জীবনে প্রথম বাঘ দেখার আশায় সুন্দরবন গেলাম।
কিন্তু বাঘের দেখা পেলাম না। বইতে কত বাঘের কথা পড়েছি। দুবলার চর এলাকায় তিন দিন দুই রাত থাকলাম। তন্নতন্ন করে খুজেও বাঘের দেখা পেলাম না। তবে, খুব উপভোগ করলাম প্রকৃতি। মুগ্ধ হলাম। হরিণ আর বানর খুব বেশি বিরক্ত করেছে। সাগরের পাড়ে শুয়ে আছে কুমিড়। বানর আর হরিন আমাদের আশপাশ দিয়েই খুব দৌড়াদৌড়ি করেছে। বঙ্গোপসাগরে যখন সূর্য ডুবে যায়, তা এক দেখার মতো ব্যাপার। এত সুন্দর, এত সুন্দর যে মরে যেতে ইচ্ছা করে।
বাঘ আমাকে দেখতেই হবে।
পরের বছর আবারও সুন্দরবন গেলাম। এবার গেলাম হিরণ পয়েন্ট। যে জাহাজে করে গিয়েছি তার নাম এম ভি মাছরাঙ্গা। বিশাল জাহাজ। চার তলা। এবারও মন খারাপ করে ফিরে এলাম, বাঘের দেখা পেলাম না। কিন্তু বাঘের পায়ের ছাপ দেখতে পেলাম। যে এলাকায় বাঘ দেখতে পাওয়া যায়, সেসব এলাকায় বন কর্মকর্তারা একটা লাল পতাকা লাগিয়ে রাখে। হাতির পিঠে চড়লাম। প্রকৃতি খুব উপভোগ করলাম। অদ্ভুত সুন্দর। মুগ্ধ! আমি মুগ্ধ! বাসার জন্য খাটি মধু নিলাম এক বোতল।
তৃতীয় বার গেলাম কটকা।
এবং অবিশ্বাস্য ভাবে বাঘের দেখা পেয়ে গেলাম। সেই গল্প'ই এখন বলব।
আমরা প্রায় একশো জনের একটা দল স্টিভ অস্টিন নামে একটা জাহাজে করে সুন্দরবন গিয়েছি। খুব সুন্দর ব্যবস্থা। থাকা, খাওয়া-দাওয়ার কোনো সমস্যা নেই। কেবিন গুলো চমৎকার। জানালা দিয়ে অনেক দূর দেখা যায়! যাই হোক, আমি সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে একা উলটো দিকে হাঁটা শুরু করলাম। প্রায় দেড় ঘন্টা হেঁটে বনের অনেক গভীরে চলে গেলাম। চারদিকে এত গাছপালা যে দুপুর বেলায় হঠাৎ যেন বনে অন্ধকার নেমে আসে। হেঁটে হেঁটে আমি অনেক ক্লান্ত। ঠিক এমন সময়- অপ্রত্যাশিতভাবে দশ গজ দূরে এক বিশাল বাঘ দেখতে পেলাম।
রয়েল বেঙ্গল টাইগার! আবেগে আনন্দে আমি হতবাক, একটা স্বপ্ন সত্যি হয়ে গেল, এই খুশিতে চোখে পানি চলে আসছে। পায়ের তলায় সদ্য শিকার করা হরিণ। তখনও হরিণটা পুরোপুরি মরে যায়নি। তবে খুব ছটফট করছিল। এক আকাশ অবহেলা নিয়ে বাঘটি যেন হরিণটিকে ধরে রেখেছে। তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে আমার দিকে একবার তাকালো বাঘটি। আমি একটুও ভয় পেলাম না। বরং এক আকাশ মুগ্ধতা নিয়ে তাকিয়ে থাকলাম। বাঘ দেখে পালানো বা লুকানোর কথা কিছুই মনে আসলো না আমার। আমার কাঁধে ক্যামেরা অথচ ছবি তোলার কথাও ভুলে গেলাম। এক পৃথিবী বিস্ময় নিয়ে স্বাধীন এক নবাবজাদাকে দেখছি।
বাঘ নিয়ে আমি কিছুটা পড়াশোনা করেছি। তাই আমি জানি, বেশির ভাগ বাঘ'ই মানুষ খেকো নয়। বাঘ যে ক'জন মানুষ মেরেছে তার চেয়ে নব্বই গুন বেশি মানুষ বাঘ হত্যা করেছে। আমি আরও কয়েক পা এগিয়ে গেলাম। আমার সাথে কোনো অস্ত্র নেই। বাঘটি একবার পেছনের দিকে চেয়ে, পর মুহূর্তেই আবার আমার দিকে তাকালো। তখনও তার পায়ের নিচে শিকার ধরা। হরিনটি তখনও পুরোপুরি মরে যায় নি। কিন্তু বাঘের থাবা থেকে পালানোর মতো অবস্থা তার নেই।
বাঘের দিকে তাকিয়ে আমি বললাম, অবশেষে তোমার দেখা পেলাম। বাঘটা হাই তুলল।
আমি আবার বললাম, আমি তোমাকে বিরক্ত করবও না। একটুও বিরক্ত করবও না। বাঘটা অসহায়ভাবে শুধু আমার দিকে চেয়ে থাকল।
আমি বললাম, আমাকে ভয় নেই, আমি তোমার বন্ধু।
বাঘটি আমাকে পাত্তা না দিয়ে, শিকার নিয়ে অন্য কোথাও চলে গেল।
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই আগস্ট, ২০১৯ রাত ৯:১৪