somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

মৎস্য মস্তিষ্ক

২২ শে আগস্ট, ২০১৮ রাত ১২:১৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



দুষ্ট লোকে বলে মাছ নাকি একটা হাবাগোবা প্রাণী। তার নাকি কিছুই মনে থাকে না। সেকেন্ডের ভেতর ভুলে যাওয়াই স্বভাব। তাই নাকি তাকে পানির ভেতর বিরতিহীন এলোমেলো সাঁতরাতে দেখা যায়। আচ্ছা, আমিও তো কিছু মনে রাখতে পারি না। আমি কি তাহলে মৎস্য প্রজাতির কাছাকাছি? মাথার সিটি স্ক্যান করলে দেখা যাবে খুলির এক কোনে বহুদিন ফ্রিজে পড়ে থাকা শুটকে যাওয়া, টোপ খাওয়া বাতাবিলেবু আকারের কি যেন একটা পড়ে আছে। ঘিলু বলতে সর্বসাকুল্যে সেটুকুই। কি ভয়ানক! নিজেকে নিয়ে আজকাল কেমন যেন একটা ধূসর সন্দেহ হয়। তারপরও মনকে স্বান্তনা দেই এই বলে যে মনে রাখার ক্ষমতা আর বুদ্ধি তো আর এক বস্তু না। স্মৃতিশক্তি ''দুব্বল'' হলে কি আসে যায়। বুদ্ধিতে তো হলেও হতে পারি শিয়াল পন্ডিত। কিছুই বলা যায় না।

স্মৃতিগত দিক দিয়ে মাছের কাছাকাছি কি না জানি না, তবে আপাতত ডাংগায় তোলা কই মাছের মত অবস্থা। নতুন চাকরি। খাবি খাচ্ছি। সপ্তাহ নাম্বার দুই চলছে। অফিস বিল্ডিঙের কোন দরজা দিয়ে ঢুকবো আর বের হবো, সেটাও এখনো আয়ত্তে আসে নি। আর প্রায় তিরিশ দেশের একশো পঞ্চান্নো জন সহকর্মীর নাম-চেহারা মনে রাখা তো বহু দিনের মামলা। তার উপর আমার সমস্যা আছে; কোন মানুষকে টানা সপ্তাহ তিনেক না দেখলে তার চেহারা মনে থাকে না। তাই এক সকালে অফিসে ঢুকে ইরানী ফারজাদকে আফগানী সাঈদ ভেবে সরল মনে বললাম, "হ্যালো সাঈদ, মর্নিং"। নকল সাঈদও খুব সহজভাবে উত্তর দিলো, "এই তো ভালো, তুমি কেমন, সাবরিনা?"। তার তিন দিন পর কফি বানাতে অফিসের কিচেনে ঢুকে দুজনকে একসাথে গল্প করতে দেখে বুঝতে পারলাম যে আমি তাদের নাম-চেহারা উল্টে ফেলেছি। এতখানি ভুল করা কিভাবে সম্ভব, মাথায় আসলো না। সাঈদ আর ফারজাদের উচ্চতায় বিশাল পার্থক্য। তার উপর একজন শ্যামলা, আরেকজন ফর্সা। সবচেয়ে বড় ব্যাপার হল সাঈদের ব্যাকব্রাশ করা চুলের সাথে একটা কেতাদুরস্ত ঝুঁটিও আছে। এত ফারাকের পরও আমার মনে হত এরা দুইজন একই লোক আর তার নাম সাঈদ ছাড়া আর কিছুই হতে পারে না।

নিজের স্মৃতিশক্তির শক্তিমত্তার উপর সন্দেহ জন্মানো শুরু করলো যখন হাতেগোণা জনাকয়েক ভারতীয় পুরুষ সহকর্মীদের সবাইকে নির্বিচারে ''ভিনায়'' (বাংলা উচ্চারণে ''বিনয়'' আর কি) বলে ডাকা শুরু করলাম। অথচ তাদের নাম ভিনায়, ভিনোদ আর অশ্বিনী। ওদিকে পর্তুগীজ এক কলিগ যার পূর্বপুরুষ খুব সম্ভবত ভারতীয় হবে, তাকেও ভিনায় বলে ডাকলাম বেশ কিছুদিন। তারপর একদিন সে অতিষ্ঠ হয়ে এসে বলল, ''আমার নাম কিন্তু রিকার্ডো, তুমি বোধহয় কোনো ইন্ডিয়ান কলিগের সাথে গুলিয়ে ফেলছো।'' খুব লজ্জিত হয়ে দুঃখ প্রকাশ করলাম। উত্তরে ভালো মানুষ রিকার্ডো এক গাল হেসে তার অফিসে ফেরত গেলো।

