বিগত কয়েক বছর থেকে দেখছি, শত শত মুসুল্লি টাইপের মানুষকে গ্রেফতার করা হয়েছে। গ্রেফতারের পর কি ঘটেছে সেটা কেউ জানে না। তাদের কি জামিন হয়েছে? তাদের বিরুদ্ধে কি কোনো মামলা-মোকদ্দমা হয়েছিল? তারা কি দন্ড পেয়েছে? দন্ড পাওয়ার পর কি তারা জেল খাটছে? সকলেরই কি শাস্তি হয়েছে? কেউ কি খালাস পায়নি? এসব কোনো তথ্যই পাওয়া যায়নি বা যায়ও না। তথ্য যা কিছুই পাওয়া যায় তা এক তরফা এবং একপেশে।
বাংলাদেশে জঙ্গিবাদী দলের সংখ্যা কত? এ সম্পর্কে সঠিক তথ্য এবং পরিসংখ্যান কেউ দিতে পারেন না। সরকারের কাছেও সঠিক কোনো তথ্য আছে বলে আমার মনে হয় না। কারণ, সরকারি সূত্রের বরাত দিয়ে কোনো সময় বলা হচ্ছে যে জঙ্গিবাদী দলের সংখ্যা ৪। আবার কোন সময় বলা হচ্ছে ১২। কোন সময় বলা হচ্ছে ১২৪। কয়েকদিন আগে বলা হয়েছে ১৩১। সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে, সরকারি হিসাব মতে জঙ্গিবাদী দলের সংখ্যা সর্বনিম্ন ৪ এবং সর্বোচ্চ ১৩১। মাঝখানে ফাঁক হলো ১২৭।
এই তো কয়েক সপ্তাহ আগে ১২টি সংগঠনকে জঙ্গি হিসাবে চিহ্নিত করে কালো তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। এই কালো তালিকাভুক্তির অর্থ আমার কাছে পরিষ্কার নয়। কালো তালিকাভুক্ত সংগঠনগুলো কি নিষিদ্ধ করা হয়েছে?
মে দিবস উপলক্ষে আয়োজিত সভায় প্রদত্ত ভাষণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আবার জঙ্গিবাদের কথা বললেন। এই সরকারের সিনিয়র এবং জুনিয়র মন্ত্রীরা সবাই সমস্বরে জঙ্গিবাদের কথা বলছেন। সমাজে এর বিরূপ প্রতিক্রিয়া হয়েছে। ব্যবসায়ীদের নেতা জনাব আনিসুল হক তো বলেই ফেলেছেন যে, সরকার যেভাবে জঙ্গিবাদ জঙ্গিবাদ করছে তার ফলে মনে হচ্ছে যে দেশের প্রতিটি ঝোঁপঝাড়ের মধ্যেই একজন করে জঙ্গি রয়েছে। এ ব্যাপারে গত ২৫ এপ্রিল ইংরেজি ?ডেইলী স্টারে' একটি নিবন্ধ ছাপা হয়েছে। নিবন্ধটির লেখক জাপানে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত ছিলেন। নিবন্ধটির শিরোনাম বাংলা করলে দাঁড়ায়- ??আমরা কি বাঘ বাঘ বলে চিৎকার করছি??? লেখক নিবন্ধের শেষে বলেছেন যে, বাঘ কিন্তু আসলে আসেনি। তার সারমর্ম হলো এই উপমহাদেশের ৩টি দেশ অর্থাৎ আফগানিস্তান, পাকিস্তান এবং বাংলাদেশ জঙ্গিবাদ বলে খুব চিৎকার করছে। তার মতে, আফগানিস্তান এবং পাকিস্তানে জঙ্গিবাদ নিয়ে শোরগোল তোলার একটি কারণ থাকতে পারে। কিন্তু বাংলাদেশে সরকার নিজেই এই শোরগোলের নেতৃত্ব দিচ্ছে। কিন্তু তার মতে, বাংলাদেশে জঙ্গিরা খুব বড় বিপদ হয়ে দাঁড়ায়নি। আন্তর্জাতিক প্রচার মাধ্যমেও এ ধরনের কোন খবর নেই।
অথচ জঙ্গিবাদ কোথায় নেই? ভারতের বোম্বেতে জঙ্গি হামলায় শতাধিক ব্যক্তি মারা গেল। এই ঘটনা নিয়ে ভারতে তো রাজনৈতিক দলগুলো হৈচৈ ফেলেনি। শ্রীলঙ্কায় ২২ বছর ধরে গৃহযুদ্ধ চললো। এতোদিনে সেটি অবসানের পথে। নেপালে মাওবাদীরা প্রায় ১২ বছর রাজতন্ত্র উচ্ছেদের জন্য সশস্ত্র সংগ্রাম করেছে। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের ৭টি অঙ্গরাজ্যে অর্থাৎ ?সেভেন সিস্টার্সে, ভারতের ভাষায়, বছরের পর বছর ধরে সশস্ত্র ?বিচ্ছিন্নতাবাদী লড়াই' চলছে। পক্ষান্তরে যারা লড়াই করছে তাদের মতে এবং পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্রগুলোর মতে এটি হলো ?