somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পিলখানায় গণহত্যার এক মাস পর .....

০৬ ই এপ্রিল, ২০০৯ দুপুর ১:২১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

২৫ শে ফেব্রুয়ারী, ২০০৯:
অফিসে অপনমনে কাজ করছি। সকাল ১০টায় শেরেবাংলা নগর থেকে এক বন্ধু ফোন করে জানালো, পিলখানায় নাকি ব্যাপক গোলাগুলি হচ্ছে। খুব সম্ভব বিডিআর সদস্যদের নিজেদের মধ্যে। ওর কথায় কোনো পাত্তা দিলাম না। এটা মুঠোফোনের যুগ, তবুও বিডিআরের মতো একটি সুশৃংখল বাহিনীর প্রধান কার্যালয়ে সদস্যরা নিজেদের ওপর গুলি চালাবে, এই সংবাদ আমার কাছে বিশ্বাসযোগ্য ছিল না। ভেবেছিলাম এটা নিছকই গুজব বা অন্য কোন ঘটনা। আমার যৌক্তিক ভাবনার অসাড়তা প্রমাণ হতে খুব বেশি সময় লাগেনি। ১১টার মধ্যে বিভিন্ন মাধ্যমে খবর পেলাম গোলাগুলি তখনো চলছে। রাস্তায় বেশ কয়েকজন গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। বিডিআর বাহিনী বিদ্রোহ করেছে। পিলখানার দরবারে বিডিআর জওয়ানরা মহাপরিচালকসহ শীর্ষ কয়েকজন সেনা কর্মকর্তাকে জিম্মি, গুলিবিদ্ধ বা হত্যা করেছেন। সেনাবাহিনী পুরো পিলখানা ঘিরে ফেলেছে।

মোবাইলের এফএম রেডিওতে কান পাতি। কেন এই পরিস্থিতি – তার কোন ব্যাখ্যা নেই। বিডিনিউজ২৪-এর ওয়েবসাইট ‘রিফ্রেশ’ করে চলি। সেখানেও কোন ‘আপডেট’ নেই। অবশেষে গুগল সার্চ-ইঞ্জিনের স্মরণাপন্ন হই। ভারতীয় জিনিউজ-ওয়েবসাইটের মূল পাতায় প্রধান শিরোনাম, ‘বিডিআর বিদ্রোহ’। বলা হচ্ছে, বিডিআর মহাপরিচালকসহ শীর্ষ সেনা কর্মকর্তারা নিহত হয়েছেন। বাংলাদেশের মিডিয়াতে প্রচারের আগেই ভারতীয় মিডিয়ায় এখবর প্রচারিত হতে দেখে বিশ্মিত হলাম। সংবাদটা অনুমাননির্ভর মনে হলো। প্রকৃত ঘটনা সম্পর্কে নিশ্চিত না হয়ে দেশের ইলেকট্রনিক-মিডিয়া সে কারণেই হয়তো কোন সংবাদ প্রচার করছে না। বিকেলে বাসায় ফিরে টিভির সামনে বসলাম। বিস্তারিত রিপোর্ট তখন আসতে শুরু করেছে। আহা! কতভাবেই না আমাদের বিডিআর জওয়ানরা নির্যাতিত হয়েছে। অপারেশন ডাল-ভাত হতে অর্জিত লভ্যাংশ সেনা কর্মকর্তারা পকেটস্থ করেছেন, আর জওয়ানরা কানাকড়িও পায়নি। নির্বাচন পরিচালনার পারিশ্রমিকও দেয়া হয়নি। আর অফিসারদের নিয়মিত নির্মম আচরণ তো আছেই। বিদ্রোহী বিডিআর জওয়ানদের ‘এক্সক্লুসিভ’ সাক্ষাৎকার প্রচারিত হচ্ছে। রাতের “টকশো”-তে কয়েকজন মুখচেনা আলোচক বিডিআর জওয়ানদের ন্যায্য দাবীর প্রতি সমর্থন জানাতে গিয়ে গোটা সেনাবাহিনীকেই ‘ধুয়ে’ ফেললেন। মন খারাপ করে রাতে ঘুমাতে গেলাম। দুচোখের পাতা এক হওয়ার আগ পর্যন্ত ভেবেছি, কেন এত বৈষম্য, কেন এই বিদ্রোহ, কার এই দায়?