আরেক সহকর্মী অ্যাংলো ইন্ডিয়ান সেবাস্টিয়ানকে দিনকয়েক ভুল করে শিবেন বলে ডেকেছি। একদিন করিডোরে দেখা হলে বললাম, আরে শিবেন, কেমন আছো? এই বুধবারে লাঞ্চ করবে নাকি একসাথে? সে ভড়কে গিয়ে বলে বসলো, শিবেনটা কে? আমি তো সেবিন, সেবাস্টিয়ান থেকে সেবিন। আমি যথারীতি থতমত খেয়ে চুপসে গেলাম। কোথায় অ্যাংলো ইন্ডিয়ানের বংশধর সেবাস্টিয়ান হোসে ওরফে সেবিন আর কোথায় শিবের সেবায়েত শিবেন!

নাম মনে রাখতে না পারার এই রোগ আমার বহু পুরানো। তখন মাত্র পিএইচডিতে ঢুকেছি। একই ল্যাবে মাস্টার্সের থিসিস করতে এসেছে এক চাইনিজ ছেলে। আমার কাজে সে টুকটাক বেশ সাহায্য-টাহায্য করে। আরো একটা চাইনিজ ছাত্র আছে- পাশের ল্যাবের। আমার মত পিএইচডি করতে এসেছে। মিউনিখ এসে রিসার্চ সেন্টারের যেই ডর্মে উঠেছি, সেও সেখানে উঠেছে। আমি তিন তলায় থাকি, আর সে থাকে চার তলায়। প্রায়ই আমরা ডর্মের কাছের স্টেশন থেকে এক সাথে বাস-ট্রেন ধরি। একথা সেকথায় বেশ কেটে যায় পথটুকু।

মুশকিলটা হল মাস দুয়েক পর। এক সকালে ল্যাবে গিয়েছি। দুই চাইনিজও মহা ব্যস্ত যে যার এক্সপেরিমেন্ট নিয়ে। আমি হন্যে হয়ে সারা ল্যাবে কি যেন একটা খুঁজছি। কিছুতেই না পেয়ে শেষে নিরুপায় হয়ে ডাকলাম, ''এই চ্যাং, এদিকে একটু আসবে, আমি আমার স্লাইডগুলো আর খুঁজে পাচ্ছি না। কালকে সন্ধ্যায় এই টেবিলের উপর রেখেছিলাম।'' আমার কথা মাটিতে পড়ার সময় পেল না। দুই চাইনিজ কাজ ফেলে দৌড়ে চলে এল। আমি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বললাম, ''এক জন আসলেই তো চলত।'' উত্তরে দুই চাইনিজ ফিঁচেল একটা হাসি দিয়ে বলল, ''কেমন করে বুঝবো কোন চ্যাং-কে ডাকলে এখন?" আমি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বললাম, ''তোমাদের দুইজনের নামই কি চ্যাং নাকি? কি আজব!'' উত্তরে তারা একজন আরেকজনকে কনুইয়ের হালকা গুঁতো দিয়ে একটা অপদস্থামূলক খ্যাকখ্যাক হাসি হেসে বলে উঠল, ''গত দুই মাস ধরে তুমি আমাদের দুইজনকেই চ্যাং বলে ডাকছো। কিন্তু আমাদের কারো নামই তো চ্যাং না। আমি হচ্ছি গিয়ে জি আর ও হল শান-জ্যে, আমাদের পাশের ল্যাবের ছেলে।'' আমি মৃদু প্রতিবাদ করে বলার চেষ্টা করলাম, ''তাহলে তোমরা আমাকে ভুলটা আগে ধরিয়ে দিলে না কেন? চ্যাং না হয়েও চ্যাং ব্যাঙ সেজে থাকার মানে কি?'' জি খুব বিভ্রান্ত হয়ে জিজ্ঞেস করল, ''ব্যাঙ কি? নাকি তুমি আমাদের একজনকে চ্যাং আর আরেকজনকে ব্যাঙ বলে ডাকতে? আচ্ছা, ব্যাঙ আবার কোনো গালি না তো?'' আমি তাড়াতাড়ি কথা ঘুরিয়ে বলি, ''না না, গালি টালি না, কথার কথা আর কি। আর তোমরা কিছু মনে করো না। আমি আসলে নাম মনে রাখার ব্যাপারে একটু কাঁচা, বুঝলে।'' শান-জ্যে এবার মাথা নেড়ে হাসতে হাসতে বলল, ''কাঁচা শুধু তুমিই না। আমার সুপারভাইজারও আমাকে চ্যাং নামেই ডেকেছে পুরো একটা মাস। আর তোমাকে আমরা কম হলেও বার দশেকবার নিজেদের নাম বলেছি। কিন্তু কাজ হয় নি। যাহোক, ব্যাপার না, এটা আমরা কৌতুক হিসেবেই নিয়েছি। আর তুমি চ্যাং বলে ডাকলে আমাদের না আসলে ভালোই লাগে।'' এই বলে দুই চ্যাং দুর্বোধ্য একটা চোখটিপি দিয়ে উল্টা ঘুরে হেলেদুলে আস্তে ধীরে যে যার কাজে ফিরে গেলো। আমি কেমন বোকা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলাম। কি যেন খুঁজছিলাম, এখন আর মনে পড়ছে না। আমি আমার এই মাছের মস্তিষ্ক নিয়ে কি করবো ভেবে পেলাম না।

