তিন.
বৈদিক যুগ থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত কৈবর্তরা সমাজে প্রান্তিকগোষ্ঠী হিসেবে বিবেচিত। বৈদিক সাহিত্য, রামায়ন ও মহাভারতে এর উল্লেখ পাওয়া যায়। 'ব্রাত্য' মানে যারা ব্রত থেকে চ্যুত বা ভ্রষ্ট। বর্তমান আধুনিক সমাজেও এদেরকে নিম্নবর্গ, হরিজন, দলিত, ছোটলোক ইত্যাদি বলে গালি পারে শিক্ষিত সমাজের গোমুর্খের দল। প্রচীন সাহিত্যে ব্রাত্য বা অন্তজ শ্রেণী হিসেবে রজক, চর্মকার, নট, বরুড়, মেদ, ভিল্ল এবং কৈবর্ত নামে মোট সাত শ্রেণীর ব্রাত্য বা অন্তজের সন্ধান মেলে। সময় এবং অঞ্চল ভেদে কৈবর্ত শ্রেণী'র আবার অনেক নাম পাওয়া যায়। যেমন মৎস্যঘাতী, মৎস্যজীবী, মাছধরা, জেলে, পাতর, ধীবর, রাজবংশী, কেওট, কৈবর্ত, দাশ, মালো, মল্লবর্মণ, গাবর, মেছো, মাউছ্যা, জাইল্যা, জলদাশ ইত্যাদি। হরিপদ কৈবর্ত মেয়ে শৈলীরানী আর মেয়েজামাই চন্দ্রমণিকে কৈবর্তদের অতীত ইতিহাস শোনাচ্ছিলেন। বিলাস রাজবংশী'র নৌকায় তারা উত্তর পতেঙ্গা থেকে কৈবল্যধাম যাচ্ছিলেন। চন্দ্রমনি শ্বশুর মহাশয়কে প্রশ্ন করলেন, আচ্ছা বাবা, আমাদের এই কোনঠাসা অবস্থার জন্য আসলে কারা দায়ী?
মেয়েজামাই'র প্রশ্নের জবাবে শ্বশুর মহাশয় হরিপদ কৈবর্ত আবার বলতে লাগলেন, 'মনুসংহিতা'র বিধান মতে, ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য আর শূদ্রের মধ্যে শূদ্ররা হল সবচেয়ে নিম্নগোষ্ঠী। ঋষি মনু বলেছেন যে, শূদ্র অর্থ সঞ্চয় করতে পারবে না, উচ্চবর্ণের পথ দিয়ে শূদ্র শবদেহ বহন করতে পারবে না, ব্রাহ্মণের নিন্দা করলে শূদ্রের জিহবা কেটে নেওয়া যাবে, ব্রাহ্মণের সঙ্গে এবসাথে বসলে শূদ্রের পাছায় লোহার ছেঁকা দিয়ে তাকে নির্বাসন করা যাবে। এমন অনেক কঠিন কঠিন বিধান উচ্চবর্ণের হিন্দুরা পালন করতো। মূলত, ক্ষমতা আর শাসনকাজ নির্বিঘ্ন করতে এভাবে উচ্চবর্ণের হিন্দুরা সমাজকে চারশ্রেণীতে ভাগ করলো। ব্রাহ্মণরা ক্ষত্রিয়ের ছত্রছায়ায় যাগযজ্ঞে আর ধর্মকর্মে পৌরহিত্য করতে লাগল। শাসনকার্যের দায়িত্ব নিল ক্ষত্রিয়রা। শিল্পবাণিজ্য আর কৃষিকাজের দায়িত্ব পেল বৈশ্যরা। আর সব ধরনের কায়িক পরিশ্রমের ভার অর্পন করলো শূদ্রদের উপর। সেই হিসেবে ধর্মের দোহাই দিয়ে উচ্চবর্ণ হিন্দুরাই আমাদের কোনঠাসার জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী। আর এই চিত্র বালুখালি, উত্তর পতেঙ্গা, হালিশহর, কাট্টলি, খেজুরতলা, সলিমপুর, কুমিরা, সীতাকুণ্ড, মীরসরাই যেখানেই যাও এখনো দেখতে পাবে। এমনি কি কর্নফুলি, মাতামুহুরী, হালদা, সাঙ্গু, এসব নদীর এপার ওপার যেসব জেলেরা এখনো বসবাস করছে সেখানেও একই অবস্থা। আমার ধারণা, শুধু বাংলাদেশে নয়, গোটা ভারতবর্ষে কৈবর্তরা এখনো উচ্চবর্ণ হিন্দুদের কাছে এখনো অচ্চুদ।
এতোক্ষণ শৈলীরানী চুপচাপ বাবা আর স্বামীর কথোপকথোন শুনছিলো। এসব বড়দের কথা শৈলীরানী একদম বুঝতে পারে না। সে বরং তার চেয়ে একটু বড় নৌকার মাঝি বিলাসের সঙ্গে পুরানো বন্ধুত্বের খাতিরটা আরেকটু ঝালাই করে নিল। আচ্ছা বিলাস দা, তুমি বিয়া করবা কবে? বিলাস রাজবংশী'র বাড়ি শৈলরানী'র বাবার বাড়ির খালের ঠিক উল্টোপারে। হরিপদ কৈবর্ত মেয়ে-জামাইকে আনতে বিলাসকে সঙ্গে নিয়েছিলেন। বিলাস শৈলীরানী'র কথায় না হেসে পারলো না। আঁই তো গড়ার চাই। মা-বাবা রাজি ন। বছর দুই যাউক। তারপর গড়ির..হে হে হে..
আষাঢ়ের গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি এই আছে এই নেই। নৌকার খোলে অবশ্য একটা ভাঙা ছাতা আছে। কিন্তু তা বের করার উপায়ও নেই। দক্ষিণা বাতাসে বিলাসের নৌকা ঠিক রাখা তখন আরো কঠিন হয়ে যাবে। যে কারণে আষাঢ়ের হঠাৎ আসা এই দমকা গুড়ি গুড়ি বৃষ্টিকে ওরা তেমন পাত্তাও দেয় না। বেলা দ্বিপ্রহর নাগাদ বিলাস হরিপদ কৈবর্তের ঘাটে নৌকা ভেড়াতে সক্ষম হল। শৈলীরানী সবার আগেই এক লাফে চিরচেনা সেই ঘাটে এমন লম্ফ দিল যে, আরেকটু হলেই চন্দ্রমনি নৌকা থেকে ছিটকে যাচ্ছিলো। ভাগ্যিস শ্বশুর মহাশয় হরিপদ কৈবর্ত চন্দ্রমনিকে ধরে রাখলো।
........................চলবে..........................
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে জুলাই, ২০১৩ রাত ১২:৪৬