somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

অরণ্যের দিনরাত্রিতে সত্যজিৎ কোথায় সেক্স আপিল কীভাবে দেখিয়েছিলেন!!!

১৯ শে জানুয়ারি, ২০১৭ সকাল ৭:২৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের 'অরণ্যের দিনরাত্রি' উপন্যাস অবলম্বনে সত্যজিৎ রায় একই নামে যে ছবিটি নির্মাণ করেছেন, সেখানে শর্মিলা ঠাকুর, কাবেরী বসু, সিমি আর অপর্ণা সেনের বিপরীতে অভিনয় করেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায়, রবি ঘোষ ও শমিত ভঞ্জ, পাহাড়ী সান্যাল, প্রেমাশিস সেন, সমর নাগ, খয়রাতিলাল লাহোরি ও দিবেন্দ্যু চ্যাটার্জি অভিনয় করেন। কিন্তু প্রশ্ন হলো ছবিতে সত্যজিৎ বাবু কেবল দিবেন্দ্যু চ্যাটার্জির নামের পেছনে 'শ্রীমান' বসালেন কেন? বিষয়টি আমাকে ভাবিয়েছে বেশ! দর্শক হিসেবে আপনাদের ভাবিয়েছে কী?

অরণ্যের দিনরাত্রির গল্পটা মনে আছে তো? চার বন্ধু অসীম (সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়), সঞ্জয় (শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায়), হরি (সমিত ভাঞ্জা) ও শেখর (রবি ঘোষ), সবাই কলকাতার নাগরিক বাসিন্দা। এক ছুটিতে চার বন্ধু মিলে পালামৌ এর কাছাকাছি একটা জায়গায় বেড়াতে এসেছে। অসীম কলকাতায় একটি সওদাগরী আপিসে উচ্চপদস্থ কর্মচারী। এই চার বন্ধুর মধ্যে অসীম অর্থনৈতিক ভাবে সবচেয়ে সচ্ছল আর একটি অ্যাম্বাসেডর গাড়ির মালিক। সঞ্জয় কলকাতায় একটি সরকারী আপিসে কাজ করে। হরি একজন ক্রিকেট খেলোয়াড়, তাছাড়া সম্প্রতি হরি'র বান্ধবী, হরির সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেছে। আর শেখর বর্তমানে বেকার কিন্তু জুয়ার প্রতি শেখরের খুব আকর্ষণ আছে। এছাড়া শেখরের সপ্রতিভ ব্যবহারের জন্য বন্ধুদের কাছে সে খুব প্রিয়।

জার বন্ধু মিলে কলকাতা থেকে পালামৌ বেড়াতে যাবার জন্য অসীমের গাড়িতে বেরিয়ে পড়েছে। পালামৌ এর কাছাকাছি গিয়ে একটা চায়ের দোকানে অসীম খোঁজ নিলে যে, কাছাকাছি কোথাও টুরিস্ট বাংলো আছে কিনা। তখন এক স্থানীয় লোক, যার নাম লখা, কিছু বখশিসের বিনিময়ে অসীমদের একটা টুরিস্ট বাংলো দেখিয়ে দিতে রাজি হয়। অসীমরা লখাকে গাড়িতে নিয়ে সেই টুরিস্ট বাংলোর কাছে যায়। টুরিস্ট বাংলোয় থাকার জন্য ডালটনগঞ্জের ডিএফও সাহেবের কাছ থেকে অগ্রিম অনুমতিপত্র নেওয়ার নিয়ম। টুরিস্ট বাংলোর গেটের সামনে সেই নোটিস বোর্ড দেখার পরেও অসীমরা ওই টুরিস্ট বাংলোতেই থাকার সিদ্ধান্ত নেয়। আর এজন্য অসীম বাংলোর চৌকিদারকে বকশিস দিয়ে বাংলোর ঘর খোলাতে বাধ্য করে।

