somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পোস্টটি যিনি লিখেছেন

রাজীব নুর
আমার নাম- রাজীব নূর খান। ভালো লাগে পড়তে- লিখতে আর বুদ্ধিমান লোকদের সাথে আড্ডা দিতে। কোনো কুসংস্কারে আমার বিশ্বাস নেই। নিজের দেশটাকে অত্যাধিক ভালোবাসি। সৎ ও পরিশ্রমী মানুষদের শ্রদ্ধা করি।

চিতই ও নিয়তি

১৮ ই ডিসেম্বর, ২০১৭ বিকাল ৫:০২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



ঢাকা থেকে নারায়নগঞ্জ যাওয়ার পথে 'বরপা' টেম্পু স্ট্যান্ডের ফুটপাতে পিঠা বিক্রি করে রহিমা। রহিমা'র বর্তমান বয়স আটত্রিশ কিন্তু দেখলে মনে হবে পঞ্চাশ পেরিয়ে গেছে। দরিদ্র মানূষদের বয়স দ্রুত বাড়ে। রহিমা'র দুই ছেলে। বড় ছেলের নাম আবু সালাম, ছোটটার নাম আবু কালাম। ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস, তারা দু'জনই প্রতিবন্ধী। পুরোপুরি মানসিক বিকাশ ঘটেনি তাদের। ছেলে দু'টাকে নিয়ে রহিমার কষ্টের সীমা নাই। পিঠা বিক্রি করে রহিমা সারাদিনে প্রায় তিন শ' টাকা আয় করে। সত্যি কথা বলতে- এই টাকা দিয়েই তার সংসার চলে। রহিমা'র স্বামী অসুস্থ। টাকার অভাবে চিকিৎসা হচ্ছে না। রহিমা ভালো করেই জানে টাকার অভাবে চিকিৎসা হচ্ছে না- এমন লোকের সংখ্যা কোটির উপরে।

সরকারি জাগায় পিঠার দোকান বলে- প্রতিদিন পুলিশকে পঞ্চাশ টাকা করে দিতে হয়। আশে পাশের সব দোকান থেকেই পুলিশরা টাকা নেয়। লক্ষ লক্ষ টাকা দিয়ে পুলিশে চাকরি নেবে আর উপরি ইনকাম করবে না- তা কি হয়! এটা তাদের অধিকার, এটা অলিখিত নিয়ম। দেশবাসী মেনে নিয়েছে। রহিমা'র সবচেয়ে দুঃখ লাগে বেশ কয়েকজন পুলিশ প্রায়'ই দশ পনেরটা চিতই পিঠা ধনিয়াপাতা আর শূটকি ভর্তা দিয়ে মুহূর্তের মধ্যে খেয়ে ফেলে। কিন্তু টাকা দেয় না। মনে মনে রহিমা তাদের অকথ্য ভাষায় গালি দেয়। একবার সরকারি লোকজন এসে রহিমার পিঠার দোকান ভেঙ্গে দিল। তখন রহিমা বলেছিল, আমি তো নিয়মিত পুলিশকে পঞ্চাশ টাকা করে দেই। কেউ রহিমার কথা শুনেনি। কারন এক মন্ত্রী বরপা এলাকায় সমাবেশ করবে। তাই রাস্তাঘাট পরিস্কার অভিযান চলছে। রহিমা মনে মনে ভাবে পুলিশ আর সরকারি অফিসের লোকজন সবাই একই পদের। কেউ কারো চেয়ে কম না।

রহিমা ছিল বাবা মা'র একমাত্র সন্তান। খুব আদরের ছিল রহিমা। রহিমার বাবা প্রায়ই বলতেন- আমার মেয়ে হবে রাজরানী। তার বাবা তাকে বিয়ে দিয়েছিলেন ফল ব্যবসায়ী আমিনূল ইসলামের সাথে। আমিনূলের ওয়াইজঘাটে ছিল বিশাল ফলের আড়ৎ। সারারাত তার আড়তে ফল নামতো। বিয়ের পর আমিনূল রহিমাকে নিয়ে গিয়েছিল সিলেটের জাফলং। বড় সুন্দর জায়গা। মানূষটা খরচের হাত খুব। দুইহাতে টাকা খরচ করতো। স্থানীয় কাউন্সিলর নানান ভয়ভীতি দেখিয়ে আড়ৎ টা দখল করে নেয়। তারপর থেকে তারা খুব অভাবে পড়ে যায়। এদিকে আবার আবু সালাম পেটে। সেই থেকে দুঃসময়ের শুরু। আল্লাহ কি নিয়তিতে এই লিখে রেখেছিলেন? কথা বলে, নিয়তির লেখন না যায় খন্ডন! আল্লাহ কি পারতেন না- রহিমার সংসারটা সুখে ভাসিয়ে দিতে? তার স্বামীর আয় উন্নতি দিয়ে ভরিয়ে দিতে। দু'টা সুস্থ সবল ছেলে দিতে। কিন্তু আজ তাকে ফুটপাতে চিতই পিঠা বিক্রি করে স্বামী সন্তান নিয়ে নুন ভাত খেয়ে জীবন যাপন করতে হচ্ছে।

