টিপাইমুখ বাঁধ, প্রথম আলো, ল্যামপোস্ট এইসব বিষয়ে দারুণ বিতর্ক হয়ে গেলো ব্লগে। এইজন্য বন্ধু ফারুক ওয়াসিফ আর মঞ্জুরুল হককে ধন্যবাদ দেওয়া প্রয়োজন প্রথমে। তাদের লেখাগুলোর সূত্র ধরেই এই বিতর্ক ব্লগে প্রাণবন্ততা পেয়েছে। আমি আরো কিছু কথা যোগ করছি:
১. বেশীরভাগ ব্লগারই প্রথম আলোর সেদিনের সংবাদ-সূত্র বিষয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। তার মানে হোল, ল্যামপোষ্টের কর্মীরা চরমপন্থি দলরে সমর্থন করে, এই বিষয়টি প্রমাণ হলেই না তারপর প্রথম আলো/শাসকগোষ্ঠির হামলা ও ক্রসফায়ার জায়েজ হবে, এর আগে নয়। তাই নাকি? এই প্রশ্ন থেকেই একজন পত্রিকার লোক ব্লগারদেরকে পরামর্শ দিয়ে গেলেন যে, প্রথম আলোর এই অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের বিরুদ্ধে যদি কারো তথ্য থাকে, তাহলে সে যেন তা উল্লেখ করে পত্রিকায় প্রতিবাদ পাঠায়, যদি কারো সেই সাহস থাকে। কারণ, মহান জাফর ইকবালকে তো প্রথম আলো সম্পাদক চরমপন্থি ও জঙ্গী আখ্যা দেন নাই, অথচ তিনিওতো টিপাইমুখ বাঁধকে পছন্দ করেন না। এই চরম ফাজলামোপূর্ণ মতামতটা তৈরী হলো এজন্য যে, এ বিষয়ক ব্লগারদের আম প্রতিক্রিয়ার গন্তব্য রিপোর্টের সত্যাসত্য নির্ণয়ের তর্কে পরিণতি লাভ করলো, এর রাজনীতিটারে উল্লেখিত পত্রিকার লোক এবং যারা এ বিষয়ে মশগুল- তারা দেখতেই জানল না। টিপাইমুখের বিরুদ্ধে একটি কার্যকর প্রতিবাদ সংবাদ থেকে হারিয়ে গেল, এমনকি সেটি সংবাদই হলো না, রহস্য-উপন্যাসের ঘটনাতে পর্যবসিত করল প্রথম আলোর ধূর্ত শার্লক-হোমসগিরি এবং নিপীড়ক শাসক গোষ্ঠির দালালী।
২. একজন ব্লগার দেখলাম ব্লগে টিপাইমুখ বিষয়ক বিতর্কে তার ভাষায়, 'এক প্রাক্তন ছাত্রদল নেতা, বর্তমানে মার্কসিস্ট' এবং 'একজন প্রাক্তন শিবিরকর্মী' বা 'জেএমবি' জড়িত হওয়ার কারণে এর নৈতিকতার দিক হারিয়েছে- এই বলে ফতোয়া দিয়ে গেলেন বিভিন্ন পোস্টে। ভালো কথা, টিপাইমুখএর বিরুদ্ধে যে প্রতিবাদ তার মনোপলি কাদের আছে বলে তিনি মনে করেন? মানলাম, বিএনপি, জামাত এবং মার্কসিস্টরা সেই অধিকার রাখেন না। তাহলে কারা? আওয়ামীলীগ? প্রসঙ্গত: আমি স্পষ্ট করে বলতে চাই, এই ইস্যুতে যারাই সংগঠিত হবে এবং এর জন্য কাজ করবে, জামাত-জেএমবি, চরমপন্থি- নির্দিষ্ট ইস্যুতে তাদেরকে সমর্থন করতে আমার কোন নৈতিক বাঁধা নেই। কারো কারে ব্যাপারে 'আইনি' বাঁধা থাকতে পারে, কিন্তু যারা আইন বদলানোর লড়াইয়ে লিপ্ত, তাদের কাছে এই বাঁধা তুচ্ছ। তার চেয়েও বড়ো কথা, বর্তমান শাসকগোষ্ঠির ফ্যাসিবাদিতা যে কোন প্রতিবাদকে আইনি বাঁধারও বহু আগের স্তরে টুটি টিপে ধরে। আইনের জন্য অপেক্ষা করে না।
৩. টিপাইমুখ বাঁধ, ফারাক্কা, তালপট্টিদখল বা বিএসএফ এর খুনোখুনি এইসবের প্রতিবাদ বা বিরোধিতা করতে গিয়ে আমরা যাতে 'ভারত' বা কোন একটি 'জাতিগোষ্ঠি'র প্রতি ঘৃণা এবং সাম্প্রদায়িক রাজনীতির গহ্বরে সচেতন বা অচেতনে পতিত না হই- সে খেয়াল রেখেই আমাদের এ প্রতিবাদ করে যেতে হবে।
৪. আচ্ছা, বলুনতো এই বিতর্ক কি প্রথম আলোতেই থিতু হয়ে যাওয়ার বিষয়, নাকি এর আরো বড়ো প্রেক্ষিত থাকা প্রয়োজন? টিপাইমুখে বাঁধের বিরুদ্ধে এই প্রতিবাদ একই সাথে মার্কিন-ভারতীয় আধিপত্যবাদ, ফ্যাসিস্ট শাসকগোষ্ঠি এবং তাদের সহযোগী বেয়াদপ মিডিয়ার কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধেও লড়াই নয় কি? এবং একই সাথে এটি কি প্রাণ-প্রকৃতি ও জীবন বাঁচানোর লড়াই নয় কি?
