somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ঘুড়ি পরিবারের সঙ্গে মহানন্দের একদিন!

২৪ শে জুলাই, ২০১৭ সন্ধ্যা ৬:১৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

ঢাকার একঘেয়ে দমবন্ধ নাগরিক জীবন ছেড়ে একদিন ঘুড়ি পরিবারের সঙ্গে 'নদীর পাশে, জলের কাছে, নীলের সাথে' ঘুড়ে বেড়ানোর সুযোগটি এবার আর হাতছাড়া করতে চাইনি। ঘুড়ি পরিবারের প্রধান কবি নীল সাধু ও তুলা ভাবী আগেই আমাকে এই আনন্দভ্রমণের ব্যাপারে উৎসাহিত করেছিলেন। সে অনুযায়ী এবারের এই আনন্দভ্রমণে প্রকৃতির কাছে যাওয়ার দিনক্ষণ আগেই নির্ধারণ হয়েছিল ২১ জুলাই ২০১৭, শুক্রবার। এই ভ্রমণে আমাদের ৬৪ জনের একটি দল যাত্রা শুরু করেছিল কমলাপুর রেল স্টেশন থেকে সকাল সোয়া সাতটার এগারো সিন্ধু'র ট্রেনে। আগেই সাধুদা স্বয়ং রেলমন্ত্রী'র সঙ্গে সাক্ষাৎ করে আমাদের জন্য রেলের পুরো একটা বগি বুকিং করেছিলেন। আমাদের বগিটা ছিল 'ঠ'। একেবারে রেলগাড়ির সামনে ইঞ্জিনের সাথের বগি।

এই আনন্দভ্রমণ নিয়ে সাধুদা ফেসবুকে 'নদীর পাশে | জলের কাছে | নীলের সাথে। ঘুড়ি আনন্দ আয়োজন ২০১৭' নামে একটি পেইজ খুলেছিলেন। আমরা সবাই এই ভ্রমণের সকল আপডেট সেখানে রাখতাম। সাধুদা টাইম টু টাইম সেই পাতায় সকল আপডেট দিচ্ছিলেন। ট্রেনের টিকিট কনফর্ম করা, সকালের নাস্তা কী হবে, দুপুরের খাবার কী হবে, কোথায় কোথায় যাত্রা বিরতি, কখন কোথায় নৌকাভ্রমণ, কোথায় নদীতে সাঁতার কাটা, কখন কোথায় জুমা'র নামাজের বিরতি, কখন কোথায় ফটোসেশন ইত্যাদি ইত্যাদি।

আগেই সাধুদা সবাইকে জানিয়ে দিয়েছিলেন আমরা সবাই কমলাপুর থেকে ট্রেনে উঠব। যারা এয়ারপোর্ট থেকে উঠবে, তারা যেন ফেসবুকে এই ভ্রমণের পাতায় সারাক্ষণ আপডেট দেয়। এমন একটি আনন্দভ্রমণকে ক্যামেরায় ধরে রাখার জন্য আমি আমার 'হরিবোল' সিনেমার এসিসট্যান্ট ডিরেক্টর ও সহকারী ক্যামেরাম্যান প্রণব দাসকে আগেই জানিয়ে রেখেছিলাম। আমার চিফ এসিসট্যান্ট সেলিম হায়দারের নবাবপুরের অফিস থেকে ক্যামেরা নিয়ে প্রণবের রাতে আমার বাসায় থাকার কথা। রাত দশটায় প্রণব জানালো, দাদা আমি একটু পরে রওনা দেব। রাত এগারোটায় আমি ফোন করলাম, প্রণব বলল, দাদা আপনি চলে আসেন। আমি কিছুই বুঝতে পারলাম না। ঘটনা কী!

তারপর প্রণবের হাত থেকে ফোন নিয়ে কাজী ফয়সল বলল, রেজা ভাই চলে আসেন। আজ শিল্পী অনন্ত দৌলত ভাই'র জন্মদিন! কাজী ফয়সল আমার 'হরিবোল' সিনেমায় একটি প্রধান চরিত্রে অভিনয় করছে। ফয়সলের থেকে ফোন নিয়ে ইউসুফ ববি বলল, দাদা চলে আসেন। আমরা সবাই আছি। ইউসুফ ববি আমার 'হরিবোল' সিনেমায় ক্রিয়েটিভ এসিসট্যান্ট। আমি কিছুই বুঝতে পারছিলাম না, কী করব। রাত সাড়ে বারোটা পর্যন্ত কয়েক দফা ফোনে ওরা আমাকে নবাবপুর যাবার জন্য অনুরোধ করলো। এক পর্যায়ে ফোনের ওপাশে স্বয়ং শিল্পী অনন্ত দৌলত। দৌলত বলল, রেজা ভাই চলে আসেন, আর কী খাবেন বলেন, ওরা এখন খাবার আনতে যাচ্ছে।