আমিনূল তার খুপরি ঘরের বিছানায় শুয়ে অতীত দিনের কথা ভাবছে। সারাদেশ থেকে বেপারিরা তার কাছ থেকে ফল কিনতে আসতো। সবার সাথেই তার সুসম্পর্ক ছিল। একদিন বেশ কয়েকটা ছেলে তার আড়ৎ এর সামনে একটা মেয়েকে খুব হেনস্তা করে। আমিনূল মেয়েটিকে সাহায্য করার জন্য দৌড়ে যায়। পুলিশকে সে সব জানায়। সবার নাম বলে দেয়। কিন্তু পরের দিন পুলিশ এসে তাকেই গ্রেফতার করে নিয়ে যায়। পুলিশের ঝামেলা মানেই টাকা। সেই সময় পুলিশ তাকে নানান ভয় ভীতি দেখিয়ে অনেক টাকা হাতিয়ে নেয়। আর এই সুযোগে স্থানীয় কাইন্সিলর তার আড়ৎ টা দখল করে নেয়। এরপর থেকেই তার দুর্দিন শুরু। দু'টা ছেলে দু'টাই প্রতিবন্ধী। এলাকার মানুষ তাদের ইচ্ছে মতো কামলা খাটিয়ে নেয়। তার বউ রহিমা সংসারের হাল ধরে। আমিনূলের ভাবতে খুব কষ্ট হয় তালুকদার বাড়ির বউ রাস্তায় পিঠা বিক্রি করে! অসুস্থ রোগা আমিনূল কোথাও কাজ পায় না। বেশ কয়েকবার টেম্পু চালানোর চেষ্টা করেছি- শরীরে কুলোয় না। খুব শখ ছিল ছেলে দু'টাকে ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার বানাবে। আজ আমিনূল তার এই অবস্থার জন্য আল্লাহকে দায়ী করে। মনে হয় তার আল্লাহর উপর থেকে বিশ্বাস'ই উঠে গেছে!

মধ্যদুপুর। প্রচন্ড রোদ। আবু সালাম আর আবু কালাম দুই ভাই একটা আম গাছের নিচে বসে আছে। তাদের মাথায় বুদ্ধি কম বলে প্রাইমারী স্কুল থেকে তাদের তাড়িয়ে দেয়া হয়েছে। সারাদিন বাসায় বসে থাকতে তাদের ভালো লাগে না। ঘরে যদি টিভি থাকতো- তাহলে দুই ভাই সারাদিন বাসায়ই থাকতো। কার্টুন নেটওয়ার্ক চ্যানেলে সারাদিন কার্টুন দেখতো। আগে বাবা তাদের খুব মজার মজার গল্প শুনাতো। ইদানিং শারীরিক অসুস্থতার কারনে সারাদিন চুপ করে শুয়ে থাকেন। এলাকার মানুষ তাদের দুই ভাইকে দেখলেই নানান কাজ করিয়ে নেয়। অবশ্য কেউ কেউ বিনিময়ে পাঁচ দশ টাকা দেয়। সারাদিন শেষে দুই ভাইয়ের চল্লিশ-পঞ্চাশ টাকা হয়। বড় ভাই আবু সালাম টাকার হিসাব রাখতে পারে না। গোন্ডগোল পাকিয়ে ফেলে, তাছাড়া সে ত্রিশ এর বেশি গুনতে পারে না। আবু কালাম অংকে ভালো সে পঞ্চাশ পর্যন্ত গুনতে পারে। কাজেই টাকার হিসাব সে'ই সব রাখে। অবশ্য দুই ভাইয়ের সারা দিনের ইনকাম পরের দিন পর্যন্ত থাকে না। চকলেট আইসক্রীম খেয়ে শেষ হয়ে যায়। দুই ভাইয়ের খুব ইচ্ছা বাবাকে ভালো একটা হাসপাতালে ভর্তি করে চিকিৎসা করবে। তারা ভালো চাকরি বা ব্যবসা করবে। মাকে আর পিঠা বিক্রি করতে দিবে না। নো নেভার।