জঙ্গলের মধ্যে একটা থাকার ব্যবস্থা হওয়ায় চার বন্ধু খুব স্বস্তিবোধ করে। কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে বিকেল বেলায় ওরা জঙ্গলের দিকে ঘুরতে বেরোয়। প্রথমদিকে মনে হচ্ছিল যে, ওরা বুঝি জঙ্গলে উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘুরতে বেরিয়েছে, কিন্তু দেখা গেল যে অসীমের ঠিকই একটা নির্দিষ্ট গন্তব্য আছে। আর সেটা হলো স্থানীয় বাসিন্দাদের নেশা করার একটা জায়গা। স্থানীয় বাসিন্দারা সেখানে প্রতিদিন সন্ধেবেলায় হাড়িয়া (বা মহুয়া বা চুল্লু) খেয়ে নেশা করে। অসীমরা সেখানে এসে প্রয়োজনীয় বাংলামদ, সোলা আর পাকরসামগ্রী কিনে মদ্পান করতে শুরু করলো।

কিন্তু বন্ধুদের মধ্যে সবাই মদ্পানে অভ্যস্ত হলেও শেখর এই জায়গায় হাড়িয়া খেতে একদম সম্মত ছিল না। অন্যরা যখন মদ্পানে ব্যস্ত, তখন শেখর একটু দূরে একটি সাঁওতালি যুবতীর দিকে হরির দৃষ্টি আকর্ষণ করলো। এই সাঁওতালি যুবতীর নাম দুলি। দুলি সেখানে তার বান্ধবীদের সাথে বসে মদ্পান করছিল। যখন দুলির বোতলের মদ শেষ হয়ে যায়, তখন দুলি উঠে এসে শেখরদের কাছে কিছু পয়সা চায়, যাতে নতুন করে সে আরো হাড়িয়া কিনে খেতে পারে। তখন নেশার ঘোরে হরি দুলিকে কিছু পয়সা দেয়। আকন্ঠ বাংলামদ গিলে চার বন্ধু মিলে জঙ্গলের রাস্তা দিয়ে রাতের অন্ধকারে গান গাইতে গাইতে বাংলোযতে ফিরে আসে।

পরদিন সকালে সবার আগে ঘুম ভাঙ্গলো শেখরের। শেখর বারান্দায় এসে দেখতে পেল তাদের বাংলোর সামনের রাস্তা দিয়ে দু'জন ভদ্রমহিলা নিজেদের মধ্যে কথা বলতে বলতে চলে যাচ্ছে। শেখর তখন খুব আনন্দের সঙ্গে অসীম ও সঞ্জয়কে খবরটা জানায়। তারপর সবাই চা খেয়ে বাজারে আসে নাস্তা করার জন্য। তখন ওই বাজারে আবার শেখর দেখতে পেল যে, দুলি ও তার বান্ধবীরা বাজারে গোল হয়ে ঝুড়ি নিয়ে বসে আছে, হয়তো ওরা কাজের অপেক্ষায় বসে আছে। দুলি তখন শেখর আর হরিকে দেখে চিনতে পারলো আর জিজ্ঞাসা করলো- তাদের সন্ধানে কোনো কাজ আছে কিনা। তখন শেখর দুলিকে বলল- পরে সময় করে বাংলোয় দেখা করতে।

সকালে নাস্তা করার সময় শেখর খুব কায়দা করে লখার কাছ থেকে সেই দুই ভদ্রমহিলার বাসস্থান কোথায় জেনে নিয়েছিল। ওই দুই ভদ্রমহিলা আসলে সম্পর্কে বৌদি ও ননদ। বৌদির একটি শিশুপুত্র আছে। পরিবারের কর্তা এক প্রবীণ ব্যক্তি, যাঁর নাম সদাশিব ত্রিপাঠি (পাহাড়ি সান্যাল)। তিনি পরিবারের সবাইকে নিয়ে ওখানে বেড়াতে এসেছেন। টুরিস্ট বাংলো থেকে খুব কাছে হাঁটা দূরত্বে সদাশিব ত্রিপাঠির একটি বাড়ি আছে। সেখানে ত্রিপাঠি বাবুর পরিবারের সবাই বছরে অন্তত একবার বেড়াতে আসে। শেখররা বাজার থেকে সেই বাড়ির সামনে আসে। ওদের ইচ্ছা ওই দুই ভদ্রমহিলাদের সঙ্গে আলাপ করার। ঠিক তখন সদাশিব ত্রিপাঠি বাবু প্রাতভ্রমণ শেষ করে বাড়িতে প্রত্যাবর্তন করছিলেন। বাড়ির দরজায় শেখরদের দেখে ওদের সঙ্গে কথা বললেন এবং খুব আনন্দের সঙ্গে তাঁর বাড়িতে আমন্ত্রণ করলেন। ত্রিপাঠি বাবুর বাড়িতে যাবার পরিচয় পর্ব শেষে সঞ্জয়, শেখর, হরি আর বৌদি ব্যাডমিন্টন খেলতে শুরু করে।

