বিলোনিয়া, মুন্সিরহাট, পরশুরাম, ফুলগাজী সবগুলো এলাকাই ফেনী জেলার অন্তর্ভুক্ত। ১৯৭১ সালে এ অঞ্চলের রণাঙ্গন আমাদের জন্য অনন্য গৌরবের। 'ব্যাটল অব বিলোনিয়া বালজ' আজ বিভিন্ন দেশের সামরিক বাহিনীর পাঠ্য। পাকি জেনারেলরা যুদ্ধ পরিচালনার জন্য এসেছিল এই রনাঙ্গনে।
৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১ সালের এই দিনে পাকি হার্মাদ বাহিনী ও তাদের দেশীয় ঘেঁটুবালক রাজাকার-আলবদর বাহিনীকে হটিয়ে ফেনীকে স্বাধীন ঘোষণা করা হয়। সকাল থেকে সশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধারা ক্যাপ্টেন জাফর ইমামের নেতৃত্বে দলে দলে ফেনী শহরে প্রবেশ করে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিতে শুরু করেন।
ফেনী শহরবাসী ৫ ডিসেম্বর সন্ধ্যা পর্যন্ত পাকিস্তানি হার্মাদ বাহিনী ও তাদের এ দেশীয় দোসর রাজাকার-আলবদর বাহিনীর সশস্ত্র মহড়া দেখেছিল। ফলে সকালে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান শুনে অনেকেই হকচকিত হয়ে ওঠেন এবং অনেকে মুক্তিযোদ্ধাদের এ স্লোগান প্রথম বিশ্বাসই করতে পারেননি। কিন্তু বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে অনেকেই পরিচিত মুক্তিযোদ্ধাদের মিছিলে দেখতে পান। তখন লোকজনের ভুল ভাঙতে শুরু করে এবং ধীরে ধীরে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সাধারণ মানুষ মিছিলে যোগ দিতে শুরু করেন।
ফেনী অঞ্চলের মুক্তিবাহিনীর অধিনায়ক হিসাবে কর্মরত তৎকালীন ক্যাপ্টেন জাফর ইমাম (পরবর্তীতে লেঃ কর্ণেল হিসেবে অবঃ) ভারতের বিলোনিয়া ও তৎসংলগ্ন অঞ্চল থেকে ১০ ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অভিযানে বিলোনিয়া, পরশুরাম, মুন্সিরহাট, ফুলগাজী, যুদ্ধ করতে করতে এগুতে থাকে, পর্যদুস্ত হয়ে ফেনীর পাকি হানাদার বাহিনীর একটি অংশ নোয়াখালীর সোনাইমুড়ী হয়ে কুমিল্লা সেনানিবাসের রাস্তায় অপর অংশ শুভপুর ব্রীজের উপর দিয়ে চট্টগ্রামের দিকে পালিয়ে যায়।
ফেনী-বিলোনিয়া যুদ্ধ মুক্তিযুদ্ধের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ক্যাপ্টেন জাফর ইমামের নেতৃত্বে ১০ ইস্ট রেজিমেন্ট এর সৈনিক ও গণযোদ্ধারা ফেনী-বিলোনিয়া যুদ্ধে পাকিসেনাদের পরাজিত করে। ফুলগাজী উপজেলায় মুন্সিরহাট, নোয়াপুর, সলিয়া, বশিকপুর, ধনিকুন্ডা ইত্যাদি জায়গায় পাকিসেনাদের সাথে মুক্তিবাহিনীর সম্মুখ যুদ্ধ হয়।
অপরদিকে বিএলএফ তথা মুজিব বাহিনীর ফেনী মহাকুমা কমান্ডার অধ্যাপক জয়নাল আবেদীনের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা দাগনভূঞা, রাজাপুর, সিন্দুরপুর হয়ে শহরের দিকে এগুতে থাকে। মুক্তিযোদ্ধাদের তুমুল আক্রমনে দিশেহারা হয়ে পাকি সেনারা ৬ ডিসেম্বর রাতে কুমিল্লার দিকে পালিয়ে পায়। সে সময় ফেনী মহাকুমার অবাঙালী প্রশাসক বেলাল এ.খান পাকিদের সঙ্গে চলে যায়।
ফেনী মুক্ত হওয়ার কারনে ঢাকা-চট্টগ্রামের সাথে সড়ক ও রেল পথে পাকি বাহিনীর যোগাযোগ ব্যবস্থা সম্পূর্ণ রূপে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এতে করে বাংলাদেশ স্বাধীনতার সূর্য উদিত হওয়ার বিষয়টি সময়ের ব্যাপার হয়ে দাড়িয়েছিল।মুক্তিযুদ্ধে ফেনীর অনেকগুলো রণাঙ্গনের মধ্যে মুন্সীর হাটের মুক্তারবাড়ী ও বন্ধুয়ার প্রতিরোধের যুদ্ধ ইতিহাস খ্যাত হয়ে আছে।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাকি বাহিনী ও তাদের দোসররা ফেনী সরকারী কলেজ, তৎকালীন সিও অফিসসহ কয়েকটি স্থানে স্বাধীনতাকামী নিরীহ মানুষকে নির্মম ভাবে নির্যাতন চালিয়ে হত্যা করেছিল। সে অমর শহীদদের স্মৃতির ভাস্কর হিসেবে ফেনী কলেজ মাঠে মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতি স্তম্ভ ও জেল রোডের পাশে বীর শহীদদের নামের তালিকা সহ মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি স্তম্ভ ও বিলোনীয়ায় মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি স্তম্ভ নির্মান করা হয়।
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই ডিসেম্বর, ২০১৭ সকাল ১০:০৫