তারপর কী আর করা! রাত পৌনে একটায় আমি বাসা থেকে বের হলাম। রাত সোয়া একটায় নবাবপুরে সেলিম-দৌলতের অফিসে পৌঁছে দেখি সেখানে এলাহি কারবার। রেড লেবেল। পুরান ঢাকার বিরিয়ানী। থাইল্যান্ড থেকে আনা সিগারেট। সে এক বিশাল যজ্ঞ! সেই যজ্ঞে অমন মধুর রাতে কে না হারাতে চায়! আমিও ওদের সাথে হারিয়ে গেলাম। দৌলতের অনেক কাহিনী শুনলাম। ফয়সলের অনেক বেদনা শুনলাম। ববি'র বিশ্বভ্রমণের প্ল্যানিং শুনলাম। প্রণবের ফিল্ম বানানোর গল্প শুনলাম। এসব গপ্পো শোনা-গান-আড্ডা-নাচ আর উথাল-পাতালে কখন যে রাত শেষ, একদম টের পাইনি। পাঁচটার মাত্র কয়েক মিনিট আগে আমরা লাইট অফ করে একটু ঝিম দিয়েছি, এই সময় সাধুদা'র ফোন।

কিন্তু পকেট থেকে ফোন কে বের করবে? সেই শক্তি কী আর আমার আছে তখন! পরপর সাধুদা আর তুলা ভাবী ফোন দিয়ে যাচ্ছেন। একপর্যায়ে ফোন রিসিভ করলাম। তুলা ভাবী শুভ সকাল না বলে দিলেন একটা ঝাড়ি। ফোন ধরেন না ক্যান! হায় মামুদ। আমার তখনকার দশা তুলা ভাবী যদি একবিন্দুও বুঝতেন! বা আন্দাজ করতে পারতেন! যাক তুলা ভাবীকে বললাম, এখনই আমি রওনা দিচ্ছি।

সকাল সাড়ে ছয়টায় আমি আর প্রণব কমলাপুর রেল স্টেশনে পৌঁছালাম। মাথা পুরো ঝিম মেরে আছে। শরীরে কোনো এনার্জি নাই। চারদিক দুলছে। পানি খেলেও গন্ধ পাই! একটা পানির বোতলে স্যালাইন গুলিয়ে ওটা খেতে শুরু করলাম। প্রণবকে বললাম, চল আমরা ট্রেনে গিয়ে বসি। সবাই আসার আগে একটু ঘুমাই। আমি আর প্রণব এই ভ্রমণের প্রথম যাত্রী হিসেবে কমলাপুর পৌঁছেছিলাম বলে আমরা এগারো সিন্ধু ট্রেনের নির্ধারিত 'ঠ' বগিতে গিয়ে একটু ঘুমানোর চেষ্টা করলাম। আবার সাধুদার ফোনে ঘুমে ব্যাঘাত। কইলাম, আমরা ট্রেনে আছি, আপনারা কোথায়, আসেন। তারপর একেএকে ঘুড়ি পরিবারের সদস্যরা এসে ট্রেনের বগি টইটম্বুর।

বাংলাদেশ রেলওয়ে'র এগারো সিন্ধু'র সোয়া সাতটার ট্রেন কয়টায় ছাড়বে, এটা নিয়ে কিছুটা বিভ্রম ছিল বটে, কিন্তু শেষপর্যন্ত সকাল পৌনে আটটায় এগারো সিন্ধু যাত্রা শুরু করলো। আমরাও হৈ হুল্লোরে মেতে উঠলাম। সাধুদা আর তুলা ভাবী ঘুড়ি পরিবারের অনেকের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন। প্রণবকে কিছু ইনস্ট্রাকশান দিয়ে আমি একটা ঘুম দেবার চেষ্টা করলাম। সারাদিনের জন্য এনার্জি রিচার্জ করার জন্য ওটা আমার খুব দরকার ছিল। এরমধ্যে ঘুড়ি পরিবারের কেউ একজন এসে আমাকে ঘুম থেকে তুলে সকালের নাস্তা দেবার চেষ্টা করলেন। আমি তাকে না করে দিলাম। কিন্তু আর ঘুমাতে পারলাম না। ততক্ষণে ট্রেন এয়ারপোর্ট স্টেশনে এসে গেছে।

