কনসার্টটির শুরুতেই পণ্ডিত রবিশংকর এক সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে বলেন, ‘প্রথম ভাগে ভারতীয় সংগীত থাকবে। এর জন্য কিছু মনোনিবেশ দরকার। পরে আপনারা প্রিয় শিল্পীদের গান শুনবেন। আমাদের বাদন শুধুই সুর নয়, এতে বাণী আছে। আমরা শিল্পী, রাজনীতিক নই। বাংলাদেশে অত্যন্ত দুঃখজনক ঘটনা ঘটছে। বাংলাদেশের পল্লিগীতির সুরের ভিত্তিতে আমরা বাজাব “বাংলা ধুন”।’ তিনি ‘বাংলা ধুন’ নামের একটি নতুন সুর সৃষ্টি করেছিলেন। সেটি দিয়েই আলী আকবরের সঙ্গে যুগলবন্দীতে কনসার্ট শুরু হয়েছিল। তবলায় ছিলেন ওস্তাদ আল্লা রাখা এবং তানপুরায় ছিলেন কমলা চক্রবর্তী। অনুষ্ঠানের শেষ পরিবেশনা ছিল জর্জ হ্যারিসনের সেই অবিস্মরণীয় গান ‘বাংলাদেশ বাংলাদেশ’। প্রথমে পরিকল্পনা ছিল, একটি কনসার্ট হবে। কিন্তু সেদিন এত বিপুল সাড়া জাগিয়েছিল কনসার্টটি যে পরে অনুষ্ঠানসূচি ঠিক রেখে, একই দিনে আরও একটি অনুষ্ঠান করতে হয়েছিল দ্য কনসার্ট ফর বাংলাদেশ-এর।
জর্জ হ্যারিসন বিংশ শতাব্দীর অত্যন্ত প্রতিভাবান একজন জনপ্রিয় গায়ক এবং গিটারিস্ট।এই কনসার্ট হতে সংগৃহীত ২,৫০,০০০ ডলার বাংলাদেশের উদ্বাস্তুদের জন্য দেয়া হয়েছিল। ১৯৭১ সালের ১ আগস্ট নিউইয়র্কের ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেনে ৪০ হাজার দর্শক-শ্রোতার উপস্থিতিতে কনর্সার্ট হয়। হানাদার নরপশু পাকিস্তানি হায়েনাদের বিরুদ্ধে প্রাণপণে লড়ার জন্য আমরা হাতে তুলে নিয়েছিলাম অস্ত্র আর জর্জ হ্যারিসন নিয়েছিলেন গিটার- হ্যারিসনের সেই প্রতিবাদী গিটার ও গানকে আমাদের স্বাধীনতার পক্ষে, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে হাতিয়ারই বলতে হবে । ব্যক্তিগত জীবনে জর্জ হ্যারিসন কিছুটা অন্তর্মুখী স্বভাবের ছিলেন। কিছুটা রহস্যাবৃত থাকতেই ভালোবাসতেন তিনি। জন লেনন বলেছিলেন, জর্জ নিজে কোনো রহস্য নয়, কিন্তু ওর ভেতরে তো অনন্ত রহস্য।
জর্জ হ্যারিসনের জন্ম ইংল্যান্ডের লিভারপুলের ওভারট্রিতে ২৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৪৩ সালে। তার বড় ভাই হ্যারি, অপর ভাই পিটার আর মা লুইস এবং বাবা হ্যারি সকলেই আইরিশ অরিজিন ছিলেন। ডোভডেল প্রাইমারি স্কুল লেভেলের পড়াশোনা শেষ করে লিভারপুল ইনস্টিটিউটে ভর্তি হন জর্জ হ্যারিসন এবং স্কুলের বাসে পল ম্যাকাটনের সাথে পরিচয় হয়। ১৩ বছর বয়সে সাড়ে তিন পাউন্ডের একটি পুরনো গিটার কিনে দেন তার মা। ’৬৬ সালে জর্জ বিয়ে করেন পেট্রিকে। ’৬৭ সালে জর্জের পরিচয় হয় রবিশংকর এবং মহাঋষি মহেষ যোগির সাথে। রবিশংকরের সাথে থেকে জর্জ ভারতীয় মিউজিকের প্রতি দুর্বল হয়ে পড়েন আর মহেষ তাকে শেখান মেডিটেশন। পেট্রিকের সাথে ছাড়াছাড়ির পর ’৭৭ সালে জর্জ বিয়ে করেন তার সেক্রেটারি অলিভিয়াকে।স্বাধীন বাংলাদেশে জর্জ হ্যারিসন কোনো রাষ্ট্রীয় সম্মান পাননি। কোনো রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে হ্যারিসনকে দাওয়াত দেওয়া হয়নি।
অক্লান্ত পরিশ্রমে হ্যারিসন শিল্পী ও যন্ত্রীদের সঙ্গে যোগাযোগ করে তিনি এই কনসার্টের আয়োজন করেন। অনুষ্ঠানের গানের অ্যালবামটি সে বছর গ্যামি পুরস্কার লাভ করে। ২০০৫ সালে ‘দি কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’ পুনরায় ডিভিডি হিসেবে ডকুমেন্টারি সহ প্রকাশিত হয়েছে। এই ডিভিডি-র বিক্রয়লব্ধ অর্থ ‘জর্জ হ্যারিসন ফান্ড ফর ইউনিসেফ’-এ জমা হবে। কোনো দেশের মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে আমেরিকার ইতিহাসে এধরণের কনসার্ট আর হয়নি। ২০০৫ সালে এবিসি টেলিভিশনের ‘গুড মর্ণিং’ অনুষ্ঠানে ‘দি কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’ প্রদর্শন করা হয় এবং ডিভিডি-র উপর আলোকপাত করার সময় জর্জ হ্যারিসনের স্ত্রী অলিভিয়া বলেছিলেন, অনুষ্ঠানটির যে ঐতিহাসিক গুরুত্ব রয়েছে তা হ্যারিসন তখনই বুঝতে পেরেছিলেন- সেজন্যেই তিনি পুরো অনুষ্ঠানের ভিডিও করেছিলেন। এই কনসার্ট ই সম্ভবত প্রথম কনসার্ট যা আর্ত্মানবতার জন্য করা হয়।
