somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পোস্টটি যিনি লিখেছেন

সত্যকা
রাজু আহমেদ । এক গ্রাম্য বালক । অনেকটা বোকা প্রকৃতির । দুঃখ ছুঁয়ে দেখতে পারি নি ,তবে জীবনের সকল ক্ষেত্রে অনুভব করেছি । সবাইকে প্রচন্ড ভালবাসি কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে প্রকাশ করতে পারি না । বাবা এবং মাকে নিয়েই আমার ছোট্ট একটা পৃথিবী ।

রাস্তায় দাঁড়িয়ে দেখা সিডরের সেই ভয়াল রাত্রি

১৩ ই নভেম্বর, ২০১৪ সন্ধ্যা ৬:৪৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

দিনটা ছিল ২০০৭ সালে ১৫ নভেম্বর । বৃহস্পতিবার । জীবনে এমন কিছু স্মরণীয় দিন কিংবা ঘটনা থাকে যা কোনদিন ভূলবার নয় । এমন একটি দুঃস্মরণীয় দূখের রাত ১৫ নভেম্বর ২০০৭ । যে দিন ঘূর্ণিঝড় সিডর বাংলাদেশেকে তছনছ করে দিয়েছিল । কেড়ে নিয়েছিল হাজার হাজার মানুষের প্রাণ । সেদিনের সে ঘটনার পর আরও কত মানুষের খোঁজ আজও পাওয়া যায়নি । প্রায় প্রতিটি মানুষকে করেছিল সহায় সম্বলহীন নিঃস্ব । বিদ্যুত, খাদ্য এবং আশ্রয়শূণ্য করে দিয়েছিল গোটা জনপদকে ও এর অধিবাসীদেরকে । যোগাযোগ ব্যবস্থাও হয়েছিল বিচ্ছিন্ন । একদিকে দেশে চলছিল স্বৈরশাসন অন্যদিকে প্রকৃতির প্রলয় । সেদিন মানুষ জ্ঞানশূন্য হয়ে দিক-বেদিক ছুটেছিল । কেউ কেউ তাণ্ডবের কবল থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পারলেও বাঁচাতে পারেনি নিকট আত্মীয় স্বজনকে । কারো কারো মৃতদেহ খুঁজে পাওয়া গেলেও বহু মৃতদেহ রয়ে গেছে নিঁখোজ । সেদিনের সে মহাপ্রলয় আজও স্মৃতির মানসপটে দুঃস্বপ্নের মত ভেসে ওঠে । আজও কাঁদায় এবং ভয়ে শিউরে উঠি । সে দিনের সে ভয়াবহতা কি কোনদিন স্মৃতি থেকে মূছে দিত পারব ? ঘূর্ণিঝড় সিডর (অতি মারাত্মক ঘূর্ণিঝড় সিড্র, ইংরেজীতে (Very severe Cyclonic storm Sidr) হচ্ছে ২০০৭ সালে বঙ্গোপসাগর এলাকায় সৃষ্ট একটি ঘূর্ণিঝড় । ২০০৭ সালে উত্তর ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড়ের মধ্যে এটি চতুর্থ নামকৃত ঘূর্ণিঝড় । এটির আরেকটি নাম ট্রপিক্যাল সাইক্লোন ০৬বি (Tropical Cyclone 06B) । শ্রীলংকান শব্দ ‘সিডর’ বা ‘চোখ’ এর নামে এর নামকরণ করা হয়েছিল । ২০০৭ সালের ৯ নভেম্বর আন্দামান দ্বীপপুঞ্জে একটি