অন্যদিকে অসীম বৌদির ননদটির প্রতি মনে মনে খুব আকৃষ্ট হয়। তাই সে কৌশলে ব্যাডমিন্টন খেলা এড়িয়ে ননদের সঙ্গে গপ্পো করার ফন্দি করে। ব্যাপারটি ত্রিপাঠি বাবুও কিছুটা সমর্থন করেন। তারপর পাশের একটি ওয়াচ টাওয়ারে গিয়ে অসীম আর ননদটি কিছুক্ষণ নিরিবিলি কথা বলে। তখন অসীম জানতে পারে- মেয়েটির নাম অপর্ণা (শর্মিলা ঠাকুর)। তার এক দাদা ছিল, কয়েক বছর আগে সে মারা গেছে। অপর্ণার মাও তার বারো বছর বয়সে মারা গেছেন। অপর্ণারা প্রতি বছর অন্তত একবার এখানে বেড়াতে আসে। কারণ জায়গাটা ত্রিপাঠি বাবুর (অপর্ণার বাবা) খুব স্যুট করে। ওই আলাপচারিতায় অপর্ণাও জানতে পারে যে, অসীমরা জোর করে পাশের ওই টুরিস্ট বাংলোটা দখল করেছে।

ওই সময় লখা এসে ওদের খবর দেয় যে, বাংলোয় টুরিস্ট রেঞ্জার সাহেব এসেছেন এবং তিনি এই চার বন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে চান। তখন অসীমরা ত্রিপাঠি বাবুর পরিবারের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বাংলোয় ফিরে আসে। কিন্তু ওরা আসার সময় বৌদি (কাবেরী বসু) পরদিন সকালে ওদের নাস্তার জন্যনিমন্ত্রণ করেন। অসীমরা বাংলোয় ফিরে আসার পর রেঞ্জার সাহেব জানান যে, বড়সাহেব, মানে ডিএফও সাহেব ডালটনগঞ্জ, খুব শিগগির বাংলো পরিদর্শনে আসতে পারেন। ফলে বিনা অনুমতিতে বাংলোয় থাকার জন্য অসীমদের বিতাড়িত হবার সম্ভাবনা আছে। তাছাড়া চৌকিদারেরও চাকরি খোয়ানোর সম্ভাবনা আছে। এই ঘটনা শুনে চার বন্ধু তখন বেশ মুষড়ে পড়ে।

একটু পরে দুলি ও তার দুই বান্ধবী বাংলোয় আসে কাজ করার জন্য। শেখর ওদেরকে অগ্রিম পারিশ্রমিক দিয়ে ঘর-দোর পরিষ্কারের কাজে লাগায়। কিন্তু চৌকিদারের আপত্তিতে দুলিরা ছুটে পালাতে বাধ্য হয়। তখন হরি হঠাৎ খেয়াল করে যে, তার মানিব্যাগ হারিয়ে গেছে। তখন হরি হঠাৎ লখাকে সন্দেহ করে আর লখাকে প্রহার করতে শুরু করে। এই উটকো ঝামেলা যাতে আর না বাড়ে তাই অসীম লখাকে তার পাওনা টাকা আর বকশিস মিটিয়ে তাড়িয়ে দেয়।

