somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ড. মাহবুবউল্লাহ স্যার

১৬ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৪ সন্ধ্যা ৬:২৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

ড. মাহবুবউল্লাহ স্যার
-------------------------------- ড. রমিত আজাদ


দীর্ঘকাল প্রবাস জীবন যাপনের পর যখন দেশে ফিরে এলাম। প্রথম প্রথম আলোচনার টেবিলে বসলে মেজাজ খারাপ হয়ে যেত। বেশীরভাগ লোককেই দেখতাম তথ্য, উপাত্ত ও যুক্তির ভিত্তিতে আলোচনা করতে জানেনা। তাদের আলোচনার ভিত্তি যাচাইহীন কিছু সাধারণ ধারণা ও ফাঁকা ভাবাবেগ।

ড. মাহবুবউল্লাহ স্যারের সাথে যখন পরিচয় হলো রীতিমতো মুগ্ধই হলাম। স্যার আর দশজনার চাইতে পৃথক। রাজনীতি, দর্শন, অর্থনীতি, সমাজবিদ্যা ইত্যাদি বিষয়ে ধারণা বেশ স্বচ্ছ। অনেকক্ষণ কথা হলো স্যারের সাথে বেশ ভালো লাগলো।
আরেকদিন এক আলোচনার টেবিলে বসলাম। অন্যান্যদের সাথে ড. মাহবুবউল্লাহ স্যারও ছিলেন। উপস্থিত সবার মাঝে আমিই অপেক্ষাকৃত তরুণ ছিলাম। স্যার কিছু বিষয় বলছিলেন। তারপর বললেন যে, বিষয়গুলো স্যারের মনে আছে তবে রেফারেন্স এখন আর মনে নাই। আমি বললাম, "রেফারেন্স আমি দিতে পারবো স্যার, আমার মনে আছে।" স্যার প্রসন্ন হলেন। কথা প্রসঙ্গে উনাকে আমার লেখা একটা আর্টিকেল দিলাম।
আরেকদিন টেলিফোন করলেন, বললেন একটা লেখা লিখবেন আমার সাহায্য প্রয়োজন। বললাম কোথায় যেতে হবে বলুন স্যার। তিনি বললেন, "আমার বাসায় চলে আসুন।" স্যারের বাসার ঠিকানা নিয়ে উনার বাসায় গেলাম।

খ্যাতিমান ব্যক্তিদের বাসা দেখার একটা আগ্রহ থাকে। উনার বাসায় গিয়ে দেখলাম মামুলি একটা এপার্টমেন্ট। জানতাম স্যার একটি ব্যাংকের চেয়ারম্যান ছিলেন। মনে মনে ভাবলাম একটি ব্যাংকের চেয়ারম্যানের বাড়ীর এই হাল! সম্পদ বলতে যা দেখলাম তা হলো বই আর বই। বুঝলাম উনার আগ্রহ কোথায়। বইয়ের প্রতি আমারও লোভ আছে। তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছিলাম। স্যার আমার মনের কথা বুঝতে পারলেন। মুচকী হেসে বললেন, "কি, বই দেখছেন?" আমি হেসে ফেললাম, বললাম, "জ্বী স্যার ঐ জিনিসগুলোর প্রতি আমারও দুর্বলতা রয়েছে। তবে আমি একটি বিশেষ ধরণের বই খুঁজছি। আমাদের উপমহাদেশে দর্শনের বিকাশ ও সামাজিক পরিবর্তনে এর প্রভাবের উপর।" স্যার বললেন, "না ওরকম বই পাবেন না। কেউ লেখেনি এর উপর। এই বইটি দেখতে পারেন কাছাকাছি কিছু পাবেন।" বইটা হাতে নিতে চাইলাম। ধুলিময় বই। স্যার বললেন, "দিন মুছে দেই।" আমি তো লজ্জ্বায় পড়ে গেলাম, "সে কি কথা স্যার। আপনি আমার পিতার বয়সী প্রায়। আপনি বই মুছবেন কেন? আমি নিজেই মুছে নিতে পারবো।" তিনি বললেন, "আপনার হাত ময়লা হবে। আমার কাছে কাপড় আছে, মুছে দিচ্ছি দিন।"তারপর বললেন, "আপনার লেখা আর্টিকেলটা পড়েছি, কিছু যায়গায় আমি একমত নই। আমি দাগ দিয়ে রেখেছি। আপনাকে দেখাবো।" এবার আমি মুচকী হাসলাম, বললাম, "আমার আর্টিকেল সার্থক স্যার। আপনার মতো নামজাদা প্রফেসর যদি আমার আর্টিকেল মনযোগ দিয়ে পড়েন ও রিমার্কস লেখেন এটা আমার কাছে বড় পাওয়া।" স্যারও হাসলেন। কিছুক্ষণ স্যারের সাথে কাজ করলাম। কাজের ফাকে ফাকে কথাবার্তা বলে বুঝলাম যে, স্যারের বাসায় কাজের লোকও নেই। উনার স্ত্রী অসুস্থ। একটা মেয়ে আছে। তিনি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। ইতিমধ্যে মেয়েটি বাড়ীতে এসে রান্নার কাজ শুরু করলো। কিছু সময় পর স্যার আমাকে খাওয়ার টেবিলে ডাকলেন। খাওয়ার টেবিলে বসে স্যারের স্ত্রীর সাথে কথা হলো। খুবই মমতাময়ী। ভাষা সৈনিক আবদুল মতিনের ভাগ্নী।

