প্রতিদিনই আমাদের কোনো না কোনো সিদ্ধান্ত নিতে হয়। বড় অথবা ছোট ইচ্ছাকৃত কিংবা অনিচ্ছাকৃত। সকালে ঘুম থেকে উঠে "চা নাকি কফি?" থেকে শুরু করে "তুমি কি আমাকে বিয়ে করবে পর্যন্ত?"। অবচেতন মনে আমরা অনেক সিদ্ধান্ত নিয়ে নিতে পারি। কিন্তু যে সিদ্ধান্তে অনেকগুলো বিকল্প থাকে, কিংবা যে সব সিদ্ধান্তের প্রভাব জীবনে অনেক বেশি হবে, সেগুলি নেওয়ার ক্ষেত্রে অনেকেরই প্রচুর সমস্যা হয়।
সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে আমাদের মস্তিষ্ক কিভাবে কাজ করে?
সোজা কথায় বলতে গেলে আমাদের ব্রেইন বা মস্তিষ্ক কোন সমস্যার অনেকগুলো বিকল্প সমাধান নিয়ে চিন্তা করে। এবং সেই বিকল্প গুলোর ভিতর তুলনা করে। এই বিকল্পগুলো তুলনা করার ক্ষেত্রে মস্তিষ্ক দুটি ধরনের কাজ করে। প্রথমটি হচ্ছে অবচেতন মনে সিদ্ধান্ত নেওয়া। এই ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় দ্রুত যেসব সিদ্ধান্ত নিতে হয়, এবং যে সিদ্ধান্তগুলো খুব বেশি সুদূরপ্রসারি হয়না। দ্বিতীয়টি হচ্ছে সচেতনভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়া। খুব গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গুলো এভাবে নেওয়া হয়। এই ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে অনেক বেশি মনোযোগ এবং বিশ্লেষণের প্রয়োজন হয় এবং এই ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে মানুষ অনেক বেশি সমস্যার সম্মুখীন হয়। আজকের এই পোস্টে এই ধরনের সিদ্ধান্ত কিভাবে সঠিকভাবে নেওয়া যায় তা নিয়ে আলোচনা করা হবে।
গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গুলো কয়েকটি ধাপে নিলে সবচেয়ে ভালো ফলাফল পাওয়া যায়। এগুলো হচ্ছে,
* সমস্যা চিহ্নিত করা এবং লক্ষ্য নির্ধারণ করা
* সম্ভাব্য বিকল্প সমাধানের তালিকা করা
* বিকল্প গুলোর সম্ভাব্য ফলাফল বিশ্লেষণ করা
* বিকল্পগুলো থেকে সবচাইতে ভালোটি বেছে নেওয়া অর্থাৎ সিদ্ধান্ত নেওয়া
* সিদ্ধান্তের প্রয়োগ ঘটানো
* সর্বশেষ ফলাফল বিশ্লেষণ
সমস্যা চিহ্নিত করা এবং লক্ষ্য নির্ধারণ করা
এই ধাপে কয়েকটি প্রশ্নের উত্তর বের করতে হবে। প্রথমত, যেই সমস্যা অথবা যে অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে সেই সমস্যা বা অবস্থাটি কি? এই প্রশ্নের উত্তর পাওয়া খুবই জরুরী। কারণ সমস্যা সঠিকভাবে চিহ্নিত না হলে সমাধান নিয়ে কখনো আলোচনা অথবা চিন্তা করা যায় না।
দ্বিতীয়ত, যেই সিদ্ধান্তটি নেওয়া হবে সেই সিদ্ধান্ত কাদের উপর প্রভাব ফেলবে? প্রতিটি সিদ্ধান্তের একটি প্রভাব বলয় থাকে। এ প্রভাব বলয়ের ভিতরে যারা অবস্থান করে অর্থাৎ যাদের উপর সিদ্ধান্তের প্রভাব পড়বে, সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় তাদের কথা অবশ্যই মাথায় রাখতে হবে।
তৃতীয়ত, কোন লক্ষ্যে সিদ্ধান্তটি গ্রহণ করা হবে? লক্ষ্য অবশ্যই সুনির্দিষ্ট হতে হবে, কেননা একটি লক্ষ্য অনেকগুলো বিকল্প পন্থায় অর্জন করা যায়।
