somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

এক নস্টালজিক রাতের নাটক 'আমি ও শ্যামা!!!

১০ ই অক্টোবর, ২০১৮ রাত ১২:৫৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

গঙ্গা-যমুনা সাংস্কৃতিক উৎসব ২০১৮-তে আজ দেখলাম জাগরণী থিয়েটার প্রযোজনা 'আমি ও শ্যামা'। নাটকটির রচয়িতা ও নির্দেশনা দিয়েছেন অনিকেত পাল বাবু। আজ ছিল নাটকটির তৃতীয় মঞ্চায়ন। বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির স্টুডিও থিয়েটার হলে 'আমি ও শ্যামা' দেখে আমিও দারুণভাবে মুগ্ধ। বিশেষ করে বাবু'দার 'আমি ও শ্যামা' গল্পটি অসাধারণ। মাত্র এক রাতের গল্প। কিন্তু দর্শক হিসেবে আমি পরিভ্রমণ করে আসি যেন ১৫শ শতকের জার্মানের বিখ্যাত শহর নুরেমবার্গ, যেখানে প্রখ্যাত চিত্রশিল্পী আলব্রেখট ডুরের ধীরে ধীরে কীভাবে একজন বিশ্ববিখ্যাত চিত্রশিল্পী হয়ে ওঠেন, সেই সময়কালে।
এক রাতের গল্পের ছলে এই ভ্রমণে যেমন জাদু আছে, তেমনি আছে নস্টালজিয়ায় আটকে থাকা আলব্রেখটের আঁকা সেই বিখ্যাত হাতজোড়া। হাতজোড়া আলব্রেখটের ভাই আলবার্টের। আলব্রেখট খুব ছোটবেলায় স্বপ্ন দেখতেন জার্মানির বিখ্যাত আর্ট ইনস্টিটিউটে পড়াশুনা করবেন। কিন্তু পড়ার খরচ আসবে কীভাবে? অন্তরের সেই স্বপ্নের কথা বড় ভাই আলবার্টকে বলেন তিনি। বড় ভাই আলবার্ট জবাবে বলেন, তারও চিত্রশিল্পী হবার খুব শখ। কিন্তু পড়াশুনার খরচ আসবে কীভাবে? তারপর আলবার্ট এক বুদ্ধি করেন। প্রথম যে পড়তে যাবে তার পড়ার খরচ চালাবে অন্য ভাই। চার বছর আর্ট কলেজে পড়ার পর সে চালাবে অন্য ভাইয়ের খরচ। পড়াশুনার খরচ চালানোর কাজটি হবে পালা করে।


তো কীভাবে নির্ধারণ হবে কে আগে পড়তে যাবে? শেষে দুই ভাই মিলে টস করেন। টসে ছোটভাই আলব্রেখট জয়লাভ করে জার্মানির বিখ্যাত নুরেমবার্গ আর্ট কলেজে পড়তে যান। আর বড় ভাই আলবার্ট ছোট ভাইয়ের পড়ার খরচ যোগাতে চলে যান পরিশ্রম করে টাকা রোজগার করতে। তিনি হয়ে যান একজন কয়লা খনি শ্রমিক। চার বছর আর্ট কলেজে পড়াশুনা করার পর আলব্রেখট যখন বড় ভাই আলবার্টকে এবার পড়ার জন্য আর্ট কলেজে যেতে বলেন, তখন জবাবে বড় ভাই আলবার্ট বলেন, তার হাত দুটো দিয়ে তো আর চিত্র আঁকার মত শক্তি নাই। হাত দুটো কয়লা খনিতে কাজ করতে করতে অবস অসার হয়ে গেছে। তারপর আলব্রেখট বড় ভাইয়ের এই নিঃস্বার্থ ত্যাগের বিনিময়ে কালি ও কলম দিয়ে আঁকেন সেই বিখ্যাত চিত্রশিল্প 'প্রেয়িং হ্যান্ডস'।
আলব্রেখটের জীবনীকে ফুটিয়ে তুলতে অনিকেত পাল বাবু এখানে বেশ মজার একটি গল্প ফাঁদেন। গল্পটি এরকম- অমরের বাবা আর অনীল বাবু ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের বন্ধু। অমর চিত্রকলায় পড়তে এসে অনীল বাবুকে তার পরিচয় দেন। অনীল বাবু'র স্ত্রী ও মেয়ে শ্যামা'র সঙ্গে অমরকে তিনি পরিচয় করিয়ে দেন। আর্ট কলেজে পড়তে পড়তে আর অনীল বাবু'র বাড়িতে যাতায়াত করতে করতে একসময় সমবয়সী অমর আর শ্যামা দু'জন দু'জনের প্রেমে পড়েন। তাদের মধ্যে ভালোবাসা গড়ে ওঠে। শ্যামা বিশ্বাস করতে চায় একদিন অমর জগতবিখ্যাত শিল্পী হবে।