এরপর বেশ কয়েকমাস স্যারের সাথে কোন যোগাযোগই হয়নাই। বড় ও ব্যাস্ত মানুষ তাই নিজে থেকে যোগাযোগ করতে সংকোচ বোধ করতাম। একদিন তিনিই ফোন করলেন। বললেন, তিনি একটি সেমিনার করবেন, সেখানে আমাকে দাওয়াত দিচ্ছেন। আমি একজন সাধারণ মানুষ, স্যার এভাবে মনে রেখে আমাকে দাওয়াত দিচ্ছেন! তাঁর হৃদয়ের বিশালত্ব দেখে অবাক হলাম। বললাম, "স্যার আমি অবশ্যই আপনার সেমিনারে যাবো।"

এরপর নানা বিষয়ে জানতে মাঝে মাঝে স্যারকে ফোন করতে শুরু করলাম। স্যার ব্যস্ত থাকলে ফোন ধরতে না পারলে নিজে থেকেই আবার কল ব্যাক করতেন। ধৈর্যের সাথে আমার প্রশ্নের উত্তর দিতেন।
মাহবুবউল্লাহ স্যারের নানার ভাই ছিলেন বাংলাদেশে কম্যুনিস্ট আন্দোলনের পথিকৃত কমরেড মোজাফফর আহমেদ। স্যারের সাথে এই মতাদর্শটি মাঝে মাঝে আলোচনা করতাম।

একবার 'ফোরাম অব ইয়াং প্রফেশনাল'-এর আত্মপ্রকাশ অনুষ্ঠানে দেশের খ্যাতিমান ব্যক্তিদের আমন্ত্রণ জানাতে শুরু করলাম। অনেকের কাছ থেকেই প্রত্যাখ্যাত হলাম। কিন্তু ড. মাহবুবউল্লাহ স্যারকে আলোচক হিসাবে আমন্ত্রণ জানানোর সাথে সাথেই তিনি তা গ্রহন করলেন। লক্ষ্য করে দেখেছি অনুষ্ঠানে প্রবন্ধ পাঠ বা সভাপতির বক্তব্য বেশীরভাগই মনযোগ দিয়ে শোনেন না, বরং নিজের মত করেই সব বলতে থাকেন। অথচ ড. মাহবুবউল্লাহ স্যারকে দেখলাম সভাপতি হিসাবে আমি যেই বক্তৃতা দিলাম তা মনযোগ দিয়ে শুনলেন এবং উনার বক্তৃতায় তার আলোকপাত করলেন।
বাকপ্রিয় জাতির মধ্যে ইদানিং টক-শো বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। রাতের দিকে ড. মাহবুবউল্লাহ স্যারকে দেখতাম টক-শো গুলোতে আলোচনায় অংশ নিচ্ছেন। দেখতাম তথ্য, উপাত্ত ও যুক্তির ভিত্তিতে চমৎকার আলোচনা করছেন স্যার।

গত শনিবার হঠাৎ শুনলাম স্যারকে আক্রমণ করা হয়েছে। মানসিকভাবে প্রবলভাবে আহত হলাম। এমন একজন জ্ঞানী পরিপাটি ভদ্রলোককে এমন বর্বরোচিত হামলার তীব্র নিন্দা ছাড়া আর কি করা যায়! যারা এটা করলো তারা আর যাই হোক মানুষের তালিকাভুক্ত নয়। কিজন্যে এই হামলা? তথ্য, উপাত্ত ও যুক্তির ভিত্তিতে চমৎকার আলোচনা করেন তাই? আমাদের দেশের মানুষের চোখ কবে খুলবে?

