শাহেদ আজ একটা কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেলল।
সে চাকরি ছেড়ে দিবে। আর না, অনেক হয়েছে। গত পাঁচ বছর ধরে সে একটানা চাকরি করে যাচ্ছে। প্রতিদিন মনে মনে সে একবার করে বলেছে, চাকরির মায়রে বাপ। চাকরি করতে এসে তার অনেক অভিজ্ঞতা হয়েছে। মানুষের বদমাশি গুলো তার চোখে স্পষ্ট ধরা পড়েছে। এই চাকরি করে-করে তার সাহিত্যিক মন নষ্ট হয়ে গেছে। গত পাঁচ বছর সে ঠিক মতো সাহিত্য চর্চা করতে পারেনি। সারাদিন গাধার মতো পরিশ্রম করে, রাতে বাসায় ফিরেই কিছু খেয়ে ঘুম। বউ নিয়ে যে শাহেদ চাঁদনী রাতে একটু ছাদে যাবে সেই উপায় নাই। শরীর ভরা থাকে ক্লান্তিতে।
শাহেদের বউ আছে। একটা পরীর মতো সুন্দর ফুটফুটে মেয়ে আছে। আপনারা হয়তো ভাবছেন, চাকরি ছেড়ে দিলে- শাহেদের সংসার চলবে কি করে? সেই ব্যবস্থা শাহেদ করতে সক্ষম হয়েছে। সে অনেক কষ্ট করে একটা ছোট ফ্লাট কিনতে সক্ষম হয়েছে। এই ফ্লাট থেকে প্রতিমাসে ৩০ থেকে ৩৫ হাজার টাকা ভাড়া সে পাবে। এই ভাড়ার টাকা দিয়ে সে কোনো রকমে ডাল ভাত খেয়ে বউ বাচ্চা নিয়ে জীবন যাপন করতে পারবে। যদিও ৩৫ হাজার টাকা এযুগে কিছুই না। তারপরও ভালো। কারো কাছে হাত তো পাততে হবে না। মানুষের কাছে হাত পাতা প্রচন্ড কষ্টের।
শাহেদের সহকর্মীরা একেকটা শুয়োরের বাচ্চা। অমানুষের বাচ্চা। পাঁচটা বছর তার সীমাহীন কষ্ট হয়েছে একদল শুয়োরের সাথে অফিস করতে। বিবেকহীন মানুষ তারা। শাহেদকে সহজ সরল পেয়ে কুকুরের মতোন খাটিয়েছে। তারপরও শাহেদ মুখ বুঝে হাসি মুখে সব সহ্য করেছে। কারন এই চাকরি ছেড়ে দিলে, অন্য চাকরি পাওয়া মুখের কথা না। দেশে চাকরির বাজার একেবারেই মন্দা। ক্ষমতাবান মামা চাচা অথবা টাকা ছাড়া চাকরি সম্ভব না। নো নেভার। অবশ্য অল্প ক'জন আছেন ভাগ্যবান- মামা চাচা অথবা টাকা ছাড়াই চাকরি পেয়ে যান।
শাহেদ ঠিক করেছে বাকি জীবন আর কাজ করবে না। ফ্লাট ভাড়ার টাকা দিয়ে চলবে। অলরেডি তার পয়ত্রিশ বছর পার হয়ে গেছে। আর পয়ত্রিশ বছর কি সে বাঁচবে? কাজেই যতদিন বাঁচে হাসি আর আনন্দে বাঁচবে। সে সারাদিন তার প্রিয় মুভি গুলো দেখবে। প্রিয় বই গুলো পড়বে। আর ঘুরে বেড়াবে পছন্দের জায়গা গুলোতে বউ বাচ্চা নিয়ে। সকালে সুন্দর ঘুম বাদ দিয়ে অফিস যাওয়ার তাড়া থাকবে না। বাস আর রাস্তা ঘাটের যে অবস্থা, সকালে অফিসে যেতেই সব শক্তি শেষ হয়ে যায়। শাহেদ আজ আনন্দিত, ওই বদ সহকর্মীদের সাথে উঠা বসা করতে হবে না। তাদের মুখ দেখতে হবে না। তাদের কটূ কথা বা গা জ্বালানো কথা শুনতে হবে না। আল্লাহ তার দিকে মুখ তুলে তাকিয়েছেন এতদিন পর।
গত দশ বছরে শাহেদ অনেক কষ্ট করে, জীবনটা তেজপাতা করে একটু একটু করে টাকা জমিয়েছে এবং তার বাবা তাকে কিছু দিয়েছে তাই দিয়েই সে ফ্লাট কিনেছে। মানুষের জীবন অনেক ছোট। এই জীবনটা শুধু দুঃখে, কষ্টে পার করাটা কি ঠিক? আপনারা হয়তো বলবেন, কাজের মধ্যেই আনন্দে খুঁজে নিতে হয়। কাজ'ই মানুষকে মহৎ করে। যার কাজ সুন্দর, তার সব সুন্দর। এইসব ভাবের কথা দিয়ে জীবন চলে না। সহজ সরল সত্য কথা হলো- কোনো চাকরিজীবি সুখে নেই। তাদের পোহাতে হয় সীমাহীন কষ্ট। আর অপমান। মাস শেষে অল্প কয়টা টাকার জন্য কি প্রচন্ড কষ্ট'ই না করতে হয়। শাহেদের ঢাকা শহরের সব অফিস ঘুরা হয়ে গেছে। সে জানে কোন অফিসের কি অবস্থা।
শাহেদ বাচ্চাকে পড়াবে। স্কুলে নিয়ে যাবে। বউকে ঘরের কাজে সহায়তা করবে। চাকরি করলে তো বউকে সময় দেওয়ার সময়'ই পাওয়া যায় না। সেই সকালে বের হতে হয়। ফিরতে হয় রাতে। শুক্রবার ছুটির দিনেও অফিস কোনো না কোনো কাজ দিয়ে ব্যস্ত রাখে। আর তাদের কথা মতো কাজ না করলে অফিস থেকে বের করে দিবে। শাহেদের তো আরামের চাকরি না। সারাটা দিন রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে লোকাল বাসে চড়ে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যেতে হয়। সে তো জমিদারের মতো- এসি রুমে বসে অফিস করে না। এক কথায় তার চাকরি কামলার চাকরি। আর এই চাকরি করতে গিয়েই সে বুঝেছে, ঢাকা শহরের সব মানূষ নষ্ট হয়ে গেছে, পচে গেছে। তার প্রমান পাওয়া যায়- রাস্তা ঘাটে, বাসে, অফিস আদালতে।
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে মে, ২০১৮ রাত ১১:১৮