ঘুড়ি পরিবার এগারো সিন্ধু ট্রেনের 'ঠ' বগি'র সামনে বিশাল এক ব্যানার টানিয়ে রেখেছিল, যাতে এয়ারপোর্ট থেকে দলের বাকিরা সবাই চট করেই আমাদের নির্ধারিত বগিতে উঠতে পারে। অনেকেই উঠতে পারলো। কিন্তু পাঁচটি মেয়ে আর ওদের দুর্বল দলপতি ছেলেটি ট্রেনে উঠতে পারলো না। হায় হায়! এবার কী হবে! সাধুদাকে বললাম, ওদের ফোন করে বলে দেন, যেন পরের কোনো ট্রেনে উঠে চলে আসে। সাধুদা খোঁজ নিলেন। আর তেমন একটা ব্যবস্থা ওরা করবে বলে ঠিক হলো!

এগারো সিন্ধুতে আমাদের বগিতে ততক্ষণে গানে লিড করেছে নুরুল ইসলাম পারভেজ। পারভেজ খুব ভালো বাঁশি বাজায়। খুব ভালো গান করে। কোনো ঢোল বা মন্দিরা না থাকায় গানের দলে আমার কোনো কারিশমা দেখানোর সুযোগ ছিল না। তাই আমি প্রণবের থেকে ক্যামেরা নিয়ে ওদের পুরো গানের অংশটা শ্যুট করেছিলাম। গান করেছে তাসলিমা, বৃষ্টি, সারা, জাহাঙ্গীর ভাই, তুষার ভাই, জাগিদ সুমন, তানহা, বনি, উপমা, প্রাপ্তি, তুলা ভাবী, ইকু, তানভীর, জাহিদুল সরোয়ার, আফতাব জামান ভাই, ইশতিয়াক, হাফিজ, অয়ন আবদুল্লাহ, চর্যাপদ, লুৎফর রহমান পাশা ভাইসহ অনেকে।

এমন হৈ হুল্লোরের মধ্যে কখন যে আমরা ভৈরব পৌঁছে গেছি, সত্যি একদম টের পাইনি। ওদিকে শ্রাবণধারা চলমান থাকায় পুরো স্টেশনে তখন তিল ধারণের ঠাই নাই। অগত্যা আমরা ভিজে ভিজেই প্লাটফরমের উল্টো দিকে আশ্রয় পাবার চেষ্টা করলাম। এবার এয়ারপোর্ট থেকে যারা ট্রেন মিস করেছে, ওদের জন্য বৃষ্টির মধ্যে অপেক্ষা করার পালা। ঘড়ির কাঁটায় তখন সকাল সোয়া দশটা। আমরা স্টেশনে ঘুরে ঘুরে তখন ছবি তুলি, চা খাই। সিগারেট খাই। গাল গপ্পো করি। আর কেউ কারো ছাতা নিয়ে কাড়াকাড়ি। এরমধ্যে সাধুদা জানালেন স্টেশানে এইমাত্র দাঁড়ানো ট্রেনে মিসিং টিমের ছয় জন এসে গেছে।

এবার আমাদের ব্যাটারি চালিত গাড়িতে করে ভৈরব ফেরিঘাটে যাবার পালা। বৃষ্টি না থাকলে হেঁটেই যাওয়া যেত। কিন্তু সাধুদা ঘোষণা করলেন, আমরা ব্যাটারি চালিত গাড়িতে যাব। একটা গাড়িতে সাত জন যাওয়া যায়। শামীম আপা'র নেতৃত্বে একটা গাড়িতে আমরা উঠলাম। পুরো দলের সব গাড়ি আমাদের পেছনে ফেলে চলে গেল। তার মধ্যে আমাদের ড্রাইভার এক ছোকরা। কখন যে গাড়ি পাল্টি খায় সেই চিন্তায় সবার মুখ শুকিয়ে খাক। পথে এক ট্রাক আটকে প্রায় বিশ মিনিট আমরা আটকে থাকলাম। তারপর ফেরিঘাটের কাছাকাছি যেতেই কেউ একজন বলল, আমরা ভুল পথে যাচ্ছি। তো এবার আবার গাড়ি ঘুরিয়ে ঠিক পথে যাবার পালা। আমাদের মত যারা এই ভুল করেছে, সবাই গাড়ি ঘুরিয়ে ভৈরব রেলওয়ে স্কুলের পাশ দিয়ে নদীর ঘাটের দিকে আগালাম।

