আমি রমনা পার্কের একটা বেঞ্চিতে বসে আছি।
মাথার উপর বিশাল এক অশ্বত্থ গাছ। সময় মধ্য দুপুর। চারদিকে খা খাঁ রোদ। চামড়া পুড়ে যায়, জ্বলে যায় এমন অবস্থা। সেই কাওরানবাজার থেকে হেঁটে হেঁটে এসেছি। পুরো শরীর ঘামে ভেজা। বিশ্রাম নিচ্ছি। পার্কে প্রচুর গাছপালা থাকার কারনে এখানে বেশ বাতাস আছে। শীতল বাতাস। বাতাসটা বেশ ভালো লাগছে। কিন্তু সমস্যা হলো আমার খুব ক্ষুধা পেয়েছে। ক্ষুধার্ত পেটে কিছুই ভালো লাগে না। না বাতাস, না স্বচ্ছ নীল আকাশ, না জড়াজড়ি করে বসে থাকা স্কুল কলেজের ছেলেমেয়ে। এক সময় ছেলে মেয়েদের লদকালদকি দেখতে ভালো লাগলো। এখন বিরক্ত লাগে।
মাস্টার্স পাশ করে বেকার বসে আছি। সরকারী চাকরি পাবো না, ত্রিশ বছর পার হয়ে গেছে। তার উপরে আবার জন্ম নিয়েছি দরিদ্র পরিবারে। নাই কোনো ক্ষমতাবান মামা চাচা। ভয়াবহ অবস্থার মধ্যে আছি। এদিকে পকেটে আছে মাত্র দশ টাকা। দশ টাকার বাদাম খেতে পারলে ভালো লাগতো। তারপর দুই গ্লাস পানি। সন্ধ্যা পর্যন্ত নিশ্চিন্ত। মনে হয় দুপুর বলেই আশে পাশে কোনো বাদামওয়ালা দেখছি না। কি করবো? কোথায় যাবো? কিছুই বুঝতে পারছি না। মাথা কাজ করছে না। অবশ্য ক্ষুধা পেলে মাথা কাজ করে না। বরং মেজাজ খিটমিটে হয়ে যায়। তখন কেউ ভালো কথা বললেও রাগে শরীর জ্বলে। আহ যদি ধনী কোনো মেয়ের সাথে প্রেম-ভালোবাসার সম্পর্ক থাকতো, ছুটে যেতাম তার কাছে। গিয়ে বললাম, খুব ক্ষুধা পেয়েছে খেতে দাও।
ঠিক এই সময় চেংড়া টাইপ এক ছেলে আমার পাশে এসে বসলো। বেশভূষা দেখে মনে হয় খুব পয়সাওয়ালা। দামী জামা কাপড়, পায়ে সেইরকম একটা সু, দেখলেই বুঝা যায় অনেক দামী। চোখে ওরজিনাল রেবনের সানগ্লাস। এই রকম একটা সানগ্লাসের আমার অনেকদিনের শখ! আমি মুগ্ধ হয়ে চেংড়াকে দেখছি। আমার মতোই বয়স হবে। কি সুন্দর পায়ের উপর পা তুলে পা নাচাচ্ছে! যেন কোনো চিন্তা নাই, ভাবনা নাই। উফ আমি যদি এই চেংড়ার মতো হতে পারতাম- কোনো চিন্তা নাই, ভাবনা নাই।
চেংড়া আমার দিকে তাকিয়ে তাচ্ছিলের সুরে বলল- কি বেকার? চাকরি নাই, পকেটে টাকা নাই? সারাদিন রাস্তায় রাস্তায় টো টো করে ঘুরে বেড়ান সারাদিন? রাত্রে বাসায় চোরের মতোন ঢুকে, কিছু খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েন। এই আপনার অবস্থা, তাই তো?