দূের‌্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার সৃষ্টি হয় । ১১ নভেম্বর আবহাওয়ায় সামান্য দূের‌্যোগের আভাস পাওয়া যায়, এবং পরের দিন তা ঘূর্ণিঝড় সিডর-এ পরিণত হয় । বঙ্গোপসাগরের বিস্তীর্ণ জলরাশিতে এটি দ্রুত শক্তি সঞ্চয় করে এবং বাংলাদেশে একটি দূের‌্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার সৃষ্টি করে । ১৩ নভেম্বর সকাল থেকে আকাশ ছিল মেঘলা এবং সাথে অবিরাম গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছিল । কোন বাতাস ছিল না । প্রকৃতি ছিল অত্যন্ত ঘোমট । ১৪ নভেম্বর আবহাওয়াবিদরা প্রথমে ৫ নম্বর সংকেত দিতে থাকেন ]এবং তা রাত অবধি ৮নং বিপদ সংকেতে গিঁয়ে পৌঁছে । ১৫ নভেম্বর সকালে ঘোষণা করা হয়, সিডর নামের ঘূর্ণিঝড় ধীরে ধীরে বাংলাদেশ উপকূলে এগিয়ে আসছে । দুপুর নাগাদ তা বাংলাদেশ উপকূল অতিক্রম করবে । মুহুর্তেই ১০ নম্বর বিপদ সংকেত ঘোষণা করা হল । রেডিও কিংবা টেলিভিশনে কয়েক মিনিটি পরপর আবহাওয়ার বিশেষ বুলেটিন ঘোষণা হতে থাকল । অবশেষে ১৫ নভেম্বর রাত ৯টায় এটি বাংলাদেশে আঘাত হানে । উল্লেখ্য যে, ১৫ নভেম্বর সকাল পর‌্যন্ত বাতাসের বেগ ছিল ঘন্টায় ২৬০কি.মি/ঘন্টা এবং ৩০৫কি.মি/ঘন্টা বেগে দমকা হাওয়া বইছিলো । একারণে সাফির-সিম্পসন স্কেল অনুযায়ী সিডরকে ক্যাটেগরি-৫ মাত্রার ঘূর্ণিঝড় আখ্যা দেয়া হয় । ঘূর্ণিঝড় সিডর সর্বপ্রথম আঘাত হানে দুবলারচরে । পর‌্যায়ক্রমে এটি আঘাত হানে বরিশালের সকল উপকূলে । পিরোজপুর, পটুয়াখালী, ভোলা, সাতক্ষীরা, লক্ষীপুর, ঝালকাঠীসহ বাংলাদেশের প্রায় ৩১টি জেলায় । সিডরের প্রচন্ড আঘাতে তুলার মত উড়তে থাকে সবকিছু । অবশেষে ১৫ নভেম্বরের গোটা রাত তান্ডব চালিয়ে শেষ রাতে উপকূল অতিক্রম করে ধীরে ধীরে দূর্বল হয়ে পড়ে । ঘূর্ণিঝড় সিডরের প্রবল আঘাত সহ্য করে যারা প্রাণে বেঁচে ছিল তার ১৬ নভেম্বর তাদের চেনা এলাকাকে আর চিনতে পারছিল না । এমনকি নিজ বাড়ীটিকেও চিনতে কষ্ট হচ্ছিল । সকাল থেকেই আর্তনাদের বেদনাবিধুর বিলাপ ভেঁসে আসতে থাকে । ঘূর্ণিঝড়ে সব লন্ডভন্ড করে দিয়েছে । আধা পাকা, কাচা এমনকি পাকা বাড়িও ঝড়ের কবলে পড়ে ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেছে । যে দৃশ্য আসলে নিজ চোখে না দেখলে বর্ণনা করে বোঝানে প্রায় অসম্ভব ।

