শুরু
জঙ্গলে তিনটি হরিণ আছে। শিকারি আছে একশো জন। এদের মধ্যে জন্মান্ধ আছে। বিকলাঙ্গ আছে। অপুষ্টিতে ভোগা দুর্বল মানুষ আছে। তবে জঙ্গল সবার জন্য মুক্ত। অর্থাৎ যে হরিণ শিকার করতে পারবে, মাংস তার। হরিণের চামড়াও তার। এটা একটা প্রতিযোগিতা। সবার অংশগ্রহনের সুযোগ আছে। এদের মধ্যে দুএকজন শিকারী শেষ পর্যন্ত হরিণের মালিক হবে। বাকিরা যেহেতু হেরে গেছে তাই তাদের ইচ্ছা অনিচ্ছার কোন মূল্য নেই আর। তবে তাদের হাতে দুটো অপশন আছে। তারা সবাই এক হয়ে মাংসের দখল নিতে পারে। অথবা বিজয়ীদের শ্রম দাস হওয়ার জন্য নিজেদের মধ্যে লড়াই শুরু করে দিতে পারে। কিন্তু এ ব্যাপারে তারা বেশ কয়েক দলে বিভক্ত হয়ে যায়। তাদের কেউ কেউ বিজয়ীদের বিভিন্ন ভাবে সেবা করে সারভাইভ করার চেষ্টা করে। কয়েক জন জাগতিক বাস্তবতাকে অগ্রাহ্য করে আধ্যাত্মিক পথে মুক্তির উপায় খুঁজে। এবং কয়েকজন বিদ্রোহ করে। কেউ কেউ আবার কোনটাই পারেনা। তারা ঝিম মেরে মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করে।
আপাতত গল্প থাক। এবার কিছু বাস্তব ঘটনার দিকে দৃষ্টি দেওয়া যাক।
সংখ্যালঘু নির্যাতন প্রসঙ্গে
এদেশের হিন্দুরা ধর্মীয় কারনে নির্যাতিত হলে, সে ঘটনা নিয়ে নানা রকম বিচার বিশ্লেষন করা হয়। যে যার যার বিশ্বাস, মতাদর্শ কিংবা যুক্তির আলোকে ব্যাখ্যা দেয় এবং সমাধানের কথাও বলে। এদের মধ্যে নাস্তিক, বাম, ডান, উগ্র মুসলিম কিংবা হিন্দু, মডারেট মুসলিম বা হিন্দু, বাম ঘেঁষা সাংস্কৃতিক সংগঠন এবং হেফাজতে ইসলামের মত সংগঠন সবই আছে। এদের ন্যারেটিভ ভিন্ন। এবং পরষ্পর বিরোধী। তবে মিলটা পাওয়া যায় সবার উপসংহারে। উপসংহারটা হলো হিন্দুদের জানমালের উপর আঘাত করাটা ঠিক হয়নি। এটা অন্যায় কাজ। অর্থাৎ এই ব্যাপারে নাস্তিক থেকে শুরু করে উগ্র মুসলমান, বাম, ডান, মধ্যপন্থী সবার মতই এক। কিন্তু তারপরও দেখা যায় এমন ঘটনা বারবার ঘটছে। অর্থাৎ কারো ব্যাখ্যা, বিশ্লেষন বা দেখানো সমাধানই প্র্যাকটিক্যালি কাজ করছেনা। কারন এদের মধ্যে এক বা একাধিক পক্ষ মুখে যা বলছে প্র্যাকটিক্যালি ঠিক তার উল্টা কাজটাই করছে। বা চাচ্ছে। ধর্মীয় আগ্রাসনের কারন শুধু ধর্ম নয়। এর সাথে ব্যাক্তি মানুষ, মনস্তত্ত্ব, সমাজ, রাজনীতি সবই রিলেটেড থাকে।
রাষ্ট্র, ধর্ম, রাষ্ট্রধর্ম এবং সেক্যুলারিজম
