঁচে বা অমর হয়ে কী লাভ। সুতরাং মানুষের এই অমরত্ব বাসনার অন্তরালে গোপন যে বাসনা তা হচ্ছে অনন্ত যৌবন। বিভিন্ন ধর্মে মৃত্যুর পর পুণ্যবানদের যে স্বর্গ বা বেহেস্তের কথা বলা হয়েছে, তাতে বলা হয়েছে সেখানে বিরাজ করবে চিরবসন্ত, স্বর্গ বা বেহেস্তবাসীরা পাবে অনন্ত যৌবন। মানুষ পৃথিবীতেই অমরত্বের সাথে সাথে সেই অনন্ত যৌবনও প্রত্যাশা করে। অবিশ্বাসীদের ধারণা মানুষের এই গোপন বাসনাই স্বর্গকে এমন করে সাজিয়েছে। সে যাই হোক মানুষের এই অমরত্ব লাভের আকাঙ্ক্ষা, অনন্ত যৌবন লাভের আকাঙ্ক্ষার প্রকাশ রয়েছে পৌরাণিক বিভিন্ন কাহিনিতেও। সে সব কাহিনি অনেকেরই জানা।

গ্রীক পুরাণের সর্বশ্রেষ্ঠ বীর হেরাক্লেস। রোমানদের কাছে হারকিউলিস। এই নামেই সর্বাধিক পরিচিত। গ্রীক ও রোমান পুরাণ কাহিনিতে হারকিউলিসের, মেসোপটেমিয়ার মহাকাব্যের বীর গিলগামেশ, হিন্দু পুরাণে অসুরদের অমরত্বের আকাঙ্ক্ষার কাহিনি লেখা আছে। কিন্তু কেউই অমরত্ব লাভ করেন নি। কেননা অমরত্ব কেবল দেবতাদের জন্যে। মানুষ বা অসুরের অমরত্ব লাভের অধিকার নেই। অসুরদের অমরত্ব প্রদান করা হলেও দেবতারা কৌশলে তাদের অমরত্ব কেড়ে নেয়, এবং তাদের হত্যা করে।

অমরত্বে অধিকার না থাকলেও দেবতাদের কৃপায় চির যৌবন লাভের অধিকার ছিলো। সেরকম দুটি কাহিনি।

প্রাচীন অ্যাসিরীয় সাহিত্যের বিখ্যাত মহাকাব্য গিলগামেশ। সুমেরীয়, অ্যাসিরীয় এবং মেসোপটেমিয়া এই তিন সভ্যতার পটভূমিতে রচিত এই মহাকাব্য। এই মহাকাব্যের নায়ক গিলগামেশ। বন্ধু এনকিডু মারা যাওয়ার পর শোকার্ত গিলগামেশ অমর জীবন লাভের জন্যে স্বর্গ লোকের উদ্দেশ্যে যাত্রা করে। বহু বাধা বিপত্তি পেরিয়ে স্বর্গলোকে পৌঁছুলে সেখানে তার পূর্ব পুরুষ উতনাপিশতিমের দেখা পায়। এই উতনাপিশতিম দেবতাদের দয়ায় অমরত্ব লাভ করে স্বর্গলোকে থাকার অধিকার পেয়েছিলো। তিনি গিলগামেশকে জানান যে, মানুষের মৃত্যু রোধ করার কোনো উপায় নেই। তবে মানুষের যৌবন ও স্বাস্থ্যকে ফিরে পাওয়া যেতে পারে। সে জন্যে তিনি গিল গামেশকে সমুদ্রের নিচের একটি কাঁটা গাছের সন্ধান দেন। গিল গামেশ পায়ে পাথর বেঁধে সমুদ্রে নেমে পড়লো এবং কাঁটা গাছটি নিয়ে উঠে এলো। ফেরার পথে গাছটি রেখে স্নান করার সময় একটি সাপ গাছটি চুরি করে খেয়ে ফেলে। আর যৌবন ফিরে পাওয়ার আশা শেষ হওয়ায় কাঁদতে থাকে।

