somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ছোটগল্প: পাগলা বাবা !!

১২ ই ডিসেম্বর, ২০১৩ সকাল ৯:৪০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

এক.
বটতলার পাগলা বাবা'র সাথে প্রথম দেখা হয়েছিল বা্জুয়া বাজারে। ওপাশে পশুর নদীর উথাল পাতাল থৈ থৈ পানি, এপাশে সোনাই খালের রাস্তার মোড়ে বিশাল বটগাছ। একটু অদূরেই লঞ্চ টার্মিনাল। ওই টার্মিনালে নামার আগেই আকাশ ভেঙ্গে তুমুল বৃষ্টি। বৃষ্টির সঙ্গে হাড় কাঁপুনে অলক্ষুণে হিমেল বাতাস। বৃষ্টি বাতাস আর পশুর নদীর উজান ঠেলে চালনা থেকে বাজুয়া আসতেই সকাল গাড়িয়ে মধ্যান্থ। ওই টুকু ছোট্ট ইঞ্জিনের লঞ্চে কি আর পরাণ রাখা যায়! বুকের মধ্যে ভারী উচাটন নিয়ে দুরু-দুরু ভীরু-ভীরু চোখে তবু বড় বড় ঢেউ ফুরে লঞ্চ যখন ঢেউয়ের ডগায় ওঠে তখন কেবল এক টুকরো আকাশ দেখা যায়। আর লঞ্চ যখন পাল্টা ঢেউয়ের তলানীতে হাবুডুবু খায় তখন চারপাশে শুধুই পানি আর পানি। এই বুঝি দরিয়ার যোম মরণ কামড় দেয়। আমার সঙ্গে নিতীশ ভয়ে ছিদ্র হওয়া বেলুনের মত একেবারে চুপশে গিয়ে ভারী হায় হুতোশ করছে। ভাগ্যিস ঝড় ওঠার আগেই আমাদের লঞ্চ টার্মিনালে পৌঁছাল। মাটির নিশানা পেয়ে আমরা ঝড়ো বৃষ্টির মধ্যেই সোনাই খালের পার ধরে সামনে এগিয়ে গেলাম। সোনাই খাল পারে সারি সারি দোকান। একটা ভাতের হোটেলে আমরা ঢুকে পরলাম।
ভয় পেলে কি মানুষের খুব ক্ষুধা লাগে? দোকান মালিক ক্যাশ বাক্সের সামনে বসে আছেন। তার স্ত্রী আমাদের খাবার পরিবেশন করছেন। খাবারের মেনুতে তেমন বৈচিত্র্য নেই। ফাইসা মাছ ভাজি, ভাইসা মাছের ঝোল, মুরগি, আলু ভর্তা আর ডাল। ঘরের মধ্যেই টিউবওয়েল। সেখানে হাতমুখ ধুয়ে আমরা খেতে বসলাম পৃথিবীর সবচেয়ে সস্তা খাবার। আমাদের খাবারের জোস দেখে দোকানি আরেকটা নতুন আইটেম বানালেন। শুটকি মাছের ভর্তা। পাঁচ ফোড়নের ডাল দিয়ে সেই ভর্তা ভারী সুস্বাদু। আমরা খাবার শেষ করে বৃষ্টি থামার অপেক্ষায় আয়েশ করে বসলাম। ততোক্ষণে নিতীশ আবার প্রাণে ফিরে আসল। দুষ্টু চোখের রহস্য মাখিয়ে বললো, এখন একটা পান খাব। এক্কেবারে মামা বাড়ির আবদার? আশে পাশে কোথায় পানের দোকান? দোকানি বললেন, আমরা স্বামী-স্ত্রী পান খাই, বসেন পান বানিয়ে দিচ্ছি। পান তামুক খেতে খেতে বিল কত জানতে চাইলে দোকানি তার স্বামীর কাছে হিসেব দিতে দিতে দু'জনে মিলে হিসেব কষে জানালেন, আশি টাকা। সেই সুযোগে দোকানিকে আমরা মাসী ডেকে বসলাম।
এবার মাসী আর মেসোকে আমরা আমাদের বাজুয়ায় আসার হেতু খুলে বললাম। কাকে কোথায় কিভাবে পাওয়া যাবে সে বিষয়ে একটু খোঁজ খবর নিলাম। সোনাই খালের সাঁকো পেরিয়ে ওপারেই বাজুয়া বাজার। সেখানে বাজুয়া'র চেয়ারম্যান বাবুকে আমরা পেয়ে গেলাম। চেয়ারম্যান বাবু আমাদের নিয়ে গোটা বাজুয়া বাজার ঘুরে দেখালেন। শনিবার আর মঙ্গলবার বাজুয়া বাজারে হাটের দিন। সেই হাটের দিনের বাজুয়া বাজারের চিত্র একেবারে অন্যরকম। গোটা দক্ষিণবঙ্গের সকল মানুষ সেই হাটে তখন কেনাবেচা করতে আসেন। ইতোমধ্যে আমাদের ঘিরে চেয়ারম্যান বাবু'র নের্তৃত্বে অম্বরেশ বাবু'র দোকানে বিশাল একটা জটলা পাকিয়েছে। উৎসুক সবাই আমাদের দেখছেন আর আমরা কি জানতে চাইছি তার জবাব দিচ্ছেন।
এক ফাঁকে আমরা সিগারেট খাবার নাম করে বাজারের জটলা থেকে বাইরে এসে বিশাল এক বটগাছ আবিস্কার করলাম। চুপচাপ সিগারেট খাচ্ছি আর রাতে আমরা কোথাও খাকব সেই চিন্তা করছি। ঠিক ওই সময় পেছন থেকে পাগলা বাবা হাঁক ছাড়লেন। ওরে তুই কিডারে? আমার বটতলায় খাড়ায়া বিড়ি ফুকিস? এতো বড় সাহস তোর? পেছন ফিরে দেখলাম, বিশাল দেহি এক লম্বা চুলের বাউল। খালি পা খালি গা। কপালে সিঁদুর। মুখে চাপ দাড়ি। বিশাল মোঁচ ফসকে সাদা দাঁতের কিঞ্চিত দৃষ্টিত হয় বুঝিবা। এক হাতে ভিজে কাপড়। অন্য হাতে পিতলের বদনা। বদনার উপরে সিঁদুরের কৌটা। পাগলা বাবা সান্ধ্য স্নান সেরে আস্তানায় ফিরছেন। ভারী সুঠাম দেহের গড়ন তাঁর। ভারী বর্জ কণ্ঠ। ভারী রহস্যময় চোখের চাহনী। দূর আকাশের অপার নীলিমার ভারী সৌন্দর্য সেই চোখেমুখে। সেই রহস্যময়ী চোখে চোখ পড়তেই পাগলা বাবা শান্ত হলেন। ঝড় থেমে গেলে যেমন প্রকৃতি একেবারে থমকে যায় তেমনি চমকে রইলেন পাগলা বাবা। যুদ্ধ ফেরত ছেলেকে দেখলে মা যেমন ভারী রহস্যময়ী ভঙ্গিতে খুব ভালো করে ছেলেকে খুটিয়ে খুটিয়ে দেখেন, তেমনি খুটিয়ে খুটিয়ে ভালো করে পাগলা বাবা আমাদের পর্যবেক্ষণ করলেন। এবার একেবারে সুমিষ্ঠ গলায় জিজ্ঞেস করলেন, কহোন আইছিস? খাইছিস কিছু? দাঁড়া একটু মুছে দি। বাদলায় সব ভিজে গেছে। নিজের পোস্তা করা লাল ইটের আসনখানি ভারী মমতা দিয়ে তিনি মুছতে লাগলেন ভিজে গামছা দিয়ে। তারপর আমাদের সঙ্গে নিজেও বসলেন। যেনো আমরা হাজার বছর ধরে তাঁর পরিচিত কোনো রত্ন বান্ধব। যেনো হাজার বছর পরে আমাদের ফের দেখা হল এক ঘোর লাগা মহাসন্ধ্যায়। যেনো এক নিমিষে পৃথিবীর সকল না বলা কথা কেবল ইসারায় বলা হয়ে গেল একটুখানি চোখাচোখিতে। তখন সূর্য ডোবার ক্ষণ। তখন গোধূলী লগ্ন। পাগলা বাবা আমাদের বসিয়ে রেখে সান্ধ্য প্রার্থণায় মগ্ন হলেন।
............................................... চলবে...................
৯টি মন্তব্য ৯টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

