somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আমরা সবাই আঠারো

০৫ ই আগস্ট, ২০১৮ সকাল ৭:৩৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

ইচ্ছা আর অনিচ্ছার মাঝে একটা জায়গা আছে। জায়গাটার নাম নিনিচ্ছা। এটা অষ্টম শ্রেণির বাংলা শিক্ষক আসলাম স্যারের নিজের দেয়া নাম। আসলাম স্যার এখন নিনিচ্ছার সাথে ব্ল্যাক বোর্ডে বিক্ষিপ্ত হাতে চক চালাচ্ছেন। কিন্তু মন পড়ে আছে ঝিগাতলায় আর সাইন্স ল্যাবের মোড়ে। কদিন যাবত নিরাপদ সড়কের দাবিতে রাস্তায় নামা বাচ্চা ছেলেপেলের উপর নাকি যা তা করা হচ্ছে। মারপিট-ধরপাকড় কোন কিছুই নাকি বাদ পড়ছে না। এর মাঝে কি আর ক্লাসে পড়াতে ভালো লাগে, নাকি ছাত্রদেরই বা পড়তে ভালো লাগে। যেই পড়াশোনার জন্যে এত সময়, শ্রম আর অর্থের ব্যয়, সেই ছাত্রদের তো আসলে কোনো ভবিষ্যৎ নেই। ফট করে একে্কটা বাস এসে এদের পিষে পিষে মেরে যাচ্ছে, আবার সেটা নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ বা সামান্য ট্যাঁ ফোঁ করলে অদ্ভূত জুজুর দল এসে শুধু ভয় না, একেবারে জানে মেরে ফেলার মত কান্ড করছে। আসলাম স্যার চক নামিয়ে বিষন্ন দৃষ্টিতে ছাত্রদের দিকে তাকালেন। ওদের চোখেমুখে আজকে চাপা উত্তেজনা। ক্লাসের অর্ধেক সারি খালি। কারণ ওরা আজকে রাস্তায়। শূন্য বেঞ্চগুলো যেন বাকি ছাত্রদের আর আসলাম স্যারকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে উপহাস করছে। এমন সময় দপ্তরি কালিপদ এসে দরজার বাইরে টোকা দিল। বলল, হেডমিস্ট্রেস জোবেদা খানম নাকি সব শিক্ষককে জরুরী মিটিঙ্গে ডেকেছেন। পরের পিরিয়ডে কোন ক্লাস হবে না। মিটিং হবে। আসলাম স্যার চিন্তিতমুখে ঘড়ির দিকে তাকালেন। ক্লাস শেষ হবার পাঁচ মিনিট বাকি। কেউ যেন ক্লাসের বাইরে এক পাও না দেয়, আর দিলে ঠ্যাং ভেঙে বাবা-মার হাতে ধরিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দেয়া হবে-এরকম একটা কলিজা কাঁপানো হুঙ্কার দিয়ে কালিপদের সাথে বেরিয়ে গেলেন।

সিড়িতে ক্লাস নাইন-টেনের ফিজিক্সের বর্মন স্যারের সাথে দেখা। তাকে কিছুটা চিন্তিত দেখাচ্ছে। আসলাম স্যার প্রশ্ন করতেই উত্তর দিলেন যে আজকে চল্লিশ জনের ক্লাসে ছাত্র এসেছে মোটে তেরো জন। বাকিরা নাকি এখন ধানমন্ডির রাস্তায় বসে আছে। সেখানে এইট আর টেনের ছেলেমেয়েরাও আছে। প্রচন্ড অনিচ্ছায় ক্লাসে আসা ওই তেরো জনের কাছ থেকে পাওয়া এই খবর। তাই ভুল হবার কোন কারণ নেই। সিড়ি ভেঙে পাঁচ তলায় থেকে নিচে নামতে দেখা গেলো জোবেদা খানমের অফিসে সব শিক্ষক গোল করে বসে আছেন। সবার ভেতরে কেমন যেন একটা অস্ফুট অস্বস্তি। জোবেদা ম্যাডাম স্বল্পভাষী। কিন্তু তারই ভেতর রাশভারী আজদাহা এবং বেপরোয়া প্রকৃতির মহিলা। সব শিক্ষক-শিক্ষিকা তাকে তাঁকে এক ধরনের ভয় মেশানো শ্রদ্ধা করে। সত্যি বলতে, ভয়ের অংশটাই বেশি। গত দশ বছর ধরে এই স্কুলের হেডমিস্ট্রেস হিসেবে আছেন। আর গত নয় বছর ধরে এসএসসি তে সেরা ফল দেখিয়ে ঢাকার উদ্দীপন উচ্চ বিদ্যালয় সব পত্রিকার শিরোনাম হয়ে আসছে। এটা জোবেদা খানমকে ছাড়া সম্ভব ছিল না। পিনপতন নীরবতায় আসলাম স্যারের উশখুশ লাগছে। কি ব্যাপার, জাদরেল জোবেদা কথা বলছে না কেনো। উদ্দীপন স্কুলের শিক্ষকরা আড়ালে তাঁকে এইনামে ডাকতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন।