ভৈরবের এই নদী ঘাটে অনেক পাথর আছে। খুব সুন্দর জায়গা। মনোরম দৃশ্য। মেঘনা নদীতে জোড়া সাঁকো। শামীম আপা এই দফায় অনেক ফটোগ্রাফি করালেন আমাকে দিয়ে। সবাই ফটো তোলায় ব্যস্ত তখন। প্রণবকে নিয়ে ওদের সেই হৈ চৈ ক্যামেরায় ধারণ করালাম। ততক্ষণে সাধুদা প্রায় পাঁচশো জনের ধারণক্ষমতা সম্পন্ন বিশাল এক ট্রলার নিয়ে পাথরঘাটে হাজির। সবাই দলবেধে সেই ট্রলারে উঠলাম। এই পর্যায়ে অয়ন জিজ্ঞেস করেছিল, ভাইয়া বৃষ্টিতে তো আমাদের নৌবিহারটা মাটি হতে যাচ্ছে। জবাবে বললাম, আমরা ট্রলারে ওঠার পর আর বৃষ্টি হবে না। আসলেই আর বৃষ্টি হয় নাই। আমরা ফেরার সময় যখন ট্রলারের ছাদে প্রখর রোদে সবাই হায়হুতোস করছে, তখন অয়ন আবার আমাকে জিজ্ঞেস করলো, ভাই আরেকটা ভবিষ্যৎ বাণী দেন! কইলাম, আর দেওয়া ঠিক হবে না।

শ্রাবণ মাসে মেঘনা নদীর অপরূপ সৌন্দর্য যারা কাছ থেকে না দেখেছে, তাদের সেই বর্ণনা শোনানো এক ব্যর্থ প্রয়াস। বাংলাদেশ নদীর দেশ। কিন্তু আমরা এমন এক জাতি, আমরা নদী দখল করে ব্যবসা করি। নদী দখল করে বসতি গড়ি। নদী দখল করে সম্পত্তি বানাই। ঢাকার চারপাশে চারটা নদী। বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষা, বালি ও তুরাগ। কিন্তু আমাদের সরকারগুলো এই নদীর কোনো যত্ন তো করেই নাই, উল্টো সেই নদীগুলো দখল, দূষণ আর ভরাট করে এমন অবস্থা করেছে যে, এখন বুড়িগঙ্গার তীরে গেলে নদী পচা গন্ধ শুকতে হয়। বুড়িগঙ্গা মেরে সেখানে ক্যান্টনমেন্ট গড়ে তোলা হয়েছে। একটা জাতির কতোটা অধপতন হলে তারা নদী দখল করতে পারে!

মেঘনা নদীতে এসে বুড়িগঙ্গার সেই কষ্ট কিছুটা দূর হলো। নদীতে নৌকায় ভেসে চলা মানে নদীতে চলাচলরত অসংখ্য স্টিমার, নৌকা, গাঙচিল, দু'পাশের জনপদ আমাকে এক নস্টালজিয়ায় নিয়ে যায়। সেই নস্টালজিয়ায় কিছুটা খোরাক জোগালেন সাধুদা ও ঘুড়ি পরিবার। এখানে নদীর পশ্চিমপাড়ে ভৈরব আর পূর্বপাড়ে আশুগঞ্জ। আমরা মেঘনা নদীতে ভাসতে ভাসতে আশুগঞ্জ ছেড়ে লালুপর বাজারে এসে ত্রিশ মিনিটের একটা যাত্রা বিরতি দিলাম। লালপুর বাজারে আমরা চা খেলাম। ছবি তুললাম।

