বিচিত্র লাগছে। বাস ছুটে চলছে। আমরা যাচ্ছি মিউনিখ থেকে বেশ খানিকটা দূরে সিওন নামের একটা জায়গায়। সেখানে আমাদের গবেষনা কেন্দ্রের বার্ষিক কনফারেন্স। চারপাশ ধবধবে সাদা। গাছপালা রাস্তাঘাট কোনটা কি কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। আমি আগামী কয়েক ঘন্টা বসে থেকে হদ্দ হয়ে যাওয়া থেকে বাঁচতে সাথে থাকা ল্যাপটপে ডাইরি লেখার বাহানায় ইতং বিতং লিখে যাচ্ছি। পাশে বসা চাইনিজ কলিগ শেন জ্যো খুব আগ্রহ নিয়ে ল্যাপটপের মনিটরের দিকে তাকিয়ে আছে। তার কাছে নাকি বাংলা ফন্ট খুব ইন্টারেস্টিং লাগছে। সে এক টুকরা কাগজ নিয়ে তার নামের বানান লিখে নিয়েছে আমার কাছ থেকে। এখন বার বার বাংলায় নামটা লিখে লিখে প্র্যাকটিস করছে। কি আজব!
গরম লাগছে। এই শীতের মধ্যেও। কিন্তু ওদিকে হাত আবার বরফের মত ঠান্ডা। বাসের ভেতরটাও ঠান্ডা। এসি ছেড়ে বসে আছে জার্মানগুলি। বাস ধরতে ব্যাপক কাঠখড় পুড়াতে হয়েছে। ভোর পাঁচটায় উঠলাম মোবাইলে সেট করা এ্যালার্মের অত্যাচারে। গরম একটা শাওয়ার নিলাম। চুলে ভালো করে শ্যাম্পু দিলাম। গত কয়েকদিন সময় হয়ে ওঠে নি। কোনমতে হাতের কাছে যা যা কাপড় পেলাম পড়ে নিয়ে এক কাপ ক্যাপাচিনো গিলে বের হয়ে গেলাম। চারিদিক ঘুটঘুটে অন্ধকার। এক হাটু বরফ। মেজাজটা খিচড়ে গেল। খুব খারাপ একটা গালি আসল মুখে। ঢোক গিলে গালিটা গিলে ফেললাম। অনেকখানি হেঁটে ট্রেন ধরলাম। হেঁটে মানে কি, রীতিমত দৌড় দিয়ে গলদ্ঘর্ম হয়ে ট্রেন স্টেশন পর্যন্ত আসলাম। বাহ! ট্রেন আসবে ১৫ মিনিট পর। কি ভালো লাগলো বলে বোঝাতে পারবো না। মনে হল স্টেশনের বেঞ্চটা তুলে অনেক দূরে ছুড়ে ফেলি। ইদানীং মেজাজ টেজাজ কেমন পুরুষালি পুরুষালি হয়ে গেছে। এটা ভালো না খারাপ?
বাসে সবাই জার্মান ভাষায় হইহুল্লোড় করছে। এটাই স্বাভাবিক। মাতৃভাষা বলে কথা। কেন যে ইংলিশ বলা কোন দেশে গেলাম না আল্লাহ জানে। মাঝে মাঝে নিজের সিদ্ধান্তের জন্যে নিজের উপর খুব রাগ হয়। অতি মাত্রায় খামখেয়ালি মানুষদেরকে তাদের খামখেয়ালির জন্যে চড়া মাশুল গুনতে হয়। সামনের তিন-চারটা বছর আমাকে পিএইচডি নামক ফাঁদে সেধে সেধে পা দেয়ার জন্যে মাশুল গুনতে হবে। কি মজা!
মাথা খালি খালি লাগছে। ধ্যাত! গান শুনছি। রেডিওহেড। আমার প্রিয় একটা ব্যান্ড। নো সারপ্রাইজ। বিষন্ন গান। মেজাজ খারাপটাকে ভিন্ন খাতে নিয়ে যাবার চেষ্টা আর কি। একটা পারফিউম আনা উচিত ছিল। সুন্দর ঘ্রান মনকে ভালো করে দেয়। নবীজী নাকি আতর লাগাতে পছন্দ করতেন। আতর বা পারফিউম লাগানো কি তাহলে সুন্নত? জানতে হবে।
এখানে সবাই খুব অবাক হল শুনে যে আমি ড্রিঙ্ক করি না। বেচারাদের হতাশ করা ছাড়া উপায় নাই। হাহা...। কয়েকদিন হল সুপার মার্কেটগুলিতে ভালো জুস খুঁজে বেরাচ্ছে। এদের জুস কেমন যেন তিতকুটে। ভালো লাগে না। এই শনিবারে ডর্মের ভারতীয় মেয়ে কবিতার সাথে ইন্ডিয়ান দোকানে যাবার কথা। সেকেন্ড থট দিচ্ছি। কারণ ঘরে খাবার দাবার আছে। শুধু শুধু বেশি বেশি কিনে কি লাভ। আবার চাল ডালের জন্যে মনও একটু কেমন কেমন লাগছে। দেখি কি করি। শুক্রবার পর্যন্ত অপেক্ষা করে দেখি। শনিবার সকালে ভেতরের বাঙ্গালিত্ব জোর করে বেরিয়ে আসলে ইন্ডিয়ান দোকানে যাওয়া ছাড়া গতি নাই। মোরগ পোলাও খেতে ইচ্ছা করছে। ইসসসস...!
জ্বর আসছে নাকি। কেমন যেন লাগছে। রাতে ঘুম হয় নাই ভালো। কফি খেয়ে শুতে যাওয়া তৃতীয় পর্যায়ের ভুল হয়েছে। আধো ঘুম আধো জেগে থাকার মাঝে না হলেও বার তিনেক ব্যাঙ্ক এ্যাকাউন্ট খুলেছি। অনেক জরুরি কাজের ভেতর এটা একটা। টেনশনে থাকলে জরুরি কাজগুলি মাথায় ঘুরপাক খায়। শুক্রবারে ল্যাবে যাওয়া যাবে না। এ্যাকাউন্ট খুলব, হেলথ ইন্সুরেন্স করব আর গেমাইনণ্ডিতে যাবো। গেমাইনণ্ডি মানে রেজিস্ট্রেশন অফিস। আর মিসেস মারগারিটা নামের এক সম্ভাব্য বাড়িওয়ালীর বাসা দেখতে তো যেতেই হবে। এক রুমের ঘুঁপচি ডর্মের মাথা গোঁজার ঠাঁইটুকু মাস তিনেক পর ফুরিয়ে যাবে। অনেক কাজ!! জীবন তামা তামা হয়ে গেল। খুব অল্প বয়সে জীবনের প্রতি বীতশ্রুদ্ধ হয়ে যাচ্ছি। ভাল্লাগছে না। হাত পা কামড়াতে ইচ্ছা করছে। বছর চারেক পর দেখা যাবে ডক্টরেট ডিগ্রির বদলে লালাবাজ এক জলাতঙ্কের রোগী হয়ে বেরিয়েছি। কি ভয়ংকর, কি ভয়ংকর।
ডিসেম্বর, ২০১০
মিউনিখ, জার্মানি
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৮ ভোর ৪:১১