৫. টিপাইমুখ বাঁধবিরোধী আন্দোলনের আরো অন্তর্গত দর্শন বিষয়ে দার্শনিক ফরহাদ মজহার চমৎকার কথা বলেছেন: সম্ভবত টিপাইমুখ ও পানির ওপর জনগণ, পশুপাখি, কীটপতঙ্গ, জলজ প্রাণীর অধিকার আদায়ের লড়াই উপমহাদেশে নতুন বিপ্লবী রাজনীতির সূচনা করবে। যার খানিক ইশারা আমরা মওলানা ভাসানীর ফারাক্কার বিরুদ্ধে লংমার্চে দেখেছিলাম। মওলানার পরিবেশ আন্দোলনকে নিছকই ‘আধুনিক’ পরিবেশ আন্দোলনের সঙ্গে তুলনা করলে চলবে না। তিনি জানতেন ‘আধুনিকতা’ ও ‘সাম্রাজ্যবাদ’ সমার্থক। তিনি তাঁর আন্দোলনকে বরং আরো গভীর আন্তরিক তাগিদ ও সৃষ্টির প্রতি গভীর মমতা ও ভালবাসার ওপর প্রতিষ্ঠিত করবার শিক্ষা আমাদের দিয়েছেন। তাঁর ভাষায় এর নাম ‘রবুবিয়াত’ বা বিশ্বপালনকর্তার স্বভাব আয়ত্ত করে প্রাণ, প্রাণের শর্ত ও পরিবেশ রক্ষা করা। পানির ওপর শুধু মানুষের ‘হক’ নাই প্রতিটি প্রাণীর প্রতিটি তুচ্ছাতিতুচ্ছ প্রাণীটিরও ‘হক’ আছে। সেই হক আদায় করার মধ্যদিয়েই মানুষ দীন বা ধর্মের পথে কামিয়াব হয়। টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণের প্রতিবাদ জানাতে গিয়ে যাঁরা আহত ও নির্যাতিত হয়েছে, তাঁদের প্রতি আমার সংহতি ও সমবেদনা। নিন্দা করি জালিমদের এবং একই সঙ্গে তাদের করুণাও করি বটে কারণ বধির তারা। তাদের ধ্বংসের ঘন্টা বেজে উঠেছে যার আওয়াজ তাদের কানে এখনো প্রবেশ করে নি।
ফারুক ওয়াসিফের লেখার লিঙ্ক: অডিসিয়াস ল্যাম্পপোস্ট ও বিসর্জিত দীপুমণি : আত্মবলিদানের প্রথম ধাপে যারা
মঞ্জুরুল হকের লেখার লিঙ্ক: "ল্যাম্পপোস্ট"কে বলির পাঁঠা বানাচ্ছে কারা? কোন দূরভিসন্ধিতে?
ব্লগের বাইরে, ফরহাদ মজহারের লেখার লিঙ্ক, যেটি আমি এখানে শেয়ার করেছি: টিপাইমুখ বাঁধবিরোধী সংগ্রাম সফল হোক: একটি আহবান
প্রথম আলো বিষয়ে আমার আগের একটি আলাপ পোস্ট: প্রথম আলোর সাম্প্রতিক সংখ্যাগুলো কি কেউ খেয়াল করে পড়েছেন?
বিডিআর বিদ্রোহ বিষয়ে একটি পুরনো লেখা: আমরা নতুন কোনভাবে বিডিআরের ইতিহাস পড়ব
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই নভেম্বর, ২০০৯ দুপুর ১:৪৭