তখন আমি মাত্র মাস্টার্সের পাট চুকিয়ে ফেলেছি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড বায়োটেকনোলজি নামের এক খটোমটো বিষয়ের হাত থেকে মুক্তি পেয়ে আমি তখন খাঁচা ছাড়া পাখি। মুশকিল হচ্ছে, বহুদিন বন্দী থাকার পরে খাঁচা খুলে দিলেও গাধা টাইপ পাখিটা ঠিকই খাঁচার চারপাশ ঘুরঘুর করতে থাকে। একই কারণে আমি ক্যাম্পাসের আশে পাশে ঘুরঘুর করে বেড়াচ্ছি। পড়াশোনার বাইরের এক্সট্রা কারিকুলার ব্যাপারে বরাবরই আমার ভীষন আগ্রহ। সেই আগ্রহ আর টিএসসিতে বেলা-অবেলায় ঘুরে বেড়ানোর অজুহাতে আপাতত বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিউক অফ এডিনবার্গ এ্যাওয়ার্ড প্রোগ্রামের অধীনে ক্যাম্পাসের ডে কেয়ার সেন্টারে স্বেচ্ছাসেবকের কাজ করছি। এখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বাচ্চাকাচ্চারা থাকে। নাম ছায়ানীড়। ছোটবেলায় আমি নিজেও এই ছায়ানীড়ে ছিলাম। জীবনের একটা আনন্দঘন সময় কেটেছে এখানে। আজকে মজার ঘটনা ঘটেছে। নিলয়ের বয়স তিন কি সাড়ে তিন। তার বেজায় মন খারাপ। অনেক চাপাচাপি করেও কারণ উদ্ঘাটন করা গেল না। তখন বাঙ্গালীর ছেলের উপর শেষ অস্ত্র হিসেবে চিরাচরিত চালাকিটা করতেই হলো।
বলা হল “নিলয়, বিয়ে করবে?”।
সাথে সাথে নিলয়ের অন্ধকার মুখ ষাট ওয়াটের বাল্বের মত জ্বলে উঠলো। “হ্যাঁ”।
তখন জানতে চাওয়া হল, “বিয়ে যে করবে, বউ আনবে কোত্থেকে?”
এমনিতেই তার জীবনের সবচেয়ে বড় খায়েশ আজকের এই দুর্বল মুহূর্তে ধরা পড়ে গেছে- এই লজ্জাতেই সে বাঁচে না। তার উপর বউ যোগাড় করার গুরুদায়িত্বও ঘাড়ে এসে পড়ল। প্রায় শোনা যায় না এমন অনুচ্চ স্বরে ভীষণ লাজুক ভঙ্গিতে সে বলল, “নিউমার্কেট থেকে কিনে আনব।”
যিনি প্রশ্ন করছেন, তিনি এতক্ষণে মজা পেয়ে গেছেন। খুঁটিয়ে খুটিয়ে জানতে চাইলেন, “ওরা তো তোমাকে এমনি এমনি বউ দিয়ে দিবে না। কি করবে তাহলে?”
“আমি টাকা দিব তো ওদেরকে। দেড়শ টাকায় একটা বউ হবে না?”
এইখানে জাহানারা আন্টি আর হেসে বাঁচেন না। আন্টি ছায়ানীড়ের একজন শিক্ষক। যাইহোক, নিলয় খুব অপ্রস্তুত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। দেড়শ টাকা দিয়ে বউ কিনতে চাওয়ার ভেতর সে কোন অসংগতি খুঁজে পাচ্ছে না। তার ভাবভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে দামটা সে অনেক বাড়িয়েই বলেছে। আন্টি কোনরকমে হাসি চেপে আবারো জিজ্ঞেস করলেন, “খালি বউ কিনলেই হবে? বউয়ের জন্যে গয়না কিনতে হবে না?”
উত্তরদাতা একটু ভেবে উত্তর দিলো, “আম্মুর কাছে থেকে তাহলে তো দেড়শ’র চেয়ে আরেকটু বেশি নিতে হবে। আচ্ছা আমি কালকে টাকা নিয়ে আসব। টিচার তুমি আমার সাথে বউ কিনতে নিউমার্কেটে যেও কিন্তু।” এই বলে নিলয় খুব ফুরফুরে মন নিয়ে লেগো সেট দিয়ে খেলতে বসে গেল। ওদিকে আর আমরা বড়রা হেসে কুটিকুটি।
ঘটনা এখানেই শেষ না। একটু পর কয়েকজন মিলে হাড়িপাতিল খেলছে। নিলয়ও আছে তাদের সাথে। অনেকগুলি মেয়ের ভেতর সে আর অতুল ছেলে। তাদেরকে তাই বাজারে পাঠিয়ে দেয়া হল পোলাওয়ের চাল আর মুরগী আনতে। আমি খুব আগ্রহ নিয়ে তাদের কর্মকান্ড দেখছি। নিলয় বাজার এনেই কই যেন দৌড় দিল। আমি খপ করে হাত ধরে জিজ্ঞেস করলাম, কই যাও? “ছাড়ো, ছাড়ো, আপিসে যাই, আমাকে গয়নাগাটি কিনতে হবে তো।” আমি হতভম্ব। এই এক ফোঁটা ছেলের অন্তরাত্মা এখন বউ নামক এক মহার্ঘ বস্তুর চিন্তায় আচ্ছন্ন। শুধু মায়ের উপর তার বিশেষ ভরসা নাই। তার কাছে যদি টাকা না পাওয়া যায়? এই ভয় থেকে এখন সে আফিস করে কামাই রোজগার করবে বলে ঠিক করেছে। বউ কেনা কি সহজ কথা! পুরো ব্যাপারটাকে সে খুব সিরিয়াসলি নিয়ে নিয়েছে। আমি তার হাত ছেড়ে দিলাম। এই আনুবীক্ষনিক মানবের সুগভীর বউপ্রীতিতে আমি মুগ্ধ। কিন্তু কালকে যদি সে সত্যি সত্যি বউ কিনতে নিউমার্কেটে যেতে চায়, তো মুশকিলে পরে যাব। তখন ভগ্নহৃদয় ক্ষুদে বরের কান্নাকাটি কি দিয়ে থামাবো তাই ভাবছি।
- ড. রিম সাবরিনা জাহান সরকার: মিউনিখ, জার্মানী
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই জুন, ২০১৮ দুপুর ১:০৪