আমি চেংড়ার কথা শুনে প্রচন্ড অবাক! চেংড়া আমার অবস্থা জানলো কি করে? এমন না যে, সে আমার পূর্ব পরিচিত। আজ'ই জীবনে প্রথম দেখলাম। নাকি দুপুরবেলা কোনো জিন মানুষের রুপ ধরে আমার কাছে এসেছে? আমি এক আকাশ বিস্ময় নিয়ে চেংড়ার দিকে তাকিয়ে আছি। চেংড়া বলল, আজ থেকে সাত বছর আগে আমারও আপনার মতো অবস্থা ছিল। আমিও না খেয়ে এই রমনা পার্কে এসে বসে থাকতাম। দিনের পর দিন, মাসের পর মাস আমার ভয়াবহ অবস্থা গেছে। কেউ কোনো খোজ খবর নেয়নি।
চেংড়াকে দেখে এখন আর খারাপ লাগছে না। মনে হচ্ছে ভিষণ সুন্দর দেখতে। একদম বাংলা সিনেমার নায়ক শাকিব খানের মতো। যখন চেংড়া বলল, চলুন আপনাকে খাইয়ে নিয়ে আসি। আপনার অনেক ক্ষুধা পেয়েছে। চোখ মুখ কেমন শুকিয়ে গেছে। মনে হচ্ছে সারাদিন কিছু খান নি।
চেংড়ার কথা শুনে আমার চোখ ভিজে উঠলো। ইচ্ছা করলো চেংড়াকে বুকে জড়িয়ে ধরি। সত্যি সত্যিই বুকে জড়িয়ে ধরলাম আমি। নাম জানতে চাইলাম। চেংড়া বলল তার নাম শাহেদ। শাহেদ জামাল। বাহ কি সুন্দর নাম! শাহেদ আমাকে পুরান ঢাকায় নিয়ে গেল। আমরা ইচ্ছা মতো হাজী বিরানী খেলাম। সাথে ফান্টা। খাওয়া শেষে বেনসন সিগারেট। পরপর দুইটা বেনসন শেষ করলাম। এখন মনে হচ্ছে জীবনটা বড় আনন্দময়। কষ্ট করে হলেও বেঁচে থাকা দরকার।
চেংড়া মানে শাহেদ জামাল লোক ভালো। অন্তরে মায়া মহব্বত আছে। এরকম দিল দরিয়া টাইপ মানুষ আজকাল আর দেখা যায় না। পুরান ঢাকা থেকে আমরা এবার বাংলা একাডেমীতে এসে বসলাম। রোদের তেজ একেবারে কমে এসেছে। আমি সিগারেটে লম্বা একটা টান দিয়ে বললাম, ভাই শাহেদ তুমি করো কি? শাহেদ বিনা দ্বিধায় বলল, আমি চুরী করি। চুরী। শাহেদের বলার ভঙ্গি দেখেই বুঝেছি সে মজা করছে না। সত্যি কথাই বলেছে। আমার মনে হলো- শাহেদ আসলে গরীবের রবিন হুড। ধনীদের কাছ থেকে ছিনিয়ে এনে গরীবদের বিলিয়ে দেয়। এটা অবশ্যই মহৎ কাজ।
শাহেদ বুঝতে পেরেছে আমি তার গল্প শোনার জন্য অস্থির হয়ে আছি। সে বলল, চুরীর গল্প বলতে ইচ্ছা করছে না। তবে চুরী করে আজ আমার গাড়ী, বাড়ি জমি-জমা সব'ই আছে। কিভাবে চুরীর চিন্তা মাথায় এলো সেই গল্পটা বলি। লেখাপড়া শেষ করে বসে আছি। চাকরি পাই না। টিউশনি করে চলি। ছাত্র হিসেবে আমি খুব ভালো ছিলাম। লেখাপড়ায় সারা জীবন ফাস্ট হয়েছি।