আবার আমরা ইঞ্জিন চালিত ট্রলারে মেঘনার বুকে ভাসতে লাগলাম। ট্রলারের একেবারের চূড়ার জায়গাটি নিয়ে তখন তুলা ভাবী আর আমার মধ্যে প্রতিযোগিতা শুরু হলো। আমি ট্রলার থেকে নামলে তুলা ভাবী সিটটা দখল করেন। আবার তুলা ভাবী ট্রলারের অন্য কোথাও গেলে আমি সেই সিট পাল্টা দখল করি। আমাকে সঙ্গ দেয় বৃষ্টি, সারা, তাসলিমারা। এভাবে মেঘনায় ভাসতে ভাসতে আমরা একপর্যায়ে বাইশমৌজার ঐতিহ্যবাহী বাজারে ত্রিশ মিনিটের যাত্রা বিরতি করি। কথা ছিল পনের মিনিটে সবাই ট্রলারে ফিরে আসবে। কিন্তু আমাদের জাহাঙ্গীর ভাই হারিয়ে গেছে। তাকে না নিয়ে তো আমরা যাত্রা শুরু করতে পারি না। পরে সাধুদার কাছে শুনলাম, জাহাঙ্গীর ভাই'র পুরনো প্রেমিকার বাড়ি নাকি এই বাইশমৌজায় ছিল! তাই উনি একটু নস্টালজিক হয়ে গেছিলেন! সেই সুযোগে আমরা বাইশমৌজা বাজার থেকে মাইক সংগ্রহ করেছি।

এই বাইশমৌজা থেকে আমরা মেঘনা নদীকে রেখে তিতাস নদী ধরে আগাতে থাকলাম। তিতাস এখানে মেঘনার তুলনায় অনেক ছোট। আরো সামনে গিয়ে আমরা তিতাসের একটি ছোট্ট শাখা ধরে আগালাম। এই জায়গায় মনে হবে অনেকগুলো নদী। আসলে এগুলো সব মেঘনা ও তিতাসের শাখা বা উপনদী। ঠিক দুপুর একটায় আমরা উত্তর লক্ষীপুর পীর বাড়ির ঘাটে ল্যান্ড করলাম। উত্তর লক্ষীপুরের এই পীর বাড়ি হলো সাধুদা'র নানা বাড়ি। এখানেই সাধুদার জন্ম। প্রতি বছর এখানে বড় পীরের জন্ম ও মৃত্যু দিবসে তিন দিনের উরুশ হয়। পীর বাড়ির সামনে বেশ বড় একটা খেলার মাঠ। সেখানে আমরা ফুটবল খেলতে শুরু করলাম।

এদিকে মাইক অন করে সাধুদা বারবার ঘোষণা দেওয়া শুরু করলেন, দেড়টায় জুমা'র নামাজ। এর আগে আপনারা ফুটবল খেলা বন্ধ করে যারা সাঁতার কাটতে চান, তারা সাঁতার কাটবেন। যারা নামাজ পড়তে চান, তারা নামাজ পড়বেন। আর নামাজ শেষে ঠিক দুইটায় আমরা কিন্তু দুপুরের খাবার খাবো। কিন্তু কে শোনে কার কথা। জুমা'র নামাজের কারণে অবশ্য ফুটবল খেলা সোয়া একটায় বন্ধ হয়ে গেল। কিন্তু এরপর শুরু হলো নদীতে সাঁতার কাটা।

এর আগে ট্রলারে বসে বৃষ্টি বলেছিল যে, ও সাঁতার জানে না। কিন্তু আজ ও সাঁতার কাটতে চায়। ওদিকে সাধুদা মাইকে বারবার ঘোষণা দিচ্ছেন, যারা সাঁতার জানেন না, তারা কেউ নদীর ভেতরের দিকে যাবার চেষ্টা করবেন না। তীরের কাছে থাকবেন। প্রণবকে নিয়ে সাঁতারের কিছু ফুটেজ নেবার পর আমিও নেমে পড়লাম ডুবাডুবিতে। একপর্যায়ে পিচ্চিদের নিয়ে ট্রলার থেকে লাফিয়ে নদীতে পড়ার সেই শৈশবের আনন্দকে আমাকেও পেয়ে বসলো। ওদিকে সাধুদা সাঁতার শেষে আবার মাইকে বকবক করছেন, আপনারা আর পাঁচ মিনিটের মধ্যে সাঁতার শেষ করেন। কিন্তু কে শোনে কার কথা। আমরা তখন ঘোর শৈশবে মহানন্দে লাফাচ্ছি, সাঁতার কাটছি।