তারপর অসীম, সঞ্জয় আর শেখর বাংলোর লাগোয়া কুয়োর পাড়ে স্নান করতে আসে। তারা যখন খালি গায়ে সাবান মেখে স্নান করছিল তখন হঠাৎ গাড়িতে করে অপর্ণা ও বৌদি সেখানে আবির্ভাব হয়। তাই দেখে সঞ্জয় বুদ্ধি করে কুয়োর পাড়ে নিজেকে আড়াল করে সটান শুয়ে পরে। আর অসীম কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। কেবল শেখর বেশ সপ্রতিভ হয়ে দুই মহিলাকে প্রীতি সম্ভাষণ করে। তখন বৌদি হরি'র মানিব্যাগটি ফেরত দেন, আর বলেন যে, হয়তো ব্যাডমিন্টন কোর্টে খেলার সময় ওটা পড়ে গিয়েছিল। গাড়ি চলে যাবার পর উচ্ছ্বসিত সঞ্জয় কুয়োর পেছন থেকে বেরিয়ে আসে। তখন অসীম নিজের ভাগ্যকে খুব দোষারোপ করে আর শেখর ওদের এই বলে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করে যে, দেখলি তো ব্যাপারটা কত স্মার্টলি হ্যান্ডেল করলাম!

ওইদিন সন্ধ্যেবেলায়ও ওরা চার বন্ধু যথারীতি সেই জায়গায় হাড়িয়া পান করতে যায়। আর রাতে মদ্যপ অবস্থায় বাংলোযতে ফেরার সময় ওরা রাস্তায় একটি গাড়ির সামনে পড়ে। গাড়ির হেডলাইট এবং হর্নের আওয়াজে বিরক্ত হয়ে অসীম তখন ভারি অপ্রকৃতস্থের মত আচরণ করেছিল। কিন্তু ওরা একদম বুঝতে পারে না যে, গাড়ির মধ্যে অপর্ণা ও বৌদি বসে ছিলেন।

পরদিন সকালে চার বন্ধুর ঘুম থেকে উঠতে যথারীতি বেশ দেরি হয়। শেখর ঘুম থেকে উঠেই বুঝতে পারে যে, ত্রিপাঠী বাবুদের বাসায় গিয়ে নাস্তার নিমন্ত্রণ রক্ষা করার সময় অনেক আগেই চলে গেছে। তাই শেখর তখন অসীম ও সঞ্জয়কে খুব তিরস্কার করে এবং বাইরে গিয়ে দেখতে পায়- বৌদি ওদের জন্য কিছু খাদ্যসামগ্রী একটা টিফিন ক্যারিয়ারে পাঠিয়ে দিয়েছেন। সঙ্গে ওদের জন্য একটি চিঠি। তারপর ওরা চার বন্ধু আবার ত্রিপাঠি বাবুর বাসায় যায় আর সকালে না আসার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে। আর হরি মানিব্যাগ ফেরত দেবার জন্য বৌদিকে ধন্যবাদ জানায়। আর ওরা দুপুর বেলায় বৌদি ও অপর্ণাকে বাংলোয় আসার আমন্ত্রণ জানায়।

অসীমরা বাংলোয় ফিরে আসার পরপরই ডিএফও সাহেব বাংলো পরিদর্শনে আসেন। আর তিনি তাঁর কর্তৃত্ববলে অসীমদের বাংলো থেকে চলে যাবার নির্দেশ দেন। ঠিক তখন অপর্ণা ও বৌদি বাংলোয় আসেন। তখন দেখা যায় যে, ডিএফও সাহেব ত্রিপাঠি বাবুর পরিবারের পূর্বপরিচিত। তখন অপর্ণা অসীমদের নিজের বন্ধু বলে পরিচয় দেওয়ায় অসীমরা সে যাত্রায় বাংলো থেকে বিতাড়িত হওয়া থেকে রক্ষা পায়। তারপর দুই ভদ্রমহিলা ও চার বন্ধু মিলে বাংলোর বাগানে গাছের ছায়ায় আড্ডায় বসে। সেখানে তারা মেমরি গেম খেলে একটা সুন্দর বিকাল কাটায়।