স্বাধীনতা সংগ্রাম বা মুক্তিযুদ্ধ।' ভারতীয়দের ভাষাতেই বলছি, এতো দীর্ঘ এবং ভয়াবহ বিচ্ছিন্নতাবাদী সশস্ত্র সংগ্রামের পরেও ভারত এটা নিয়ে দেশে বা বিদেশে কোন হৈ-চৈ ফেলেনি। স্বাধীনতা সংগ্রামীদের নির্মূল করার জন্য বিশাল সামরিক শক্তি প্রয়োগসহ যা কিছু করা দরকার তার সবকিছুই তারা করে যাচ্ছে। ওখানে পরেশ বড়য়া আছে, আছে লাল ডেঙ্গা, আছে ডঃ ফিজো। বাংলাদেশে কিন্তু ফিজো, লাল ডেঙ্গা বা অরবিন্দ রাজখোয়ার মতো সংগঠক, যোদ্ধা এবং সুবিন্যস্ত দুর্ধর্ষ সংগঠন নেই। চারদলীয় জোট সরকারের আমলে জেএমবির শীর্ষ নেতা শায়খ আবদুর রহমান এবং বাংলা ভাইকে গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতারের পর বিচারে তাদের ফাঁসির রায় হয়। এই রায় ঘোষণার পরেও দেশের কোথাও বিন্দুমাত্রও কোন প্রতিক্রিয়া হয়নি। তারপর সেই ফাঁসির আদেশ কার্যকর করা হয়। তারপরেও দেশে সামান্যতম প্রতিবাদও হয়নি। এই বিষয়টি অত্যন্ত রহস্যময়। ডেইলী স্টারের ঐ নিবন্ধের মতে বাংলা ভাইদের পেছনে এমন কোন শক্তিশালী মহল ছিল যারা পরবর্তীতে তাদের সমর্থন প্রত্যাহার করে নেয়। এটি কোন রাজনৈতিক শক্তি বলে মনে হয় না। এটি এমন একটি শক্তি যারা রাজনীতির দূরনিয়ন্ত্রক।
তাহলে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে, এরা কারা? এমন একটি ঘোলাটে এবং অস্পষ্ট পরিস্থিতিতে ভারত থেকে একটি চাঞ্চল্যকর খবর পরিবেশন করা হয়েছে। ?ইঙ্গো আমেরিকান নিউজ সার্ভিস' (আইএএনএস) নামক বার্তা প্রতিষ্ঠান ২৯শে এপ্রিল খবর দিয়েছে যে বাংলাদেশে অতি সহসাই ইসলামী জঙ্গিবাদের উত্থান ঘটতে যাচ্ছে। জঙ্গিদের এই তৎপরতা পরিচালিত হবে হিজবুত তৌহিদ নামক একটি সংস্থার নেতৃত্বে। খবরে বলা হয়, ??হিজবুত তৌহিদের ৪০ জন শীর্ষস্থানীয় জঙ্গি বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে অবস্থান গ্রহণ করছে। এখানে তারা তাদের ১০ হাজার সশস্ত্র ক্যাডারকে সংগঠিত করবে। গত ১৩ ও ১৪ই এপ্রিল ভারতের পররাষ্ট্র সচিব শিব শঙ্কর মেননের দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে সরকার ইসলামী জঙ্গিবাদ মোকাবিলা করার জন্য ১৭ সদস্যের একটি টাস্কফোর্স গঠন করেছেন। এই টাস্কফোর্সের নেতৃত্ব দেবেন জনাব সোহেল তাজ।?? ভারতীয় সূত্র হতে উৎসারিত এই খবরের সত্যাসত্য সম্পর্কে আমাদের কোন মন্তব্য নেই। হিজবুত তৌহিদ নামক একটি সংগঠনের ১০ হাজার সশস্ত্র ক্যাডার রয়েছে কি না সে সম্পর্কে আমাদের কোন ধারণা নেই। তবে আমাদের প্রশ্ন হলো : এই ধরনের প্রতিটি চাঞ্চল্যকর এবং লোমহর্ষক খবর শুধুমাত্র ভারতীয় সূত্র হতে আসে কেন? বাংলাদেশের গোয়েন্দা সার্ভিসসমূহ কি এই খবর কনফার্ম করেছে? তাদের ভাষ্য জনগণের জানা দরকার। কারণ ১০ হাজার জঙ্গি তো আর খালি হাতে আসেনি। তাদের সাথে তাহলে ১০ হাজার অস্ত্র এসেছে। এতোগুলো গেরিলা বা যোদ্ধা বা সশস্ত্র ব্যক্তি হামলা পরিকল্পনা করবে, আর ভারতের হাতে আমাদের সরকার ঝোল খাবে, এটি কোন অবস্থাতেই গ্রহণযোগ্য নয়। আমাদের মনে করবার যথেষ্ট কারণ আছে যে, খবরগুলোর উৎস যেমন ভারত তেমনি ঐসব জঙ্গি সংগঠন ভারতেরই সৃষ্টিতে হতে পারে। এগুলোকে বলা হয় কাউন্টার টেরোরিস্ট বগি বা পাল্টা সন্ত্রাসী কৌশল। এই কৌশল প্রয়োগ করে ইরান ও আফগানিস্তান দখল করা হয়েছে। বর্তমানে সেই কৌশলের শিকার পাকিস্তান। তাহলে পরবর্তী টার্গেট কি বাংলাদেশ?
তাহলে প্রশ্ন এদের দালাল কারা? কাদের মদদে এমন অপপ্রচার চালানো হচ্ছে?