এছাড়াও কয়েকটি বিষয় মাথায় রাখতে হবে। সেগুলা প্রথমটি হচ্ছে সময়, দ্বিতীয়টি হচ্ছে অর্থ, এবং তৃতীয়টি হচ্ছে সম্পর্ক। কত দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে হবে অথবা যে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে তার প্রতিফলন ঘটানোর জন্য কি পরিমাণ অর্থ প্রয়োজন হবে কিংবা সিদ্ধান্ত নেওয়ার ফলে যাদের উপর প্রভাব পড়বে তাদের সাথে সম্পর্ক কেমন হবে তা নিয়ে অবশ্যই বিবেচনা করতে হবে।
সম্ভাব্য বিকল্প সমাধানের তালিকা করা
এ ধাপের শুরুতেই আপনার মনে হতে পারে আপনার হাতে কোনো বিকল্প নেই, যে কারণে এই ধাপটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সমস্যাটি যত ছোটই হোক না কেন আপনাকে অবশ্যই বিকল্প সমাধানগুলোর তালিকা করতে হবে। নিচে বেশ কিছু পদ্ধতি সম্পর্কে আলোচনা করা হবে, যার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান সম্পর্কিত আইডিয়া কিভাবে তুলে আনা যায় তা আমরা জানতে পারব।
Brainstorming: এই পদ্ধতির শুরুতে মনে রাখতে হবে কোন আইডিয়াই ছোট নয়। আপনাকে আপনার পুরাতন আইডিয়া গুলো সম্পর্কে চিন্তা করতে হবে এবং সেগুলো নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে হবে। এক্ষেত্রে আপনি আপনার সহকর্মী বন্ধুদের সাহায্য নিতে পারেন। তাহলে আপনি সমস্যাটিকে তাদের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে পারবেন। যার ফলে আপনার জন্য সমস্যাটি চিহ্নিত করা এবং সমাধানের দিকে এগুনো সহজ হবে। আইডিয়াগুলোকে নিয়ে চিন্তা করার পর আপনার অবশ্যই আইডিয়া গুলো লিখে ফেলতে হবে। আপনার কাছে কোন আইডিয়া হাস্যকর মনে হলেও তাও লিখতে হবে। আইডিয়া গুলো লিখে ফেলার পর আপনার আইডিয়া গুলো সম্পর্কে সীমাবদ্ধতা এবং কী কী অসুবিধা আসতে পারে তা নিয়ে চিন্তা করতে হবে। এবং ধীরে ধীরে একটা একটা করে আইডিয়া বাদ দিতে হবে। প্রথমেই যে আইডিয়াগুলোর বাস্তবায়ন করা একদমই অসম্ভব সেগুলো বাদ দিয়ে দিন।
Decision tree: এই পদ্ধতিতে সবার আগে আপনার সমস্যাটি কি তা নিশ্চিত করতে হবে। তারপর সমস্যাটির কি কি সম্ভাব্য সমাধান থাকতে পারে তা বের করতে হবে। সেই সমাধান গুলোর কি কি ফলাফল হতে পারে তা বের করতে হবে। এরপর আপনাকে একটি decision tree আঁকতে হবে, যা শুরু হবে সমস্যাটি নিয়ে তারপর সম্ভাব্য সমাধান গুলো এবং এরপর সম্ভাব্য সমাধান গুলোর কি কি ফলাফল আসতে পারে। এই ট্রি আকার মাধ্যমে আপনি আপনার সমস্যাটির একটি পরিষ্কার ধারনা পাবেন।
বিকল্প গুলোর সম্ভাব্য ফলাফল বিশ্লেষণ করা
Brainstorming অথবা Decision tree এর মাধ্যমে আপনি যেই সম্ভাব্য সমাধান গুলো চিন্তা করেছেন সেগুলোর সম্ভাব্য ফলাফল কি হতে পারে তা নিয়ে এই ধাপে আপনাকে চিন্তা করতে হবে। প্রথমেই সম্ভাব্য সমাধান গুলোর নিচে সম্ভাব্য ফলাফলগুলো লিখে ফেলুন। তারপর কোন ফলাফলগুলো ভালো কিংবা কোন ফলাফলগুলো খারাপ তা চিহ্নিত করুন। এক্ষেত্রে আপনি আপনার সুবিধার জন্য যোগ অথবা বিয়োগ চিহ্ন ব্যবহার করতে পারেন। এছাড়াও আপনি লাল অথবা সবুজ রঙের কালি ব্যবহার করতে পারেন।