সিডরের আঘাতে যে অঞ্চলগুলোর সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছিল সেই অঞ্চলসমূহের একটি মঠবাড়ীয়া উপজেলার বলেশ্বর নদীর তীরবর্তী একটি গ্রামে আমার জন্ম এবং বেড়ে ওঠা । সিডরের রাত্রিতেও ভাগ্যক্রমে গ্রামে ছিলাম ! কোন একটা উপলক্ষে আমাদের বাড়ীতে ভাই-বোনসহ পরিবারের সকল সদস্যরা উপস্থিত ছিল । অতীতে বন্যার কোন অভিজ্ঞতা না থাকায় তেমন ভয়ানক কিছুই আঁচ করতে পারছিলাম না বরং এক ধরনের উত্তেজনায় ভূগছিলাম । পরিবারের বায়োজেষ্ঠ্যদের মধ্যে চিন্তার স্পষ্ট রেখা ফুটে উঠলেও আমার তেমন কোন পরিবর্তন হয়নি । সে রাতে ভারত পাকিস্তানের মধ্যে উত্তেজনাকর ক্রিকেট ম্যাচ চলছিল এবং আমি শুয়ে শুয়ে তা দেখছিলাম । হঠাৎ টেলিভিশনের নিচে শিরোনামে ভেসে আসল, দু’ঘন্টার মধ্যে ঘূর্ণিঝড় সিডর বলেশ্বর নদী দিয়ে অতিক্রম করবে । এ সংবাদ দেখার পরেও ব্যক্তিগতভাবে ভাবান্তর হয়নি । বাবাকে খুব বিষন্ন দেখছিলাম এবং তিনি কিছু সময় পরপর টেলিভিশন এবং রেডিওতে খবর শোনার চেষ্টা করছিলেন এবং যতক্ষন মোবাইলে নেটওয়ার্ক ছিল ততক্ষন বিভিন্ন যায়গায় মোবাইল করে সেখানের অবস্থা জানছিলেন । বলেশ্বর নদী থেকে সিডর অতিক্রম করার সংবাদ দেখে তিনি কিছুটা বিচলিত হয়ে পড়লেন কারন তার ১৯৭০ এর ১২ নভেম্বরের সেই ভয়াল রাত্রের অভিজ্ঞতা রয়েছে । উল্লেখ্য যে, আমাদের বাড়িটি টিনশেট এবং অনেকদিনের পুরানো । বাবা ভরসা পেলেন না । তার মনে কোন এক অজানা আতঙ্ক যা স্পষ্টই তার চেহারায় ফুটে উঠেছিল । আমাকে নির্দেশ দিলেন, পরিবারের সকলকে পাশের গ্রামে বোনের পাকা বাড়ীতে রেখে আসার জন্য । সবাই বোনের বাড়ীতে যেতে রাজী হলেও মা অনড় । তিনি বাবা এবং ঘর ছেড়ে কোথাও যাবেন না । তখন বাহিরে তুমুল বাতাস বইছিল । ছোট ছোট ভাইপো-ভাগনীদের কোলে নিয়ে অনিশ্চয়তার মধ্যে রওয়ানা দিলাম এবং মিনিট বিশের সংগ্রামের পরে তাদেরকে নিরাপদে পৌঁছে দিতেও সক্ষম হলাম । যাওয়ার পথে রাস্তায় কেবল দু’এটি গাছ পড়ে থাকতে দেখিছিলাম কিন্তু তাতে যাত্রাপথে খুব বেশি সমস্যার সৃষ্টি করেনি । বিপত্তিটা বাঁধল আমার ফেরার