আজ বইমেলায় যেতে একটু দেরী হয়েছে। একটু জ্বর জ্বর ভাব ছিল। ওষুধ খেয়ে বইমেলায় ঢুকেছিলাম। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ঢুকে দেখলাম কবি আসাদ মান্নান বক্তৃতা করছেন! কবি কী নিয়ে কথা বলছেন শুনতে এগিয়ে গেলাম। পরে আসাদ ভাই স্টেজের বক্তৃতা পর্বের কাজ সেরে আমার সঙ্গে যোগ দিলেন। কারো হয়তো বইয়ের মোড়ক উন্মোচনের ব্যাপার ছিল। কে যেন এসে জোর করে আমাদের মিষ্টি খাওয়ালো। পরে আসাদ ভাই আর আমি এলোমেলো ঘুরতে ঘুরতে বিদ্যাপ্রকাশের স্টলে গেলাম। আসাদ ভাই আমার বসনিয়া যুদ্ধ নিয়ে ঐতিহাসিক উপন্যাস 'বসনা' কিনলেন। পরে আমরা আবারো এলোমেলো ঘুরতে লাগলাম। একসময় আগামী প্রকাশনীর প্রকাশক ওসমান গণি জোর করেই আমাদের স্টলের ভেতরে বসালেন। গণি ভাই'র পাল্লায় পড়লে আমার বইমেলা মাটি হবে, তাই আসাদ ভাইকে রেখে আমি ভেগে গেলাম।
লিটল ম্যাগ চত্বরে এসে দেখলাম শুনশান নিরবতা। কোথায় গেল আমাদের কবি-লেখকদের গং? কথাসাহিত্যিক স্বকৃত নোমানকে ফোন দিলাম। নোমান বললেন, উপরে আসেন। উপরে গিয়ে আমি ডক্টর সরকার আমিনের রুমে বসে কিছুক্ষণ আড্ডা দিলাম। আমিন ভাই আমার 'বসনা' উপন্যাস কেনার জন্য আমাকেই টাকা ধরিয়ে দিলেন। ছোট ভাই বন্ধু হিসেবে মহান দায়িত্ব বলে কথা। পরে নোমানকে নিয়ে নিচে আসলাম। নোমানের তখন বাংলা একাডেমি স্টলে দায়িত্ব ছিল। নোমান স্টলে রয়ে গেলেন।
আমি আবার এলোমেলো ঘুরতে ঘুরতে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে গেলাম। আমার প্রকাশকদের কার কোথায় স্টল এখনো জানি না। বইমেলায় এখন পর্যন্ত স্টল চেনার কোনো উপায় বাংলঅ একাডেমি সাইন দিয়ে কোথাও বোর্ডে দেয়নি। অথচ বইমেলার ১২ দিন চলে যাচ্ছে। আমিও এলোমেলো ঘুরতে ঘুরতে দেখা হলো তরুণ কবি রাব্বী আহমেদের সাথে। রাব্বী এবার বাংলাদেশ টেলিভিশনের লাইভ অনুষ্ঠানে কিছু একটা কারবারি করছে। রাব্বী বলল, রেজা ভাই আজকের অনুষ্ঠানে আপনি কথা বলেন! পরে বাংলাদেশ টেলিভিশনের লাইভ অনুষ্ঠানের জন্য মেলায় ঘোরাঘুরিটাই কিছু সময়ের জন্য মাটি হয়ে গেল।
সন্ধ্যায় বাংলাদেশ টেলিভিশনে 'বইমেলা লাইভ অনুষ্ঠানে' কথা বলেছি আমার সদ্য প্রকাশিত বই নিয়ে। বসনিয়া যুদ্ধ নিয়ে ঐতিহাসিক উপন্যাস 'বসনা' (প্রকাশ করেছে বিদ্যাপ্রকাশ), মহান কিউবান বিপ্লবী কমরেড ফিদেল ক্যাস্ত্রোকে নিয়ে 'ফিদেল দ্য গ্রেট কমরেড' (প্রকাশ করেছে শ্রাবণ প্রকাশনী, আমার ষষ্ঠ গল্প সংকলন 'গল্পেশ্বরী' (প্রকাশ করছে সব্যসাচী) ও আমার বেস্ট সেলার বই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের জীবনী 'মুজিব দ্য গ্রেট' (প্রকাশ করেছে ত্রয়ী প্রকাশনী) নিয়েই মূলত আজ কথা বলেছি!