সেক্যুলারিজম মানে ধর্মনিরপেক্ষতা নয়। সেক্যুলারিজম মানে ধর্মহীনতা। একটা রাষ্ট্র সেক্যুলার হওয়া মানে সে রাষ্ট্রের কোন ধর্ম থাকতে পারবেনা। অর্থ্যাৎ সে রাষ্ট্রের বিচার বিভাগ, প্রশাসন ইত্যাদি ইত্যাদির কাজকারবারে ধর্মীয় মতবাদ, আইনকানুন এসবের কোন প্রভাব থাকবেনা। ধর্ম পালনের ব্যাপারটা হবে নাগরিকদের যার যার ব্যাক্তিগত ব্যাপার। এবং কেউ কারো উপর এ ব্যাপারে বলপ্রয়োগ করতে পারবেনা। বলপ্রয়োগ করলে রাষ্ট্র সেখানে হস্তক্ষেপ করবে। মোটাদাগে এটা হচ্ছে তত্ত্ব। তবে এই তত্ত্ব প্রয়োগ বা চর্চা যারা করবে তারা মানুষ। এরা রাষ্ট্রের শাসক হতে পারে। আবার শোষিত কিংবা সুবিধাভোগী জনগণও হতে পারে। এখন প্রশ্ন হলো এইসব মানুষ যদি কোন নির্দিষ্ট ধর্মীয় মতবাদে বিশ্বাসী হয় এবং একই সাথে রাষ্ট্রের কাজে অংশগ্রহন করে তবে ব্যাপারটা কি ঘটবে? ধর্মীয় বিশ্বাসের ভেতর থেকে তারা কিভাবে ধর্মহীন হবে সেক্যুলার রাষ্ট্রের প্রয়োজনে? কোন ধর্মে বিশ্বাস করা মানে সে ধর্মের প্রতিই পক্ষপাতিত্ব করা। এক ধর্মের পক্ষে থেকে রাষ্ট্রের হয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় একজন মানুষ কিভাবে তার ধর্মীয় বিশ্বাসকে দূরে সরিয়ে রাখবে? এবং একই সাথে সেক্যুলার হওয়া এবং মানুষকে যার যার ধর্ম তার মত পালন করতে দেওয়া বাস্তবিক অর্থে কতটুকু সম্ভব। এসব সমস্যা নিয়ে মানুষে মানুষে কনফ্লিক্ট চলছে। যার প্রতিক্রিয়ায় কেউ প্রবল ধর্মবিদ্বেষী হয়ে যাচ্ছে। কেউ হয়ে যাচ্ছে সেক্যুলার বিদ্বেষী। কেউ বা মধ্যপন্থী হয়ে নিজেকে নিজে সান্তনা দিচ্ছে। উদাহরন হিসাবে ভারতের কথা বলা যায়। দেশটি কাগজে কলমে সেক্যুলার। সেখানে প্রকৃত অর্থেই অনেক সেক্যুলার বুদ্ধিজীবী এবং মানুষ রয়েছে। আবার দেশটির ক্ষমতায় আছে একটা ধর্মান্ধ দল। সেখানে প্রচুর ধর্মান্ধ মানুষ রয়েছে। ফলে সব মিলে কালচারাল কনফ্লিক্ট অনিবার্য সেখানে। ভবিষ্যতে তারা বিষয়টা কিভাবে রিসলভ করে সেটা দেখার বিষয়। রাষ্ট্র, ধর্ম, সেক্যুলারিজম সবকিছুই আসলে সমস্যার সমাধান হিসাবে মানুষের সৃষ্টি করা তত্ত্ব। যা আবার একই সাথে সমস্যার কারনও। তবে এভাবেই মানব সমাজ বিবর্তিত হয়। হয়তো কোন এক সময় দেখা যাবে ধর্ম, রাষ্ট্র, সেক্যুলারিজম বলে কোন টার্মই মানব সমাজে আর এক্সিস্ট করছে না।
ফেমিনিজম
নারীবাদীদের বিরুদ্ধে লিবারেল নারী পুরুষদের একটা জনপ্রিয় যুক্তি হলো নারীবাদীরাও প্রতিক্রিয়াশীল। তারা পুরুষ বিদ্বেষী। এবং তারাও পুরুষবাদীদের মত কর্তৃত্ব দখল করতে চায়। অর্থাৎ লড়াইটা কর্তৃত্ব দখলের। তাদের মতে উভয় পক্ষেরই উচিৎ লিঙ্গ রাজনীতির বাইরে এসে মানবতাবাদী হওয়া। আমি নিজেও এই মানবতাবাদী হওয়ার অপশনটাকেই বেটার অপশন মনে করি। তাত্ত্বিক দিক থেকে আমি এই মতের সাথে একমত। তবে বিষয়টাকে ইতিহাস, সমাজবিজ্ঞান, ন্যাচারাল সাইন্স এবং চলমান বাস্তবতার আলোকে নির্মোহ ভাবে দেখলে কিছু ব্যাপার উপলব্ধি করা যায়। ফেমিনিজম একটা মুভমেন্ট। যা আকাশ থেকে