somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

একদিন, কিছু মুহূর্তের যোগফল, একজন মানুষ এবং......

২৫ শে অক্টোবর, ২০১৭ বিকাল ৫:৩০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :




দেয়ালে হাঁটতে থাকা একটা টিকটিকির দিকে তাকিয়ে আছে রনক। টিকটিকিটা পোকা শিকারের মতলবে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তার একটা উদ্দেশ্য আছে। পোকাগুলোও টিকটিকির কবল থেকে মুক্ত হয়ে বাঁচার চেষ্টা করবে। কিন্তু তাদের মধ্যে সবাই বাঁচতে পারবেনা। এটা হচ্ছে একধরনের খেলা। মানুষকেও এমন খেলায় অংশ নিতে হয়। একজন অদৃষ্টবাদীর দৃষ্টিভঙ্গি থেকে মানুষকে বুঝার চেষ্টা করলে মনে হয় সব মানুষই কোন একটা এক্সটার্নাল ফোর্স দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে। তবে মজার ব্যাপার হচ্ছে সেই ফোর্সটাও আসলে মানুষের একটা কালেক্টিভ বিশ্বাস ছাড়া আর কিছুই না। এই কালেক্টিভ বিশ্বাসটাকেই আসলে সমাজ, কালচার কিংবা ধর্ম বলা যেতে পারে যা মানুষ নিজেরাই নিজেদের উপর আরোপ করে। মানুষ আসলে নিজেরাই নিজেদের সৃষ্টি করা গল্পের মধ্যে ঘুরপাক খেতে থাকে। গল্পটাই তখন সেই এক্সটার্নাল ফোর্সের মত কাজ করতে থাকে যা মানুষকে একটা নির্দিষ্ট ডেসটিনি কিংবা প্যাটার্নের দিকে ধাবিত করতে থাকে। রনক ভাবছে।

এমন সময়, এমন সব একান্ত দার্শনিক ভাবনার সময় রনক দেখে তার সামনে মীরা দাঁড়িয়ে আছে। পায়েসের বাটি নিয়ে। মীরার খোলা ভেজা চুলে, সিঁথিতে দেওয়া বড় করে সিঁদুড়ের ফোটায় এবং লাল শাড়িতে তাকে ঠিক দেবীর মত লাগছে। রনক মীরার চোখের দিকে তাকায়। তার চোখে হাসি লেগে আছে।সে একজন সুখি মানুষ। অথচ সকালে মেয়েটার চীৎকার এবং কান্নার শব্দ শুনেছিল রনক। জানতে পেরেছিল তার স্বামী তাকে মেরেছে। প্রায়ই নাকি মারে। একবার নাকি মারতে মারতে অজ্ঞান করে ফেলেছিল। যদিও সকালের ঘটনার কোন ছাপ তার চেহারায় প্রতিফলিত হচ্ছেনা। মীরা চলে যায়। পায়েস খেতে খেতে রনক অবনীর কথা ভাবে। ভালোবাসা, টাকা পয়সা, সামাজিক মর্যাদা, শিক্ষা কোন কিছুরই অভাব ছিলনা মেয়েটার। তবুও সে সুখি হতে পারেনি। আত্মহত্যা করেছিল এক পূর্ণিমার রাতে।

প্রতিবছর যত মানুষ যুদ্ধে নিহত হয়, তার চেয়ে অনেক বেশী মানুষ মরে আত্মহত্যা করে। ব্যাপারটা এমন না যে মানুষ ক্ষুধার জ্বালায় আত্মহত্যা করছে। বরং দেখা গেছে যারা আর্থিক কষ্টে থাকে তাদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা কম। এই আত্মহত্যা করার পেছনের কারন আসলে আনহ্যাপিনেস। আধুনিক সভ্যতা, বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রা মানুষের হাতে অনেকগুলো অপশন তুলে দিয়েছে। একই সাথে যখন অনেক কিছু করার অপশন থাকে তখন মানুষ বিভ্রান্ত হয়ে যায়। অনেকগুলো পথের মধ্যে একটা পথ তাকে বেছে নিতে হয়। যখন সে একটা পথ দিয়ে হেঁটে যায় তখন একই সাথে অন্য পথগুলোর প্রতি সে একধরনের আকর্ষণ অনুভব করে। তার মধ্যে সৃষ্টি হয় ডিলেমা। অনুশোচনা। যারা শেষ পর্যন্ত ভেঙ্গে পরে তারা আত্মহত্যাকেই মুক্তির একমাত্র পথ মনে করে।

