আমি যখন ঢাকা শহরের রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাই- তখন গাড়িওয়ালা লোকদের উপর আমার খুব রাগ হয়। ঢাকা শহরে এত মানুষজন যে শান্তিতে একটু হাঁটাও যায় না। সামান্য বৃষ্টিতে রাস্তায় পানি জমে যায়। এর মধ্যে বাস গাড়ি সিএনজি এমন বেপরোয়া ভাবে চালায় যে, জীবনটা হাতে নিয়ে চলাচল করতে হয়। রাস্তায় জমে থাকা ময়লা পানি গাড়ির চাকায় ছিটকে এসে গায়ে লাগে। ড্রাইভার এমন ভাব করে যেন এটাই অলিখিত নিয়ম।
আবার এই আমিই যখন কোথাও গাড়ি করে যাই, তখন মনে হয়, ঢাকা শহরের মানুষজন গুলো খুব অদ্ভুত। এরা কোনো নিয়ম কানুন মানে না। ফুটপাত ছেড়ে রাস্তায় হাঁটছে। আবার হুটহাট রাস্তার মাঝখানে চলে আসে। এর মধ্যে গাড়ি চালানো যে কি মুশকিল তা তারা বুঝে না। হর্ন দিলেও সরে না। হঠাত রাস্তার মাঝখানে এক হাত উঁচু করে রাস্তা পার হয়। উন্নত দেশ হলে এই রকম লোককে গ্রেফতার করা হতো।
এই কয়েকদিন আগে, সকালে অফিসে যাব দেরী হয়ে যাচ্ছে- কোনো বাস থামছে না। অনেকক্ষন ধরে দাঁড়িয়ে আছি। শেষে এক চলন্ত বাসে লাফ দিয়ে উঠলাম। দরজা লাগানো। আমি দরজায় ঝুলে আছি। আমি খুব করুনভাবে বলছি প্লীজ দরজা খুলুন। আমি পড়ে যাচ্ছি। বাসের ভেতর থেকে একসাথে অনেকজন বলে উঠলো- জায়গা নেই। জায়গা নেই। এদিকে আমার অবস্থা কাহিল। যে কোনো সময় আমি পরে যেতে পারি। প্লীজ দরজাটা খুলুন। হেলপারের দয়া হলে দরজাটা একটু ফাঁক করলো। সেই ফাঁক দিয়েই আমি সাপের মতো ঢুকে গেলাম। বাসের অনেক যাত্রী রেগে গেল, কেউ কেউ অনেক উপদেশ দিল। আমি চুপ করে তাদের সবার মন্তব্য শুনলাম। আসলেই বাসের ভিতর খুব ভিড়। দাড়াবার জায়গাও নেই।
বাসটা কিছু দূর যাওয়ার, আমার মতোই আরেকটা ছেলে দরজার কাছে ঝুলে আছে আর বলছে- দরজাটা একটু খুলুন। আমার খুব তাড়া আছে। বাসের ভেতর থেকে অনেকে বলছে জায়গা নেই। জায়গা নেই। বাসের দরজায় ঝুলে থাকা ছেলে কিছুতেই তা শুনছে না। মানছে না। তাদের সাথে আমিও বলছি- জায়গা নেই। জায়গা নেই। অন্য যাত্রীদের থেকে আমি বেশি রেগে গিয়ে বললাম- নির্বোধের মতো ঝুলে আছেন কেন? আপনাদের কি কোনোদিন জ্ঞান বুদ্ধি হবে না? মুহূর্তের মধ্যে আমার মানসিকতা বদলে গেল! আজিব! একটু আগে আমি নিজেই এই কাজ করেছি।
একবার অফিসে কে যেন আমার সাথে দেখা করতে এলো। নাম সম্ভবত মকবুল। সেদিন আমি খুব ব্যস্ত ছিলাম এবং মন-মেজাজও খুব বিক্ষিপ্ত ছিল। রিসেপশনিস্টকে বললাম, মকবুলকে অপেক্ষা করতে বলো- ফ্রি হলে ডাকবো। এরপর দুই ঘন্টা পার হয়ে গেল। ব্যস্ততার কারনে সেই লোকটির কথা ভুলেই গেলাম। খেয়াল হতেই রিসেপশনিস্টকে ফোন দিলাম, জানতে পারলাম এক ঘন্টা অপেক্ষা করে মকবুল চলে গেছে।
একদিন আমি এক অফিসে গেলাম। চেয়ারম্যানের সাথে দেখা করবো। চেয়ারম্যান সাহেব আমাকে অল্প চিনেন। চেয়ারম্যানের পিয়ন বলল, আজ দেখা হবে না স্যার খুব ব্যস্ত। আপনি আগামীকাল আসেন। রিসিপশনের দু'টি মেয়ে হা করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি খুব করে পিয়নকে বললাম, তুমি কি গিয়ে শুধু আমার নামটা বলো। আমি দুই মিনিটের বেশি সময় নেব না। আমি নিজে শ্লিপে আমার নামটা বড় বড় করে লিখে দিলাম। এবং বললাম স্যারকে গিয়ে শ্লিপটা দেখাও। তখন তিনি নিজে এসে আমাকে ভেতরে নিয়ে যাবেন। পিয়নটি ভেতরে গেলে এবং একটু পর ফিরে এসে বলল- স্যার বলেছে আজ দেখা হবে না। আপনি অন্য কোনোদিন ফোন করে আসবেন।
আমি প্রচন্ড অপমানিত বোধ করলাম। মাথা ঝিম-ঝিম করতে শুরু করলো। মনে হচ্ছে এ মুহূর্তে আমি অজ্ঞান হয়ে যাব। অপ্রত্যাশিতভাবে অপমান হলে সেই মুহূর্তে আমি চোখে অন্ধকার দেখি। সিড়ির রেলিং ধরে অতি কষ্টে নিজেকে সামলে নিলাম। রাগ করে লিফটে না গিয়ে আমি সতের তলা থেকে হেঁটে নামলাম। ঠিক তখন আমার মকবুলের কথা মনে পড়ল।
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই জুন, ২০১৭ রাত ১:২৭