ড. মাহবুবউল্লাহ স্যারকে ফোন করলাম, ফোন ধরলেন স্যারের স্ত্রী, উনার সাথেই টেলিফোনে কথা বললাম। স্যার ল্যাব এইড হসপিটালে আছেন। স্যারের স্ত্রীর মন ভীষণ খারাপ (তিনি নিজেও অসুস্থ)। তাদের বাড়ীতে এই মুহূর্তে কেউ নেই। তাদের যে মেয়েটি সাথে থাকতেন তিনিও সপ্তাহ খানেক আগে পিএইচডি করার উদ্দেশ্যে চীন চলে গেছেন। স্যারের স্ত্রী-কে বললাম, "আপনি মনে কষ্ট নেবেন না। আমরা দেশের মানুষরা স্যারের মত একজন জ্ঞানী, সজ্জন ও দেশপ্রেমিককে ভালোবাসি।" তিনি দুঃখ ভরা কন্ঠে বললেন, "এই কি ভালোবাসার নমুনা?"

আজ (১৬ই সেপ্টেম্বর, ২০১৪) ড. মাহবুবউল্লাহ স্যারের সাথে টেলিফোনে কথা হলো। স্যার এখন মোটামুটি সুস্থ। চোখে আঘাত পেয়েছেন সেই সমস্যা এখনো রয়েছে। একটু ধীরে কথা বলছিলেন। আপনারা স্যারের জন্য দোয়া করবেন।

(এদেশের একশ্রেণীর মানুষ তথ্য, উপাত্ত ও যুক্তির ভিত্তিতে আলোচনার গুরুত্ব এখনও বোঝেনা, অথবা সহ্য করতে পারেনা )
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৪ সন্ধ্যা ৬:৩০
৫টি মন্তব্য ৫টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমি হাসান মাহবুবের তাতিন নই।

লিখেছেন ৎৎৎঘূৎৎ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



ছোটবেলা পদার্থবিজ্ঞান বইয়ের ভেতরে করে রাত জেগে তিন গোয়েন্দা পড়তাম। মামনি ভাবতেন ছেলেটা আড়াইটা পর্যন্ত পড়ছে ইদানীং। এতো দিনে পড়ায় মনযোগ এসেছে তাহলে। যেদিন আমি তার থেকে টাকা নিয়ে একটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতীয় পণ্য বয়কটের কেন এই ডাক। একটি সমীক্ষা-অভিমত।।

লিখেছেন সাইয়িদ রফিকুল হক, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৩:১৫



ভারতীয় পণ্য বয়কটের কেন এই ডাক। একটি সমীক্ষা-অভিমত।।
সাইয়িদ রফিকুল হক

বিএনপি ২০২৪ খ্রিস্টাব্দে দেশে অনুষ্ঠিত “দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে”-এ অংশগ্রহণ করেনি। তারা এই নির্বাচনের বহু আগে থেকেই নির্বাচনে অংশগ্রহণ... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সাংঘাতিক উস্কানি মুলক আচরন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৪



কি সাঙ্ঘাতিক উস্কানিমুলক আচরন আমাদের রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর । নাহ আমি তার এই আচরনে ক্ষুব্ধ । ...বাকিটুকু পড়ুন

একটি ছবি ব্লগ ও ছবির মতো সুন্দর চট্টগ্রাম।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৮:৩৮


এটি উন্নত বিশ্বের কোন দেশ বা কোন বিদেশী মেয়ের ছবি নয় - ছবিতে চট্টগ্রামের কাপ্তাই সংলগ্ন রাঙামাটির পাহাড়ি প্রকৃতির একটি ছবি।

ব্লগার চাঁদগাজী আমাকে মাঝে মাঝে বলেন চট্টগ্রাম ও... ...বাকিটুকু পড়ুন

×