বিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে শিল্পী আবদুল জব্বার গ্রিন রোডের যে বাসায় ভাড়া থাকতেন, একই বাসায় আমরা বন্ধুরাও থাকতাম। শিল্পী আবদুল জব্বার থাকতেন তৃতীয় তলায়। আর ছয় তলা বিল্ডিংয়ের ঘষ্ঠ তলা ছিল ব্যাচেলরদের জন্য। আমরা থাকতাম সেই ব্যাচেলর ফ্লোরে। বাড়িওয়ালা আবুল কালাম আজাদ আংকেল পরিবার নিয়ে থাকতেন নিচতলায়।
তৃতীয় তলায় শিল্পী আবদুল জব্বার যে পাশে থাকতেন, সেই দরজায় একটা সাইনবোর্ড ছিল। সেখানে লেখা ছিল 'জাতীয় কণ্ঠ শিল্পী আবদুল জব্বার'। এই সাইনবোর্ড নিয়ে প্রায় রাতেই আমরা মজার কিছু ঘটনা ঘটতে দেখতাম। সেই ঘটনার নায়ক ছিলেন দুই পার্টনার। বাড়িওয়ালা আবুল কালাম আজাদ আংকেল ও শিল্পী আবদুল জব্বার।
প্রায়ই ওনারা দু'জন রাতের বেলায় একসঙ্গে ড্রিংক করতেন। সাধারণত রাত বারোটা থেকে একটার মধ্যে ওনারা বাসায় ফিরতেন। ড্রিংক করা ও আড্ডা ঠিকঠাক চললেও কোনো এক রহস্যময় কারণে ঠিক বাসার বাইরের গেটে এসেই দু'জনে দুনিয়ার যত মাতলামি করতেন। আশেপাশের বাসার লোকজনদের মত আমরাও মধ্যরাতের সেই বিনোদন দেখতে ব্যালকনিতে ঠিকই বসে থাকতাম।
মাঝেমাঝে দু'জনের মুখ থেকে অশ্রাব্য ভাষা বের হতো। সেদিন হয়তো ওনারা বেশি টাল থাকতেন। আজাদ আংকেল খোটা দিতেন- 'তুই আমার চ্যাটের বাল আবদুল্লাহ। আমার বাসায় ভাড়া থাকোস, আবার সাইনবোর্ড ঝুলাইছোস- 'জাতীয় কণ্ঠ শিল্পী'। তুই আমার বালের শিল্পী'! জবাবে শিল্পী আবদুল জব্বারও মুখ খারাপ করতেন। পাল্টা জোরগলায় বলতেন, 'তুই আমার চ্যাটের বাড়িওয়ালা। তোর তো কোনো সাইনবোর্ডই নাই। তোরে ক্যাডা চিনে? আমি দয়া করে তোর বাসায় থাকি বলে অনেকে তোরে চেনে!'
তো এই বচ্চা কিছুক্ষণ চলার পর তৃতীয় তলা থেকে শিল্পী আবদুল জব্বারের স্ত্রী কবি হালিমা জব্বার নিচে নেমে শিল্পী আবদুল জব্বারকে ধরে টেনে তুলতেন তিন তলায়। আর আমাদের মাথার উপরে ছাদে থাকতেন আজাদ আংকেলের এসিসট্যান্ট করিম। করিম সাত তলা থেকে নেমে আজাদ আংকেলকে ধরে নিয়ে যেতেন তার ঘরে। কারণ আজাদ আংকেলের কাছে ওই সময়ে করিম ছাড়া আর কেউ যেতে পারতো না।
তখনো চিঠিযুগ শেষ হয়নি। সবার হাতে মোবাইল নেই। আজকের মত ফেসবুকও আসে নাই। তখন ওই বাসায় দু'জনের নামে খুব চিঠি আসতো। তার একজন হলেন কবি হালিমা জব্বার। আর দ্বিতীয় জন স্বয়ং এই অধম। অন্যদের সে তুলনায় চিঠি খুব কম আসতো। এমন কি শিল্পী আবদুল জব্বারের চেয়েও আমাদের নামে বেশি চিঠি আসতো। তো নিচতলার লেটারবক্স থেকে এই চিঠি নেওয়ার সময়ই একদিন পরিচিত হয়েছিলাম কবি হালিমা জব্বারের সাথে।
ওই বাসায় সবচেয়ে মজার ঘটনা ঘটতো দুপুরের দিকে। তখন শিল্পী আবদুল জব্বার গান করতেন। আমরা তিন ফ্লোর উপরে থাকলেও শিল্পীর কণ্ঠ ঠিকই আমাদের ব্যাকুল করে দিত। মান্না দে'র গানগুলো উনি খুব আয়েশ করে করতেন। এমন হয়েছে অনেকবার যে, ওনার গান গাওয়া শেষ হয় না। আমাদের স্নান করতে যাবার অপেক্ষাও শেষ হয় না। কারণ স্নান করতে গেলে আর ভালো করে শিল্পী আবদুল জব্বারের গান শোনা হবে না। তাই আমরা ওনার গান শেষ না হওয়া পর্যন্ত বসে থাকতাম।
সুরের সঙ্গে শিল্পী আবদুল জব্বারের যে আত্মার যোগাযোগ ছিল, সেটা হারমোনিয়ামে উনি যখন একা একা গান করতেন, তা না শুনলে ঠিক বোঝা যেতো না, কতোটা তন্ময় হয়ে আমরা তা মনযোগ দিয়ে শুনতাম। আমরা অনেকদিন দুপুরের খাবার বিকেলে খেয়েছি কেবল ওনার গান শোনা মিস করব না এটা ভেবে। উনি যখন সারগম রেওয়াজ করতেন, তখন আমরা অবশ্য ততোটা মনযোগী শ্রোতা হতাম না। কিন্তু যখনই গান ধরতেন, তখন আমাদের অন্য সকল কাজ অনেকটাই ফ্রিজ হয়ে যেত।
শিল্পী আবদুল জব্বারকে আমাদের মনে থাকবে। জয় বাংলা বাংলার জয়’, ‘সালাম সালাম হাজার সালাম’, ‘তুমি কি দেখেছ কভু’, ‘পিচ ঢালা এই পথটারে ভালোবেসেছি’, ‘সুচরিতা যেয়ো নাকো আর কিছুক্ষণ থাকো’, ‘ওরে নীল দরিয়া’, 'নীলা গগন হে, 'রোদে পুড়ে পীচ গলে', 'নাচের পুতুল', 'তুমি আছো সবই আছে'সহ অসংখ্য জনপ্রিয় গানের জন্য শিল্পী আবদুল জব্বারকে বাংলার মানুষ চিরকাল মনে রাখবে।
-----------------------
৩০ আগস্ট ২০১৭
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে আগস্ট, ২০১৭ বিকাল ৫:০৮