-ডঃ রিম সাবরিনা জাহান সরকার
মিউনিখ, জার্মানি
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে আগস্ট, ২০১৮ ভোর ৫:৪৫
৭টি মন্তব্য ৮টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ইসরায়েল

লিখেছেন সাইফুলসাইফসাই, ১৬ ই এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১০:৪৮

ইসরায়েল
সাইফুল ইসলাম সাঈফ

এ মাকে হত্যা করেছে ইসরায়েল
এ বাবাকে হত্যা করেছে ইসরায়েল
নিরীহ শিশুদের হত্যা করেছে ইসরায়েল
এই বৃ্দ্ধ-বৃদ্ধাদের হত্যা করেছে ইসরায়েল
এ ভাইক হত্যা করেছে ইসরায়েল
এ বোনকে হত্যা করেছে ইসরায়েল
তারা মানুষ, এরাও মানুষ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

গ্রামের রঙিন চাঁদ

লিখেছেন আলমগীর সরকার লিটন, ১৬ ই এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১২


গ্রামের ছায়া মায়া আদর সোহাগ
এক কুয়া জল বির্সজন দিয়ে আবার
ফিরলাম ইট পাথর শহরে কিন্তু দূরত্বের
চাঁদটা সঙ্গেই রইল- যত স্মৃতি অমলিন;
সোনালি সূর্যের সাথে শুধু কথাকোপন
গ্রাম আর শহরের ধূলি... ...বাকিটুকু পড়ুন

পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহার।

লিখেছেন নাহল তরকারি, ১৬ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:১৭



পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহারের ধ্বংসাবশেষঃ
পালবংশের দ্বিতীয় রাজা শ্রী ধর্মপালদেব অষ্টম শতকের শেষের দিকে বা নবম শতকে এই বিহার তৈরি করছিলেন।১৮৭৯ সালে স্যার কানিংহাম এই বিশাল কীর্তি আবিষ্কার করেন।... ...বাকিটুকু পড়ুন

পরবাসী ঈদ

লিখেছেন মঞ্জুর চৌধুরী, ১৬ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:২৩

আমার বাচ্চারা সকাল থেকেই আনন্দে আত্মহারা। আজ "ঈদ!" ঈদের আনন্দের চাইতে বড় আনন্দ হচ্ছে ওদেরকে স্কুলে যেতে হচ্ছে না। সপ্তাহের মাঝে ঈদ হলে এই একটা সুবিধা ওরা পায়, বাড়তি ছুটি!... ...বাকিটুকু পড়ুন

×