এবার ভারতীয় হিন্দু পুরানের কাহিনি। যযাতির যৌবন ফিরে পাবার কাহিনি। শুক্রাচার্য মেয়ে দেবযানীর অভিযোগে ক্ষুব্ধ হয়ে চন্দ্র বংশীয় রাজা যযাতিকে দুর্জয় জরাগ্রস্ত হবার অভিশাপ দেন। যযাতি অনেক অনুনয় করলে শুক্রাচার্য বললেন, তার অভিশাপ মিথ্যে হবে না। তবে যযাতি ইচ্ছে করলে অন্যের শরীরে নিজের জরা সংক্রামিত করতে পারেন। যযাতি তার পুত্রদের ডেকে তার জরা গ্রহণ করতে এবং তাদের যৌবন তাকে দান করতে বলেন। কিন্তু দেবযানীর গর্ভজাত দুই পুত্র এবং শর্মিষ্ঠার গর্ভজাত প্রথম দুই পুত্র জরা গ্রহণে অস্বীকার করলেন। অবশেষে শর্মিষ্ঠার কনিষ্ঠ পুত্র জরা গ্রহণে সম্মত হলেন। যযাতি চার পুত্রকে অভিশাপ দিয়ে পুরুর দেহে নিজের জরা সংক্রামিত করে পুরুর যৌবন নিজে গ্রহণ করে পুরুকে বললেন, “ আমি তোমার যৌবন নিয়ে কিছুদিন সুখ ভোগ করবো। এক হাজার বছর পূর্ণ হলে তোমার যৌবন আবার তোমাকে ফিরিয়ে দিয়ে আমি জরা গ্রহণ করবো। ”

এ কাহিনির এখানেই শেষ নয়। কাহিনির সাথে একটি নৈতিক শিক্ষাও আছে। কিন্তু আমাদের প্রয়োজন এটুকুই। কেননা আমাদের অন্বিষ্ট মানুষের অমরত্ব বা অনন্ত যৌবন বাসনা। মাটির পৃথিবীতে সেই অনন্ত যৌবন লাভ করাও কখনো সম্ভব নয়। কিছুকাল হয়তো জরাকে ঠেকিয়ে রাখা যাবে, কিন্তু অনন্ত কালের জন্যে তা ঠেকিয়ে রাখা মানুষের পক্ষে কোনোদিন সম্ভব হবে না এই জন্যে যে, তা প্রাকৃতিক নিয়ম বিরুদ্ধ। প্রকৃতির কাছে এখনো মানুষ বহু ক্ষেত্রে খুবই অসহায়। তাই অনন্ত যৌবন বা অনন্ত জীবনের প্রত্যাশা মানুষের এক অলীক বাসনা। কোনোদিন মানুষ যদি এমন ওষুধ বা পথ্য আবিষ্কার করে যা মানুষকে দীর্ঘকাল বাঁচিয়ে রাখবে বা মৃত্যু প্রক্রিয়াকে বিলম্বিত করবে তা হলেও আশা নেই। প্রাকৃতিক নানা দুর্যোগের কথা বাদই দিলাম, মানুষের সৃষ্টি নানা কারণ সেই মৃত্যু প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করতে পারে।
তাই কোনোভাবেই পৃথিবীতে দৈহিক ভাবে অমর হওয়া সম্ভব নয়। তবু মানুষ বসে থাকে নি। অন্য কোনোভাবে নিজের বিদেহী অস্তিত্বকে পৃথিবীতে অমর করবার নিরন্তর চেষ্টা। এই চেষ্টায় মানুষের কিছুটা সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে পরিবার প্রথা ও সমাজ ব্যবস্থা। পারিবারিক প্রথা গড়ে উঠার সময় মানুষ নিশ্চয়ই এই অমরত্বের চিন্তা করেনি, তবে বেঁচে থাকার, ভালোভাবে বেঁচে থাকার জন্যেই তো পরিবার ও সমাজের সৃষ্টি। পরিবারের কারণেই একজন মানুষ তা সে যতোই নগণ্য হোক মৃত্যুর পরও তার নামটি বেঁচে থাকে সন্তান সন্ততির মাঝে হয়তো কয়েক পুরুষ ধরে। পরবর্তী সময়ে মানুষের মনে এই পরিবার আশ্রয়ী অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখবার বাসনা বিকশিত হতে থাকে। পিতৃতান্ত্রিক পরিবার প্রথা ও সমাজ ব্যবস্থা গড়ে উঠার পেছনেও এ ভাবনার ভূমিকা ছিলো। বংশের নামের উৎপত্তি, পদবী সৃষ্টির সাথেও এ অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার বাসনা জড়িয়ে আছে। তার প্রমাণ মেলে পরবর্তীকালে মানুষের মধ্যে বংশলতিকা তৈরি করে রাখার প্রবণতার মধ্যে। শতাব্দীকাল পরে হলেও বংশলতিকা পড়ে আমাকে কেউ স্মরণ করবে এ ইচ্ছাটি বেশ প্রবলই ছিল বংশলতিকা সৃষ্টিতে। পারিবারিক প্রথার শুরুতে মানুষ তেমন করে ভাবেনি, যেমন করে ভেবেছে পরবর্তী কালে। তাই আমরা বলতে পারি সন্তান সন্ততির মধ্য দিয়ে অমর হবার বাসনা প্রাথমিক পর্যায়ে সচেতন প্রয়াস ছিলো না।