একটি ছবি ব্লগ ও ছবির মতো সুন্দর চট্টগ্রাম।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৮:৩৮


এটি উন্নত বিশ্বের কোন দেশ বা কোন বিদেশী মেয়ের ছবি নয় - ছবিতে চট্টগ্রামের কাপ্তাই সংলগ্ন রাঙামাটির পাহাড়ি প্রকৃতির একটি ছবি।

ব্লগার চাঁদগাজী আমাকে মাঝে মাঝে বলেন চট্টগ্রাম ও... ...বাকিটুকু পড়ুন

মেহেদী নামের এই ছেলেটিকে কি আমরা সহযোগীতা করতে পারি?

লিখেছেন ইফতেখার ভূইয়া, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১০:০৪


আজ সন্ধ্যায় ইফতার শেষ করে অফিসের কাজ নিয়ে বসেছি। হঠাৎ করেই গিন্নি আমার রুমে এসে একটি ভিডিও দেখালো। খুলনার একটি পরিবার, ভ্যান চালক বাবা তার সন্তানের চিকিৎসা করাতে গিয়ে হিমশিম... ...বাকিটুকু পড়ুন

দ্য অরিজিনস অফ পলিটিক্যাল জোকস

লিখেছেন শেরজা তপন, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১১:১৯


রাজনৈতিক আলোচনা - এমন কিছু যা অনেকেই আন্তরিকভাবে ঘৃণা করেন বা এবং কিছু মানুষ এই ব্যাপারে একেবারেই উদাসীন। ধর্ম, যৌন, পড়াশুনা, যুদ্ধ, রোগ বালাই, বাজার দর থেকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। ভালোবাসা নয় খাবার চাই ------

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৯ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১:০৬


ভালোবাসা নয় স্নেহ নয় আদর নয় একটু খাবার চাই । এত ক্ষুধা পেটে যে কাঁদতেও কষ্ট হচ্ছে , ইফতারিতে যে খাবার ফেলে দেবে তাই ই দাও , ওতেই হবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

জাতীয় ইউনিভার্সিটি শেষ করার পর, ৮০ ভাগই চাকুরী পায় না।

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৯ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৪:৫৭



জাতীয় ইউনিভার্সিটি থেকে পড়ালেখা শেষ করে, ২/৩ বছর গড়াগড়ি দিয়ে শতকরা ২০/৩০ ভাগ চাকুরী পেয়ে থাকেন; এরা পরিচিত লোকদের মাধ্যমে কিংবা ঘুষ দিয়ে চাকুরী পেয়ে থাকেন। এই... ...বাকিটুকু পড়ুন

×