এক পর্যায়ে শ্যামা'র মায়ের কাছে শ্যামাকে বিয়ে করার প্রস্তাব করে অমর। শ্যামা'র মা এতে খুব খুশি হন। কিন্তু বেঁকে বসে শ্যামা। অমরের বিয়ের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে শ্যামা। শ্যামা অমরকে ভালোবাসে সত্যি কিন্তু প্রেয়সী শ্যামার কাছে যাতে অমরের শিল্পস্বত্ত্বা কোনোভাবেই ক্ষতিগ্রস্থ না হয়, সেই ভয়ে শ্যামা বিয়েতে রাজি হয় না। শ্যামা'র সেই প্রত্যাখ্যানই অমরকে একদিন জগতবিখ্যাত চিত্রশিল্পী হতে বাধ্য করে। স্বয়ং শ্যামার যে ছবি অমর তীলে তীলে এঁকেছিল, এক ঝড়ের রাতে খুব মন খারাপ হলে অমর সেই ছবি টুকরো টুকরো করে ছিড়ে ফেলে।
চিত্রশিল্পী অমরের জীবনের সাথে সমান্তরাল আলব্রেখটের শিল্পী জীবনের যে ফিকশান অনিকেত পাল রচনা করেছেন, এক কথায় তা অসাধারণ। সেই নস্টালজিক ঝড়ের রাতে অমরকেই যেন আলব্রেখট মনে হয়। মাত্র এক ঘণ্টার নাটক 'আমি ও শ্যামা'। কিন্তু ফিকশানটি একদম হৃদয়ে ছুঁয়ে যায়। হয়তো এরকম এক নস্টালজিক ঝড়ের রাতেই রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, 'আজি ঝড়ের রাতে তোমার অভিসার, পরাণসখা বন্ধু হে আমার...' গানটি। নিজের স্বার্থ ত্যাগ ও অন্যকে উপকার করার যে মেসেসটি এই নাটক থেকে দর্শক পায়, তা দীর্ঘদিন আমাদের মনে থাকবে।


'আমি ও শ্যামা' নাটকের সেট ডিজাইন করেছেন নাটকটির রচয়িতা ও নির্দেশক অনিকেত পাল বাবু। বেশ গুছানো চমৎকার সাটামাটা সেট। অমরের বসতবাড়ি, অমরের ছবি আঁকার ইজেল, পড়ার টেবিল, বৈঠকখানা, অনীল বাবু'র বাড়ি, আলব্রেখটের আর্ট কলেজ, কয়লা খনি সব যেন নিমিষেই এই সেটে শোভাবর্ধন করে। অত্যন্ত চমৎকার ভাবনা আছে সেট নির্মাণে। চরিত্রের সাথে সেট একদম জুতসই মানিয়েছে। কেবল ঝড়ের পরে রাতের চাঁদকে আরো একটু ফুটিয়ে তোলা গেলে দর্শকের ঘোরলাগা আরো কয়েকগুণ বেড়ে যেত।
চিত্রশিল্পী অমরের এক নস্টালজিক রাতের গল্প 'আমি ও শ্যামা'। পুরো গল্পটি অনিকেল পাল বাবু ফ্ল্যাশব্যাকে দর্শককে দেখান। আসলে সেই ঝড়ের রাতে অমর আর তিনটি মাত্র ইংরেজি শেখা কাজের ছেলে রমেশ পুরো গল্পটি টেনে নিয়ে যায়। দীর্ঘদিন পর শিল্পকলায় নাটক দেখতে গিয়ে সত্যি সত্যি এক নস্টালজিক রাত সফর করে ফিরলাম।
নাটকটির আলোক পরিকল্পনায় ঠাণ্ডু রায়হান আবারো দর্শককে জাদু দেখান। অত্যন্ত সুন্দর আলোক নিক্ষেপ। সঙ্গীত পরিকল্পনায় সোয়েব হাসনাত মিতুলও সেই জাদুর রেশ টেনে নিয়ে যান। আলো ও ব্যাকগ্রাউন্ড সঙ্গীতের দারুণ সংমিশ্রণে গোটা নাটকটি দর্শককে টানা একঘণ্টা যেন বুদ করে রাখে।
নাটকটির মঞ্চসজ্জা ও কোরিওগ্রাফি করেছেন অনিকেত পাল বাবু। আলোক পরিকল্পনা করেছেন ঠাণ্ডু রায়হান। সঙ্গীত পরিকল্পনায় ছিলেন সোয়েব হাসনাত মিতুল। কস্টিউম করেছেন রিপা হালদার। প্রোপস করেছেন রফিকুল ইসলাম রনি। শব্দ নিয়ন্ত্রণ করেছেন মো. আকাশ মিয়া। পোস্টার ও প্রকাশনায় ছিলেন আমিনুর রহমান মুকুল।
অমর চরিত্রে অভিনয় করেছেন স্মরণ সাহা। তিনি নাটকটির প্রযোজনা অধিকর্তা ও সহযোগী নির্দেশক। শ্যামা চরিত্রে অভিনয় করেছেন মুনিরা রহমান অবনী। রমেশ চরিত্রে সঞ্জীব ঘোষ, ছোট অমর, উত্তীয় ও বজ্রসেনের ভূমিকায় রফিকুল ইসলাম রনি, অনীলের ভূমিকায় সঞ্জীব ঘোষ, অনীলের স্ত্রী ও শ্যামার মায়ের ভূমিকায় জুলিয়েত সুপ্রিয়া সরকার, আলবার্টের ভূমিকায় আরিফ খান ও আলব্রেখটের ভূমিকায় আরিফ খান অভিনয় করেন।
সবার অভিনয় অত্যন্ত সাবলিল ছিল। কেবল কারো কারো সংলাপ উচ্চারণে কিছুটা ছন্দহীনতা ছিল। উচ্চারণের প্রতি বাবুদা আরেকটু নজর দিলে এটি কাটিয়ে ওঠা সম্ভব। নাটকের শুরুতে কাজের ছেলে রমেশের আরো একটু গতিবৃদ্ধি এবং চরিত্রের সাথে মানানসই অভিনয় দাবি রাখে। সবমিলিয়ে দারুণ একটা গল্প, সেইরকম নস্টালজিক এক রাতের নাটক 'আমি ও শ্যামা'। নাটকটি শিল্পকলার স্টুডিও থিয়েটার হলের পরিবর্তে এক্সপারিমেন্টাল হলে প্রদর্শিত হলে দর্শক আরো বেশি নস্টালজিক ও কাবু হতে বাধ্য। স্টুডিও থিয়েটার হলের জন্য এই নাটকটি সিলেকশানে কিছুটা দুর্বলতা ধরা পড়েছে। যা এক্সপারিমেন্টাল হলে আরো চমৎকার মানিয়ে যেত।
ধন্যবাদ অনিকেত পাল বাবু ও স্মরণ সাহাকে এরকম সুন্দর একটি প্রযোজনা উপহার দেওয়ার জন্য। জয়তু বাংলা থিয়েটার। জয়তু জাগরণী থিয়েটার। জয়তু 'আমি ও শ্যামা'।
----------------------
'আমি ও শ্যামা' প্রথমবার দেখার পর প্রতিক্রিয়া
১০ অক্টোবর ২০১৮
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই অক্টোবর, ২০১৮ রাত ১২:৫৭
৭টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে মুক্তিযোদ্ধাদের মুমিনী চেহারা ও পোশাক দেখে শান্তি পেলাম