মানুষের পৃথিবীর বুকে অমর হবার সচেতন প্রয়াস নানা প্রকার জনহিতৈষী কাজ কর্ম, নানা কীর্তি স্থাপন এবং শিল্প সাহিত্য চর্চার মাধ্যমে। নিজের নাম মানুষের মাঝে অক্ষয় করে রাখার জন্যে বহু কাল আগে থেকেই মানুষের মধ্যে নানা জনহিতকর কাজ করার প্রবণতার উন্মেষ লক্ষ্য করা যায়। মসজিদ মন্দির গির্জা প্রভৃতি উপাসনালয় প্রতিষ্ঠা, মানুষের জলকষ্ট দূর করার জন্যে পুকুর দিঘি খনন, বিদ্যমান পুকুর দিঘির ঘাট বাঁধিয়ে দেয়া, নদীর জল ব্যবহারের জন্যে নদীর ঘাট বাঁধিয়ে দেয়া, মানুষের চলাচলের সুবিধার জন্যে রাস্তা ঘাট নির্মাণ, শিক্ষা বিস্তারের জন্যে স্কুল কলেজ প্রতিষ্ঠা, ব্যবসা বাণিজ্যর জন্যে হাট বাজার প্রতিষ্ঠা, চিকিৎসার জন্যে দাতব্য চিকিৎসালয়, হাসপাতাল নির্মাণ প্রভৃতি বহু কাজের পেছনে জন কল্যাণের পাশাপাশি অমরত্বের বাসনাও প্রবল ছিলো। মানুষের সে চেষ্টা অনেকাংশে সফল হয়েছে। অনেকেই তাদের মৃত্যুর পরও বহুকাল ধরে মানুষের মনে বেঁচে আছেন তাদের সেসব জনহিতকর কাজের মধ্য দিয়ে। এসব কাজের মাধ্যমে অমরত্ব পিয়াসীদের মধ্যে সাধারণ বিত্তবান মানুষ থেকে শুরু করে রাজা জমিদার, তাদের অমাত্যবৃন্দও রয়েছেন। বর্তমান সময়েও সে ধারা অব্যাহত।