পথে । সকলের নিষেধ উপেক্ষা করে প্রবল বাতাসকে পাশ কাটিয়ে বাবা-মায়ের কাছে ফিরে আসার জন্য এক প্রকার জেঁদ চেপেছিল । হাতে পাঁচ বেটারির চার্জার লাইট এবং সৃষ্টিকর্তা সৃষ্ট বিজলীর চমক তো আছেই । অনেক সাহস করে রাওয়ানা দিয়েছিলাম । কিছু পথ মাড়িয়ে বড় রাস্তায় ওঠার পর বুঝলাম ফেরার সিদ্ধান্তে ভূল ছিল কেননা রাস্তায় গাছ পড়ে আটকে আছে । পিছনে আর ফিরতে ইচ্ছা করল না । বাতাসের বিপরীতে প্রাণপনে ছুটছি কিন্তু পথ এগুচ্ছে না । একদিকে গাছ পড়ার শব্দ অন্যদিকে প্রবল বাতাস । ভয়ে গোটা দেহে শিহরণ খেলছিল । গাছের বাঁধ পেরিয়ে ফাঁকা পেলেই ছুট কিন্তু সে ছোটা বেশিক্ষণ স্থায়ী হচ্ছে না । কারন রাস্তজুড়ে পতিত গাছে সাড়ি । মিনিট চল্লিশের চেষ্টায় প্রায় মাঝ পথ পাড় হয়ে হিন্দু এলাকার সামনের রাস্তার পাশে শতাব্দী প্রাচীন বিশাল এক তেঁতুল গাছের নিচে আশ্রয় নিলাম । অনেকটা ক্লান্ত এবং বাতাসের তীব্রতায় সকল শক্তি প্রয়োগ করেও আর সামনে এঁগুতে পারছিলাম না । সম্ভবত মিনিট পাঁচেক তেঁতুল তলায় দাঁড়িয়ে ছিলাম । সেই পাঁচ মিনিটের অভিজ্ঞতা স্মৃতি থেকে মৃত্যুর পূর্বে মিইয়ে দেয়া যাবে না । বই-পুস্তকে কিংবা গুরুজনদের কাছে আসন্ন কেয়ামতের দিন কি ভয়াবহ অবস্থা হবে তার ভাবী আলামতের কথা শুনেছি কিন্তু সিডরের রাতে যা দেখেছি তার চেয়ে ভয়াবহ অবস্থা আর কি কিছু হতে পারে ? প্রতিটি বিজলীর চমকে আকাশ-ভূমির মধ্যকার ফাঁকা স্থান যখন আলোকিত হচ্ছিল তখন গোটা এলাকার তছনছ হয়ে যাওয়ার অবস্থা দেখেছি । মনে হচ্ছিল-এখনি বোধহয় পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে । আমার মধ্যে ভয় ঢুকে গিয়েছিল এবং ভাবছিলাম এটাই মনে হয় জীবনের সর্বশেষ মূহুর্ত । বাবা-মায়ের কাছে ফিরতে পারব তা একবারের জন্যও মনে হয়নি । বাবা-মায়ের কোলে ফিরবার জন্য শেষ চেষ্টা করতে লাগলাম । তেঁতুল তলা ছেড়ে বাড়ীর উদ্দেশ্যে ছুটলাম । তেঁতুল গাছটা ছেড়ে বিশ সেকেন্ডর পথ এগুনোর পরে চর-চর করে বিকট শব্দ শুনলাম । সম্মূখে গতি রেখেই পিছন ফিরে লাইট মেরে দেখলাম, আমি যেখানে দাঁড়িয়ে