ব্যাঙের কথা শুনে বিভা আকুল হয়ে কাঁদতে লাগল। ব্যাঙ বিভার সংবেদনশীলতায় অভিভূত হয়ে মুগ্ধ নয়নে বিভার দিকে তৃষিতের মত তাকিয়ে রইল।
হঠাৎ চোখ মেলে বিভা দেখে হরি অনির্মেষ চেয়ে আছে ওর দিকে। কোথা থেকে একরাশ অকারন লজ্জা লাল আবীর ছড়াল বিভার কপোলে। ত্রস্ত বিভা “আমি যাই, বেলা বয়ে এল” বলে পালানোর উপক্রম করতেই হরি গেয়ে উঠল,
“আরো একটু বসো তুমি, আরো একটু বলো।
পথিক, কেন অথির হেন- নয়ন ছলোছলো।
আমার কিযে শুনতে এলে তার কি কিছু আভাস পেলে—
নীরব কথা বুকে আমার করে টলোমলো।
যখন থাক দূরে
আমার মনের গোপন বাণী বাজে গভীর সুরে।
কাছে এলে তোমার আঁখি সকল কথা দেয় যে ঢাকি—
সে যে মৌন প্রাণের রাতে তারা জ্বলো জ্বলো।“
বিভার মন ছুঁয়ে গেল আকুল এই গানের সুর। তবু প্রশ্ন না করে সে পারল না, “কি করে এই গান আমার তরে গাইছো তুমি? আদিতি কি একেবারে মুছে গেছে মন থেকে?”
গাঢ় স্বরে হরি বললে “বিভা, আদিতি আছে আকাশের তারা হয়ে। সারা জীবনই তাকে অনেক উঁচু মহিমায় রেখেছি। শ্রদ্ধায় সমর্পিত হয়েছিলাম তার কাছে কিন্তু তোমাকে আমি ভালবেসেছি মনের সমস্ত সচেতন সত্তা দিয়ে। প্রতিদিন প্রদোষের আলো তোমার মুখে কি যে আবীর ছড়াত তা আমার মুগ্ধ নয়নই জানে- তোমার বুদ্ধিদীপ্ত হাসি, মোহন ললিত গীতি কবে যে আমার মন রাঙাল, আমি নিজেই জানি না- শুধু জানি অধীর হয়ে প্রহর গুনতাম তোমার জন্য—একবার দূর থেকে দেখার জন্য। আজ অসীম সাহসে তোমার সামনে এসেছি। কোন ক্ষুদ্রতা, কোন দীনতা নাই তোমার—সেই ভরসায় হাত পেতেছি—দাও ভিক্ষা তব হিয়া।“
“তবু এত স্বল্পকালে জীবনের এত বড় সিদ্ধান্ত কি করে নিলে হরি? আর আমি তো তোমায় চিনিনে ঠিকমত—ক্ষমো মোরে—আমি অপারগ তোমারে আমার হৃদয় দিতে।“
“দাঁড়াও বিভা, “আমি তোমার হৃদয় মোর হৃদয় আলোকে চকিতে দেখেছি” –নিজেরে করো না বঞ্চনা। তবু যদি ফিরে যাও, সে তোমার অধিকার। তবে আমি অনন্ত প্রহর তোমারেই চেয়ে যাব। শুধু তোমার জন্যই গাইব,
“চাও নাহি নাও, ডাকো নাই ডাকো,
কাছেতে আমার থাকো নাই থাকো,
যাব সাথে সাথে, রব পায় পায়, রব গায় গায় মিশি—
এ বিষাদ ঘোর, এ আঁধার মুখ, এ অশ্রুজল, এই ভাঙা বুক,
ভাঙা বাদ্যের মতন বাজিবে সাথে সাথে দিবানিশি।“
এ আকুল ডাক বিভা এড়াবে কি করে। তাই বনের মাঝেতে এ দুই প্রাণে এল প্রেমের জোয়ার। মজিলো দুজন দুজনাতে—ভুলে গেল স্থান কাল- পুরো
পৃথি একদিকে ওরা আরেকদিকে—
“যেন রে অকুল সাগর মাঝারে ডুবেছে জগৎ তরী,
তারি মাঝে শুধু ওরা দুটি প্রাণী-
রয়েছে জড়ায়ে বাহুতে বাহুখানি—--“
অর্ক দিনান্তে দিগন্তে মিলানোর উপক্রম করলেন। গোধূলী লগণে মায়াবী আলোয় তীব্র ভালবাসায় বিভা আর হরি পরস্পরকে আঁকড়ে ধরল---আসন্ন বিচ্ছেদ বেদনায় ভারাক্রান্ত হদয়ে পরম যত্নে একে অন্যকে আদর করতে লাগল। তাদের প্রথম চুম্বন যেন জাদুকরী –চারদিকে তাই আতসবাজির ঝলমল-পাখির কলতান- আর ফুলের সুঘ্রান—সমস্ত প্রকৃতি যেন হেসে উঠল প্রেমিকযুগলের মিলনে! হরি ফিরে পেল তার পূর্বাবয়ব।