অমরত্ব বাসনার আরেকটি প্রতিরূপ হচ্ছে এমন কিছু কীর্তি স্থাপন যা মানুষের জন্যে কল্যাণকর নয়, শুধু ব্যক্তির নাম কে জাঁকিয়ে তোলার জন্যে। মিশরের পিরামিড, ব্যাবিলনের ঝুলন্ত বাগান, হ্যালিকারনাসাসের সমাধি মন্দির, ভারতের তাজমহল প্রভৃতি তেমন কীর্তিরই উদাহরণ। এসব কীর্তি সাধারণ মানুষের পক্ষে গড়া কখনোই সম্ভব নয়। রাজা বাদশাহরা তাদের অমরত্ব লাভের বাসনায় এসব কীর্তি গড়ে গিয়েছেন। এসব কীর্তি বহু বছর মানুষকে বিস্মিত করলেও এসবের সাথে জড়িয়ে আছে কতো না মানুষের দীর্ঘ শ্বাস। সে যাই হোক যারা এসব নির্মাণ করেছেন, তাদের উদ্দেশ্য ব্যর্থ হয় নি। মিশরের পিরামিড, তাজমহলের অস্তিত্ব থাকলেও ব্যাবিলনের ঝুলন্ত বাগানের কোনো অস্তিত্ব আজ আর নেই। হালিকারনাসাসের সমাধি মন্দিরের শুধু ধ্বংসাবশেষ রয়েছে। তবু তারা আজও স্মরণীয়।

অমরত্ব বাসনার অন্য একটি রূপ বলা যায় প্রবল এবং সার্বজনীন রূপ হচ্ছে শিল্পের সাধনা। এর শুরু নানা রকম গুহাচিত্র দিয়ে। এরপর মূর্তি গড়া এবং তারও বহু পরে অমরত্ব বাসনার আশ্রয় হয়েছে লেখা। শুধু ছবি, মূর্তি বা লেখাই নয়, অমরত্ব বাসনার আশ্রয় হয়েছে নাচ গান অভিনয় আরও কতো কিছু। এ প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বক্তব্য স্মরণ করা যায়। তিনি বলেছেন –

আমরা যে মূর্তি গড়িতেছি, ছবি আঁকিতেছি, কবিতা লিখিতেছি, পাথরের মূর্তি করিতেছি, দেশে বিদেশে চিরকাল ধরিয়া অবিশ্রাম এই যে একটা চেষ্টা চলিতেছে, ইহা আর কিছুই নয়, মানুষের হৃদয় মানুষের হৃদয়ের মধ্যে অমরতা প্রার্থনা করিতেছে।

অবশ্য প্রাচীন কালে যে সব গুহাচিত্র দেখা যায়, সেসবে অমরত্ব বাসনা হয়তো এতো প্রকট ছিল না। হয়তো সেসব ছবি এঁকে অমর হবার কোনো ইচ্ছে তাদের মনে জাগে নি, হয়তো তা ছিল শুধুই শিকার শিক্ষার বা অন্য প্রয়োজনে বা নানা ইচ্ছা পূরণের জন্যে, তবে পরবর্তী কালে ছবি এঁকে মানুষের মধ্যে অমর হবার ইচ্ছে স্পষ্ট হয়ে উঠে। লেখা আবিষ্কার হওয়ার পর মানুষ তো ছবির গায়ে নিজের নাম লিখে সে ইচ্ছে মূর্ত করে তোলে। অনেক চিত্রকর মনে করতেন, এখনো করেন যে, ছবির মধ্য দিয়ে তারা অমর হয়ে থাকবেন। তাদের এই মনে করা অসঙ্গত নয়। তার প্রমাণ লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি। তাঁর ‘মোনালিসা’ তাঁকে সৌন্দর্য পিয়াসী মানুষের কাছে দিয়েছে অমরতা। তেমনি ভ্যানগগ, পাবলো পিকাসো, সালভাদার দালি, মকবুল ফিদা হুসেন, জয়নুল আবেদিন এই নামগুলো তো পৃথিবীর মানুষ চেনে তাদের চিত্রকর্মের জন্যেই।