বিকেলের দিকে ওরা সবাই মিলে স্থানীয় একটা মেলায় যায়। সেখানে অসীম অপর্ণার সঙ্গে বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলে আর যখন জানতে পারে যে, অপর্ণারা আগামীকাল সকালেই কলকাতায় ফিরে যাবে। তখন অসীম অপর্নাকে তার মনের কথা খুলে বলে আর কলকাতায় অপর্ণার সঙ্গে দেখা করার অনুমতি চায়। অপর্নাও অসীম কে তখন নিরাশ করে না। একটা টাকার উপর নিজের ফোন নাম্বার লিখে দেয়। ওদিকে শেখর মেলাযর মাঠে জুয়া খেলে বেশ কিছু টাকা হারায়। এদিকে হরি মেলায় দুলিকে দেখতে পেয়ে তাকে নিয়ে জঙ্গলের মধ্যে যায়। দু'জনে সেখানে খুব ভালোবাসাবাসি করে। কিন্তু হরি একদম দেখতে পায় না যে, দূর গাছের আড়াল থেকে লখা হরিকে নজরে রেখেছে। হরি দুলিকে বিদায় দিয়ে যখন বাংলোয় ফিরে আসছে, তখন লখা প্রতিশোধ নেবার জন্য হরিকে পেছন থেকে আক্রমণ করে। আর হরির মানিব্যাগ নিয়ে পালায়। হরি কিছুক্ষণ সেখানে জ্ঞান হারিয়ে পড়ে থাকে। কিছুক্ষণ পর হরি ধুঁকতে ধুঁকতে জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে বাংলোয় ফেরার চেষ্টা করে। তখন শেখর মেলা থেকে ফেরার পথে হরিকে দেখতে পেয়ে বাংলোযয় নিয়ে আসে।

ওদিকে মেলা থেকে কিছু কেনাকাটার পর সঞ্জয় বৌদিকে তাদের বাড়িতকে পৌছিয়ে দিতে আসে। বৌদি তখন সঞ্জয়কে কফি খাবার আমন্ত্রণ জানালে সঞ্জয় সানন্দে তা গ্রহণ করে। কিছুক্ষণ পর বৌদি মেলায় কেনা সাঁওতালি গহনা পরে সঞ্জয়কে দেখাতে আসলে সঞ্জয় তখন বেশ অপ্রস্তুত হয়ে যায়! সঞ্জয়ের কাছ থেকে প্রেমের আলিঙ্গন না পেয়ে বৌদি তার ঘরের দরজা বন্ধ করে দেন। সঞ্জয় তখন সেই বাসা থেকে বাংলোর দিকে ফিরতে থাকে। পথে অসীম আর অপর্ণাকে দেখে সঞ্জয় কফি খাবার কথা বলে। অপর্ণা বাসায় চলে গেলে অসীম আর সঞ্জয় নিজেদের বাংলোয় ফেরে।

পরদিন সকালে চার বন্ধু কলকাতায় ফেরার প্রস্তুতি নেয়। সারা রাত শেখরের সুশ্রষায় হরি কিছুটা ভালো বোধ করে। অসীম চৌকিদারকে বাংলোর প্রাপ্য টাকা দিয়ে বলে যে, তোমার চাকরি খোয়ানোর কোনো সম্ভাবনা নেই। চৌকিদার তখন গাড়ির সামনে এসে এক বাক্স খাবার ওদের হাতে দিয়ে বলে যে, বৌদি পাঠিয়ে দিয়েছেন। ওরা তখন আনন্দের সঙ্গে বাক্সটি গ্রহণ করে আর কলকাতা অভিমুখে রওনা দেয়। এই হলো গল্পটা।

'অরণ্যের দিনরাত্রি' ছবিতে সত্যজিৎ রায় চিত্রনাট্য, সংগীত ও পরিচালনা করেছেন। পালামৌ'র কাছে জঙ্গলের ভেতর ডাক বাংলাতো পৌছানোর পর দেখা যায়- শেখর (রবি ঘোষ) কূপ থেকে জল তুলে আরামসে স্নান করে। আর গুন গুন করে গান করে- 'খুঁজে দেখো পাইনি তোমার পরাণ... তবু আছি...' এমন সময় ঘাড় ঘুরিয়ে দেখতে পায়- দূর থেকে ছোট ছোট কিছু পাহাড়ি ছোকরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তার স্নান দেখছে। শেখর (রবি ঘোষ) সেদিক ঘুরে ছোকরাদের আচ্ছামত ধমক দিয়ে বলে- কিরে! কী এখানে? ভাগ ..ভাগ। ছোকরারা ভয়ে যখন চলে যেতে থাকে, শেখর (রবি ঘোষ) তখন আবার স্নানে ব্যস্ত হয়ে শরীর ঘষতে ঘষতে ছোকরাদের উদ্দ্যেশে বলে- অসভ্য।

