“আল্লাহ এক। তাঁর কোন শরীক নেই। তিনিই সমস্ত জাহানের সৃষ্টিকর্তা। তিনি ব্যতীত কোন ইলাহ নেই। হযরত মুহাম্মদ (দঃ) তাঁর রাসূল।” এই বানী প্রচার করার জন্য আল্লাহ তায়ালা পৃথিবীতে অসংখ্য নবী-রাসূল প্রেরণ করেছেন। তাঁরা মানব সমাজে এই বাণী প্রচারে নিজের জীবনকে উৎসর্গ করেছেন। যারা তাঁদের মূল্যবান এই মহাবাণী মনে-প্রাণে গ্রহণ করেছেন এবং কাজকর্মে তা বাস্তবায়ন করেছেন তাদের ইহকাল-পরকাল ধন্য হয়েছে। যারা এই বাণীর উপর দৃঢ়-বিশ্বাস রাখে তাদের ‘মুসলিম’ বলা হয়। মুসলমানদের ধর্ম ইসলাম। ইসলাম ধর্ম প্রতিষ্ঠিত হয় নবী কুলের স¤্রাট, মানবতার মুক্তির অগ্রদূত হযরত মুহাম্মদ (দঃ) এর মাধ্যমে। এবং এটাই আল্লাহর মনোনীত ধর্ম বলে আল্লাহ নিজেই কুরআন পাকে ঘোষণা দিয়েছেন। ইরশাদ হচ্ছে-“নিশ্চই আল্লাহর নিকট মনোনীত ধর্ম হলো ইসলাম” (সূরা আল- ইমরান আয়াত ১৯)। নবী করিম (দঃ) যেহেতু শেষ নবী, তাঁর পরে নবুয়তের দরজা বন্ধ সেহেতু তাঁর প্রতিষ্ঠিত ধর্ম ইসলামকে বাস্তবায়ন রাখার দায়িত্ব সাহাবায়ে কেরামের পর আলেমগণের উপর অর্পিত হয়। কেননা রাসূল (দঃ) ইরশাদ করেন- ‘আল ওলামায়ূ ওরাছাতুল আম্বিয়া’ তথা আলেমগণ নবীগণের উত্তরাধিকারী। অর্থাৎ নবীগণের যে দায়িত্ব ছিলো সে দায়িত্বটা তাঁদের পরিবর্তে আলেমরাই সমাজে বাস্তবায়ন করবে। আলেমদের উপর অর্পিত দায়িত্ব কোন মানুষ কর্তৃক অর্পিত নয় বরং আল্লাহ ও তাঁররাসূলে করীম (দঃ) কর্তৃক নির্ধারিত।তাঁদের সেই দায়িত্বটা হল পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্রের মধ্যে এমনকি সারা বিশ্বে ইসলামের যে শিক্ষা, ত্যাগ, ঔদার্য,স্বাধীনতা তা সম্পূর্ণরূপে বাস্তবায়ন করা। এছাড়া শরীয়তে যা করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে তা সাধারণ মানুষকে পালনে আদেশ এবং যা পালনে নিষেধ করা হয়েছে তা বর্জনে নির্দেশ দেওয়াইতো আলেমদের কাজ।
কিন্তু বর্তমান সমাজে কিছু সংখ্যক আলেম আছে যারা নিজ স্বার্থে, টাকার লোভে যেমনি হারিয়েছে নবী করিম(দঃ) এর দেওয়া সম্মান-মর্যদা তেমনি আজ সারা বিশ্বে আর্জন করেছে লাঞ্চিত হওয়ার গৌরব। অথচ সব আলেমরাই যে স্বার্থপর-লোভী তা নয়,কিছু আলেমের কারণে আজ সারা বিশ্বে আলেম সমাজ কলুষিত ও অপমানিত।তারা ইসলামী শিক্ষায় শিক্ষিত হয়েছে বটে কিন্তু ইসলামী আদর্শে আদর্শিত না হওয়ার কারণে এই করুণ পরিণতি। আজ এই আলেমরা ইসলামী আদর্শে আদর্শিত হয়ে নিজ স্বার্থ ত্যাগ করে যদি একই কাতারে দাঁড়াতেন তাহলে বিশ্বের মুসলমান কখনো লাঞ্চিত হতোনা।যদি সকল আলেমরাই একত্রিত হয়ে মুসলমানদের পুনর্জাগরণের চেষ্টা করে তাহলে বিশ্বের মুসলমান লাঞ্চিত জীবন থেকে বেরিয়ে এসে অতীত গৌরবের মুকুট পুনঃরায় পরিধান করতে পারবে।
