ফোনের স্ক্রীনে নাম্বার টা দেখে বেশ অবাক হল রাতুল। গত কয়েক বছর ধরে নাম্বারটা ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করছে সে। কিন্তু মানব মস্তিষ্ক খুব অদ্ভুত। অনেক কিছু হাজার মনে রাখার চেষ্টা করলেও মনে রাখা যায় না আবার ভুলতে চাইলেও ভুলা যায় না অনেক কিছু।
একটা সময় ছিল যখন সারাদিনে বেশীরভাগ ফোন/মেসেজ আসত এই নাম্বার থেকে। কিন্তু সবই অতীত। গত পাঁচ বছরে এই নাম্বার থেকে আর কোন ফোন বা মেসেজ কিছুই আসে নি। আর সে এই পাঁচ টি বছর প্রায় যুদ্ধ করেছে নাম্বার টা ভুলার জন্য। কিন্তু আজ এতকাল পরে আবার নাম্বারটা দেখে বেশ অবাকই হতে হল।
-হ্যালো
-হ্যালো রাতুল, আমি অর্পিতা
-হ্যাঁ বল
খুব সাধারনভাবেই বলল যেন কিছুই হয় নি তাদের মাঝে।
-তুমি কি ব্যস্ত?
-কেন? কিছু বলবে?
-কিছু না। অনেক কিছু বলব
-আচ্ছা বল
-রাতুল আমি তোমার কাছে অনেক অনেক সরি। প্লিজ আমাকে ক্ষমা করে দাও
-আজ হটাত? কি হয়েছে?
-অনেক কিছু হয়েছে। আমি কখনও ভাবিনি তোমাকে ঠকানোর শাস্তি আমাকে এভাবে পেতে হবে। প্লিজ তুমি আমাকে ক্ষমা কর
-তুমি আমাকে ঠকিয়েছ কে বলল? আমি নিজেই নিজেকে ঠকিয়েছি
-প্লিজ এভাবে বল না। আমি জানি আমি কি করেছি। তোমার কত বড় ক্ষতি করেছি তা আমি জানি
অর্পিতার কণ্ঠ ভারী হয়ে এসেছে এতক্ষনে।
-বললাম তো তুমি কিছু কর নি। যা করার আমি করেছি। তোমার ক্ষমা চাওয়ার কিছু নেই। তোমাকে তো আমি কোন দোষ দেই নি
-তুমি জাননা আমার জীবনে কি কি হয়ে গেছে। আমি জানি সবকিছু হচ্ছে আমার পাপের কারনে। আমি যা কিছু করেছি এগুলো তারই ফলাফল
-আমি তো তোমাকে কখনও কোন দোষ দেই নি
-তুমি প্লিজ আমাকে ক্ষমা কর। তুমি যদি আমাকে ক্ষমা না কর আমি কখনই ভাল থাকতে পারব না
মনে মনে হাসল রাতুল। সেদিনও সে ভাল থাকতে চেয়েছিল। সেদিনও সে অর্পিতাকে কিছু বলে নি। শুধু অবাক হয়ে তাকিয়েছিল। আজ এতদিন পর আবার সে ভাল থাকার জন্য এসেছে তার কাছে। মেয়েরা ভাল থাকার জন্য কি না করতে পারে!!
-রাতুল প্লিজ কিছু বল। প্লিজ চুপ করে থেক না। বলতে বলতে অঝোরে কাদছে সে
একে একে সবকিছু আবার রাতুলের চোখের সামনে ভেসে উঠতে থাকে। সেদিনও অর্পিতা এভাবেই কেদেছিল। কিন্তু কে জানত সেদিনের কান্না শুধুই ছলনা ছিল । সেদিনের সমস্ত আবেগমাখা কথা সবই মিথ্যা ছিল। ছলনা আর আসলকান্না যদি কোনোভাবে আলাদা করা যেত তাহলে হয়ত খুব ভাল হত। কোথায় যেন শুনেছিল মায়াকান্নার জল লোনা হয় না। ব্যাপারটা পরীক্ষা করে দেখতে পারলে ভাল হত।
ঐ দিনগুলোর কথা কখনও ভুলবে না সে। জীবনে উঠা-নামার সন্ধিক্ষণ চলছিল তখন। অর্পিতা এক ভার্সিটিতে ভর্তি হয়ে গেল কিন্তু ভাগ্য দেবতা তার সহায় না হওয়ায় কোথাও ভর্তি হতে পারল না সে। খুব কষ্ট করে কানাডাতে একটা স্কলারশিপ জোগাড় করতে পেরেছিল। যাওয়ার জন্যও প্রস্তুতি নিচ্ছিল। কিন্তু অর্পিতা বাধ সাধল। সে রাতুল কে একটা দিন ও না দেখে থাকতে পারে না সেখানে কয়েক বছর কিভাবে থাকবে? সেদিনও আজকের মতই অঝোরে কেদেছিল সে। রাতুল ও সরল মনে ভালবাসার কাছে নিজের ভবিষ্যৎ বলি দিয়েছিল। কিন্তু কে জানত এই বলিদান তার জীবনেই কাল হয়ে দাঁড়াবে।
পরিবারের সবার কথা উপেক্ষা করে সে দেশেই রয়ে গেল। ভর্তি হল খুবই সাধারন মানের এক বেসরকারি ভার্সিটিতে। প্রথমে কিছুদিন ভালই চলছিল। কিন্তু কয়েকমাস যাওয়ার পর হটাত করেই অর্পিতার আচার আচরনে বড় ধরনের পরিবর্তন শুরু হল। যোগাযোগ ও অনেক কমিয়ে দিল।এদিকে রাতুল কিছু ভেবে কুল কিনারা করতে পাচ্ছিল না। একদিন সে সরাসরিই জিজ্ঞেস করল তাকে। কিন্তু তার উত্তর শুনে কিছুক্ষন বজ্রাহতের মত বসে ছিল সে। অর্পিতা সরাসরিই বলেছিল "দেখ রাতুল এভাবে আসলে হচ্ছে না। আর তাছাড়া তুমি আমার চেয়ে অনেক ভাল মেয়ে ডিজার্ভ কর"।
কথাটার মধ্যে একটা ইঙ্গিত ছিল আর রাতুল সেটা খুব ভালভাবেই বুঝতে পেরেছিল। সেই শেষ। আর কখনও যোগাযোগ হয় নি তাদের মাঝে। মাঝে মাঝে কষ্টে ভেতরটা জমে যেত। খুব ইচ্ছে করত একবার চেষ্টা করে দেখতে তাকে ফিরিয়ে আনার। কিন্তু পরক্ষনেই নিজেকে বুঝাত যে এটা আর সম্ভব না।
-রাতুল প্লিজ কিছু বল। তুমি এভাবে চুপ করে থেকো না। প্লিজ।
ওপাশের কথার আওয়াজে হটাত বাস্তবে ফিরে এল সে। কিছু না বলে ফোনটা আস্তে করে কেটে দিল। সৃষ্টিকর্তার সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি মানুষ। মানুষের জীবন নিয়ে খেলা করা অনেক বড় আর জঘন্য পাপ। যেটা ক্ষমা করার ক্ষমতা রাতুলের নেই।