আমি বড় হয়েছি বলেশ্বর নদের তীরে। নদীতে আর পুকুরে সাঁতার কাটা ছিল আমার শৈশবের একটা বিশাল বিনোদন। সাধুদার নানাবাড়িতে এসে সেই বিনোদনের সূত্র পেয়ে কে শোনে কার কথা! একপর্যায়ে সাধুদা মাইকে ঘোষণা দিলেন, যারা দেরিতে আসবে, তারা খাবার পাবে কিনা আমরা জানি না। কারণ, আমাদের সবার খুব ক্ষুধা লেগেছে। আমরা আর দুই মিনিটের মধ্যে খেতে বসব। যারা সাঁতার কাটতে চান, নিজ দায়িত্বে খাবার পেলে খাবেন, না পেলে বইসা থাকবেন। এবার আমাদের হুশ ফিরলো। তাইতো, অনেক ক্ষুধা লেগেছে। এবার আর সাঁতার কাটা চলে না।

সাধুদার দুই মামী আমাদের খাবার ব্যবস্থাপনা তদারকি করলেন। চিংড়ি মাছের ভাজি, মুরগীর মাংশ, ডাল আর ঘরে বানানো দই। আহা কী যে সুস্বাদু সেই খাবার। অতিরিক্ত সাঁতার কেটে যে পরিমাণ ক্ষুধা লেগেছিল, তা পুষিয়ে দিলাম ডাল আর দই দিয়ে। দীর্ঘদিন এই দইয়ের স্বাদ আমার মুখে লেগে থাকবে। আহা ঘরে বানানো খাঁটি দই। খাবার সময় শৈশবের জোগেন দইওয়ালার সেই প্রিয় ডাক 'দই, ভালো দই' বলে বেশ কয়েকটা চিৎকারও ছুড়লাম।

খাওয়া শেষে সেই মাঠের গাছের ছায়ায় বসলো কবিতা পাঠ, গান ও গল্প বলার আসর। কবিতা পড়লেন সাধুদা, জাহাঙ্গীর ভাই, তুষার ভাই, জাহিদ ভাই, জামান ভাই, চর্যাপদ ভাই, পাশা ভাই, তাসলিমা। আমি ছোট্ট করে গল্প শোনালাম আর সেদিনের ঘুড়ি পরিবারের সঙ্গে আনন্দ অনুভূতি ব্যক্ত করলাম। তাসলিমা গান শোনালো। পারভেজ বাঁশি শোনালো, গান শোনালো। এক পর্যায়ে সাধুদা ঘোষণা করলেন, আমরা ঠিক চারটায় আবার ট্রলারে উঠব। তারপর সেই মাঠে আমাদের গ্রুপ ছবির ফটোসেশন করা হলো। এরপর মামীদের ও সাধুদার নানা বাড়ির অন্যদের থেকে বিদায় নিয়ে আমরা ট্রলারে উঠলাম। এবার আমরা তিতাস ও মেঘনা নদী ধরে আশুগঞ্জ গিয়ে নৌবিহার শেষ করব।

এবার ফেরার পথে রোদের বেশ তাপ। আমরা ট্রলারের ছাদে বসে ছবি তুললাম। গান গাইলাম। আর নদীর দু'পাশের অসংখ্য মনোরম দৃশ্য উপভোগ করতে করতে ঠিক সাড়ে পাঁচটায় আশুগঞ্জ পৌঁছালাম। এর মধ্যে এক ঘটনা ঘটেছে। গ্রুপ ছবি তোলার সময় কে যেন আমার হাতে ক্যামেরা ধরিয়ে দিয়েছিলেন, ক্যামেরার মালিককে পাওয়া যাচ্ছে না। তুলা ভাবীকে মডেল বানিয়ে অনেক ছবি তুললাম সেই ক্যামেরায়। একপর্যায়ে সাধুদাও মডেল হলেন। ট্রলারে বসে বসে নদী ও নদীর দু'পাশের ছবি তুলে আমি ততক্ষণে মেমোরিকার্ড ভরতি করে ফেলেছি। এখন বোকা ক্যামেরার মালিকের খবর নাই। সাধুদাকে বললাম, এই ক্যামেরার যে মালিক, তাকে একটু দরকার। সাধুদা বললেন, টেনশন নিয়েন না। ক্যামেরার যে মালিক, সে ঠিকই আপনার থেকে ক্যামেরা বুঝে নেবে। কেউ না নিলে আমার কাছে দিয়েন।