ছিলাম শতবর্ষী তেঁতুল গাছটা সে দিকেই উপুড় হয়ে পড়ছে । মনে হচ্ছিল জ্ঞান হারাচ্ছি কিন্তু শেষ অবধি মনের জোড়ে শরীরে অনেক ক্ষত চিহ্ন নিয়ে বাড়ীতে পৌঁছলাম । বাড়ীতে পৌঁছার পর বাতাসের গতি আরও বেড়ে গেল । মনে হচ্ছিল, সবকিছুকে ধ্বংসাবশেষে পরিণত করে যাবে । কিছুই অবশিষ্ট রাখবে না । বাতাসের তীব্র বেগে বাড়ীর অসংখ্য নারীকেল-সুপারিগাছসহ সবকিছু ভেঙ্গে কিংবা উপড়ে যাচ্ছিল । সে দিকে আমার কোন খেয়াল নেই । যেন চেতনাশূণ্য হয়ে রয়েছি । রাস্তার তিক্ত অভিজ্ঞতা, তেঁতুল গাছটি উপরে পড়ার দৃশ্য এবং তেঁতুল তলায় আমার দাঁড়িয়ে থাকার অবস্থান কেবল স্মৃতিপটে ভাসছিল । পরবর্তীতে কি হচ্ছিল সে দিকে আর খেয়াল নেই । ভয়াল সে রাত্রির বাতাসের তেজ একসময় ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল এবং আমিও ঘুমিয়ে পড়েছিলাম । মায়ের ডাকে খুব সকালে ঘুম ভাঙ্গার পর যখন বাহিরে বের হয়েছিলাম তখন আমার চির চেনা বাড়ীটিকে আর পরিচিত মনে হয়নি । গ্রামের বিভিন্ন দিকে তাকিয়ে মনে হয়নি ওটা আমার গ্রাম । মনে হচ্ছিল, দুঃস্বপ্নের মধ্যে সময় পাড় হচ্ছে । যেদিকে তাকাচ্ছিলাম সেদিকেই কেবল ধ্বংসের ছাপ । ভাগ্যিস আমাদের উপজেলাকে রক্ষাকারী বলেশ্বর তীরবর্তী বেড়িবাঁধটি থাকায় আমরা প্রাণে রক্ষা পেয়েছি । সমতল থেকে প্রায় ৩০-৩৫ ফুট উঁচু বেড়িবাঁধটি লাখ লাখ মানুষকে প্রাণে রক্ষা করেছিল । সিডরের পরের দিন সকালে বেড়িবাঁধে গিয়ে ৩০-৩৫ ফুট উঁচু বেড়িবাঁধটির উপর দিয়ে পানি গড়ানোর ছাপ দেখেছি । বাতাসের চাপ যদি আর সামান্য কিছু সময় দীর্ঘ হত তবে বেড়িবাঁধ গড়িয়ে আমাদের আবাসভূমিতে পানি প্রবেশ করত এবং আমাদের ঘরের টিনের উপর দিয়ে সে পানি প্রবাহিত হত । ভাবা যায়, তখন আমাদের কি অবস্থা হত ? সিডর পরবর্তী কয়েকদিন অনেক কাজ করতে হয়েছে । গ্রামে কোন কাজের মানুষ পাওয়া যাচ্ছিল না । সবাই তার নিজ কাজ নিয়ে ব্যস্ত । অনেক গাছ কাটতে হয়েছিল । আর কিছু না হোক অন্তত চলাচলের জন্য রাস্তা পরিস্কার করা দরকার । কুঠার, করাতের ব্যবহারে হাত ক্ষত-বিক্ষত হয়ে গিয়েছিল ।

