গতকাল ছিল অমর একুশে বইমেলার বাঁইশতম দিন। এখনও বইমেলায় যে পরিমাণ মানুষ যায়, প্রত্যেকে একটি করে বই কিনলে প্রকাশকদের স্টল খালি হয়ে যাবার কথা। কিন্তু দুঃখের বিষয়, অনেকেই কেবল আড্ডা দেবার জন্য বইমেলায় যায়। আজকে বইমেলার লিটলম্যাগ প্রাঙ্গন থেকে ফোন করে আমাকে ঘুম থেকে তুলেছে 'সূর্যাই ডোম ও রাম্বা আখ্যান' খ্যাত তরুণ কথাসাহিত্যিক রুদ্র সাইফুল। পরে বইমেলায় যাবার আগেই পথে পথে কয়েক দফা আড্ডা হলো।
পাবলিক লাইব্রেরির সামনে দীর্ঘদিন পর দেখা হলো শিল্পী মামুন হোসাইনের সাথে। এ বছর 'দিগন্ত ধারা সাহিত্য পুরস্কার ২০১৭'তে সেরা প্রচ্ছদ শিল্পী হিসেবে পুরস্কার পেয়েছে মামুন। কিন্তু মামুন এতোটা নিভৃতচারী যে, আমার সঙ্গে অনেকক্ষণ আড্ডা দিলেও পুরস্কারের কথাটি একবারও বলেনি। মামুনকে অভিনন্দন।
মামুনের সঙ্গে আড্ডারত অবস্থায় পেছন থেকে ডাক দিলেন জাকির ভাই। কথাসাহিত্যিক জাকির তালুকদার গতকাল ভারত থেকে দেশে ফিরেছেন। কিন্তু আজই আমার সঙ্গে প্রথম দেখা। পুরুলিয়া বইমেলা উদ্ভোধন করার অভিজ্ঞতা ও এবারের ভারত সফরের অনেক টাটকা স্মৃতি নিয়ে জাকির ভাই কথা বললেন। এই সময় বন্ধু কবি ও চলচ্চিত্র নির্মাতা টোকন ঠাকুরের ফোন। ঠাকুর বললেন, শক্তি কমিশনের সামনে বসে আছি। মেলায় ঢুকতে পারব না। আজিমপুরে একটা কাজে যাব। আপনার সঙ্গে দেখা হওয়া লাগবে।
জাকির ভাই পাবলিক লাইব্রেরিতে একটা সেমিনারে ঢুকলেন আর আমি মামুনের থেকে বিদায় নিয়ে টিএসসি'র দিকে হাঁটা ধরলাম। ঠিক পরমানু কমিশনের সামনে আমার পথ রোধ করলেন গিয়াস ভাই। ঝিনেদা'র গিয়াস ভাইকে আমি প্রথমে চিনতে পারিনি। পরে গিয়াস ভাই নাম বলতেই জড়িয়ে ধরলাম। বললাম, দেখেন ওই যে কে বসে আছে? পরমানু কমিশনের সামনে লাল টি-শাট পড়া টোকন ঠাকুর। সেদিকে আমি, গিয়াস ভাই ও আমার তিন সঙ্গী অভিনেতা ও নাট্যকর্মী ইকতারুল ইসলাম, সুরকার নিহার আহমেদ ও সুরকার মুরাদ নূর এগিয়ে গেলাম।
ঠাকুর আমাদের উদ্দেশ্যে হাতে থাকা ডিএসএলআর দিয়ে কিছুক্ষণ ব্রাশ-ফায়ার করলেন। তারপর সেই মেশিনগান হাতে নিয়ে ঠাকুর আর গিয়াস ভাই'র ছবি তুললাম আমি। দেখি, ওপাশে শিল্পী শতাব্দী ভব বসে আছে। ভবরে জিগাইলাম, কীরে তুই এখানে বসে আছিস কেন? ভব বলল, টোকনদার জন্য! পরে ঠাকুর নতুন ছবি 'কাঁটা'র জন্য দুই আর্টিস্ট শতাব্দী ভব আর ইকতারের ছবি তুললেন। কিছুক্ষণ আড্ডা দিয়ে গিয়াস ভাই চলে গেলেন।