২৬ শে ফেব্রুয়ারী, ২০০৯:
সকালবেলা অফিসে যাওয়ার আগে টিভি পর্দায় কিছু সময়ের জন্যে চোখ রাখলাম । নাহ্, এখনো এই রুদ্ধশ্বাস অবস্থার সমাপ্তি ঘটেনি। চলতি বাসের সহযাত্রীরা বিডিআর জওয়ানদের সমর্থনে আলোচনায় মগ্ন। অফিসেও সমর্থনের জোয়ার একই দিকে। নিজে কেবল ভেবে চলেছি, শেষ হোক এই রুদ্ধশ্বাস অবস্থার, শান্তিপূর্ণভাবে। কোন বিশৃংখল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়ে আর যেন কোন প্রাণহানী না ঘটে। সুস্থভাবে ফিরে আসুক সকল জিম্মি সেনা কর্মকর্তা এবং তাদের পরিবারের সদস্যরা। কানে এয়ারফোন – শুনছি এফএম রেডিওর বিশেষ বুলেটিন। আর মনিটরে বিরতিহীনভাবে তাকিয়ে আছি ওয়েবসাইটের পাতায়। বাসায় ফোন করেও খবর নিচ্ছি টিভিতে ‘লাইভ’ কি দেখাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী একের পর এক বৈঠক করে চলেছেন। কখনো দলীয় নীতিনির্ধারকদের সাথে, কখনো সামরিক বাহিনীর প্রধানদের সাথে। তবু অগ্রগতির কোন সুনির্দিষ্ট খবর নেই। সরকার আসলে কি পদক্ষেপ নিচ্ছে সে বিষয়েও স্পষ্টভাবে কিছু জানা যাচ্ছে না। সমগ্র জাতির দীর্ঘ প্রতিক্ষার অবসান ঘটিয়ে অবশেষে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ভাষণ দিলেন। প্রধানমন্ত্রীর সে ভাষণ ছিল অত্যন্ত সুলিখিত, সংক্ষিপ্ত হলেও সে ভাষণ ছিল যথার্থই কার্যকরী। যেখানে প্রয়োজন তিনি কঠোর হয়েছেন, যেখানে প্রয়োজন তিনি কোমল হয়েছেন। ভাষণের প্রতিটি শব্দের আবেদন প্রধানমন্ত্রীর অভিব্যক্তিতে ফুটে উঠছিল। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ মানেই উন্নয়নের জোয়ারের ফিরিস্তি আর বিরোধী দলের বিরুদ্ধে দেশে অরাজকতা সৃষ্টির অভিযোগ। প্রধানমন্ত্রীর ব্যতিক্রমী সে ভাষণ মোটামুটিভাবে সাধারণ জনগণ দলমতের উর্দ্ধে উঠে স্বাগত জানিয়েছিল। ৩৩ ঘন্টার রুদ্ধশ্বাস অবস্থার সমাপ্তি ঘটিয়ে অবশেষে বিডিআরের বিদ্রোহী জওয়ানরাও আত্মসমর্পণ শুরু করলো। সাধারণ জনগণ হিসেবে আমরা ধারণা করেছিলাম দরবার হলে সম্ভবত মহাপরিচালকসহ কয়েকজন হতাহত হয়েছেন। সন্ধ্যার আগেই যখন নবাবগঞ্জ ড্রেনে একের পর এক সেনা কর্মাকর্তার মৃতদেহ ভেসে উঠতে লাগলো, তখন আর বুঝতে বাকি রইলো না, এখানে যা ঘটেছে তা শুধু কয়েকটি হত্যাকান্ড নয়, বরং সুস্পষ্ট গনহত্যা।