যদিও 'মুজিব দ্য গ্রেট' ২০১৫ সালের বই, ২০১৬ সালে এটি পরিবর্তিত সংস্করণ প্রকাশ পায়। কিন্তু বইটি এখন পর্যন্ত বেস্ট সেলার তালিকায় আছে। তাই বইটি নিয়ে এক মিনিট কথা বলেছি। পরে রাব্বী'র খপ্পর থেকে ছুটে আমিন ভাই'র জন্য বিদ্যাপ্রকাশ থেকে আমার উপন্যাস 'বসনা' কিনতে গিয়ে পেলাম মোহিত ভাইকে। মোহিত ভাই (মনোবিজ্ঞানী লেখক মোহিত কামাল) বিদ্যাপ্রকাশের স্টলের সামনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নাকি আমার 'বসনা'র ব্যাপক মার্কেটিং করেছেন। মোহিত ভাই হয়তো নিজের জরিমানা অনাদায়ের দায় মেটাচ্ছিলেন। কিন্তু মোহিত ভাই'র জরিমানা মাফ হবে কিনা এটা তো আমাদের প্রেসিডিয়াম বৈঠকে ঠিক হবে! বিদ্যাপ্রকাশে অল্প সময়ের জন্য পেয়েছিলাম কিশোর-সাহিত্যিক ও অনুকাব্যিক দন্ত্যস্য রওশন ভাইকে। বিদ্যাপ্রকাশের প্রকাশক মজিবর রহমান খোকা ভাইকে খুব মিস করলাম!
বিদ্যাপ্রকাশ থেকে ছুটে গেলাম শ্রাবণ প্রকাশনীতে। বন্ধু প্রকাশক রবীন আহসান আমাকে মাইর দেওয়ার জন্য সেখানে আগে থেকে ওৎ পেতে ছিল। ভাগ্যিস বিপ্লবী লেখক ইফতেখার আহমেদ বাবুদা, বিপ্লবী আকরামুল হক ভাই, কবি নীল সাধুদা আর সাদিয়া নাসরিন সেখানে ছিলেন। ফলে রবীন কেবল বকাঝকা কইরা চুপ মাইরা গেছে! তারপর 'ফিদেল' ভক্তদের কয়েকটা অটোগ্রাফ দিয়ে সাধুদা'র সঙ্গে আবার পগার পার হয়ে লিটল ম্যাগ কর্নারে আসলাম।
আজ ছিল কথাসাহিত্যিক ও মুক্তিযোদ্ধা মহান ঋষি এস্তেবানের একশো আটতম জন্মদিন। কিন্তু শাফি বলল ঋষিদার নাকি একুশতম জন্মদিন। ঋষিদার সঙ্গে বুক মিলিয়ে আমি ফরহাদ নাইয়াকে নিয়ে একাডেমিতে সরকার আমিন ভাইকে বই দিতে গেলাম। আমিন ভাই নিজ হাতে আমাদের কফি বানিয়ে খাওয়ালেন। আহ, সারাদিনের ক্লান্তি দূর করার জন্য আমিন ভাই'র বানানো কফিতে প্রাণটা জুড়িয়ে গেল। তারপর আবারো স্বকৃত নোমানের পাল্লায় পড়ে নিচে আসলাম। তারপর লিটল ম্যাগ চত্বরে কিছুক্ষণ আড্ডা মারলাম।
আজকের আড্ডায় মধ্যমণি ছিলেন মহান ঋষি এস্তেবান, দ্রষ্টব্য ও করাতকল সম্পাদক কামরুল হুদা পথিক, মেঘফুল সম্পাদক ও কবি নীল সাধু, কবি শাফি সমুদ্র, কবি অহো নওরোজ প্রমুখ। বইমেলায় আমাদের আড্ডা যখন জমে উঠল ততক্ষণে ছুটির ঘণ্টা বেজে গেল। মেলা থেকে বের হবার পথে দেখা হল তরুণ কথাসাহিত্যিক খালিদ মারুফের সাথে। এ বছর তরুণ কথাসাহিত্যিক মারুফ রসুলের ৬ষ্ঠ উপন্যাস 'কাঁচা দুধের গন্ধ' ও তরুণ কথাসাহিত্যিক খালিদ মারুফের প্রথম উপন্যাস 'বুনোকুলির রক্তবীজ' বই দুটি'র দিকে আমার বিশেষ নজরদারি রয়েছে। দুই মারুফের অটোগ্রাফসহ বই কিনতে চাই। এছাড়া কথাসাহিত্যিক স্বকৃত নোমানের 'শেষ জাহাজের আদমেরা' আমার বিশেষ নজরদারিতে রয়েছে।