এসে মাটিতে পরে নাই। এটাকে দীর্ঘ সময়ের সাপ্রেশনের একটা প্রতিক্রিয়া বলা যায়। পুরুষদের কর্তা হতে চাওয়ার হাজার বছরের বাসনা বা চর্চার বিরুদ্ধে এটা নারীদের একটা পাল্টা অবস্থান। ফলে সংঘাত অনিবার্য। এবং এই সংঘাত থেকেই একটা বেটার সিনথিসিস একসময় বের হয়ে আসবে। যেমন লিবারেলরা লিঙ্গ বৈষম্য এবং রাজনীতির বলয় থেকে বের হয়ে এসে যেভাবে মানবতাবাদী হওয়ার কথা ভাবছেন। বাট এইভাবে ভাবানোর জন্যই নারীবাদের সাথে পুরুষতান্ত্রিক সমাজের দ্বন্দ্বটা প্রয়োজনীয় ছিল এবং আছে। পুরুষদের একক কর্তৃত্ব একটা অপশন। কর্তৃত্ব নিয়ে নারী পুরুষের দ্বন্দ্ব তার চেয়ে বেটার অপশন। তার পরের অপশনটা হচ্ছে মানবতাবাদ। কিন্তু প্রথম স্টেপ থেকে লাফ দিয়ে থার্ড অপশনে আসা যেতনা। যার জন্যই নারীবাদীদের মুভমেন্টটা প্রয়োজনীয় মনে করি।
মার্কেটের ধর্ম
ফ্রি মার্কেটে কাস্টমারদের কথাই শেষ কথা। তাই তাদের চাওয়া এবং সিদ্ধান্ত নেওয়াটাকে প্রভাবিত করতে পারাই মার্কেটারদের আসল খেলা। কাস্টমারদের অনেক প্রবনতার মধ্যে একটি হচ্ছে কম খরচে বেশী সেবা গ্রহন করা। তাদের মধ্যে যদি এমন ধারনার জন্ম হয় যে তারা ”ক“ এর চেয়ে “খ” এর কাছ থেকে কম খরচে বেশী সেবা পাচ্ছে তবে তারা “খ” কেই প্রেফার করবে। একারনেই যারা উবার এবং সিএনজি দুটোর সেবাই গ্রহন করেছেন তারা উবারের প্রতি বেশী আগ্রহী হচ্ছেন। তাদের হাতে এখন তুলনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়ার একটা অপশন আছে। আর এই অপশনটা ক্রিয়েট করে যাত্রীদের প্রভাবিত করতে পারাটাই উবার কিংবা পাঠাও সার্ভিসের সফলতা। অপর দিকে সিএনজি মালিক এবং চালকরা এতদিন প্রতিদ্বন্দ্বীহীন মার্কেটে অধিক টাকা বাগিয়ে নেওয়ার সুযোগটা উপভোগ করছিল যা এখন চ্যালেন্জের সম্মুখীন। তবে তাদের সারভাইভ করার প্রয়োজনে তারা আরো একটা রাস্তা খোলা রেখেছে। তারা একটা শক্তিশালী সিন্ডিকেট গঠন করতে পেরেছে। যার সাথে পলিটিক্যাল নেতা এবং গডফাদাররাও যুক্ত। ফলে প্রয়োজনের সময় এরা প্রশাসনকে প্রভাবিত করে যাত্রীদের জিম্মি করে ফেলতে পারে। তবে এই প্রক্রিয়া কিছু সময়ের জন্য কাজ করলেও লং টার্মের জন্য বিপদজনক। পলিটিক্যাল লিডার এবং গডফাদাররা যখন দেখবে যাত্রীরা উবার বা পাঠাও কে প্রেফার করছে তারাও সেদিকে ঝুঁকে যাবে। এবং নিজেদের প্রয়োজনেই তার প্রসার ঘটাবে। তাই লং টার্মের হিসাব নিকাশে গেলে সিএনজি ড্রাইভারদের উচিৎ হবে কাস্টমার ফ্রেন্ডলি সিদ্ধান্ত নেওয়া। সেবার মান বাড়ানো। সেবা দিয়ে তাদের সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করা। নিজেদের সারভাইভের জন্যই তাদের এটা করা উচিৎ।
