হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাস এবং হাইকোর্ট এর দেয়াল
লেখক হুমায়ুন আহমেদ দেয়াল নামে একটি নতুন উপন্যাস লিখেছেন, পঁচাত্তর যার পটভূমি। লেখাটির সামান্য অংশ প্রথম আলোতে প্রকাশিত হয়েছে কিছুদিন আগে। তারপর থেকে বিতর্কের শুরু। স্বভাবতই বিতর্ক উঠবে। কারণ বিষয় পঁচাত্তর, আমাদের ইতিহাসের পবিত্রতম অধ্যায়গুলোর একটি, যার ব্যাপারে প্রায় সব পক্ষই কোন না কোন ভাবে স্পর্শকাতর এবং যুদ্ধংদেহী । এই যুদ্ধংদেহী ও আবেগের ভাবটা কাটিয়ে উঠতে পারলে, বিতর্ক ওঠা খারাপ নয়। বরং বেশ জরুরী কাজ হল, কাজের বিতর্ককে উসকে দেয়া। বিতর্কে নাখোশ বন্ধুদের অনেকেই লিখছেন, ফিকশনকে ইতিহাস দিয়ে বিচার করা 'উচিত' নয়। আমি এই ঔচিত্যের ধার ধারি না। ইতিহাস নিয়ে ফিকশন লিখবেন, ইতিহাসের বাছ-বিচারের দায় তো থাকেই। আবার, ভগবান রামের বিপরীতে মেঘনাধবধকাব্য লেখারও পূর্ণ স্বাধীনতা লেখকের আছে। রাবনই যেখানে নায়ক। ইতিহাসের পাটাতনে দাঁড়িয়ে লেখকের রাজনৈতিক বোধ-বুদ্ধি যদি বিচার না করা যায়, তাহলে লেখাটির কোন গন্তব্যই নেই। স্রেফ শিল্প বলতে কিছু নেই।
তবে, সেইসব আমার বক্তব্য নয় এখানে। এমনকি এই উপন্যাসের শিল্পগুণ বিচারও আমার এই ক্ষুদ্র নোটের উদ্দেশ্য নয়। উদ্দেশ্য হলো, সাম্প্রতিক এই উপন্যাস নিয়ে তর্ক-বিতর্কই শুধু নয়, একটি গোষ্ঠি এর প্রকাশনা ও প্রচার নিষিদ্ধের দাবী তুলেছে। এবং সবসময়ের মতো, হাইকোর্টের রুল এসেছে, উপন্যাস সংশোধনের হুকুম জারি করে। দৃশ্যপটে সরাসরি রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা। উপন্যাসের কয়েকটি অংশে আপত্তি জানিয়ে রাষ্ট্রের এটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “হুমায়ূন আহমেদের ওই উপন্যাসে বঙ্গবন্ধু হত্যার ঘটনার সময় শেখ রাসেলের মৃত্যুর দৃশ্যপটটি যথাযথভাবে উপস্থাপন করা হয়নি। এই হত্যাকাণ্ডটি ছিল একটি বীভৎস ঘটনা। কিন্তু হুমায়ূনের বিবরণে সেটা ফুটে ওঠেনি।” “এছাড়া খন্দকার মোশতাককে যেভাবে তুলে ধরা হয়েছে, তাতে মনে হয়েছে, তিনি এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনা আগে থেকে জানতেন না। প্রকৃতপক্ষে তিনি ওই ষড়যন্ত্রে জড়িত ছিলেন,” বলেন সরকারের প্রধান আইন কর্মকর্তা। “আদালত আশা প্রকাশ করেছে যে, বইটির তথ্যগত ভুল সংশোধন করা হবে।” তবে তিনি এও বলেন, “আদালতের আশা প্রকাশও আদেশ হিসেবে গণ্য।”
উপন্যাস সংশোধন, আদালতের ইতিহাসে নতুন সংযোজন। আমার বোধ-বুদ্ধি লোপ পাচ্ছিল, কী ধরণের মূর্খ লোকেরা রাষ্ট্রের আইন কর্মকর্তা হন, যিনি আশা করেন যে, একটি নির্দিষ্ট জায়গায় আওয়ামী আবেগ ঘনিভূত হয় নাই বলে এটি পূনর্বার লিখতে হবে। এবং পরিহাস, মাননীয় হাইকোর্ট থেকেই এমন আদেশ আসে। অবশ্যই, এটি রাষ্ট্রের ফ্যাসিবাদী চরিত্রের নাঙ্গা প্রকাশও।