অবশেষে নাটকীয় বিরতিটা ভেঙে জাদরেল জোবেদা গলা খাঁকরি দিলেন। বললেন, মাফ করবেন, আপনাদেরকে ক্লাসের মাঝখান থেকে ডেকে পাঠিয়েছি। কারন, জরুরী কিছু কথা আছে আপনাদের সাথে। আপনারা কেউ কেউ নিশ্চয়ই এরই মাঝে শুনেছেন যে, ক্লাস এইট, নাইন আর টেনের ছাত্রছাত্রীরা অনেকে গতকাল থেকে স্কুলে আসছে না ঠিক মত। আপনারা কি জানেন তারা কেন, কোথায়, কি করছে? এক নিশ্বাসে কথাগুলো বলে জোবেদা ম্যাডাম একটা দম নেবার জন্যে থামলেন। আসলাম স্যার, বর্মন স্যারসহ সবার মেরুদন্ড দিয়ে ভয়ের একটা শীতল স্রোত বয়ে গেলো। আজকে চাকরিটাই বোধহয় গেলো। জোবেদা ম্যাডাম আবার বলা শুরু করলেন, আমি খোঁজ নিয়ে জেনেছি, আজকে আমাদের ছেলেরা ধানমন্ডি এলাকায় অন্য স্কুলের ছাত্রদের সাথে যোগ দিয়ে রাস্তায় বসে আছে। ওরা এখন রাস্তায়, ফুটপাথে, বুঝতে পারছেন ব্যাপারটা?? আপনারা কেন বলেন নি আমাকে এই কথা, কেন আমাকে এটা বাইরে থেকে শুনতে হল? চুপ কেন আপনারা, বলেন?! শিক্ষকদের ভেতর একটা চাঁপা শোরগোল উঠল। বয়োজ্যেষ্ঠ্য শিক্ষক তালুকদার স্যার বোধহয় কিছু বলার জন্যে মুখ খুললেন। বলতে চাইছিলেন যে, ছাত্রদের তারাও যোগ দিতে চান। শিক্ষকদের ভেতর গতকাল টিফিন পিড়িয়ডে এ নিয়ে একদফা আলোচনা হয়ে গিয়েছে। কিন্তু জোবেদা ম্যাডাম অর্ডার, অর্ডার, অর্ডার বলার ভঙ্গীতে টেবিলে চাপড়ে মেরে তালুকদার স্যারকে থামিয়ে দিলেন। সবাই ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে নীরব হয়ে গেলে তিনি আবার বলতে শুরু করলেন, সবাই মন দিয়ে আর কান খুলে শোনেন। আমি একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আমিসহ আমরা সব শিক্ষক আজকে ধানমন্ডি যাবো। জোরাজুরি নাই, কিন্তু বিবেক থাকলে আপনারা যাবেন। আর ক্লাস এইট থেকে টেনের ছেলেমেয়েরা যারা যারা যেতে চায় যাবে আমাদের সাথে। আমরাই ওদের সাথে যাবো। এটা তো ওদেরই আন্দোলন। আবার সন্ধ্যা নামলে আমরা ওদের বাসায় পৌঁছে দিব। ওদের দাবি আজকে থেকে আমাদেরও দাবি। আর সেভেন পর্যন্ত ক্লাসের বাচ্চাদের ছুটি দিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দিন। পড়াশোনার দরকার নাই। আগে জান। যেই রাস্তা দিয়ে স্কুলে আসে বাচ্চারা, আগে সেই রাস্তাগুলি নিরাপদ হোক। তারপর ক্লাস আর পরীক্ষা। তখন আবার পড়াবো ওদের। কি, বোঝা গেলো আমার কথা?

কিছুক্ষন পরের দৃশ্য। বুড়িগঙ্গা পাড়ের উদ্দীপন স্কুল থেকে হইহই করে শখানেক ছেলেপেলে বেড়িয়ে আসছে। বাচ্চাগুলির একদম পেছনের সারিতে অর্ধেক শিক্ষক আর সামনের সারিতে বাকি অর্ধেক শিক্ষক। কালকের মত অতর্কিতে হামলা হলে যেন তাদের গায়ে আগে আঘাত লাগে, কিন্তু ছেলেমেয়েদের গায়ে যেন আঁচড়ও না পড়ে, তাই এই ব্যবস্থা। সামনের সারিতে আসলাম স্যার আর বর্মন স্যারকেও দেখা যাচ্ছে। তাঁরা অবাক বিস্ময়ে জোবেদা ম্যাডামের দুইপাশে হাঁটছেন। এই ভদ্রমহিলাকে আর জাঁদরেল বলে মনে হচ্ছে না। মনে হচ্ছে যেন এক অন্য ধাতুতে গড়া বজ্রমানবী, যার গা থেকে সত্য আর ন্যায়ের আলো ঠিকরে পড়ছে।