এই পর্যায়ে দেখি একটা সুন্দরী মেয়ে হঠাৎ ভবকে পা ছুয়ে সালাম করছে। ঘটনা কী? বললাম, ভব'র চেয়ে এখানে অনেক মুরব্বী আছে। তুমি কেমন মেয়ে হে! পরে ও আমাকে আর ঠাকুরকেও পায়ে-হাত দিয়ে সালাম করল। পরে দেখি, এই সেই সায়মা। সায়মা আমাদের একটা গোপন ইনফরমেশান দিল। কুহক সেই নষ্টের গোড়া! তাই আমরা বইমেলার দিকে ছুটলাম আর ঠাকুর চলে গেলেন আজিমপুর, মনজুরে মওলার ইন্টারভিউ নিতে।
বইমেলায় ঢোকার মুখে আমাদের সঙ্গে যোগ দিল বন্ধু শিল্পী মোবাশ্বির আলম মজুমদার। লিটলম্যাগ চত্বরে গিয়ে পেলাম কুহক অ্যান্ড গংকে। যথারীতি কুহক ওর সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে ততক্ষণে লীলা শেষ করেছে। পরে কুহক আমাদের মনের কষ্ট ভোলাতে কিছু ছবি তুললো। কিন্তু দুধের স্বাদ কী আর ঘোলে মেটে! পরে আমি, মোবাশ্বির আর শিমুল চললাম সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে।
বিদ্যাপ্রকাশের স্টলে গিয়ে কথাসাহিত্যিক জুলফিয়া ইসলামের বাসায় বানানো পিঁয়াজো খেয়ে আমরা দুঃখ ভোলার চেষ্টা করলাম। কিন্তু যখনই কুহকের কথা মনে পড়ে, তখনই ওরে মারতে ইচ্ছা করে! বিদ্যাপ্রকাশ থেকে বের হয়ে আমরা এলোমেলা ঘুরছিলাম। হঠাৎ শতাব্দী সানজানা এসে ছো মেরে শিমুলকে ভাগিয়ে নিয়ে গেল। আমার তখন প্রচণ্ড চায়ের তৃষ্ণা। তাই শ্রাবণ প্রকাশনীতে গিয়ে নিজে চা বানালাম। বিপ্লবী আকরাম ভাই আর মোবাশ্বিরকে নিয়ে চা খেলাম।
তখন শ্রাবণের সামনে দেখি বিশাল একটা বাহিনী নিয়ে শফিক ভাইয়ের আগমন। লেখক গোলাম শফিক বললেন, একটা কবিতার বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করতে গিয়ে আমার দশা খুব খারাপ! কে যেন তখণ আমাদের মিষ্টি খাওয়ালেন। বিপ্লবী বাবুদা বললেন, কবি'র সঙ্গে কথা না বলে মিষ্টি খাই কী করে?
এই সময় সেখানে উপস্থিত হলেন শাকুর ভাই। এ বছর আজ প্রথম বইমেলায় আসলেন লেখক, স্থপতি, শিক্ষক ও নির্মাতা শাকুর মজিদ। শাকুর ভাই শ্রাবণ থেকে আমার 'ফিদেল দ্য গ্রেট কমরেড' কিনলেন। রবীন কী যেন নালিশ দিচ্ছিল শাকুর ভাইকে। তখন শাকুর ভাই দুই কপি কিনলেন ফিদেল দ্য গ্রেট কমরেড'। তখন রবীনের মুখ বন্ধ। এই সময় কোনো একটি চ্যানেল রবীনের ইন্টারভিউ নেওয়ার জন্য ওকে জেকে ধরলো। আমরা সেই সুযোগে পালালাম।
এই সময় কবি ও নির্মাতা মাসুদ পথিকের ফোন। মাসুদ পথিক আগরতলা থেকে 'দক্ষিণারঞ্জন ধর স্মৃতি স্রোত সাহিত্য ও সংস্কৃতি সম্মাননা' নিয়ে তখন মাত্র ঢাকায় ফিরেছেন। বললেন, বেহুলাবাংলা থেকে আমার 'লাঙলের ভুবন' বইমেলায় এসেছে। আমি আসতে আসতে বইমেলা শেষ হয়ে যাবে। আমার জন্য 'লাঙলের ভুবন' নিয়ে আসেন। আমি ছুটলাম বেহুলাবাংলায়। শাকুর ভাই গেলেন অন্যপ্রকাশে। বেহুলাবাংলায় আমার সঙ্গে যোগ দিলেন নির্মাতা সন্দিপ বিশ্বাস। 'লাঙলের ভুবন' নিয়ে আমি আর সন্দিপ আবার লিটলম্যাগ প্রাঙ্গনে ফিরলাম।