উৎফুল্ল হরি চোখ মেলে দেখতে চাইলো তার প্রিয়ার অনিন্দ্য সুন্দর মুখখানি। কিন্তু নয়ন মেলে দেখে বিভা কোথাও নেই। তার স্থানে মাটিতে পড়ে আছে একটি ছোট্ট সোনালি ব্যাঙ। চেয়ে আছে ছলোছলো নয়নে। ব্যাঙরূপী বিভার কথা বলার ক্ষমতাও যে নেই! আকাশ ভেঙ্গে এল হরির মাথায়। এ কেন হল? তার অভিশাপে বিভার এই পরিনতি। পাহাড়সম কষ্টের ভার না নিতে পেরে হরি মাটিতে লুটিয়ে কাদঁতে লাগল।
এদিকে আচার্য্য মেয়েকে সারাদিন না দেখে খুঁজতে খুজতে এসে দেখেন হরি মাটিতে লুটিয়ে কাঁদছে। স্নেহ ভরে তার কাঁধে হাত রেখে শুধালেন,
“কে তুমি বাছা? কেন কাঁদছ এত আকুল হয়ে?” দীর্ঘশাস ফেলে স্বগতোক্তি করলেন “আমার নিজেরও মনটাও ভাল নেই। আমার মেয়ে বিভাকে খুঁজে পাচ্ছি না।“
বিভার নাম শুনে হরি লাফ দিয়ে উঠে আচার্য্যের হাত ধরে কাঁদতে কাঁদতে সব খুলে বললে। শুনে আচার্য্য মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লেন। বল্লেন,
“এ তুমি কি করলে হরি? বিভার প্রেম ছিল নিখাদ, তাই তোমার অভিশাপ মিটেছে। কিন্তু তোমার প্রেমে খাঁদ ছিল নিশ্চয়ই –সেকারনে বিভার রূপান্তর। সত্যি করে বল তুমি কি বিভার কাছে মিথ্যাচার করেছিলে তোমার এই একাকীত্ব থেকে--এই অভিশাপ থেকে মুক্তি পেতে?”
বাকহারা হরি শুধু মাথা নেড়ে ব্যাঙটাকে হাতে নিয়ে আদর করতে থাকল। ওর অশ্রুজল মাটিতে পড়েই শ্বেতশুভ্র শিউলী ফুলে পরিনত হচ্ছিল। হরির দুঃখের তীব্রতা দেখে আচার্য্য উপলব্ধি করলেন হরি সর্বান্তকরনে বিভাকেই ভালবাসে। তাহলে কেন এমন হল? এখন উপায় কি?
তিনি হরির বাহুমুল চেপে ধরে গভীর আকুলতায় জানতে চাইলেন, “ভাল করে ভেবে দেখ তুমি, কোন সত্য কি করেছিলে গোপন যা তুমি মনে করেছিলে অপ্রয়োজনীয়? হয়তো তার মাঝেই এর প্রতিকার নিহিত!”
অনেক ভেবেও হরি কিছু মনে করতে পারল না। হঠাৎ বিদ্যুতের মত তার মনে চমকিল মীরার কথা। না মীরার প্রতি তার ছিল না কোন প্রেম কিন্তু ক্ষনিকের ক্ষীণ আকর্ষন ছিল কবিতা রচনার কালে—যেটুকু থাকে স্রষ্টার তার সৃষ্টির প্রতি!
সব শুনে আচার্য্য অঝরে কাঁদতে লাগলেন। হরিকে বললেন তোমার অজ্ঞাতে সামান্য এক ভুলের কারনে আজ এই হাল। এর নেই কোন প্রতিকার। শুধুমাত্র প্রকৃত প্রেমিকের চুম্বনে এ থেকে মুক্তি কিন্তু তুমিই যে বিভার প্রকৃত প্রেমিক! তোমার ভুলের মাশুল তোমাকে এভাবেই দিতে হবে। ব্যাঙরূপী সাথী নিয়েই তোমাকে কাটাতে হবে এ মানবজীবন। এ কথা শুনেই ব্যাঙটি হরির হাত থেকে লাফিয়ে পালিয়ে যেতে চাইল তাকে মুক্তি দিয়ে। কিন্তু হরি তাকে ধরে রাখল পরম যত্নে। গভীর বেদনায় অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে সুর উঠে এল তার কন্ঠে--
“নিত্যকালের সঙ্গী আমি যে, আমি যে রে তোর ছায়া;
কিবা সে রোদনে, কিবা সে হাসিতে,
দেখিতে পাইবি কখনো পাশেতে
কভু সম্মুখে কভু পশ্চাতে আমার আঁধার কায়া।
গভীর নিশীথে একাকী যখন বসিয়া মলিন প্রাণে
চমকি উঠিয়া দেখিবি তরাসে,
আমিও রয়েছি বসে তোর পাশে
চেয়ে তোর মুখ-পানে।“
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১০ দুপুর ১২:১৪