"বিশ্বব্যাপী বিরাজ করছে এক মহাশক্তি ৷ সেই মহাশক্তিই আমাদের কাছে ভিন্ন ভিন্ন শক্তিরূপে প্রকাশ পেয়ে থাকে
৷ যা-তাপশক্তি, আলোকশক্তি, বিদ্যুত্শক্তি, চুম্বকশক্তি, ইত্যাদি এবং সর্বোপরি প্রাণশক্তি ৷
...অন্যান্য শক্তির ন্যায় 'প্রাণ' শক্তিটিও মহাশক্তির কোটি কোটি বছরের আবর্তন, বিবর্তন ও রাসায়নিক ক্রিয়ার ফল ৷"৫০
অধ্যয়ন, বিশেষণ এবং পর্যবেক্ষণের মধ্য দিয়ে তিনি সমাজ ও তার ভবিষ্যত্সম্পর্কেও একটি সিদ্ধান্তে এসেছিলেন ৷ তিনি বলেছেন,
"সমাজদেহের অঙ্গবিশেষের অর্থাত্শ্রেণীবিশেষের অতিমাত্রায় উত্থান ও পতন ডেকে আনে সমাজদেহের পঙ্গুতা ও অকর্মণ্যতা ৷
...'সমাজতন্ত্র' তথা 'সাম্যবাদ' হচ্ছে বিশ্বমানবের মঙ্গল বিধানের একমাত্র মাধ্যম৷" এই শর্ত পূরণ ছাড়া বিজ্ঞান ও ধর্মের ফলাফল তাঁর কাছে মনে হয়েছে অভিন্ন, অর্থহীন; 'রকেট-রোবট ব্যবহার' অর্থাত্বিজ্ঞানের বিচ্ছিন্ন 'বিকাশ' এবং ধর্মের আধিপত্য কিংবা 'স্বর্গ নরকের স্বপ্ন দর্শন', তাঁর বিবেচনায়, মানুষকে একই জায়গায় নিপে করে ৷ তিনি তাই বলেছেন, উপরের শর্ত পূরণ ছাড়া
"শুধুমাত্র রকেট-রোবট ব্যবহার ও স্বর্গ নরকের স্বপ্ন দর্শনের দ্বারা সমাজ উন্নয়নের যে প্রচেষ্টা, তা ভেল্কি ছাড়া আর কিছু নয় ৷"৫১
এক ধর্ম বহু ধর্ম : ধর্ম না সমাজ
আরজ আলী বলেন, "আগুন আবিষ্কার থেকে শুরু করে পারমাণবিক শক্তি আবিষ্কার পর্যন্ত অন্য কোন আবিষ্কারেই আঞ্চলিকতা নেই, কিন্তু ধর্ম ও রাষ্ট্র হচ্ছে আঞ্চলিকতায় ভরপুর ৷"৫২
একদিকে একটি নির্দিষ্ট অঞ্চল, তার সমাজ ও সংস্কৃতির আদলে ধর্ম গড়ে উঠে, অন্যদিকে প্রকৃতপক্ষ সমাজ-রাষ্ট্রের অভিব্যক্তি হয়ে উঠে ধর্ম ৷ ধর্ম সম্পর্কে আলোচনা আসলে তাই সমাজ রাষ্ট্র নিয়েই আলোচনা ৷ কেননা সমাজ রাষ্ট্র বাদ দিয়ে ধর্মের অস্তিত্ব নেই ৷ আমরা ইতিহাসে দেখি, মানুষের সমাজজীবনের পরিবর্তনের সাথে সাথে ধর্মের রূপও পরিবর্তিত হয়েছে ৷ গোত্র জীবন থেকে মানুষ যখন রাষ্ট্র জীবনে প্রবেশ করেছে তখন ধর্মও গোত্রীয় পরিচয় থেকে রাষ্ট্রীয় বা বৈশ্বিক পরিচয়ে পরিচিত হয়েছে৷ যেসব জনগোষ্ঠী রাষ্ট্রীক-সামরিক-অর্থনৈতিক দিক থেকে শক্তিশালী হয়েছে তাদের ধর্মের প্রভাবও পড়েছে তত বেশি ৷
মানুষের জ্ঞানবৃদ্ধির সাথে সাথে ধর্মের ঈশ্বরের জ্ঞানও বৃদ্ধি পেয়েছে ৷ সেজন্যই আগের ঈশ্বরের চাইতে পরের ঈশ্বরের জ্ঞান অনেক পরিণত দেখা যায় ৷ বহু ভাষা, বহু জাতি, বহু গোত্র যেভাবে বিলুপ্ত হয়েছে তেমনি বিলুপ্ত হয়েছে অনেক ধর্ম, অনেক ঈশ্বর, অনেক দেবতা ও অনেক নবী৷ এই কালে যে আর কোন ধর্মের উদ্ভব হয় না, কেউ চেষ্টা করলেও তা পাত্তা পায় না সেটাও মানুষের ক্রমবিবর্তিত সমাজেরই 'ইচ্ছা' ৷