২০০১ সালের ৩০ নভেম্বর রাত দেড়টায় জর্জ হ্যারিসন চিরদিনের জন্য সবার থেকে বিদায় নিয়ে চলে যান। ক্যান্সার নামক মরণ ব্যাধি বিশ্বনন্দিত এই সঙ্গীত প্রতিভার প্রাণ কেড়ে নিয়েছে।ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ার বলেছিলেন, বাল্যকালে তিনিও বিটলস দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ, ব্রিটেনের রানী এলিজাবেথও পৃথকভাবে শোক প্রকাশ করেছিলেন। ৮২ বছর বয়সী রবিশংকর কন্যা অনুস্কাকে নিয়ে লস এ্যাঞ্জেলসে জর্জ হ্যারিসনের মৃত্যুশয্যাপাশে উপস্থিত ছিলেন। বাংলাদেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধীদলের নেত্রীও শোক প্রকাশ করেছিলেন। বাংলাদেশ টেলিভিশন ও রেডিও দয়া করে সাধারণ খবরের মত সংবাদটি দিয়েছিল।
‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’ শুরু হয় রবি শঙ্করের পরিবেশনা দিয়ে। তিনি প্রথমে বাংলাদেশের পল্লীগীতির সুরে বাজালেন প্রায় ১৮ মিনিটের ‘বাংলা ধুন’। কনসার্টের দ্বিতীয় অংশে জর্জ হ্যারিসন একাই গেয়েছিলেন আটটি গান। বব ডিলান গেয়েছিলেন পাঁচটি গান। রিংগো স্টার ও বিলি প্রেস্টন একটি করে গান। কনসার্টটি শেষ করেন জর্জ হ্যারিসন তাঁর অবিস্মরণীয় সৃষ্টি ‘বাংলাদেশ বাংলাদেশ’ গানটি দিয়ে।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের এক অনন্য, ব্যাতিক্রমী অংশীদার জর্জ হ্যারিসনের কাছে পুরো বাঙালি জাতি ঋণী। আমরা কি জর্জ হ্যারিসনকে মনে রেখেছি? জর্জ হ্যারিসন প্রতিবেশি ভারতে কয়েকবার এলেও আমরা কি একটি বারের জন্য পারলামনা জীবিত অবস্থায় তাঁকে বাংলাদেশে এনে সম্মান করে সংবর্ধনা দিতে! এর চেয়ে দুঃখজনক, বেদনাকর ও লজ্জাজনক ঘটনা আর কি হতে পারে? ঢাকার একটি গুরুত্বপূর্ণ সড়কের নাম জর্জ হ্যারিসনের নামে রাখার জন্য গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আকুল আবেদন জানাচ্ছি। যতদিন বাংলাদেশ থাকবে, ততদিন বাংলাদেশের মুক্তিকামী মানুষ মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে জর্জ হ্যারিসনের নাম শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করবে- কারণ তিনি চিরকৃতজ্ঞতার বন্ধনে আমাদের আবদ্ধ করে গেছেন। শুধু হ্যারিসনই নয়, ববভিলান, লিওনরাসেল, বিলপ্রেষ্টন, রিঙ্গোষ্টার এরিক্ল্যাপটন, ওস্তাদ আলী আকবর সহ বিশ্ববরেণ্য এসব মহৎ শিল্পীদের কতটুকু সম্মান দেখাতে পেরেছি?
জর্জ হ্যারিসনের বাংলাদেশ গানটি-
My friend came to me, with sadness in his eyes
He told me that he wanted help
Before his country dies
Although I couldn't feel the pain, I knew I had to try
Now I'm asking all of you
To help us save some lives
Bangladesh, Bangladesh
Where so many people are dying fast
And it sure looks like a mess
I've never seen such distress
Now won't you lend your hand and understand
Relieve the people of Bangladesh
Bangladesh, Bangladesh
Such a great disaster - I don't understand
But it sure looks like a mess
I've never known such distress
Now please don't turn away, I want to hear you say
Relieve the people of Bangladesh
Relieve Bangladesh
Bangladesh, Bangladesh
Now it may seem so far from where we all are
It's something we can't neglect
It's something I can't neglect
Now won't you give some bread to get the starving fed
We've got to relieve Bangladesh
Relieve the people of Bangladesh
We've got to relieve Bangladesh
Relieve the people of Bangladesh
( তথ্যসুত্রঃ ইন্টারনেট )
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই সেপ্টেম্বর, ২০১২ বিকাল ৩:৫৪