বারান্দায় বসে তখন অসীম (সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়) আর সঞ্জয় (শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায়) গপ্পো করছিল। পুরানো দিনের কথা। পত্রিকা কীভাবে করতো, বয়স বাড়লে কী হয়, সঞ্জ বলে- পত্রিকায় কিন্তু আমরা কখনো খারাপ লেখা ছাপি নাই, মনে আছে? ওদিকে স্নান শেষ করে স্যান্ডো গেঞ্জি আর হাফ প‌্যান্ট পরা অবস্থায় শেখর (রবি ঘোষ) একটি পেপার হাতে বারান্দা দিয়ে আসার সময় অসীম (সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়) জিজ্ঞেস করে- কীরে তোর স্নান কেমন হোলো? জবাবাে শেখর (রবি ঘোষ) বলে- ফার্স্ট ক্লাশ। এবার একটা জিওম্যাট্রিক ব্যাপার করব, দেখবি? জবাবে অসীম বলে- তোর যা খুশি কর। তারপর শেখর (রবি ঘোষ) হাতের পত্রিকায় আগুন লাগিয়ে বলে- সভ্যতার সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক শেষ! এই পর্যায়ে শেখর (রবি ঘোষ)কে সঞ্জয় (শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায়) ধমক মারে। খুব হোলো- ওটা রেখেছিলুম, যাবার সময় জুতো-টুতো মুরে নিয়ে যাবো বলে, ধ্যাৎ!

জঙ্গলের মধ্যে চার বন্ধু দল বেধে হাঁটছে। শেখর (রবি ঘোষ) হঠাৎ জিজ্ঞেস করে- আচ্ছা, আমরা কী উদ্দেশ্যহীনভাবে হেঁটে চলেছি? না আমাদের কোনো লক্ষ্য আছে? অবশ্য লক্ষ্য থেকেও কোনো লাভ নেই! লক্ষ্যে থেকে কটা লোক বা বড় লোক হতে পেরেছে? তখন সামনে থেকে অসীম (সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়) বলে- বগবগ না করে চুপচাপ স্রেফ আমাকে ফলো কর। জবাবে শেখর (রবি ঘোষ) সুবোধ বালকের মত বলে- ওকে বস।

তারপর ঘুরতে ঘুরতে ওরা জঙ্গলের ভেতর দিয়ে একটা জায়গায় গিয়ে সূর্যাস্থ উপভোগ করে। তারপর ঘুরতে ঘুরতে একট ডেরায় গিয়ে দেখতে পায় সবাই লাইন ধরে বাংলামদ কিনে বসে বসে খাচ্ছে। অসীম (সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়)ওদের বলে- তোরা দাঁড়া, আমি আসছি। বলে বাংলামদ কিনে আনে। তখন শেখর (রবি ঘোষ) আর হরি (সমিত ভাঞ্জা) মিলে ছোলা আর পাপর কেনে। তারপর ওরা সবাই বাংলামদ খেতে বসে যায়।

এই সময় পেছনে থেকে লখা আসে। যে ওদের পথ চিনিয়ে বাংলাতে নিয়ে এসেছিল। লখা বলে- বাবু আমিও একটু খাবো। জবাবে অসীম (সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়) বলে- বাজার করে কত ফিরলো রে? দে? লখা তখন পয়সা ফেরত দেয়। অসীম (সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়) তখন বিড়বিড় করে বলে- কত মারলো কে জানে? তারপর লখাকে বকসিস দেয়। লখা তখন বাংলামদ কিনতে চলে যায়।

ওদিকে শেখর (রবি ঘোষ) ঘাড় ঘুরিয়ে দেখতে পায়- একপাশে কয়েকটি মেয়ে বসে বসে বাংলামদ খাচ্ছে। শেখর (রবি ঘোষ) তখন হরিকে (সমিত ভাঞ্জা) ডেকে বলে, হরি, এ হরি, দ্যাখ পেছনে দ্যাখ? হরি (সমিত ভাঞ্জা) জানতে চায়- কী দেখব? জবাবে শেখর (রবি ঘোষ) বলে- দ্যাখ না? মুখ ঘুরিয়ে দ্যাখ? হরি (সমিত ভাঞ্জা) যখন তাজ্জব হয়ে মেয়েগুলোকে দেখছে, বিশেষ করে কালো সুন্দরী মেয়েটিকে (সিমি গরেওয়াল), তখন শেখর (রবি ঘোষ) জবাব দেয়- মিস ইন্ডিয়া! নাইস না?