এরপর আমরা বলতে পারি মূর্তি বা ভাস্কর্য গড়ার কথা। এর মাধ্যমে অমরত্বের প্রত্যাশাও বহু প্রাচীন। কেউ নিজের মূর্তি বা ভাস্কর্য অন্যকে দিয়ে বানিয়ে, কেউ অন্যের বা অন্য কিছুর মূর্তি ভাস্কর্য গড়ে অমরত্ব পেতে চেয়েছেন সে সবের মাঝে। সে কারণেই আমরা প্রাচীন গ্রিসে, রোমে, মিশরের ভাস্কর্য শিল্পের অসাধারণ কিছু নিদর্শন দেখতে পাই। তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য কটি হচ্ছে গ্রিসের অ্যাপোলো, ভেনাস ডি মিলো, হারমিস, রোমের ব্রুটাস, অগাস্টাস ও ক্লডিয়াসের মূর্তি, মিশরের রাণী নেফারতিতি, তুতেনখামেন, মেমন ও স্ফিংসের মূর্তি। গ্রিসের ভেনাস ডি মিলো এবং মিশরের স্ফিংসের মূর্তিতো জগদ্বিখ্যাত।

সংগীত, সাহিত্য চর্চায় মানুষকে আনন্দ দেয়ার আড়ালে গোপন ইচ্ছাটি হলো মানুষের অন্তরে ঠাঁই করে নেয়া। কখনো কখনো কবি সাহিত্যিকের লেখায় সে ইচ্ছের প্রকাশও ঘটেছে। ছবি বা ভাস্কর্যের শিল্পীদের পক্ষে তেমন করে বলার সুযোগ নেই। গালিব তাঁর মানুষের মাঝে বেঁচে থাকার আশা প্রকাশ করেছেন এ ভাবে –

দয়া করে যখন খুশি আমাকে ডেকে নাও।
আমি বিগত সময় নই যে আবার আসতে পারবো না।

ইংরেজ কবি Samuel Taylor Coleridge তাঁর সমাধি স্তম্ভের জন্যে লিখে রেখে যান যে এপিটাফ, তাতেও এই অমরত্বের আকাঙ্ক্ষার কাব্যিক প্রকাশ –

Stop, Christian passer-by ! Stop, child of God
And read with gentle breast. Beneath this sod
A poet lies, or that which once seeme’d he .
O,lift one thought in prayer for S.T.C. ;
That he, who many a year, with toil of breath
Found death in life, may here find life in death !
Mercy for praise to be forgiven for fame
He asked, and hoped, through Christ.Do thou the same!

এ রকম আকাঙ্ক্ষার চিত্র দেখতে পাই আমদের মাইকেল মধুসূদন দত্তের এপিটাফেও –
দাঁড়াও, পথিক বর, জন্ম যদি তব
বঙ্গে ! তিষ্ঠ ক্ষণকাল ! এ সমাধির স্থলে
( জননীর কোলে শিশু লভয়ে যেমতি
বিরাম) মহীর পদে মহানিদ্রাবৃত
দত্তকুলোদ্ভব কবি শ্রী মধুসূদন !
যশোরে সাগরদাঁড়ী কবতক্ষ-তীরে
জন্মভূমি, জন্মদাতা দত্ত মহামতি
রাজনারায়ণ নামে, জননী জাহ্নবী !

রবীন্দ্রনাথ যখন বলেন -
মানবের সুখে দুঃখে গাঁথিয়া সংগীত
যদি গো রচিতে পারি অমরালয় !

তখন আমাদের বুঝতে অসুবিধা হয় না যে তিনিও তাঁর সৃষ্টির মাঝেই অমরত্ব প্রত্যাশা করেছেন। এই যে সংগীতে, সাহিত্যে অমরত্ব লাভের ইচ্ছা, সে ইচ্ছারও সফলতার দৃষ্টান্ত অনেক। তাইতো সংগীত প্রেমিক মানুষ মনে রেখেছে বেটোফেন, মোজার্ট, বাখ, ভিভালডিকে, মনে রেখেছে আমির খসরু, মিয়াঁ তানসেনকে। আমাদের হাসন, লালন, রবীন্দ্রনাথ, নজরুলের গান কি কোনোদিন হারিয়ে যাবে বাঙালির মন থেকে। এই যে যাদের অমরত্ব আকাঙ্ক্ষার উদ্ধৃতি দিলাম, তাঁরা কি হারিয়ে গেছেন? না যান নি। তেমনি গ্যেটে, সেক্সপিয়ার, কালিদাস আজো মানুষের মাঝে বেঁচে আছেন।