এক ধর্ম কখনোই আসলে এক ধর্ম নয় ৷ প্রতিটি ধর্মের মধ্যেই বহু ধর্মের বাস ৷ এটাও নির্ধারিত হয় সমাজেরই ইচ্ছা দিয়ে, তার তাগিদে ৷ সমাজে মানুষের মধ্যেকার বৈষম্য, ভিন্ন ভিন্ন সামাজিক অবস্থান, নিপীড়ক ও নিপীড়িত এর সবেরই বহিঃপ্রকাশ দেখা যায় 'একই' ধর্মের ভিন্ন ভিন্ন উপলব্ধি, চর্চা ও ব্যাখ্যার মধ্যে ৷
'একই' আলাহ, ভগবান, ঈশ্বর কিংবা 'একই' নবী, দেবতা ভিন্নভিন্ন ভাবে গৃহীত হয় ভিন্ন ভিন্ন সামাজিক অবস্থানে ৷ কখনো হয়ে যায় তা সম্পূর্ণ বিপরীত ৷
"১৯৭১ এ বাংলাদেশে পাকিস্তানী বাহিনী নারকীয় ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে আল্লাহ আর রসুলের নামে, আবার নিপীড়িত অসংখ্য নারী পুরুষ বুক চিরে আর্তনাদ করেছে, জালেমদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছে সেই একই আলাহ আর রসুলের নামেই" ৷
পোপের যীশু বিশ্বব্যাপী যখন সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন, দেশে দেশে স্বৈরশাসন, নিপীড়ন ও বৈষম্যকে মহিমান্বিত করে তখন দেশে দেশে সাম্রাজ্যবাদ ও স্বৈরতন্ত্র বিরোধী লড়াইয়ে যীশুকে সম্পূর্ণ বিপরীত অবস্থানে স্থাপন করে মুক্তির ধর্মতত্ত্ব ৷ এই বৈপরীত্য, এই লড়াই ধর্মের লড়াই নয় এটা সমাজের ভেতরে শ্রেণীসমূহের, বিভিন্ন বর্গসমূহের (লিঙ্গীয়, জাতিগত, বর্ণগত) সমাজের ভেতরকার ভিন্ন ভিন্ন বিশ্বদৃষ্টিভঙ্গীর লড়াই ৷ ধর্ম এসব ভিন্ন ভিন্ন অবস্থানের ভিন্ন ভিন্ন ভাষা ৷
আরজ আলী মাতুব্বরের প্রশ্নের যে শক্তি তা নিজে নিজে তৈরি হয়নি, সে শক্তি এসেছিল পা ভাঁজ করে শোয়ার অবস্থা নিয়েও মহাবিশ্বকে, মানুষ ও জগতকে দেখার মতা থেকে, সামাজিক কর্তৃত্ব এবং মতাদর্শিক আধিপত্যকে অস্বীকার করবার অব্যাহত লড়াই থেকে ৷ আরজ আলী মাতুব্বর সমাজের মুখোমুখি দাঁড়াতে গিয়েই সামনে লাঠি হাতে দাঁড়ানো দেখেছিলেন ধর্মকেই ৷
তিনি যেসব প্রশ্ন উত্থাপন করেছিলেন সেগুলো আপাতঃদৃষ্টিতে ধর্ম নিয়ে প্রশ্ন মনে হলেও আদতে সেগুলো সমাজ মতা কর্তৃত্ব অধিপতি সংস্কৃতি নিয়েই প্রশ্ন ৷ কেননা একটি নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট সমাজে ধর্মের অধিপতি অস্তিত্ব আসলে ঐ সময়ের ঐ সমাজের বিধিব্যবস্থা অনুশাসন আর প্রবল মতাদর্শিক অবস্থানেরই একটি সংগঠিত রূপ ৷
তথ্যসূত্রঃ
৫০. জীবন সম্পর্কে আমার ব্যক্তিগত ধারণা, ১, ২৭৪
৫১. ঐ
৫২. সমাজ সম্পর্কে আমার ব্যক্তিগত ধারণা, ১, ২৮০