বইমেলা থেকে বের হবার পথে দেখা হলো কবি-সাংবাদিক রওশন ঝুনু আপার সাথে। এরপর তরুণ কবি ও সম্পাদক লাকি অ্যান্ড গং ও কথাসাহিত্যিক সেলিম মোরশেদ ভাই'র সাথে কুশল বিনিময়। তারপর ক্যাম্পাসে হাকিম চত্বরে ঋষিদা অ্যান্ড গংয়ের সাথে কিছুক্ষণ আড্ডা। বাসে যখন বাসায় রওনা দিয়েছে পথে হঠাৎ চাষার পুত কবি ও নির্মাতা মাসুদ পথিকের ফোন। ফোন ধরিয়ে দিলেন গুণদাকে। কবি নির্মলেন্দু গুণ মাসুদের হাতিরপুলের মোকামে বসে আড্ডা মারছেন। আমার যাবার ইচ্ছা থাকা স্বত্ত্বেও শরীরে জ্বরের উতাল-পাতাল ঢেউ আমাকে বাসায় নিয়ে গেল। গুণদা সকালে যাবেন নেত্রকোণা কাশবন স্কুল ও নির্মলেন্দু গুণ কালাচারাল সেন্টার ভিজিট করতে। আমারও যাবার কথা! দেখা যাক সকাল হোক, তারপর শরীর কী বলে!
অমর একুশে বইমেলায় এবার কবি-লেখকদের উপস্থিতির একটা আকাল নজরে পড়লো। একাডেমির লিটল ম্যাগ চত্বরে একটা মাত্র বসার বেঞ্চি আজ বসিয়েছে কর্তৃপক্ষ। লিটল ম্যাগ চত্বরে এখনো আড্ডা জমে ওঠেনি। একাডেমির নজরুল মঞ্চ থেকে নতুন বইয়ের মোড়ক উন্মোচন সরিয়ে নেওয়া হয়েছে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে। সেখানে সৌন্দর্যের ছিটেফোটাও নজরে পড়েনি। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে লেখকদের বসার কোনো জায়গাও নজরে পড়েনি। এবার বইমেলায় বাংলা একাডেমি'র কী আয়-রোজগার কমে গেল নাকি? দোয়েল চত্বর ও টিএসসি থেকে বইমেলায় যাবার প্রধান দুই প্রবেশ পথে দায়সারা গোছের রুগ্ন সাজসজ্বা আর নজরুল মঞ্চকে পরিত্যক্ত করায় বইমেলার প্রাণ যেন হারিয়ে গেছে।
অনেক কবি-সাহিত্যিকদের ফোন করেও বইমেলায় আনা যায়নি। তারা ঘোষণা দিয়ে বইমেলা এড়িয়ে চলছে। আমি প্রথম ১০ দিন বইমেলায় না থাকায় ব্যাপারটা এখনো বুঝে উঠতে পারছি না। আজকে পর্যন্ত বইমেলায় নতুন বই এসেছে ১৪১৬টি। আর আজকে বইমেলায় নতুন বই প্রকাশ পেয়েছে ৯৬টি।
বন্ধুরা, অমর একুশে বইমেলা আমাদের প্রাণের মেলা। বাংলা একাডেমি জুজুর ভয়ে এই মেলাকে একেবারে তলানিতে ঠেকিয়েছে। আমরা যদি বইমেলায় না আসি তাহলে সেই জুজুর ভয় আরো সংক্রামিত হয়ে একসময়ে এই মেলাটি বন্ধ হবার উপক্রম হবে। আমরা নিজেরা গোস্যা না করে বইমেলাকে উজ্জীবিত করার প্রয়াস নেব, এই হোক আজকের ব্রত। বই কিনুন। প্রিয়জনকে বই উপহার দিন। অমর একুশে বইমেলা অমর রহে। জয়তু প্রাণের বইমেলা!
.............................
১২ ফেব্রুয়ারি ২০১৭
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৭ রাত ১২:৪২