তবে প্রশ্ন হচ্ছে, কতোজন তার সৃষ্টি কর্মের মাঝ দিয়ে বেঁচে থাকতে পারেন? কতোজনের মাঝে বেঁচে থাকতে পারেন? কতোকাল বেঁচে থাকতে পারেন? এ প্রশ্নের উত্তরে বলা যায়, যতো মানুষ বিভিন্ন শিল্পের মাধ্যমে পৃথিবীর বুকে নিজের নামকে অক্ষয় করে রাখতে চায়, তাদের খুবই সামান্য কজন, মহামানবের বিচারে খুবই অল্প কিছু মানুষের মাঝে, মহা কালের বিচারে অতি অল্প কাল বেঁচে থাকে। তারপর কালের ধুলোয় ঢাকা পড়ে সব।

(গ্রন্থ – মৃত্যু এবং কী আছে শেষে)

সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে আগস্ট, ২০১৬ সকাল ১১:২২
১টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছিঁচকাঁদুনে ছেলে আর চোখ মোছানো মেয়ে...

লিখেছেন খায়রুল আহসান, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:০৯

ছিঁচকাঁদুনে ছেলে আর চোখ মোছানো মেয়ে,
পড়তো তারা প্লে গ্রুপে এক প্রিপারেটরি স্কুলে।
রোজ সকালে মা তাদের বিছানা থেকে তুলে,
টেনে টুনে রেডি করাতেন মহা হুলস্থূলে।

মেয়ের মুখে থাকতো হাসি, ছেলের চোখে... ...বাকিটুকু পড়ুন

অহমিকা পাগলা

লিখেছেন আলমগীর সরকার লিটন, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১৪


এক আবেগ অনুভূতি আর
উপলব্ধির গন্ধ নিলো না
কি পাষাণ ধর্মলয় মানুষ;
আশপাশ কবর দেখে না
কি মাটির প্রণয় ভাবে না-
এই হলো বাস্তবতা আর
আবেগ, তাই না শুধু বাতাস
গায়ে লাগে না, মন জুড়ায় না;
বলো... ...বাকিটুকু পড়ুন

হার জিত চ্যাপ্টার ৩০

লিখেছেন স্প্যানকড, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩




তোমার হুটহাট
চলে আসার অপেক্ষায় থাকি
কি যে এক ছটফটানি
তোমার ফিরে আসা
যেন প্রিয় কারো সনে
কোথাও ঘুরতে যাবার মতো আনন্দ
বারবার ঘড়ি দেখা
বারবার অস্থির হতে হতে
ঘুম ছুটে... ...বাকিটুকু পড়ুন

জীবনাস্ত

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৪৪



ভোরবেলা তুমি নিশ্চুপ হয়ে গেলে একদম,
তোমার বাম হাত আমার গলায় পেঁচিয়ে নেই,
ভাবলাম,তুমি অতিনিদ্রায় আচ্ছন্ন ,
কিন্তু এমন তো কখনো হয়নি
তুমি বরফ জমা নিথর হয়ে আছ ,
আমি... ...বাকিটুকু পড়ুন

যে দেশে সকাল শুরু হয় দুর্ঘটনার খবর দেখে

লিখেছেন এম ডি মুসা, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:১১

প্রতি মিনিটে দুর্ঘটনার খবর দেখে অভ্যস্ত। প্রতিনিয়ত বন্যা জলোচ্ছ্বাস আসে না, প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনার খবর আসে। আগে খুব ভোরে হকার এসে বাসায় পত্রিকা দিয়ে যেত। বর্তমানেও প্রচলিত আছে তবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×