সিডরের আঘাতে যোগাযোগ মাধ্যমে মহাপিরর‌্যয় নেমে আসে । আত্মীয়-স্বজন, প্রতিবেশীরা বেঁচে আছে না মরে গেছে তাও জানতে পারিনি । বিভিন্ন টেলিকম কোম্পানীর নেটওয়ার্কের টাওয়ার একটাও দাঁড়ানো ছিল না । অন্যদিকে দেশব্যাপী বিদ্যুত বিপরর‌্যয় । সিডরে সবচেয়ে ক্ষতি হয়েছিল রায়েন্দা উপজেলার সাউথখালী ইউনিয়নে । শুধু বেড়িবাঁধের অভাবে পানিতে প্লাবিত হয়ে হাজার হাজার মানুষের জীবন বিপন্ন হয়েছিল । সিডরের চারদিন পর, গ্রামের কয়েকজন বন্ধু মিলে সাউথখালীর অবস্থা দেখতে গিয়েছিলাম । সাথে ছিল কয়েক বোতল পানি ও কয়েক প্যাকেট বিস্কুট । ট্রলারে যখন বলেশ্বর নদী পাড়ি দিচ্ছিলাম তখন মাঝের চর ঘেঁষে সুন্দরবন থেকে ভেসে আসা মৃত হরিনসহ বিভিন্ন প্রাণীর মরদেহ স্তুপ হয়ে পড়ে থাকতে দেখেছি । সাউথখালী প্রবেশ করে সেটা অনাবাদী অঞ্চল বলে মনে হচ্ছিল । কোথাও কিছু নেই । একটি ঘরও দাঁড়িয়ে নেই । যা দু’একজন মানুষ চোখে পড়ছিল তাদেরকে খুব ক্লান্ত এবং ক্ষুধার্ত মনে হচ্ছিল । রাস্তার পাশে কবেল গণকবরের সাঁড়ি দেখেছিলাম । আমাদেরকে পূর্ণ পোশাক পরিহিত দেখে গ্রাম্য অর্ধপোষাক কিংবা কেবল লজ্জাস্থান আবৃত পোষাকে আবৃত মানুষ ছুটে আসছিল আমাদের কাছে কিছু খাবার পাওয়ার আশায় । তখন নিজেরা নিজেদেরকে কেবল অসহায় মনে করিনি বরং কিছুটা বেওকুফও মনে করেছিলাম । সামান্য যে বিস্কুট ও পানি আমরা নিয়ে গিয়েছিলাম তা শুধু আমাদের জন্য । আমরা একবারের জন্যও ভাবতে পারিনি ঐ জনপদের অবস্থা এমন বেহাল হয়েছে । অনেকক্ষন হেঁটে পরিচিত একজনের বাড়িতে গিয়ে দেখলাম তাদের ছোট ছোট ছেলে-মেয়েরা না খেয়ে বসে আছে । ব্যাগ থেকে তাদেরকে বিস্কুট এবং পানি দিলাম তবে তা প্রয়োজনের তুলনায় মোটেই যথেষ্ট ছিল না । সে বাড়ীর এক বয়স্কা মহিলা আমাদেরকে তাদের বাগান-বাড়ির ধ্বংসস্তুপ ঘুরে ঘুরে দেখাচ্ছিল আর হাপিত্যেশ করছিল । হঠাৎ চোখে পড়ল এক মহিলার মরদেহ । সিডরের চারদিন অতিবাহিত হলেও কেউ জানে না কোথা থেকে সে ভেসে এসেছে । যে ডোবাটিতে মহিলার মরদেহ ভাসছিল তার পাশেই সুন্দর একটি পুতুলের মত কিছু একটা ভাসছিল । খুব কাছে গিয়ে দেখলাম, পুতুল নয় বরং সদ্য জন্ম নেয়া একটি ফুটফুটে বাচ্চার নিথর দেহ । আমরা নিজেদেরকে আর ধরে রাখতে পারছিলাম না । সাথে থাকা মহিলাটি জানাল, গত বিকালেও শুধু মহিলার লাশ ছিল । তখন বুঝলাম, রাতের কোন এক সময়ে এ বাচ্চাটি পৃথিবীতে এসেছে । আজও চোখ বুজলে সে বাচ্চাটির ছবি ভেসে ওঠে । শুনেছি, স্রষ্টা ধরাবাসীর পাপের শাস্তি দেয়ার জন্য মাঝে মাঝে বিপদ দিয়ে শাস্তি দিয়ে থাকেন । কিন্তু ভেবে পাচ্ছিলাম না, সদ্য জন্ম নেয়া পুতুলের চেয়েও সুন্দর বাচ্চাটির দোষটা কোথায় ? ওই দিন বন্ধুরা মিলে অনেক পথ হেঁটে ছিলাম আর মানুষের করুন অবস্থার স্বাক্ষী হয়েছিলাম । আজও আঁৎকে উঠি যখন ১৫ নভেম্বর এবং তৎপরবর্তী দিনগুলোর স্মৃতিচারণ করি ।