অতপর ... ... :
২৭শে ফেব্রুয়ারী তারিখেই পিলখানার নিষ্ঠুর গণহত্যা সম্পর্কে জাতি পুরোপুরি নিশ্চিত হলো। নিখোঁজ সেনাসদস্যদের খোঁজে স্বজনদের উদ্বেগ, নবাবগঞ্জ ড্রেনে আরো সেনাসদস্যের লাশ ভেসে ওঠা, একেরপর এক গণকবর আবিষ্কার, সে গণকবরে সেনা কর্মকর্তাদের বিকৃত লাশ, নিহত কর্মকর্তাদের পরিবারের সদস্যদের আহাজারি, জওয়ানদের হাতে আবালবৃদ্ধবনিতার নিযার্তিত হওয়ার খবর, কর্মকর্তাদের বাসভবনে জওয়ানদের লু্ঠতরাজ – এর সবই যেন কোন দুঃস্বপ্নের দৃশ্যপট। ঘুম ভাঙ্গলেই দেখবো সবকিছু স্বাভাবিক, এতক্ষণ আসলে দুঃস্বপ্ন দেখছিলাম।

নাহ্‌, এটাই আসলে নির্মম বাস্তবতা, যার ফল হয়তো জাতিকে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে বয়ে বেড়াতে হবে। ২৫শে ফেব্রুয়ারীর সে ঘটনাকে আমি বিদ্রোহ বলতে রাজি নই, এটা ছিল সুস্পষ্ট গনহত্যা। এই গনহত্যাকে ঘিরে অনেক বিষয়, অনেক প্রশ্ন এখনো অমিমাংসিত। আমরা সেসব প্রশ্নের উত্তরের অপেক্ষায় রইলাম।

প্রশ্নবিদ্ধ প্রধানমন্ত্রীঃ
এনির্মমতার ভয়াবহতা প্রথম দুদিন জনসমক্ষে প্রকাশিত হয়নি বলেই হয়তো প্রধানমন্ত্রীর ভূমিকা নিয়ে কোন প্রশ্ন উঠেনি। পরবর্তীতে সত্য সামনে আসার পর তাঁর গৃ্হীত সিদ্ধান্ত ও পদক্ষেপ সম্পর্কে চতুর্দিকে আলোচনা-সমালোচনার ঝড় উঠে। প্রশ্ন দেখা দিল – আসলেই প্রধানমন্ত্রী সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছেন কিনা। সবচেয়ে বড় প্রশ্ন, এতজন সেনা কর্মকর্তার জীবন বাঁচানো কোনভাবে সম্ভব ছিল কিনা। এবিতর্ক চিরদিনই থাকবে। বিশেষত সেনাবাহিনী যখন মনে করে – অভিযান পরিচালনার সুযোগ পেলে নির্মমভাবে নিহত অনেক সেনা কর্মকর্তার জীবন বাঁচানো যেত। পরবর্তীতে সেনাসদরে প্রধানমন্ত্রীর সাথে সেনা কর্মকর্তাদের বৈঠকের যে অডিও-টেপ আমরা শুনেছি, তাতে পরিস্কার বোঝা গেছে, সেনাবাহিনী অভিযান পরিচালনার পক্ষে জোরালো অবস্থানে ছিল। তবে শেষ পর্যন্ত অনিচ্ছাসত্ত্বেও তারা রাজনৈতিক সরকারের সিদ্ধান্ত মেনে নিয়েছেন।