আশুগঞ্জে ট্রলারে নেমে পুরো টিমকে হটিয়ে দিয়ে সাধুদা, শিমুল আর আমি একটু পেছনে থেকে গেলাম। আমাদের কিছু জরুরি মিটিং করার জন্য। সবার পেছনে হেঁটে হেঁটে আমরা সেই মিটিং শেষ করে সামনে এসে দলের অনেককে আর পাওয়া যাচ্ছে না। অনেকে হাঁটার ভয়ে রিক্সা নিয়ে বাসস্ট্যান্ড চলে গেছে। কিন্তু সাধুদার প্লান ছিল পাহাড়ি টিলা টপকে সবাইকে হাঁটিয়ে বাসস্ট্যান্ড নেবার। কিন্তু দলের অর্ধেকের বেশি রিক্সায় করে আগেই ভেগে গেছে। শেষপর্যন্ত আমরা কয়েকজন পাহাড়ি টিলার মত উচু ঢিবি টপকে সেই রোমাঞ্চ শেয়ার করলাম। ওই পুরোটা পথ আমরা হেঁটেই বাসস্ট্যান্ড এসেছি।

সাধুদা আগেই বলেছিলেন যে, বাসে ওঠার আগে আমরা মালাই চা খাবো। আমরা পুরো এলাকায় একটা চক্কর দিয়ে এক পশলা চা খেলাম। বাসের কোনো খবর নাই। আর ওদিকে সাধুদাকেও পাওয়া যাচ্ছে না। কোথায় গেল মানুষটা। তুলা ভাবীও কিচ্ছু জানেন না। ঘটনা বুঝলাম যে, বাসস্ট্যান্ডের কাছেই সাধুদার এক পুরানো প্রেমিকার বাড়ি। থাক। ঘটনা আর সেদিকে না বাড়াই। নইলে সাধুদা তো ক্ষেপবেনই। আর তুলা ভাবী আখেরী গ্যাঞ্জাম পাকাবেন! একসময় সাধুদা হাজির হলেন। সঙ্গে মালাই চা। মালাই চা'র কারণে সাধুদার এই হারিয়ে যাওয়ার ঘটনা আমরা মন থেকে ভুলে গেলাম। কিন্তু তুলা ভাবীরে দেখলাম, বাকিটা পথ আর সাধুদাকে এক মিনিটের জন্যও আলাদা হতে দেননি। কী জানি ঘটনা আসলে কী ঘটেছিল! ওটা না হয় রহস্য হয়েই থাক!

মালাই চা খেয়ে আমরা যখন বাসে উঠব ঠিক তখন ক্যামেরার মালিকের দেখা মিললো। ক্যামেরার মালিক আমাদের লুৎফর রহমান পাশা ভাই। পাশা ভাই এসে বললেন, রেজা ভাই এবার ক্যামেরাটা দেন। আমি তো এখান থেকে বিদায় নিচ্ছি। বুঝলাম, পাশা ভাই'র নৌবিহার শেষে একটু শ্বশুরবাড়ি ঘুরে আসার বাসনা জেগেছে। আশুগঞ্জ বাসস্ট্যান্ডে আমরা দলের ৬৪ জন থেকে একমাত্র পাশা ভাইকে রেখে ৬৩ জন আবার ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। পাশা ভাই আমাদের বিদায় দিয়ে শ্বশুর বাড়িতে দিকে আগালেন।

ঢাকা থেকে দূরের শহরের বাসগুলো অনেক ভালো। সে তুলনায় ঢাকা থেকে কাছের শহরগুলোর বাসগুলো তত ভালো না। কিন্তু আশুগঞ্জে সাধুদা অনেক ভালো একটা বাস ম্যানেজ করেছেন। কিন্তু ড্রাইভারের চান্দি অনেক গরম। আমাদের বাংলা সিনেমার অচল গানগুলো ফুল ভলিউমে বাজিয়ে উল্টাপাল্টা বাস চালানো যেন তার মিশন। বাসের ড্রাইভারকে প্রায় আমাদের সবাই বারবার সতর্ক করা স্বত্ত্বেও আমাদের নৌপরিবহণ মন্ত্রী'র চ্যালা এই ড্রাইভার নিজের পছন্দমত সারাপথ জোরসে বাস চালালেন। তুলা ভাবী এক ধমক দিয়ে তার ফুল ভলিউমের গান বন্ধ করালেন। মাগার জোরসে বাস না চালানোর ব্যাপারটা আমরা কেউ তাকে বুঝিয়েও করানো গেলা না।