এই প্রসঙ্গে গৌতম বুদ্ধ সম্পর্কে প্রচলিত একটা গল্পের কথা মনে পরে গেল রনকের। যদিও সেটা সত্য না মিথ্যা তা জানা এখন আর সম্ভব না। তবে গল্পটার একটা তাৎপর্য্য আছে।তার জন্মের পর জ্যোতিষীরা বলেছিল এই ছেলেকে আটকে রাখা যাবেনা। তাই তারা রাজাকে পরামর্শ দিয়েছিল সিদ্ধার্থের সব ইচ্ছা যেন পূরণ করা হয়। সে যেন কখনো অসুখি ফিল না করে। রাজা তাই করেছিলেন। কিন্তু আসলে পরামর্শটা ভুল ছিল। কারন সুখি হওয়ার কনসেপ্টের কোন সীমা নেই। মানুষ যখন কোন জিনিস পেয়ে যায় তখন একই সাথে সে তার চাওয়াটাও হারিয়ে ফেলে। এমন করে বুদ্ধের আর চাওয়ার কিংবা পাওয়ার কিছু ছিলনা। তাই সে নিজেও একটা ডিলেমার মধ্যে পরে গিয়েছিল। সে ডিলেমা থেকে বাঁচতে সে নিজের মত করে একটা পথ খুঁজে বের করেছিল। কারন সে থেমে না গিয়ে অনুসন্ধান করেছিল।

অনেক পথের মধ্যে নিজের একটা পথ খুঁজে পাওয়াটাই আসলে জীবনের মজা। অনেক গল্পের মাঝে নিজের একটা গল্প ক্রিয়েট করতে পারাটাই আসল খেলা। যাপিত জীবন একই সাথে সুন্দর এবং অসুন্দর। অসুন্দরকে নির্মোহ ভাবে বিশ্লেষণ করে নিজের মত করে কোন সুন্দর গল্প বিনির্মাণ করাটাই হিউম্যান স্পিরিট।

রনক কি তার মত করে কোন পথ খুঁজে পেয়েছে। নাকি তার অনুসন্ধান এখনো চলছে। অথবা সে থেমে আছে, থেমে গেছে।

রনক কোন পলিটিক্যাল ইজম, দর্শন বা ধর্মীয় মতবাদকে পরম সত্য এবং একমাত্র সমাধান হিসাবে মনে করতে পারেনা। যখনই কোন কিছু দ্বারা সে প্রভাবিত হ্য়, তখনই সে প্রভাবিত হওয়াটাকে সে প্রশ্নবিদ্ধ করতে থাকে। একসময় প্রভাবটা আর থাকেনা। আবার সে বাতিলও করে দেয়না। মানুষ দরকার মত ইজম নিয়ন্ত্রন করবে এই লাইনটাই রনকের কাছে যৌক্তিক। ইজম মানুষকে নিয়ন্ত্রন করবে এই ভাবনার প্যাটার্ন থেকে রনক অনেক আগেই বের হয়ে এসেছে। সে ক্ষেত্রবিশেষে শান্তির পক্ষে। আবার দরকার হলে যুদ্ধেরও পক্ষে(যখন প্রতিপক্ষ শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের সব পথ বন্ধ করে দেয়)। সে ধর্মের তীব্র সমালোচনা করে। আবার মাঝেমাঝে ধর্ম থেকে সমাধানের পথও খুঁজে। সে কম্যুনিজম বা পুঁজিবাদ বা নৈরাজ্যবাদ কোনটাকেই একমাত্র সমাধান বা পারফেক্ট সিস্টেম বলে মনে করেনা। কখন কোনটা কিভাবে প্রয়োগ করতে হবে তা আসলে সুনির্দিষ্ট সমস্যার উপর নির্ভর করে। রনক আসলে কোন দিকদিয়েই বিশ্বাসী মানুষ না। মাঝেমঝে নিহিলিজম তার ভেত্র একটা অ্যাবসার্ড অস্তিত্বের জন্ম দেয়। তখন সে আত্মিক শুন্যতার উত্তাল সমুদ্রে একবার ডুবে, একবার ভাসে। মাঝেমাঝে সারভাইভ করে একটা আত্মদর্শন নিয়ে ফিরে আসে। মাঝেমাঝে ডুবে যায়।

ধূপের গন্ধ পাচ্ছে রনক। বাজির শব্দ। উলুধ্বনি। আযানের সুরও ভেসে আসছে। ঝিঝি পোকার ডাক শোনা যাচ্ছে। তারপরও গভীর এক নির্জনতা ঘিরে আছে চারপাশ। হঠাৎ করে রনকের মনে পরে যায় আজ লক্ষী পুজো। সোশিওপ্যাথের মুখোশ পরে বসে থাকার কিছু সুবিধা আছে। মাঝেমাঝে কোলাহলেও নির্জনতা উপভোগ করা যায়।