এখানে ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি, প্রধানমন্ত্রীর এই সিদ্ধান্তটি দুটি প্রেক্ষাপটে বিবেচনা করা যায়। প্রথমতঃ পিলখানার অভ্যন্তরের অবস্থা সম্পর্কে পুরোপুরি নিশ্চিত হয়েই সেনাবাহিনী মনে করেছিল, অভিযানে গেলে লুকিয়ে থাকা বা জিম্মি সকলকেই কোন ক্ষয়ক্ষতি ছাড়া উদ্ধার করা সম্ভব হবে। এক্ষেত্রে সেনাবাহিনীর নিশ্চয়তা প্রদান সত্ত্বেও প্রধানমন্ত্রী যদি অভিযান পরিচালনার অনুমতি না দিয়ে থাকেন, তবে এর দায় প্রধানমন্ত্রীকেই নিতে হবে। সুযোগ পেলেই সেনাবাহিনীকে সর্বোচ্চ দক্ষতায় গড়ে তোলা হয়েছে বলে দাবী করা হবে, আর দেশের সবচেয়ে প্রয়োজনের মুহুর্তে তাদের সিদ্ধান্ত বা কৌশলের উপর আস্থা রাখা হবে না, এরকম দ্বৈত অবস্থান গ্রহণযোগ্য নয়। সেক্ষেত্রে ধরে নিতে হবে সেনাবাহিনীকে আসলে কখনোই নির্ভরযোগ্য দক্ষ বাহিনী হিসেবে গড়ে তোলা হয়নি। দ্বিতীয়তঃ পিলখানার অভ্যন্তরের অবস্থা সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী বা সেনাবাহিনী – কেউই পুরোপুরি নিশ্চিত ছিলেন না। অনুমাননির্ভর বা আবেগতাড়িত অবস্থান থেকে সেনা অভিযান পরিচালনা করা হলে হয়তো প্রাণহানি বা ক্ষয়ক্ষতি আরো ব্যাপক হতো। সেনাসদস্য, জিম্মি পরিবারবর্গ এবং নিকটবর্তী বেসামরিক জনগণের প্রাণহানির সম্ভবনা অনেক বেড়ে যেত। সেক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর গৃহীত সিদ্ধান্ত বাস্তবতার বিবেচনায় গ্রহণযোগ্য। তবে সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়াটি ঠিক কি ছিল, কারা এপ্রক্রিয়ায় যুক্ত ছিলেন, কোন সময়ে কোন অবস্থার প্রেক্ষিতে কি সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে – তা হয়তো আমাদের অজানাই থেকে যাবে।

এখানে আরো কিছু বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ থেকে গেছে। রাষ্ট্রের চরম সংকটকালীন মূহুর্তে কেন প্রধানমন্ত্রী বিরোধীদলের সাথে আলোচনা করেননি বা তাদের অবহিত করেননি? হতে পারে ঐতিহ্য অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রী পূর্বসরীদের মতো অঘটনের দায় বিরোধীদলের উপরে চাপানোর পথ খোলা রাখতে চেয়েছেন। হতে পারে সন্দেহের বশবর্তী হয়ে তিনি বিরোধীদলের উপর আস্থা রাখতে পারেননি। আবার এটাও হতে পারে, বিদ্রোহের রক্তপাতহীন অবসানে তিনি এতটাই আত্মবিশ্বাসী ছিলেন যে সম্ভাব্য প্রশংসার অংশীদার আর কাউকে করতে চাননি। তবে সংসদে এবিষয়ে তার বক্তব্য জাতিকে হতাশ করেছে। কোন গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা না দিয়ে বিষয়টিকে তিনি ‘ছেলের-বিয়ে, মেয়ের-বিয়ের দাওয়াত’-এর সাথে তুলনা করে এর গুরুত্বকে খাঁটো করেছেন। সহকর্মী হারানোর বেদনায় ব্যথিত এবং ক্ষুব্ধ সেনাসদস্যদের মুখোমুখি হয়ে তিনি সৎসাহসের পরিচয় দিয়েছেন বটে। তবে এ প্রসংগে সংসদে বিরোধীদলীয নেত্রীর বক্তব্যের সমালোচনায় বলেছেন, একই ধরনের বক্তব্য তিনি সেনাসদরে শুনে এসেছেন। হায়রে অভাগা দেশ, হায়রে রাজনীতি!!! কাকে দোষ দেব? বিরোধী নেত্রীকে? কেন তিনি সেনাসদস্যদের মতো একই ভাষায় শোক প্রকাশ করলেন? নাকি সেনাসদস্যদের? কেন তাদের অনুভূতির প্রকাশ বিরোধী নেত্রীর সাথে সামন্জস্যপূর্ণ হলো? কেন সবার শোকের অনুভূতি, শোক প্রকাশের ভাষা আলাদা নয়?