কিন্তু আমাদের আলেমদের মধ্যে যে ভেদাভেদ সৃষ্টি হয়েছে তাতে পুনর্জাগরণ তো দূরের কথা সারা বিশ্বে মুসলমানরা তাদের আদর্শ হারাচ্ছে ক্রমশই। কিছু আলেম আছে যারা আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের উপর অটল থেকে কুরআন-হাদীসের সঠিক ব্যাখ্যা দিয়ে ইসলামের মূল আদর্শকে বিকশিত করে সাধারণ মানুষকে সঠিক পথের সন্ধান দিয়ে সমাজ- রাষ্ট্রকে শান্তি ও সুন্দর করে গড়ে তোলার এবং ইহকালীন ও পরকালীন মুক্তির জন্য চেষ্টা করেছেন।আমরা তাদের সবসময় শ্রদ্ধা ও সম্মান করি। আর কিছু আলেম আছে যারা আত্মকেন্দ্রিক হয়ে ইসলাম তথা কুরআন-হাদীসের অপব্যাখ্যা করে সাধারণ মানুষকে ভ্রান্ত পথ দেখিয়ে ইসলামকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে।কেউ ইসলাম কায়েম করছে আল্লাহ এবং আল্লাহর রাসূলের নির্দেশিত পথ অনুসারে আবার কেউ কায়েম করছে বোমাবাজী ও সন্ত্রাসীর মাধ্যমে বিশ্বে অশান্তি সৃষ্টি করে। যে নবী করিম (দঃ) এর প্রেমে আল্লাহ সমস্ত সৃষ্টিকূল সৃজন করেছেন, যাকে স্বয়ং আল্লাহ নিজের নূর হতে সৃষ্টি করেছেন; সে নবী করীম (দঃ) কে একদল বেআদব আলেম আমাদের মতো মাটির ও সাধারণ মানুষ বলে আখ্যায়িত করে সহজ সরল মানুষকে পথভ্রষ্ট করার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। আর কিছু আলেম যারা আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের মুখোশ পরে টাকার কাছে বিক্রি হয়ে, ইহুদীদের পরামর্শে মুসলমানদের ইসলামী কাজ-কর্ম থেকে দূরে রেখে মুসলিমদের মধ্যে ফাটল সৃষ্টি করে সারা বিশ্বকে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে সন্ত্রসী গোষ্ঠী হিসেবে।
শরীয়তের দৃষ্টিতে আলেমদের অবস্থান সমাজে নেতা হিসেবে, কিন্তু তাঁদের এহেন কাজ-কর্মে আজ সমাজে নিম্নস্তরে অবস্থান করছেন। যার কারণে আলেমরা এখন সাধারণ মানুষের সমালোচনার পাত্র। বর্তমান সমাজের দিকে লক্ষ্য করলে আমরা দেখতে পাই অনেক আলেম আছেন যাদের উপর যাকাত ফরজ হয়েছে, যারা সাধরণ মানুষকে যাকাত আদায় করতে বলেন অথচ নিজেরা যাকাত আদায় করে না। অনেক বিজ্ঞ আলেম আছেন যারা স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠানে সর্বোচ্চ পদে অধিষ্ঠিত; তাঁরা ঘুষের শরয়ী শাস্তি সম্পর্কে অনেক পড়েছেন এবং অপরকে বলছেন যে, ঘুষ ইসলামের মধ্যে হারাম করা হয়েছে। অথচ তাদের নিকট কোন ব্যক্তি যদি প্রয়োজনে যায়, তখন তারা হাদিয়ার নামে জোড় পূর্বক ঘুষ আদায় করেন। তখন তাঁরা হাদীয়া-ঘুষের মধ্যে পার্থক্য ভুলে যান। আমরা জানি এবং হাদীসে আছে যে প্রথমে সালাম দেয় সে