ঠিক একই সময়ে রাজশাহী জেলা স্কুলের প্রধান শিক্ষক হোসেন আলী তার সব শিক্ষকদের আর ছাত্রদের নিয়ে এগোতে থাকলেন শহরের প্রানকেন্দ্র সাহেব বাজারের দিকে। ওদিকে চট্টগ্রামের হালিশহরের রাস্তা টইটুম্বুর হয়ে গেছে শহরের যে কয়টা স্কুল কলেজ আছে সেগুলোর ছাত্র-শিক্ষক দিয়ে। বরিশাল, কক্সবাজার, কুষ্টিয়া, টেকনাফ থেকে তেতুলিয়ার সমস্ত স্কুলে কলেজে বড় বড় তালা ঝুলিয়ে জোবেদা খানম আর হোসেন আলীরা তাদের সন্তানতুল্য অবিশ্বাস্য তারুণ্যে টগবগ ছেলেমেয়েগুলোকে নিয়ে বাংলাদেশের সমস্ত সড়ক ছেয়ে ফেলতে লাগলেন।

আস্তে আস্তে বেলা বাড়ার সাথে সাথে আরো মানুষ রাস্তায় নেমে আসতে থাকলো। ছাত্র-শিক্ষকের দলগুলো ভারি হয়ে উঠতে থাকল অফিস-আদালত, কিংবা চুলার রান্না ফেলে আসা বাবা-মার ভিড়ে। ভিড়টা আরো বাড়লো রাস্তার পাশে রিকশা দাঁড় করিয়ে রাখা রিক্সাওয়ালাদের সতর্ক উপস্থিতিতে। ভুয়া লাইসেন্স ফিরিয়ে দিতে আসা কোন এক বিবেকতাড়িত বাস ড্রাইভারের পদচারনায়। শহর-জেলা-বন্দরের বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল, টেকনিক্যালের ছাত্ররাও আসছে। আর পাশ করে যাওয়া যে সব হতাশ তরুণ চাকরি না পেয়ে উদ্যমী উদ্যোক্তা হয়ে উঠেছিলো, তারা আজকে তাদের উদ্যোগগুলো সযত্নে তাকে তুলে রেখে উদ্যমের সবটা সাথে নিয়ে এসে দাঁড়িয়েছে মাঝ রাস্তায়। ছাত্রদের সাথে। ভিড়ের আকার বেড়েই চলেছে আলোর গতিতে। দুই হাজার আঠারোর আগস্টের এই ঘোরলাগা সকালে এই দেশের বুকে আরো একবার সুকান্তের আঠারো নেমে এসেছে। আজকে আমরা সবাই আঠারো। আমাদের একটাই দাবী, একটা নিরাপদ পথের আশ্বাস চাই।

-রিম সাবরিনা জাহান সরকার; ০৫.০৮.২০১৮

সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই আগস্ট, ২০১৮ সকাল ৭:৪১
১১টি মন্তব্য ১০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। মুক্তিযোদ্ধা

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:২১



মুক্তিযুদ্ধের সঠিক তালিকা প্রণয়ন ও ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা প্রসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেছেন, ‘দেশের প্রতিটি উপজেলা পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধা যাচাই বাছাই কমিটি রয়েছে। তারা স্থানীয়ভাবে যাচাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতীয় রাজাকাররা বাংলাদেশর উৎসব গুলোকে সনাতানাইজেশনের চেষ্টা করছে কেন?

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:৪৯



সম্প্রতি প্রতিবছর ঈদ, ১লা বৈশাখ, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, শহীদ দিবস এলে জঙ্গি রাজাকাররা হাউকাউ করে কেন? শিরোনামে মোহাম্মদ গোফরানের একটি লেখা চোখে পড়েছে, যে পোস্টে তিনি... ...বাকিটুকু পড়ুন

চুরি করাটা প্রফেসরদেরই ভালো মানায়

লিখেছেন হাসান মাহবুব, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৫৩


অত্র অঞ্চলে প্রতিটা সিভিতে আপনারা একটা কথা লেখা দেখবেন, যে আবেদনকারী ব্যক্তির বিশেষ গুণ হলো “সততা ও কঠোর পরিশ্রম”। এর মানে তারা বুঝাতে চায় যে তারা টাকা পয়সা চুরি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঘুষের ধর্ম নাই

লিখেছেন প্রামানিক, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:৫৫


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

মুসলমানে শুকর খায় না
হিন্দু খায় না গাই
সবাই মিলেই সুদ, ঘুষ খায়
সেথায় বিভেদ নাই।

হিন্দু বলে জয় শ্র্রীরাম
মুসলিম আল্লাহ রসুল
হারাম খেয়েই ধর্ম করে
অন্যের ধরে ভুল।

পানি বললে জাত থাকে না
ঘুষ... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইরান-ইজরায়েল দ্বৈরথঃ পানি কতোদূর গড়াবে??

লিখেছেন ভুয়া মফিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:২৬



সারা বিশ্বের খবরাখবর যারা রাখে, তাদের সবাই মোটামুটি জানে যে গত পহেলা এপ্রিল ইজরায়েল ইরানকে ''এপ্রিল ফুল'' দিবসের উপহার দেয়ার নিমিত্তে সিরিয়ায় অবস্থিত ইরানের কনস্যুলেট ভবনে বিমান হামলা চালায়।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×