সিডর আমাদের থেকে কম কিছু কেঁড়ে নেয়নি । সরকার প্রদত্ত পরিসংখ্যান মতে, সিডর কেড়ে নিয়েছিল ৩ হাজার ৩০০ মানুষের জীবন । কিন্তু রেড ক্রসের মতে, মৃত্যের সংখ্যা ২০ হাজারের অধিক । সিডর আঘাত হেনেছিল ১ হাজার ৮১১ টি ইউনিয়নে । প্রায় ৮০ লাখ মানুষ সিডরের কবলে পড়ে । এতে প্রায় ৯ লাখ ৬৮ হাজার ঘর-বাড়ি ধ্বংস হয় । কৃষি মন্ত্রনালয়ের রিপোর্টে বলা হয়েছে, ঘূর্ণিঝড় সিডরে বাংলাদেশের প্রায় ৬০ লাখ টন ধান নষ্ট হয়েছে । ৩১টি জেলার ২১০টি উপজেলায় ২০ লাখ একর জমির ফসল নষ্ট হয়েছিল । সিডরের আঘাতে প্রায় সাড়ে ২৪ লাখ গবাদি পশু মারা যায় । ১০ হাজার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্থ হয় । সব মিলিয়ে ক্ষয়ক্ষতির পরিমান প্রায় ৪৫ কোটি ডলার বা ৬ হাজার ৫০০ কোটি টাকা । যা পূরণ করা বাংলাদেশের জন্য আসলেই কষ্ট সাধ্য । ‘মানুষ মানুষে জন্য’ এই মন্ত্রে দিক্ষীত হয়ে ঝড় শেষ হওয়ার পড়েই বাংলাদেশ নৌ বাহিনীর ৫টি জাহাজ খাদ্য, ত্রাণ সামগ্রীসহ সর্বাধিক ঘূর্ণিঝড় কবলিত এলাকায় পৌঁছে । ইউরোপীয় কমিশন তড়িতভাবে ১.৫ মিলিয়ণ ইউরো অর্থ্যাৎ প্রায় ২.৪ মিলিয়ণ ইউএস ডলার সমপরিমান ত্রাণ সামগ্রি বাংলাদেশের আক্রান্ত মানুষের কাছে পাঠায় । যুক্তরাষ্ট্রের ইউনাইটেড স্টেট নেভী প্রায় ৩৫০০ নৌ সেনা ঘূর্ণিঝড় পরবর্তী উদ্ধার সহায়তার জন্য বাংলাদেশে আসে । অন্যান্য অনেক সংস্থাও সাহায্যের জন্য এগিয়ে এসেছিল । যুক্তরাষ্ট্র, ফিলিপাইন, সৌদি আরবসহ বিশ্বের অনেক দেশ সিডরে ক্ষতিগ্রস্থ মানুষের সাহায্যের জন্য অর্থ সাহায্য এবং লোকবল পাঠিয়েছিল কিন্তু দূর্ভাগ্য আমাদের, এ সাহায্যের দ্বারা সিডর আক্রান্ত মানুষের চেয়েও স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বর থেকে শুরু করে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাসহ অনেকেই বেশি উপকৃত হয়েছেন । বাংলাদেমের প্রেক্ষাপটে অবশ্য সম্পদ বন্টরে এ দৃশ্য দেখে অন্যসময় অবাক হওয়ার উপায় না থাকলেও সিডরের ভুখা, আশ্রয়হীন মানুষের জন্য প্রেরিত বিদেশী সাহায্যের টাকা আত্মসাৎ করতে দেখে অনেকের মত আমিও অবাক হয়েছিলাম । দেশি-বিদেশী বিভিন্ন সংস্থা ও রাষ্ট্র থেকে যে পরিমান অর্থ সাহায্য এসেছিল তাতে সিডর আক্রান্ত প্রতিটি পরিবারে আবারও স্বচ্ছলতা ফিরে আসত যদি সঠিক ভাবে তা বন্টন করা হত । কিন্তু তা হয়নি । আজও সিডর আক্রান্ত মানুষের ক্ষত মোছেনি । সিডরের সেই ধ্বংসযজ্ঞ আজ রয়ে গেছে । ব্রিজ, সুইসগেট, কালভার্ট, সাইক্লোন শেল্টারে যে ক্ষতি হয়েছিল আজও তার অধিকাংশ সংস্কার করা হয়নি অথচ আজ সিডরের ৬ বছর পূর্তি হল । সেদিনে সে ভয়াবহতা আজও শরীর ও মনে কাঁপন সৃষ্টি করে । সুতরাং যথাযথ পদক্ষেপের মাধ্যমে ভবিষ্যতে যেন ঘুর্ণিঝড়ের আঘাতের ভয়াবহতা ও ক্ষতি থেকে মানুষ কিছুটা লাঘব পেতে পারে তার নিশ্চয়তা প্রদান করতে হবে এবং বেশি বেশি করে গাছ লাগাতে হবে । আমরা গাছ রোপন না করে কেবল বনভূমি ধ্বংস করছি । বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, বাংলাদেশের দক্ষিনে যদি সুন্দরবন না থাকত তবে কেবল সিডরের আঘাতে গোটা দেশ জনমানবশূণ্য মরুভূমিতে পরিণত হত ।