কিছুক্ষণ পর সেই কালো মেয়েটি (সিমি গরেওয়াল) উঠে এসে একটা গাছ জড়িয়ে ধরে শেখরের (রবি ঘোষ) পিঠে টোকা মেরে বলে- এ বাবু, দে না বাবু? শেখর (রবি ঘোষ) তখন কিছুটা ভড়কে যায়। হরিকে (সমিত ভাঞ্জা) ডেকে বলে, দ্যাখতো কী চায়? হরি (সমিত ভাঞ্জা) জিজ্ঞেস করে- তুই আরো খাবি? জবাবে মেয়েটি (সিমি গরেওয়াল) বলে- আধা পোয়া। হরি (সমিত ভাঞ্জা) আবার ফোড়ন কাটে- আধা পোয়া? কী নাম তোর? এই সময় শেখর (রবি ঘোষ) জবাবে বলে- মিস ইন্ডিয়া! হরি (সমিত ভাঞ্জা) আবার মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করে- কী নাম তোর? জবাবে মেয়েটি (সিমি গরেওয়াল) বলে- দুলি! হরি (সমিত ভাঞ্জা) ঠাট্টা করে শেখরের (রবি ঘোষ) গায়ে একটা গুতা দিয়ে ফোড়ন কাটে- দুলি।

সত্যজিৎ বাবুর 'অরণ্যের দিনরাত্রি' ছবির গাছতলার সেই খেলাটার কথা মনে আছে তো? বৌদির (কাবেরী বসু) কথায় অপর্ণা (শর্মিলা ঠাকুর ) যে মেমরি গেম খেলতে সবাইকে উৎসাহিত করে! রবীন্দ্রনাথ- কার্ল মাক্স- ক্লিওপেট্রা-অতুল্য ঘোষ-হেলেন অব ট্রয়-শেক্সপিয়ার-আউট-মাও সেতু-ডন ব্রাডম্যান-আউট-আউট-রানী রাশমনি-আউট-জন এফ কেনেডি-টেকচাঁদ ঠাকুর-নেপোলিয়ন-মমতাজ মহল-....তারপর অপর্ণার (শর্মিলা ঠাকুর ) পালা যখন আসে তখন অপর্ণা বলে- বোধ হয় পারব না! তখন বৌদি (কাবেরী বসু) বলেন- সে কিরে? তুই মনে করতে পারছিস না? জবাবে অপর্ণা বলে- আমার হরি বাবুর দশা হয়েছে! বৌদি (কাবেরী বসু) তখন আবার বলেন- তুই বলতে চাস- তোর গোড়ার নামগুলো মনে পড়ছে না? তখন শেখর (রবি ঘোষ) বলে- একটু ঠাণ্ডা জল খাবেন? কুয়োর জল? তারপর অপর্ণা (শর্মিলা ঠাকুর ) অনেকক্ষণ চিন্তা করে বলে- নাহ- আউট!

সঞ্জয় (শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায়) আর বৌদি (কাবেরী বসু) মেলার মাঠে ব্যস্ত হয়ে গেল। ওরা ত্রিপাঠি বাবুর বাসায় ফিরে যায়, কারণ বৌদি তখন বারবার ছেলের কথা বলছিলেন! অসীম (সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়) আর অপর্ণা (শর্মিলা ঠাকুর ) বাংলোতে গেল, কারণ অপর্ণা বাংলোয় চশমা ফেলে এসেছিল সেই অজুহাত! শেখর (রবি ঘোষ) জুয়া খেলতে ব্যস্ত হয়ে গেল। কিন্তু হরি কোথায়? হরি (সমিত ভাঞ্জা) তখন সেই মিস ইন্ডিয়াকে নিয়ে (দুলি- সিমি গরেওয়াল) জঙ্গলের দিকে ভেগেছে! জয় মা কালি! সেখানে হরি সেই মিস ইন্ডিয়ার সঙ্গে কী করেছিল? মনে আছে তো?