বিরোধীদলের ভূমিকাঃ
সংকট শুরু হওয়ার পর প্রধান বিরোধী দলের পক্ষ থেকে সরকারকে সকল প্রকার সহযোগিতা দেয়ার আশ্বাস দেয়া হয়। বিদ্রোহের দায় সরকারের উপরে না চাপিয়ে তারা যে দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিয়েছিলেন তা জাতিকে আশ্বস্ত করেছিল। তবে বিরোধীদলের সনাতন ভূমিকায় ফেরত যেতে বেশি সময় লাগেনি। হতে পারে সরকারের পক্ষ থেকে আলোচনায় ডাক না পেয়ে তারা ক্ষুদ্ধ হয়েছেন। অথবা এই দুদিন তারা অবস্থা পর্যবেক্ষণ করেছেন। দুদিন পর যখন গণহত্যার বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া গেল, তখন তারা স্বমহিমায় আবির্ভূত হলেন। দুদিন পরে এসে তারা ঘোষণা করলেন, প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক সাধারন ক্ষমা ঘোষণার সিদ্ধান্তটি ছিল মারাত্মক ‘ভুল’। যদিও ঘটনা শুরুর প্রথম দিন থেকে প্রধান বিরোধীদল যে বক্তব্য দিচ্ছিল, তাতে সাধারন ক্ষমার বিপক্ষে তাদের সামান্যতম অবস্থান চোখে পড়েনি। অথচ প্রধানমন্ত্রী সাধারন ক্ষমা ঘোষণা করেছিলেন বিদ্রোহের প্রথম দিনেই। যেহেতু একটি বিপর্যয় ঘটে গেছে, তা যতো অমানবিকই হোক না কেন, সে বিপর্যয় থেকে যতটা সম্ভব সুবিধা নিশ্চিত করা যায়, এটাই তো এদেশের রাজনীতিবিদদের ধর্ম!!