রনকের মত আরেকজন আছে। সেও ডুবে আছে নির্জনতায়। একা। উৎসব তাকে স্পর্শ করছেনা। তাকে বারবার এসে বলে যাওয়া হচ্ছে দাদু আজ লক্ষী পুজো। বাবা আজ লক্ষী পুজো। কাকা, জ্যাঠা আজ পুজো। সে গুরুজন। সবাই এসে তার পা ছুঁয়ে প্রণাম করছে। সে নির্লিপ্ত ভাবে তাকিয়ে আছে।


চাঁদ উঠেছে। জোৎস্নার স্পর্শে টের পাচ্ছে রনক। ফেলে রাখা চায়ের কাপে পিপড়াদের উৎসব চলছে। চাঁদের দিকে তাকায়নি রনক। মুখোমুখি বসে থাকা বুড়োটার ঘোলাটে চোখের দিকে তাকিয়ে আছে সে। বুড়োটার দু আঙ্গুলের ফাকে জোনাকি পোকার মত সিগারেট জ্বলছে। হাতটা কাঁপছে।তার নিঃসঙ্গ, অসহায় ঘোলাটে দৃষ্টিতে এক ইতিহাস লেখা আছে। পুঁজিবাদের কাছে সামন্তবাদের পরাজয়ের ইতিহাস।

বুড়োকে একা রেখে রনক পুকুরে মাছ ধরা দেখতে আসে। চারপাশে জোছনার প্লাবন।কেউ ব্যবসায় নিমগ্ন। কেউ শ্রমে। রনক চুপচাপ বসে আছে। বসে বসে মানুষ দেখে সে। অথবা প্রকৃতি।
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে অক্টোবর, ২০১৭ দুপুর ১২:৪৬
৪৪টি মন্তব্য ৪৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বাংলাদেশের লোকসংস্কৃতিঃ ব্যাঙের বিয়েতে নামবে বৃষ্টি ...

লিখেছেন অপু তানভীর, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:০০



অনেক দিন আগে একটা গল্প পড়েছিলাম। গল্পটা ছিল অনেক এই রকম যে চারিদিকে প্রচন্ড গরম। বৃষ্টির নাম নিশানা নেই। ফসলের মাঠ পানি নেই খাল বিল শুকিয়ে যাচ্ছে। এমন... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাংলাদেশি ভাবনা ও একটা সত্য ঘটনা

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১০:১৭


আমার জীবনের একাংশ জুড়ে আছে; আমি চলচ্চিত্রাভিনেতা। বাংলাদেশেই প্রায় ৩০০-র মত ছবিতে অভিনয় করেছি। আমি খুব বেছে বেছে ভাল গল্পের ভাল ছবিতে কাজ করার চেষ্টা করতাম। বাংলাদেশের প্রায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাকি চাহিয়া লজ্জা দিবেন না ********************

লিখেছেন মোহাম্মদ সাজ্জাদ হোসেন, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১০:৩৫

যখন প্রথম পড়তে শিখেছি তখন যেখানেই কোন লেখা পেতাম পড়ার চেষ্টা করতাম। সেই সময় দোকানে কোন কিছু কিনতে গেলে সেই দোকানের লেখাগুলো মনোযোগ দিয়ে পড়তাম। সচরাচর দোকানে যে তিনটি বাক্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

=এই গরমে সবুজে রাখুন চোখ=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:২১

০১।



চোখ তোমার জ্বলে যায় রোদের আগুনে?
তুমি চোখ রাখো সবুজে এবেলা
আমায় নিয়ে ঘুরে আসো সবুজ অরণ্যে, সবুজ মাঠে;
না বলো না আজ, ফিরিয়ো না মুখ উল্টো।
====================================
এই গরমে একটু সবুজ ছবি দেয়ার চেষ্টা... ...বাকিটুকু পড়ুন

কুড়ি শব্দের গল্প

লিখেছেন করুণাধারা, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:১৭



জলে ভাসা পদ্ম আমি
কোরা বাংলায় ঘোষণা দিলাম, "বিদায় সামু" !
কিন্তু সামু সিগারেটের নেশার মতো, ছাড়া যায় না! আমি কি সত্যি যাবো? নো... নেভার!

সানমুন
চিলেকোঠার জানালায় পূর্ণিমার চাঁদ। ঘুমন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

×