এরপর শুরু হলো ঘাটে ঘাটে আমাদের দলের কেউ কেউ নেমে যাবার পালা। নরসিংদিতে নামলো কয়েকজন। কাঁচপুর ব্রিজের ওপারে নামলো কয়েকজন। নারায়নগঞ্জের একটা দল নামলো কাঁচপুর ব্রিজের এপারে। কয়েকজন নামলো যাত্রাবাড়িতে ফ্লাইওভারে ওঠার আগে। রাত এগারোটায় আমরা কমলাপুর বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছালাম। অবশিষ্ট দলের থেকে বিদায় নিয়ে আমি আর প্রণবও এরপর ছুটলাম নিজেদের গন্তব্যে।

গোটা দিনের নানান কিসিমের আনন্দময় ঘটনাগুলো বারবার তখন ফ্ল্যাসব্যাক দিচ্ছিলো মাথার ভেতরে। এমন একটি আনন্দময় দিন উপহার দেওয়ার জন্য ঘুড়ি পরিবার এবং বিশেষভাবে সাধুদা ও তুলা ভাবীকে অসংখ্য ধন্যবাদ। এখন থেকে আমিও ঘুড়ি পরিবারের একজন। ঘুড়ি পরিবারের অন্যান্য সকল কর্মযজ্ঞে আমিও সানন্দে যোগ দিতে চাই। অবশ্য যদি সাধুদা আর তুলা ভাবী বিষয়টি অনুমোদন করেন। ঘুড়ি পরিবারের সবাইকে শুভেচ্ছা ও ধন্যবাদ। জয়তু ঘুড়ি পরিবার। জয়তু নৌবিহার!

-----------------------------------
২৪ জুলাই ২০১৭




সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে জুলাই, ২০১৭ রাত ১:৫০
৫টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

চুরি করাটা প্রফেসরদেরই ভালো মানায়

লিখেছেন হাসান মাহবুব, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৫৩


অত্র অঞ্চলে প্রতিটা সিভিতে আপনারা একটা কথা লেখা দেখবেন, যে আবেদনকারী ব্যক্তির বিশেষ গুণ হলো “সততা ও কঠোর পরিশ্রম”। এর মানে তারা বুঝাতে চায় যে তারা টাকা পয়সা চুরি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শিব নারায়ণ দাস নামটাতেই কি আমাদের অ্যালার্জি?

লিখেছেন ...নিপুণ কথন..., ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৫:৫৭


অভিমান কতোটা প্রকট হয় দেখেছিলাম শিবনারায়ণ দাসের কাছে গিয়ে।
.
গত বছরের জুন মাসের শুরুর দিকের কথা। এক সকালে হঠাৎ মনে হলো যদি জাতীয় পতাকার নকশাকার শিবনারায়ণ দাসের সঙ্গে দেখা করা সম্ভব... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঘুষের ধর্ম নাই

লিখেছেন প্রামানিক, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:৫৫


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

মুসলমানে শুকর খায় না
হিন্দু খায় না গাই
সবাই মিলেই সুদ, ঘুষ খায়
সেথায় বিভেদ নাই।

হিন্দু বলে জয় শ্র্রীরাম
মুসলিম আল্লাহ রসুল
হারাম খেয়েই ধর্ম করে
অন্যের ধরে ভুল।

পানি বললে জাত থাকে না
ঘুষ... ...বাকিটুকু পড়ুন

প্রতি মাসে সামু-ব্লগে ভিজিটর কত? মার্চ ২০২৪ Update

লিখেছেন জে.এস. সাব্বির, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:০৮

মার্চ ২০২৪ সালে আমাদের প্রিয় সামু ব্লগে ভিজিটর সংখ্যা কত ছিল? জানতে হলে চোখ রাখুন-

গত ৬ মাসের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ভিউ ছিল জানুয়ারি মাসে। ওই মাসে সর্বমোট ভিজিট ছিল ১৬... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইরান-ইজরায়েল দ্বৈরথঃ পানি কতোদূর গড়াবে??

লিখেছেন ভুয়া মফিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:২৬



সারা বিশ্বের খবরাখবর যারা রাখে, তাদের সবাই মোটামুটি জানে যে গত পহেলা এপ্রিল ইজরায়েল ইরানকে ''এপ্রিল ফুল'' দিবসের উপহার দেয়ার নিমিত্তে সিরিয়ায় অবস্থিত ইরানের কনস্যুলেট ভবনে বিমান হামলা চালায়।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×