সেনাবাহিনীর ভূমিকাঃ
গত ৩৮ বছরে স্বাধীন বাংলাদেশে সেনাবাহিনী বারবার বিতর্কিত হয়েছে। কখনো এই বাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তাদের উচ্চাভিলাষের কারণে। কখনো বা জাতীয় প্রয়োজনে, জাতির প্রত্যাশায়। রাষ্ট্রীয় গভীর সব সংকটে শেষ মূহুর্তের ত্রাতা হিসেবে আমরা কামনা করেছি সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপ, আবার সুযোগ পেলে তাদের ঘাঁড়ে দায়ভার চাপাতেও দ্বিধা করিনি। তারা যেন অন্য গ্রহের কোন বাসিন্দা!! আমাদের কারো সন্তান, ভাই বা বাবা নন। ১/১১-এর পূর্বে রাজনৈতিক দলগুলোর একগুঁয়েমির কারণে রাষ্ট্র যখন গভীর সংকটে নিপতিত, দেশের সাধারণ জনগণ অপেক্ষার প্রহর গুনেছে, কখন সেনাবাহিনী সংকট সমাধানে এগিয়ে আসবে। সেনাবাহিনীর হ্স্তক্ষেপকে জনগণ স্বাগত জানিয়েছিল বটে, তবে অবস্থান পরিবর্তনেও তারা দেরি করেনি। বিশেষত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের শেষ সময়ে এবং নতুন সরকারের সূচনালগ্নে সংসদ এবং এর বাইরে রাজনৈতিক নেতৃত্ব বিরতিহীনভাবে সেনাবাহিনীর কঠোর সমালোচনা করেছেন। যেন ১/১১-এর পটভূমির দায়ভার তাদের নয়, সেনাবাহিনীর। পিলখানার ঘটনায় সেনাবাহিনী যে ভূমিকা পালন করেছে, তা বাংলাদেশ তথা বিশ্বের ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। যদিও এঘটনায় সবচেয়ে বড় মূল্য দিতে হয়েছে সেনাবাহিনীকেই। তবুও বলতে চাই, ৯০-এর এরশাদ সরকারের পতনের পর সেনাবাহিনী নিজেদের একটি পূর্ণ পেশাদারী বাহিনী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে সফল হয়েছে। ৭০ বা ৮০-এর দশকে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ঐতিহ্য অনুসরণের যে ধারাবাহিকতা আমরা এবাহিনীতে দেখেছিলাম, গত ১৯ বছরে সে ঐতিহ্যের কোন আগ্রাসন আর দৃশ্যমান হয়নি, বরং সে ঐতিহ্যের অনেকটাই অবসান হয়েছে। আন্তর্জাতিকভাবেও এই সময়ে সেনাবাহিনীর অর্জন ছিল অসমান্য। সব অর্জনই বৃথা মনে হয়, যখন এতজন দক্ষ দেশপ্রেমী সেনা কর্মকর্তা নিরস্ত্র অবস্থায় পৈশাচিকভাবে দেশের আরেকটি বাহিনীর হাতে নিহত হয়। ওই বিডিআর জওয়ানরা কি এদেশের সন্তান নাকি কোন শত্রু রাষ্ট্রের? কিছুতেই মেনে নিতে পারি না। এটাই কি স্বাধীন বাংলাদেশ? সন্তান হারানো বাবা-মা, স্বামী হারানো স্ত্রী কিংবা বাবা হারানো সন্তান – আর্তনাদ আর আহাজারি প্রতি মূহুর্তে ধ্বনিত হয় কানের পর্দায়। যারা শহীদ হয়েছেন, আমরা তাদের জন্য গর্বিত, আমার বিশ্বাস অন্তত আমাদের প্রজন্ম তাদের এই আত্মত্যাগ জীবদ্দশায় প্রতি মূহুর্তে অনুভব করবে। শোকে মূহ্যমান পরিচিত কয়েকজন সেনা কর্মকর্তা কষ্ট বুকে চেপে আমাকে বলেছেন, সব ধরনের সক্ষমতা ও প্রস্তুতি থাকা সত্ত্বেও তারা তাদের সতীর্থদের বাঁচাতে পারেননি। এই অক্ষমতার জ্বালা তাদের আজীবন বয়ে বেড়াতে হবে। জানি, যে হারায় সেই বুঝে। তবু বলি, এই ধৈর্য্যের পরিচয় না দিলে সত্যটা কি আমাদের জানা সম্ভব হতো? শহীদ সেনা কর্মকর্তারা কি মাণুষের হৃদয়ে বীরের মর্যাদায় অধিষ্ঠিত হতেন? আমার ধারণা, ১/১১-এর ধারাবাহিকতায় ক্ষতিগ্রস্থ রাজনীতিবিদরা এবং মিডিয়া এঘটনাকে ‘সেনাবাহিনী এবং বিডিআরের অভ্যন্তরীণ গোলযোগের ফলে প্রাণহানী’ হিসেবে উল্লেখ করতো। এরপরও সেনাবাহিনী যে ধৈর্য্যের পরিচয় দিয়েছে, তা দেশ তথা সেনাবাহিনীর ইতিহাসে একটি ঐতিহাসিক অধ্যায় হিসেবে বিবেচিত হবে। পেশাদারিত্বের অনন্য নজীর হিসেবে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর এঅবস্থান ইতিহাসে চিরস্মরনীয় হয়ে থাকবে।