রাত ৯ টা। আমিনূল তার দুই ছেলেকে নিয়ে খেতে বসেছে। দুপুরে এক ফাঁকে এসে রহিমা রান্না করে রেখে যায়। আজ মেন্যুটা বেশ ভালো। বেগুন আর আলু কুচিকুচি করে পোয়া মাছ রান্না হয়েছে। মাছটা আগে ভেজে নেয়া হয়েছে। সাথে ডাল। ডালে জলপাই দেয়া হয়েছে। রহিমা'র হাতের রান্না বেশ ভালো। তাদের সামনে খাবার কিন্তু তারা কেউ খাচ্ছে না। তারা অপেক্ষা করছে রহিমার জন্য। কিছুক্ষনের মধ্যেই রহিমা চলে আসবে। চারজন মিলে একসাথে খাবে। যদিও রহিমা বহুবার বলেছে, আমার জন্য অপেক্ষা করার দরকার নেই, তোমরা খেয়ে নিবে। কিন্তু আমিনূর রোজ দুই ছেলে নিয়ে রহিমার জন্য অপেক্ষা করে। বাসায় এসে রহিমা যখন দেখে তার পরিবার খাবার সামনে নিয়ে না খেয়ে বসে আছে, তখন তার খুব ভালো লাগে। আনন্দে চোখ ভিজে যায়। জীবনটা খুব আনন্দময় বলে মনে হয়। এইজন্য রহিমা খুব দ্রুত বাসায় আসার জন্য খুব তাড়াহুড়া করে। কিন্তু আজ রহিমা বাসায় আসতে পারবে না। কিছুক্ষন আগে একটা ট্রাক রহিমা'র দোকানের উপর উঠে যায়। ট্রাকের একটা চাকায় রহিমার শরীর ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়।
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই ডিসেম্বর, ২০১৭ রাত ১০:৩৮
১৩টি মন্তব্য ১০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

=এই গরমে সবুজে রাখুন চোখ=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:২১

০১।



চোখ তোমার জ্বলে যায় রোদের আগুনে?
তুমি চোখ রাখো সবুজে এবেলা
আমায় নিয়ে ঘুরে আসো সবুজ অরণ্যে, সবুজ মাঠে;
না বলো না আজ, ফিরিয়ো না মুখ উল্টো।
====================================
এই গরমে একটু সবুজ ছবি দেয়ার চেষ্টা... ...বাকিটুকু পড়ুন

হালহকিকত

লিখেছেন স্প্যানকড, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:১২

ছবি নেট ।

মগজে বাস করে অস্পষ্ট কিছু শব্দ
কুয়াসায় ঢাকা ভোর
মাফলারে চায়ের সদ্য লেগে থাকা লালচে দাগ
দু:খ একদম কাছের
অনেকটা রক্তের সম্পর্কের আত্মীয় ।

প্রেম... ...বাকিটুকু পড়ুন

কুড়ি শব্দের গল্প

লিখেছেন করুণাধারা, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:১৭



জলে ভাসা পদ্ম আমি
কোরা বাংলায় ঘোষণা দিলাম, "বিদায় সামু" !
কিন্তু সামু সিগারেটের নেশার মতো, ছাড়া যায় না! আমি কি সত্যি যাবো? নো... নেভার!

সানমুন
চিলেকোঠার জানালায় পূর্ণিমার চাঁদ। ঘুমন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

ধর্ম ও বিজ্ঞান

লিখেছেন এমএলজি, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৪:২৪

করোনার (COVID) শুরুর দিকে আমি দেশবাসীর কাছে উদাত্ত আহবান জানিয়ে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম, যা শেয়ার হয়েছিল প্রায় ৩ হাজারবার। জীবন বাঁচাতে মরিয়া পাঠকবৃন্দ আশা করেছিলেন এ পোস্ট শেয়ারে কেউ একজন... ...বাকিটুকু পড়ুন

তালগোল

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৩৫


তু‌মি যাও চ‌লে
আ‌মি যাই গ‌লে
চ‌লে যায় ঋতু, শীত গ্রীষ্ম বর্ষা
রাত ফু‌রা‌লেই দি‌নের আ‌লোয় ফর্সা
ঘু‌রেঘু‌রে ফি‌রে‌তো আ‌সে, আ‌সে‌তো ফি‌রে
তু‌মি চ‌লে যাও, তু‌মি চ‌লে যাও, আমা‌কে ঘি‌রে
জড়ায়ে মোহ বাতা‌সে ম‌দির ঘ্রাণ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

×