রাজু আহমেদ । কলামিষ্ট ।
[email protected]


২টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

কুড়ি শব্দের গল্প

লিখেছেন করুণাধারা, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:১৭



জলে ভাসা পদ্ম আমি
কোরা বাংলায় ঘোষণা দিলাম, "বিদায় সামু" !
কিন্তু সামু সিগারেটের নেশার মতো, ছাড়া যায় না! আমি কি সত্যি যাবো? নো... নেভার!

সানমুন
চিলেকোঠার জানালায় পূর্ণিমার চাঁদ। ঘুমন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

ধর্ম ও বিজ্ঞান

লিখেছেন এমএলজি, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৪:২৪

করোনার (COVID) শুরুর দিকে আমি দেশবাসীর কাছে উদাত্ত আহবান জানিয়ে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম, যা শেয়ার হয়েছিল প্রায় ৩ হাজারবার। জীবন বাঁচাতে মরিয়া পাঠকবৃন্দ আশা করেছিলেন এ পোস্ট শেয়ারে কেউ একজন... ...বাকিটুকু পড়ুন

তালগোল

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৩৫


তু‌মি যাও চ‌লে
আ‌মি যাই গ‌লে
চ‌লে যায় ঋতু, শীত গ্রীষ্ম বর্ষা
রাত ফু‌রা‌লেই দি‌নের আ‌লোয় ফর্সা
ঘু‌রেঘু‌রে ফি‌রে‌তো আ‌সে, আ‌সে‌তো ফি‌রে
তু‌মি চ‌লে যাও, তু‌মি চ‌লে যাও, আমা‌কে ঘি‌রে
জড়ায়ে মোহ বাতা‌সে ম‌দির ঘ্রাণ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

মা

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৩


মায়াবী রাতের চাঁদনী আলো
কিছুই যে আর লাগে না ভালো,
হারিয়ে গেছে মনের আলো
আধার ঘেরা এই মনটা কালো,
মা যেদিন তুই চলে গেলি , আমায় রেখে ওই অন্য পারে।

অন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

কপি করা পোস্ট নিজের নামে চালিয়েও অস্বীকার করলো ব্লগার গেছে দাদা।

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:১৮



একটা পোস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ আগে থেকেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। পোস্টটিতে মদ্য পান নিয়ে কবি মির্জা গালিব, কবি আল্লামা ইকবাল, কবি আহমদ ফারাজ, কবি ওয়াসি এবং কবি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×