গণমাধ্যমের ভূমিকাঃ
তীব্র প্রতিযোগিতার আধুনিক এই বিশ্বে এক মিনিটের পুরোনো সংবাদও “বাসি খবর”। দর্শকের কাছে ‘নিউজ’-কে কতটা ‘এক্সক্লুসিভ’-ভাবে উপস্থাপন করা যায়, সংবাদকর্মীদের মূল বিবেচ্য এখন সেটাই । তাতে কার কি ক্ষতি হলো, কার অনুভূতিতে আঘাত লাগলো, কার আত্মসম্মান গেল - সেটা বিচার করার সময় কোথায়? সেজন্যেই টিভিপর্দায় ২৫তারিখের নায়ক – বিডিআরের তথাকথিত বিদ্রোহী জওয়ানরা। আবার গণহত্যার ঘটনাটি প্রকাশিত হওয়ার পর চ্যানেলে চ্যানেলে চলেছে শহীদ সেনাকর্মকর্তাদের স্মরণে বিরামহীন শোকগাথাঁ। বাস্তবতা হচ্ছে, দায়িত্বহীন সংবাদ পরিবেশনের কারণেই ২৫ তারিখে সাধারণ মাণুষ বিভ্রান্ত হয়েছে। মেজর শাকিলের বৃদ্ধ মাতার ক্রন্দনরত মুখখানি প্রায়ই মনে পড়ে। সন্তান হারানোর শোকে বিলাপ করার সুযোগটুকুও পাননি। বরং বার বার সন্তানের সততার পক্ষে কাতর কন্ঠে মুখ খুলেছেন। একে তো সারা জীবন দেশকে সেবা করার পর নির্মমভাবে মৃত্যুবরণ করতে হয়েছে, তারপর তাদের ব্যক্তিগত সততাকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়েছে। আরেকটি দৃশ্যের কথাও না বলে পারছি না। বিভীষিকাময় ৩৩ ঘন্টার বন্ধীদশা কাটিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বের হয়ে আসছে বিপর্যস্থ সেনাসন্তান। আর তাদের পেছনেই মাইক্রোফোন হাতে দৌড়িয়ে প্রশ্ন ছুড়ে দেয়া হচ্ছে, মুক্তি পাওয়ার পর তাদের অনুভূতি কি অথবা ভেতরের পরিস্থিতি কেমন? হায়!! আজ সংবাদ কি শুধুই পণ্য, এই পণ্য যারা তৈরি করেন তারা কি মাণুষ না মেশিন, সংবাদকর্মীদের মধ্যে কি নূন্যতম মানবতাবোধ নেই?? যতদিন পর্যন্ত প্রচার মাধ্যমগুলো তথ্য সম্প্রচারের ক্ষেত্রে সততা, দায়িত্বশীলতা এবং মানবিক মূল্যবোধের সমন্বয় না ঘটাবে, ততদিন জাতিকে বারবার এভাবেই বিভ্রান্ত হতে হবে।