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৭ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৯:৫৮



স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে স্টেজে উঠেছেন বত্রিশ মুক্তিযোদ্ধা তাঁদের চব্বিশ জনের দাঁড়ি, টুপি ও পাজামা-পাঞ্জাবী ছিলো। এমন দৃশ্য দেখে আত্মায় খুব শান্তি পেলাম। মনে হলো আমাদের মুক্তিযোদ্ধা আমাদের মুমিনদের... ...বাকিটুকু পড়ুন

দু'টো মানচিত্র এঁকে, দু'টো দেশের মাঝে বিঁধে আছে অনুভূতিগুলোর ব্যবচ্ছেদ

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১২:৩৪


মিস ইউনিভার্স একটি আন্তর্জাতিক সুন্দরী প্রতিযোগিতার নাম। এই প্রতিযোগিতায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সুন্দরীরা অংশগ্রহণ করলেও কখনোই সৌদি কোন নারী অংশ গ্রহন করেন নি। তবে এবার রেকর্ড ভঙ্গ করলেন সৌদি... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমাদের দুই টাকার জ্ঞানী বনাম তিনশো মিলিয়নের জ্ঞানী!

লিখেছেন সাহাদাত উদরাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ২:৫৯

বিশ্বের নামীদামী অমুসলিমদের মুসলিম হয়ে যাওয়াটা আমার কাছে তেমন কোন বিষয় মনে হত না বা বলা চলে এদের নিয়ে আমার কোন আগ্রহ ছিল না। কিন্তু আজ অষ্ট্রেলিয়ার বিখ্যাত ডিজাইনার মিঃ... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমি হাসান মাহবুবের তাতিন নই।

লিখেছেন ৎৎৎঘূৎৎ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



ছোটবেলা পদার্থবিজ্ঞান বইয়ের ভেতরে করে রাত জেগে তিন গোয়েন্দা পড়তাম। মামনি ভাবতেন ছেলেটা আড়াইটা পর্যন্ত পড়ছে ইদানীং। এতো দিনে পড়ায় মনযোগ এসেছে তাহলে। যেদিন আমি তার থেকে টাকা নিয়ে একটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×