শাসক, রাজনীতি, জনগণ
সেনাবাহিনী, পুলিশ, প্রশাসন এবং মিডিয়া পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আছে। এরা নিয়ন্ত্রণে থাকলে জনগনও নিয়ন্ত্রণে থাকবে। এমনটা ভেবে ক্ষমতাবানরা অনেক সময় মাস পিপলের সেন্টিমেন্টকে অগ্রাহ্য করে। তাদের ক্ষোভ, চাওয়া পাওয়া এসবকে পাত্তা দেয়না। তবে মাস পিপল ক্ষমতাবানদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ শুরু করলে সেনাবাহিনী, পুলিশ, প্রশাসন এবং মিডিয়া মুহূর্তের ভেতর ডিগবাজি দিতে পারে। এবং এ সময়টাতে অনেকেই জনগনের বিদ্রোহের ফসল নিজেদের ঘরে তুলতে চায়। যেমন অনেকসময় দেখা যায় এমন পরিস্থিতিতে সেনাবাহিনী ক্ষমতায় চলে আসে। জনপ্রিয়তা হারানোটা তাই যেকোন শাসকের জন্য খুব রিস্কি একটা ব্যাপার।
অনুমান
রেস্টুরেন্টে খাওয়া সার্ভ করছে রোবট। একসময় কল কারখানায় মানুষের বদলে রোবট কাজ করবে। গাড়ি ড্রাইভ করবে রোবট। মানুষের ঘরের কাজ করে দেবে রোবট। ভবিষ্যৎ পৃথিবীতে এমন ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা খুব প্রবল। এমন কিছু ঘটলে পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষ জবলেস হয়ে যাবে। মেশিন এবং প্রযুক্তি হবে তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী। এবং তারা হারবে। যাদের হাতে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি থাকবে তারা হবে সুপারম্যান বা সুপারপাওয়ার। যাদের হাতে থাকবেনা তারা হবে অবমানব।( বর্তমানেও এমনটাই হচ্ছে)। হারারি তার "Homo Deus: A brief History of Tomorrow” বইতে ব্যাপারটা খুব চমৎকার ভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। যদিও লক্ষণ দেখেই ভবিষ্যৎ সম্পর্কে নিখুঁত অনুমান করা কারো পক্ষেই সম্ভব না। কারন মানুষ একই সাথে প্রেডিক্টেবল এবং আনপ্রেডিক্টেবল।
উপসংহার
একটা ঈগল প্রতিদিন প্রমিথিউসের লিভার খেয়ে তাকে হত্যা করে। কিন্তু সে আবার বেঁচে উঠে। এটা তার শাস্তি। তার অপরাধ সে জিউসের আদেশ অমান্য করে অলিম্পাস পাহাড় থেকে আগুন চুরি করেছিল। সে আগুন চুরি করে সে মানুষকে দিয়েছিল। এই প্রমিথিউস এবং জিউসের বাস মানুষের মনোজগতে। অলিম্পাস পাহাড়টাও সেখানে অবস্থিত। মানুষ প্রমিথিউস হয়ে আগুন চুরি করে। আবার জিউস হয়ে প্রমিথিউসকে শাস্তি দেয়। ঈগল হয়ে লিভার খায়। আবার প্রমিথিউস হয়ে আর্তনাদ করে। প্রতিদিন মরে যায়। আবার বেঁচে উঠে।
বি.দ্রঃ সাম্প্রতিক সময়ের ঘটে যাওয়া কিছু ঘটনা নিয়ে হালকা পাতলা পর্যবেক্ষণ। যা ফেবুতেও স্ট্যাটাস দিয়েছিলাম।
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে নভেম্বর, ২০১৭ সন্ধ্যা ৬:১৭