আমাদের প্রত্যাশাঃ
“Justice hurried, justice buried. Justice delayed, justice denied.” – পুরোনো এই প্রবাদ বাক্য এখন সাবেক সেনা কর্মকর্তা বাণিজ্যমন্ত্রীর মুখে বারবার উচ্চারিত হচ্ছে । এই প্রবাদবাক্য সবপক্ষকে ফাঁকি দিয়ে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগও বটে। শুক্রবার ক্যান্টনমেন্টের গেটে পিলখানায় শহীদ সেনা কর্মকর্তাদের সন্তানেরা বিচারের দাবীতে মানববন্ধন কর্মসূচী পালন করে। হাতেধরা প্ল্যাকার্ডের বক্তব্যগুলোতে ঘুরেফিরে একটিই দাবী – ‘বিচার চাই’। সেদিন দেখলাম, একটি প্ল্যাকার্ডে লেখা আছে, “We want justice. We have full confidence on our government.” শহীদদের সন্তানদের মতো সাধারণ জনগণেরও সরকারের উপর এখনো আস্থা রয়েছে। আমরা এখনো বিশ্বাস করি, বাণিজ্যমন্ত্রীর বক্তব্য দেশবাসীকে ফাঁকি দেয়ার জন্য নয়, বরং তদন্তের মাধ্যমে খুনী ও দোষীদের সনাক্ত করার জন্য, ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার জন্য। আমরা চাই দ্রুততম সময়ে এই গণহত্যার সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার সম্পন্ন হোক। তবে দ্রুত বিচার নিশ্চিত করতে গিয়ে একজন অপরাধীও যেন ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে না যায়, আবার কোন নিরাপরাধ ব্যক্তি যেন পরিস্থিতির শিকার না হন। স্থানীয় সরকারমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম মিডিয়ার মুখোমুখি হয়ে দেশবাসীর কাছে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, “বিচারের রায় এবার নিভৃতে কাঁদবে না”। আমরা সেই প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের প্রতিক্ষায় রইলাম। স্বাধীন বাংলাদেশে একাত্তরের গণহত্যার বিচার হযনি, যার ধারাবহিকতায় বঙ্গবন্ধু, জাতীয় চারনেতা, মেজর জিয়াসহ অন্য গণহত্যাগুলো সংগঠিত হয়েছে, বিচারের কোন দৃষ্টান্ত ছিল না বলেই খুনীরা উৎসাহিত হয়েছে। আমাদের বিশ্বাস এইবার দৃষ্টান্ত স্থাপিত হবে। অন্তত এইবার আমরা আশাহত হবো না।
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই এপ্রিল, ২০০৯ দুপুর ১:০২
১টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

কুড়ি শব্দের গল্প

লিখেছেন করুণাধারা, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:১৭



জলে ভাসা পদ্ম আমি
কোরা বাংলায় ঘোষণা দিলাম, "বিদায় সামু" !
কিন্তু সামু সিগারেটের নেশার মতো, ছাড়া যায় না! আমি কি সত্যি যাবো? নো... নেভার!

সানমুন
চিলেকোঠার জানালায় পূর্ণিমার চাঁদ। ঘুমন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

ধর্ম ও বিজ্ঞান

লিখেছেন এমএলজি, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৪:২৪

করোনার (COVID) শুরুর দিকে আমি দেশবাসীর কাছে উদাত্ত আহবান জানিয়ে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম, যা শেয়ার হয়েছিল প্রায় ৩ হাজারবার। জীবন বাঁচাতে মরিয়া পাঠকবৃন্দ আশা করেছিলেন এ পোস্ট শেয়ারে কেউ একজন... ...বাকিটুকু পড়ুন

তালগোল

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৩৫


তু‌মি যাও চ‌লে
আ‌মি যাই গ‌লে
চ‌লে যায় ঋতু, শীত গ্রীষ্ম বর্ষা
রাত ফু‌রা‌লেই দি‌নের আ‌লোয় ফর্সা
ঘু‌রেঘু‌রে ফি‌রে‌তো আ‌সে, আ‌সে‌তো ফি‌রে
তু‌মি চ‌লে যাও, তু‌মি চ‌লে যাও, আমা‌কে ঘি‌রে
জড়ায়ে মোহ বাতা‌সে ম‌দির ঘ্রাণ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

মা

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৩


মায়াবী রাতের চাঁদনী আলো
কিছুই যে আর লাগে না ভালো,
হারিয়ে গেছে মনের আলো
আধার ঘেরা এই মনটা কালো,
মা যেদিন তুই চলে গেলি , আমায় রেখে ওই অন্য পারে।

অন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

কপি করা পোস্ট নিজের নামে চালিয়েও অস্বীকার করলো ব্লগার গেছে দাদা।

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:১৮



একটা পোস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ আগে থেকেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। পোস্টটিতে মদ্য পান নিয়ে কবি মির্জা গালিব, কবি আল্লামা ইকবাল, কবি আহমদ ফারাজ, কবি ওয়াসি এবং কবি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×