উত্তম। কিন্তু কয়জন আলেম প্রথমে সাধারণ মানুষকে সালাম দেন? বরং নিজে সালাম নেওয়ার অপেক্ষায় থাকেন। যদি হাফেজ সমাজের প্রতি লক্ষ্য করি তাহলে শতকরা ২০% হাফেজ তাদের ছাত্রদের সাথে অনৈতিক কাজে লিপ্ত। কেউ কেউ আবার জিহাদের নাম দিয়ে সাধারণ মানুষকে মৃত্যু মুখে ঠেলে দেয় অথচ জেহাদের সময় তাদের কাউকে ময়দানে পাওয়া যায় না। কেউ বা আবার নারী নেতৃত্ব হারাম বলে, যখন নির্বাচন আসে তখন দেখা যায় তারাই নারীর আঁচল ধরে ক্ষমতায় যাওয়ার চেষ্টা করে। সমাজে এমনও আলেম আছেন যারা দাখিল পাশও করেনি অথচ কুরআন পাঠকে ব্যবসা হিসেবে গ্রহণ করে, কুরআনের সম্পূর্ণ খতম আদায় না করে সাধারণ মানুষ থেকে খতমের পুরো মূল্যই নেয়। কোন মুসলমান ইন্তিকাল করলে তার কবরের পাশে কুরআন তেলওয়াত শরীয়ত সম্মত জায়েজ, কেউ এটাকে বলে বেদআত। আবার কেউ এটাকে জায়েজ করে কবর পাহারার নাম দিয়ে সমস্ত আলেমকে অপমানিত করেছে। যার কারণে সাধারণ মানুষ আলেমদের বলে ‘মোল্লা’। অনেকেই আছে আবার এই রকম- যাদের নির্দিষ্ট মোটা অংকের টাকা না দিলে মাহফিলেও যায় না। এরকমও আছে যারা নিজে আলেম বা পীর হয়ে অন্য পরহেজগার আলেম বা পীরকে পছন্দ করে না তাদের নামে গীবত করে প্রতিনিয়ত। সাধারণ মানুষকে বলে আপনার সন্তানকে মাদ্রাসা তথা দ্বীন-ই শিক্ষায় শিক্ষিত করুন। অথচ নিজের সন্তানকে পড়ান স্কুল-কলেজে। বাংলাদেশে ঘুষ, সুদ, যৌতুক প্রথা ছাড়াও বহুধরণের অপসংস্কৃতি মুসলমানদের মধ্যে প্রবেশ করেছে। এগুলোর বিরুদ্ধে অল্প সংখ্যক আলেম ব্যতীত কেউই কথা বলেনা। কারণ এগুলোর বিরুদ্ধে কথা বললে তাঁদের পকেটে টাকা আসার রাস্তা বন্ধ হয়ে যাবে! নিজের স্বার্থে তারা আজ সত্য বলতে ভয় পান। পরস্পরের মতের অমিল হলে কাফেরের ফতওয়াহ দিয়ে ছিন্নভিন্ন করছে ইসলামী ঐক্য।এই আলাম সমাজে আহসান হাবীব পেয়ার’র মতো লোকও লুকিয়ে থাকতে আমরা দেখেছি। একজন পেয়ারই হতে পরে অনেকের উদাহরণ।
আলেমদের মধ্যে যদি এই রকম দুর্নীতি ও শরীয়ত বিরোধী কাজকর্ম পরিলক্ষিত হয় তাহলে সাধারণ মানুষ কিভাবে সঠিক পথের সন্ধান পাবে!
আলেম সমাজের প্রতি আমাদের অনুরোধ নিজ স্বার্থ ত্যাগ করে, যারা ইসলামের সঠিক ব্যাখ্যা দিয়ে থাকেন তাদের সাথে একত্রিত হয়ে হযরত হোসাইন (রঃ)’র রক্তের পবিত্রতা রক্ষা করে লাখো শহীদের প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত বিজিত এই ইসলামকে অপব্যাখ্যা ও প্রশ্নবিদ্ধ না করে; ইসলামের বিজয় নিশান বিশ্বের আনাছে-কানাছে পৌঁছিয়ে বিশ্ববাসীকে বলে দিন “ইসলাম বিশৃংখলার ধর্ম নয়, ইসলাম শান্তির ধর্ম।”
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই আগস্ট, ২০১৭ রাত ১:০৩