বিকল্পগুলো থেকে সবচাইতে ভালোটি বেছে নেওয়া অর্থাৎ সিদ্ধান্ত নেওয়া
আগের ধাপে আপনি ফলাফল গুলোতে বিশ্লেষণ করেছেন। এই ধাপে আপনার সিদ্ধান্ত নেওয়ার পালা। প্রত্যেকটি সম্ভাব্য সমাধান নিয়ে আরেকবার ভাবুন তার ফলাফল গুলো দেখুন এবং সেখান থেকে আপনি সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন যে সবচেয়ে ভালো সমাধান কোনটি। সিদ্ধান্ত নেয়ার এই ধাপে আপনাকে অবশ্যই আত্মবিশ্বাসী হতে হবে। আপনি আপনার অভিজ্ঞতা থেকে এবং এতক্ষণ যাবত করে আসা বিশ্লেষণ থেকে আপনি সঠিক সিদ্ধান্তটি বেছে নিবেন। এরপর যদি আপনার সিদ্ধান্ত নিতে সমস্যা হয়, তাহলে এই ধরনের সমস্যায় এর আগে যে পড়েছে এমন কারো সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করুন।
সিদ্ধান্তের প্রয়োগ ঘটানো
আপনার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়ে গেলে অবশ্যই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে হবে। এই ক্ষেত্রে আপনাকে কোনরূপ শঙ্কা অথবা আত্মবিশ্বাসহীনতায় ভুগলে চলবে না। সিদ্ধান্তটি যাদের উপর প্রভাব বিস্তার করবে তাদের সাথে সিদ্ধান্তটি নিয়ে অবশ্যই পরিষ্কার ভাবে কথা বলে নিতে হবে। সিদ্ধান্তের ব্যাপারে তাদের সাথে যত বেশি পরিষ্কার থাকে তবে তাদের পক্ষ থেকে আপনার প্রতি সমর্থন ততো বেশি থাকবে। এর মাধ্যমে আপনার সামগ্রিক লক্ষ্য অর্জন করা সহজ হবে।
সর্বশেষ ফলাফল বিশ্লেষণ
এই ধাপে আপনার কয়েকটি প্রশ্নের উত্তর জানতে হবে যা আপনাকে কে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে সাহায্য করবে। প্রথমত আপনার নেয়া সিদ্ধান্তটির ভালো এবং খারাপ দিক গুলো কি কি ছিল? দ্বিতীয়তঃ আপনি যেই ফলাফল আশা করেছিলেন তার বাস্তবিক প্রতিফলন ঘটেছিল কিনা? তৃতীয়ত এমন সমস্যায় যদি আপনি আবারো পড়েন তখন কি আপনি একই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন নাকি অন্য সিদ্ধান্ত বেছে নিবেন? যদি অন্য সিদ্ধান্ত বেছে নেন তবে কেন?
উপরের প্রত্যেকটি ধাপ সফলভাবে শেষ করার মাধ্যমে আপনি যে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন আশা করা যায় তার সুদূর প্রসারী ফলাফল আপনার লক্ষ্য অর্জনে সহায়তা করবে। Albert Camus এর একটি কথা দিয়ে শেষ করতে যাচ্ছি। তিনি বলেছেন "Life is the sum of your choices." সে জন্য প্রতিটি সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে ভেবে চিন্তে এবং সতর্ক ভাবে সিদ্ধান্ত নিতে হবে এবং আত্মবিশ্বাসের সাথে সে সিদ্ধান্তের প্রতিফলন ঘটাতে হবে।
Reference:
1. Kahneman, D. (2011) Thinking, Fast and slow, McMillan.
2. Stanovich, KE, & West, RF (2000). Individual Differences in reasoning: Implications for the rational debate?
3. Damasio, A. (2008). Descartes' Error: Emotion, Reason and Human Brain.
বিঃদ্রঃ এই লেখাটি আমার মিডিয়াম ডট কম ব্লগে পূর্বে প্রকাশিত হয়েছে।
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে আগস্ট, ২০১৮ রাত ১২:০১