১.
মানবকণ্ঠ থেকে ফিরতে প্রায় দিনই বেশ রাত হয়ে যায়। যেহেতু একটু বেলা করেই পত্রিকা অফিসে যাই, তাই সন্ধ্যার পরও অধিকাংশ দিনই থাকি। এছাড়া কোথাও কোন প্রোগ্রাম থাকলে সেখানেও এটেন্ড করার চেষ্টা করি। আর প্রোগ্রাম না থাকলেও রাস্তার জ্যাম পেরিয়ে কোনদিনই রাত ৯/১০টার আগে বাসার তালা খুলতে পারি না। গুলশান থেকে মিরপুর ফেরার বাস এভেইলেবেল। বেশ কয়েকটি সিটিং সার্ভিস বাস থাকায় এখন আর আগের মতো টেনশন করতে হয় না। যাই হোক, সাম্প্রতিক সময়ে দেশব্যাপী অবরোধ ডাকার পর থেকে ইদানিং ফেরার টেনশন একটু অন্যরকম হয়। টেনশন ঘিরে থাকে এই ভেবে যে, আজ ফেরার পথে বাস পাবো তো? পুলিশ ডাইভারশন দিয়ে রাস্তা বন্ধ করে দেয়নি তো? কিংবা বাসে অনাকাঙ্ক্ষিত কোন দুর্ঘটনা হবে না তো?
বাস আগারগাঁও পার করার পর হেলপার যখন বাইরে থেকে ছুঁড়ে মারা বোমার আতঙ্কে সবাইকে জানালা বন্ধ করে দিতে বলে, তখন সবার মনের মধ্যে যে কি পরিমাণ অজানা শঙ্কার সৃষ্টি হয় সেটি ভাষায় প্রকাশ করতে পারবো না। এই গতকালও বেশ কয়েক জায়গায় যাত্রীবেশী দুর্বৃত্তরা বাসে আগুন দিয়েছে। জ্বলে ওঠা আগুনের লেলিহান শিখার কাছে অসহায় যাত্রীদের আত্মসমর্পণ যেন মানবতাকেই আবারো প্রশ্নবিদ্ধ করে যায়। ফলে যাত্রীরা এখন আর বাসের মধ্যে একে-অন্যের সাথে স্বাভাবিক আলাপচারিতায় মেতে ওঠেন না। এর বদলে তারা একে অন্যের প্রতি সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকান। শনাক্ত করার চেষ্টা করেন অজানা আততায়ীকে।
২.
মিরপুর ১০ নম্বরের গোল চক্কর থেকে বাসায় ফেরার পথে প্রায় দিনই একটা শর্টকাট গলির রাস্তা ব্যবহার করি। এই গলিতে বেশ কয়েকটি চায়ের দোকান। অধিকাংশ সময়ই এসব চায়ের দোকানে ভারতীয় কিংবা বাংলাদেশি চলচ্চিত্র দেখার জন্য উৎসুক মানুষের ভীড় থাকে। তবে বাংলাদেশের ক্রিকেট খেলার সময় অবশ্য ভিন্ন দৃশ্য দেখা যায়। বিভিন্ন দোকানে ভিন্ন ভিন্ন চলচ্চিত্র চললেও বাংলাদেশের ক্রিকেট খেলার সময় সব দোকানেই কেবল খেলাই দেখা হয়। এই এলাকায় আসার পর যতদিন এই গলিটি অতিক্রম করেছি এই সব দৃশ্যের কখনো ব্যত্যয় ঘটেনি। তবে আজ একটি ভিন্ন দৃশ্য দেখে একটু অবাক হলাম। আশপাশ মিলিয়ে প্রায় অর্ধ-ডজন চায়ের দোকানের সব টেলিভিশনেই সংবাদ দেখা হচ্ছে। কোন নির্দিষ্ট চ্যানেলের নির্দিষ্ট কোন সংবাদ যে দেখা হচ্ছে সেটাও কিন্তু নয়। ভিন্ন ভিন্ন দোকানে ভিন্ন ভিন্ন চ্যানেলের সংবাদ দেখা হচ্ছে। সেগুলো দেখতে উৎসুক মানুষদের ভীড়ও কিন্তু একেবারে ফেলনা নয়। ক্ষণিকের জন্য হাঁটার গতি স্লথ করে কান পাতলাম সংবাদে। যদি বা কোন ভালো খবর পাই এই আশায়। একসময় হাঁটার তালে তালে টেলিভিশনের শব্দও ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়ে গেলো। আর মনের অশান্তি, মনেই রয়ে গেলো।
৩.
আমার এখনো মনে আছে, ২০০৮ সালে সেনা-সমর্থিত সরকার যখন কার্ফু দিলো তখন মোহাম্মদপুরের রিং রোড থেকে তেজগাঁও লাভ রোডে যায়যায়দিনে গিয়েছিলাম পায়ে হেঁটে। আমার অনেক সাংবাদিক বড় ভাই, কলিগ সে সময় আইন-শৃঙ্খলাবাহিনীর কাছে শারীরীক ও মানসিক ভাবে হেনস্তার শিকার হয়েছিলেন। তবে কার্ফু বলে আমরা কিন্তু কাজ বন্ধ করার সুযোগ পাইনি।
একটা বিষয় খুবই পরিষ্কার যে, দেশের ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে যেই থাকুক না কেন এতে সাধারণ মানুষদের প্রত্যক্ষ কোন লাভ নেই। দেশের অধিকাংশ মানুষই দিন আনে, দিন খায়। পূর্ব-পুরুষের অগাধ সম্পদে টেনশনবিহীন রয়েছেন এমন মানুষ হাজারে নয়, বরং লাখে কয়টা মেলে সেটাই খুঁজতে হবে।
হরতাল, অবরোধ কিংবা কার্ফু জারি করলেও চাকুরীজীবীদেরকে অফিসে হাজিরা দিতে হয়। নির্দিষ্ট সময় অতিক্রম করলে লেট কিংবা অনুপস্থিতির খড়গেও তাদেরকে পড়তে হয়। সুতরাং, জাতির কর্ণধার ও বিবেক যারা রয়েছেন তারা আমাদেরকে এমন অশান্তি, উদ্বেগ আর আতঙ্ক থেকে মুক্তি দিন। আমরা সাধারণ খেটে-খাওয়া মানুষ। আমরা বসে থাকার বদলে পরিশ্রম করতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি। আমাদের পরিশ্রমের পথটি অন্তত রুদ্ধ করবেন না। আর এই পথটি কিভাবে খোলা রাখবেন সেই ফয়সালা আপনারাই করুন।
দৈনিক ঢাকা রিপোর্ট ও বিএনএনঅনলাইন২৪.কম-এ প্রকাশিত
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই জানুয়ারি, ২০১৫ বিকাল ৫:৪৬