সে যাই হোক, তখন আমার ঘুরে বেড়ানোর খুব শখ। হাতে কিছু টাকা জমলেই চলে যেতাম ঢাকা থেকে অনেক দূরে। একবার বান্দারবন গিয়েছি। মন ভরে পাহাড় আর মেঘ দেখছি। হঠাত দেখলাম একটি পরিবার বেড়াতে এসেছে। পরিবারের প্রধান ব্যক্তিটি বেঞ্চে বসে আছে। তার বউ আর মেয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে মনের আনন্দে। ছবি তুলছে ইচ্ছে মতোন। ভদ্রলোক বেঞ্চে বসে পকেট থেকে দামী সিগারেটের পেকেট বের করে একটা সিগারেট ধরালানে। পেকেটি পকেটে রাখতে গিয়ে মাটিতে পড়ে গেল। ভদ্রলোক চলে যাওয়ার সময় দেখলাম মাটি থেকে পেকেটটি তুলে নিলেন না। আমার মনে হলো লোকটি হয়তো সিগারেটের পেকেটির কথা ভুলে গেছেন। আমি তাকে ডেকে বললাম, স্যার আপনি মনে হয় ভুলে সিগারেটের প্যাকেটটি রেখে যাচ্ছেন। ভদ্রলো আমাকে অবাক করে দিয়ে বললেন, মাটিতে পড়ে যাওয়া জিনিস আমি আর তুলি না। একবার পঞ্চাশ হাজার টাকার একটি বান্ডিল হাত থেকে পড়ে গিয়েছিল। সেই টাকার বান্ডিলও তুলিনি, এতটুকু বলেই ভদ্রলোক চলে গেলেন।
আমি সিগারেটের পেকেটি কুড়িয়ে নিলাম। পুরো নতুন পেকেটে মাত্র একই সিগারেট খাওয়া হয়েছে। আমি একটা সিগারেট ধরালাম। চমৎকার স্বাদ। মুখ ভরতি করে ধোয়া টানতে টানতে আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম- এই রকম লোকদের কাছ থেকে আমি চুরী করবো। তাদের অফুরন্ত ভান্ডার। আমি তাদের কাছ থেকে সামান্য চুরী করলেও তাদের গায়েই লাগবে না। তাদের কাছে চাইলে দিবে না। তাই চুরী করা ছাড়া অন্য কোনো উপায় নাই।
আমি মুগ্ধ হয়ে শাহেদের কথা শুনে যাচ্ছি।
শাহেদ বলেই যাচ্ছে- আমি গরীব মানুষ দেখলেই তাদের সাহায্য সহযোগিতা করি। অসংখ্য দরিদ্র পিতা মাতার সন্তানদের আমি লেখাপড়ার খরচ দেই। অসুস্থ দরিদ্র মানূষদের চিকিৎসা করাই। তবে আমার কোনো ফাউন্ডেশন নেই। অনেককেই দেখি ফাউন্ডেশন খুলে জনসেবা করতে লেগে যায়। তাদের জনসেবা করার পেছনে উদ্দেশ্য আছে। আমার কোনো উদ্দেশ্য নেই। মানুষ হয়ে জন্মেছি তাই মানুষের উপকার করতে চাই। সে যাই হোক, আমি এমন নিখুঁত ভাবে চুরী করে আজ পর্যন্ত কেউ আমাকে ধরতে পারেনি। আমি দেখেছি, খুব টাকা পয়সা হয়ে গেলে মানুষ গুলো নির্বোধ হয়ে যায়। তখন তারা অন্যের মুখের ঝাল খায়। শাহেদ একটানা অনেকক্ষন কথা বলে থামলো।
আমি বললাম, শাহেদ আমাকে আপনার সাথে নিয়ে নিন।
শাহেদ বলল, আপনি পারবেন না। তবে আপনি ব্যবসা শুরু করুন যা টাকা লাগে আমি দিব।
আমি বললাম, শুকুর আলহামদুলিল্লাহ। আচ্ছা, শাহেদ ভাই আপনার হাতে এখন কোনো কাজ নেই?
শাহেদ বললেন, অবশ্যই কাজ আছে। এবার আমি বিশ্বকাপটা চুরী করবো। সারা পৃথিবীতে তাক লাগিয়ে দিব। গত একমাস ধরে বিশ্বকাপ কিভাবে চুরী করবো তা নিয়েই অনেক ব্যস্ত ছিলাম। নানান রকম চিন্তা ভাবনা পরিকল্পনা করতে হয়। ফ্রান্সের ভিসা হয়ে গেছে। আগামী সপ্তাহে রওনা দিব।
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই জুলাই, ২০১৮ বিকাল ৩:৪০