সেখানে বহেড়াতলায় সব্যসাচীতে দেখা হলো শিল্পী ও তরুণ কবি ফারিসা মাহমুদ ও তার বন্ধু অরণ্য শারমিনের সঙ্গে। দেখা হলো শিল্পী ও নির্মাতা উজ্জ্বলদার সঙ্গে। পরে সন্দিপ আর আমি যাব একাডেমির উত্তরাধিকার দপ্তরে। তখন শিল্পী এষা জাবিনের ফোন। পরে এষাকে সহ গেলাম কবি সরকার আমিনের সঙ্গে দেখা করতে। গিয়ে পেলাম কবি সাদ কামালী ও ডক্টর অনু হোসেনকে। আমিন ভাই নিজ হাতে দার্জেলিংয়ের চা বানিয়ে খাওয়ালেন। ওখানে আড্ডা শেষে আমরা যখন লিফটে নামব, তখন আরেক পশলা আপ্পায়ন করলেন কথাসাহিত্যিক স্বকৃত নোমান।
পরে আমরা লিটলম্যাগে আসতে আসতেই বইমেলার ঘণ্টা বেজে গেল। সেখানে দেখা হলো তরুণ কবি পরাগ রিছিলের সঙ্গে। এ বছর তিউড়ি প্রকাশনী থেকে প্রকাশ পেয়েছে কবি পরাগ রিছিলের কাব্যগ্রন্থ ' ফুলগুলি ফুলকপির'। বইটির প্রচ্ছদ করেছেন শিল্পী রাজীব দত্ত। বইটি পাওয়া যাচ্ছে লিটলম্যাগ চত্বরের চিবিমা স্টলে। পরাগ রিছিলকে অভিনন্দন।
বইমেলা থেকে বের হব তখন দেখ হলো কবি ফরিদ কবিরের সঙ্গে। একটু আড্ডার ফাঁকেই পেছন থেকে ডক্টর মাসুদুজ্জামান দুই সুন্দরী রমনী বেষ্টিত আমাদের হামলা করলেন। তাদের একজন শিলা বৃষ্টি। আমাকে দেখেই বললেন, আপনি রেজা ঘটক। কী আর করা? পরে আমরা হেঁটে হেঁটে বইমেলা থেকে বের হলাম। মিলন চত্বরে এসে পেলাম ব্যাচেলর সমিতির প্রেসিডেন্ট শেখ শাহেদ আলীকে। শাহেদ ভাই এক ফোন পেয়ে কালো গ্লাসের এক গাড়িতে চড়ে গুলশান ছুটলেন। আমরা চারুকলার সামনে এসে কিছুক্ষণ আড্ডা দিলাম।
আমাদের সঙ্গে যোগ দিলেন মাসুদ পথিক, রুদ্র সাইফুল ও তূর্ণা। পরে যোগ দিল জেরিন ও ইমু। আরো পরে যোগ দিল নজরুল কবির। নজরুল আজ আমাদের চা খাওয়ালো। পথিক আমার জন্য আগরতলা থেকে সিগারেট নিয়ে এসেছে। ধন্যবাদ ভাইডু।
গুণদা জাদুঘরের সামনে আছে শুনে আমরা সেদিকে এগোলাম। গিয়ে পেলাম গিরিশ ও মাহবুবকে। কিন্তু গুণদার ততক্ষণে পাখা গজিয়েছে। মার্কিন প্রবাসী কবি হাসানআল আবদুল্লাহ'র গাড়িতে গুণদা বাসায় চলে যাচ্ছেন। ফোন দিলাম গুণদাকে। গুণদা বললেন, কাল দেখা হবে। কিছুক্ষণ পর আমাদের সঙ্গে যোগ দিলেন টোকন ঠাকুর। তারপর শাহবাগ হয়ে গেল আমাদের কাছে এক টুকরো রাতের ল্যাটিন আমেরিকা।
..............................
২৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৭
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৭ রাত ২:১৭