'অরণ্যের দিনরাত্রি' ছবিতে অসীম ও অপর্ণা, সঞ্জয় ও বৌদি এবং সঞ্জয় ও দুলিকে দিয়ে সত্যজিৎ কিছুটা সেক্স আপিল দেখান। যেটা সত্যজিতের অন্য ছবিগুলোতে তেমন একটা দেখা যায় না। হরি ক্রিকেটার হওয়ায় সে খুব ক্রিকেট খেলার ভক্ত। আগের প্রেমিকার (অপর্ণা সেন) সাথে হরি'র (সমিত ভাঞ্জা) যে ব্রেকআপ হয়েছিল, সেই জ্বালা মেটাতে পাহাড়ি মেয়েটি (দুলি- সিমি গরেওয়াল) হরি'র হৃদয় জয় করেছিল। বৌদি কফি খাওয়ানোর কথা বলে সঞ্জয়কে ঘরে বসিয়ে রেখে মেলায় কেনা গহনা পড়ে যখন সঞ্জয়কে চমকে দিতে চেয়েছিলেন, তখন সঞ্জয় কেমন নার্ভাস ছিলেন মনে আছে? আর অসীম ও অপর্ণা বাংলোয় যাবার নাম করে পথে কী কী করেছিল, মনে আছে তো? এই ছবিতেও সত্যজিৎ বাবু সাওতাঁলি গান ও নাচের বেশ চমৎকার ব্যবহার করেছেন।

দীর্ঘদিন পর আবারো 'অরণ্যের দিনরাত্রি' দেখে অনেক পুরানো স্মৃতি মনে পড়লো। কিন্তু সেই গপ্পো অন্য কোথাও অন্য কোনো সময় করব। আপাতত সবাই ভাবতে থাকুন- কলকাতায় ফেরার পরে কী অসীম আর অপর্ণার ফের দেখা হয়েছিল?

.......................................
১৯ জানুয়ারি ২০১৭

সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে জানুয়ারি, ২০১৭ সকাল ৭:৫০
৮টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

কুড়ি শব্দের গল্প

লিখেছেন করুণাধারা, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:১৭



জলে ভাসা পদ্ম আমি
কোরা বাংলায় ঘোষণা দিলাম, "বিদায় সামু" !
কিন্তু সামু সিগারেটের নেশার মতো, ছাড়া যায় না! আমি কি সত্যি যাবো? নো... নেভার!

সানমুন
চিলেকোঠার জানালায় পূর্ণিমার চাঁদ। ঘুমন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

ধর্ম ও বিজ্ঞান

লিখেছেন এমএলজি, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৪:২৪

করোনার (COVID) শুরুর দিকে আমি দেশবাসীর কাছে উদাত্ত আহবান জানিয়ে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম, যা শেয়ার হয়েছিল প্রায় ৩ হাজারবার। জীবন বাঁচাতে মরিয়া পাঠকবৃন্দ আশা করেছিলেন এ পোস্ট শেয়ারে কেউ একজন... ...বাকিটুকু পড়ুন

তালগোল

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৩৫


তু‌মি যাও চ‌লে
আ‌মি যাই গ‌লে
চ‌লে যায় ঋতু, শীত গ্রীষ্ম বর্ষা
রাত ফু‌রা‌লেই দি‌নের আ‌লোয় ফর্সা
ঘু‌রেঘু‌রে ফি‌রে‌তো আ‌সে, আ‌সে‌তো ফি‌রে
তু‌মি চ‌লে যাও, তু‌মি চ‌লে যাও, আমা‌কে ঘি‌রে
জড়ায়ে মোহ বাতা‌সে ম‌দির ঘ্রাণ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

মা

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৩


মায়াবী রাতের চাঁদনী আলো
কিছুই যে আর লাগে না ভালো,
হারিয়ে গেছে মনের আলো
আধার ঘেরা এই মনটা কালো,
মা যেদিন তুই চলে গেলি , আমায় রেখে ওই অন্য পারে।

অন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

কপি করা পোস্ট নিজের নামে চালিয়েও অস্বীকার করলো ব্লগার গেছে দাদা।

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:১৮



একটা পোস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ আগে থেকেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। পোস্টটিতে মদ্য পান নিয়ে কবি মির্জা গালিব, কবি আল্লামা ইকবাল, কবি আহমদ ফারাজ, কবি ওয়াসি এবং কবি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×