আদালত দিয়ে উপন্যাস এবং ইতিহাস লেখানোর এই অদ্ভূত ইচ্ছা দেখে শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতার ঘোষণা সংক্রান্ত রায়ের কথা মনে পড়লো। যে ইতিহাস সংরক্ষণের কথা বলে এইসব রায় আসে, রায়ের মাধ্যমে সবার আগে সেই ইতিহাসেরই মৃত্যু ঘটে। কারণ, ইতিহাস যখন আদালতের রায় দিয়ে প্রতিষ্ঠার দরকার পড়ে, তখন দুই ধরণের গোলমাল হয়। এক. রায়ের আগেই বুঝতে পারা যায় যে, আদালতের রায় (মানে বল প্রয়োগ) ছাড়া এই নির্দিষ্ট মতামতের আর কোন উপায়-উপাত্ত-বা ভবিতব্য নেই, তাই রায়-ই তথাস্তু। যেমন শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতার ঘোষণা সংক্রান্ত রায়- এমন একটি ভাব নিয়ে হাজির হয় আমাদের মাঝে। যার দরকার ছিল না। দুই. আদালতের এখতিয়ারে এখতিয়ারবিহীন ভজঘট ঢুকে পড়ে। এইটা অনাকাঙ্ক্ষিত। সামাজিক, রাজনৈতিক ও ইতিহাস বিতর্কের মিমাংসা এবং কোর্ট কাছারির মিমাংসার বিষয় আশয়ের মধ্যে স্পষ্ট যে পার্থক্য বিদ্যমান, সেই ভাবটি আমাদের সংস্কৃতিতে এখনো অনুপস্থিত। ইতিহাসতর্কের কাইজ্যা আদালতে নিয়ে আসার ফলাফল এই হতে পারে যে, কিছু পাঠ্যবই পরিবর্তন হবে, কিন্তু এর দ্বারা ইতিহাস নির্ধারিত হবে না। এটি মনে রাখার ধৈর্য্য আমাদের রাজনীতিবিদ, উকিল, ইতিহাস গবেষক এবং আদালত- কারুই তৈরী হয় নি এখনতক।
খান-এ-সবুর সড়ক ও শাহ আজিজ অডিটোরিয়াম
আর একটি খবর, একটি রিট আবেদনের প্রেক্ষিতে, মহামান্য হাইকোর্ট খান-এ-সবুর এবং শাহ আজিজুর রহমানের নামে বিভিন্ন নামকরণ কেন অবৈধ হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেছে। যারা রিট আবেদনটি করেছেন, তাদের মধ্যে একজন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, ইতিহাস গবেষণা করেন। মুনতাসির মামুন। অপরজনের নাম শাহরিয়ার কবির। নাছোরবান্দা অধ্যাপক এবং শাহরিয়ার কবিরের এই রিট দেখে আমার হাসি পেল। কারণ এটা অবৈধ ঘোষণার বিষয় নয়, সিদ্ধান্ত নেয়ার বিষয়। শুধু খান এ সবুর বা শাহ আজিজ নয়, গোলাম আজমের নামেও যদি কোন সড়ক বা অডিটোরিয়াম করা হয়, তা আইনের দৃষ্টিতে অবৈধ হতে পারে না। কারণ, প্রথমত তারা এদেশের নাগরিক, যে অধিকারে উভয়ের একজন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীও হয়েছিলেন। দ্বিতীয়ত, যদি নাগরিক নাও হন এবং শত্রু হন, তাহলেও তাদের নামে সড়ক বা মিউজিয়াম বা অডিটোরিয়াম হতে কোন আইনি বা সংবিধানগত বাধা নেই। বরং শত্রু, যার সাথে যুদ্ধ করে পরাজিত করা হয়েছে, তার স্মৃতি ও অন্যান্য ব্যাপারগুলো অক্ষয় এবং সংরক্ষিত রাখার রেওয়াজ আছে বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে। ব্রিটিশ গোলামী শেষ হবার বহু বছর পরও, তাদের জেনারেল ও গভর্নরদের নামে বাংলাদেশ এবং ভারতে এখনো বহু ভবন, রোড ও এলাকা রয়েছে। এইসব ব্যাপার কি মুনতাসির মামুন সাহেবের অজানা? যদ্দুর জানি, সাহেবি আমল নিয়ে তার গবেষণা আছে। এই মামলাটি একজন অতি উৎসাহী আওয়ামীলীগ বা বিএনপির কর্মী করতে পারতেন। অথবা এ মামলাটির প্রয়োজনই হত না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কিছুদিন আগে যেভাবে জিয়া আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, মাওলানা ভাসানি নভোথিয়েটারের নাম পরিবর্তন করেছেন, সেইভাবেই খান এ সবুর বা শাহ আজিজের নামগুলোও পরিবর্তন করার অধিকার রাখেন, কোনরকম বৈধতা অবৈধতার গণ্ডগোল এড়িয়ে। মনে রাখতে হবে, মাওলানা ভাসানী বা জিয়া কেউ রাজাকার ছিলেন না, বরং উভয়েই জাতীয় নেতা ছিলেন। তারপরও তাদের নাম পরিবর্তনে কোনরূপ অবৈধতার প্রশ্ন আসে নাই হাইকোর্ট থেকে।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনাল
বেশ কিছুদিন আগে, গণমাধ্যমে প্রকাশিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালের প্রধান নিজামুল হক এবং বিবাদি বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর মধ্যকার কিছু গুরুত্বপূর্ণ বাহাস নজরে পড়েছিল। বাহাসটি এরকম: ট্রাইব্যুনাল-প্রধান নিজামুল হক: “মনে হচ্ছে উনি সিআরপিসি এবং সাক্ষ্য আইন মাথা থেকে বের করতে পারছেন না। উনার মতো শিক্ষিত লোকজন যদি এরকম কথা (জংলি আদালত/আইন) বলেন, তাহলে তা খুবই দুর্ভাগ্যজনক।” সাকা চৌধুরী: “একদম সত্যি। আপনারা বলছেন, ট্রাইব্যুনালের আইন অনুযায়ী সিআরপিসি ও সাক্ষ্য আইন এখানে গ্রহণযোগ্য নয়। এটা সত্যিই জংলি আইন! কিন্তু জংলি আইন হলেই যে আদালত জংলি হয়ে যাবে-এই কথা শতভাগ সঠিক না।” আদালতে অনুপস্থিত সাক্ষির জবানবন্দীকে সাক্ষী হিশেবে গ্রহণ করায় বিএনপি নেতা এম কে আনোয়ারের সমালোচনা প্রসঙ্গে এই বাহাস।
গতকালও একই আদালত এবং একই বিবাদির ঘটনা। রাষ্ট্রের প্রধান সাক্ষী বর্ষিয়ান অধ্যাপক আনিসুজ্জামান সাক্ষ্য হিশেবে বিভিন্ন শ্রুত ঘটনার কথা বলেন (যেমন, গ্রামবাসী তাকে জানায়, সালাউদ্দিন কাদেরই পাকিস্তানি সেনাদের কুণ্ডেশ্বরীতে নিয়ে যায়। তার ইঙ্গিতেই গুলি করে হত্যা করা হয় নূতন চন্দ্রকে। ফিরে যাওয়ার সময় সালাউদ্দিন কাদের নিজেও গুলি করেন/ বিডিনিউজ )। এ সময় আসামীপক্ষের আইনজীবী প্রফেসর আনিসুজ্জামানকে জেরা শুরু করলে, ট্রাইবুনাল প্রধান এই বলে থামিয়ে দেন যে, সাক্ষীকে বিচারিক আদালতের মত জেরা এই আদালতে করা যাবে না (এই লাইনটি এখন দেখি বিডিনিউজের সংবাদ থেকে হাওয়া হয়ে গেছে)। বিচারিক আদালতের মত জেরা চলবে না, সিআরপিসি, সাক্ষ্য আইন ভুলে যেতে হবে, কারণ, প্রচলিত আইনে কে কার থেকে কী শুনেছেন এইসব ছাইপাশের সাক্ষমূল্য নেই। ইত্যাদি ইত্যাদি। মনে হল এটি বেশ রহস্যপূর্ণ আদালত। এবং এর বিচারকগণ আসামীপক্ষের ব্যাপারে আরো রহস্যপূর্ণভাবে অধৈর্য্য।
সর্বশেষ, আইনজীবীদের অশিক্ষিত ও অভদ্র ভাষা
বিভিন্ন সময়ে গণমাধ্যমে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালের আইনজীবীদের কথা-বার্তা ও বিবৃতিসমূহ লক্ষ করেছি। এবং অন্যান্য আদালতের আইনজীবীদেরকেও। সব সময়ই দেখি, রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ কর্মকর্তা এটর্নি জেনারেল থেকে শুরু করে সাধারণ আইনজীবীরা প্রায় সকলেই অভদ্রের মত বিবাদী পক্ষকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য সহকারে 'সে' সম্বোধনে কথা বলেন। কালকে দেখলাম অদ্ভূত ঘটনা। সালাউদ্দীন কাদের চৌধুরী সাহেবের আইনজীবী ফখরুল ইসলাম সাহেব তার নিজের মক্কেল বিষয়ে কথা বলছেন 'সে' সম্বোধন দিয়ে। এবং প্রফেসর আনিসুজ্জামান সম্পর্কে মিডিয়াকে বলছেন, 'সে একজন মিথ্যুক। এর ওর কাছ থেকে শোনা কথা সাক্ষ্য দিয়ে বেড়াচ্ছে।' এঁরা কি এতটাই অশিক্ষিত, যে, 'সে' এবং তিনির ব্যাবহার সম্পর্কে জানেন না, নাকি ইচ্ছে করে অসম্মান করেন?
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই মে, ২০১২ রাত ১১:৩৬