somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পোস্টটি যিনি লিখেছেন

তানজীর আহমেদ সিয়াম
সবার অবগতির জন্য জানাচ্ছি যে আমি কোন ব্লগার নই মন চায় তাই লিখি তথ্য-উপাত্ত সবার সাথে শেয়ার করি ।nজব এর পাশাপাশি এয়ার টিকেট ও ট্রাভেল ভিসার ব্যাবসা করি ।nধন্যবাদn

কুড়ানো ( পর্ব - ১৪) ★ " মাটিকাটার জাহাজমারা যুদ্ধ ও জাহাজমারা হাবিব " ★

৩০ শে জানুয়ারি, ২০১৮ সকাল ১১:৫২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



একাত্তরের আগস্ট মাস। এশিয়ার, স্বঘোষিত শ্রেষ্ঠ বাহিনীর মনোবলে তীব্র চিড় ধরেছে। রাত নেই দিন নেই কোথা থেকে এক বাহিনী এসে আচমকা হামলা করে চলে যায়। প্রতিদিনই কেউ না কেউ খতম হচ্ছে। অনবদ্য এক রণকৌশল এবং সাংগঠনিক ক্ষমতার পরিচয় দিচ্ছে টাঙ্গাইল অঞ্চলের কাদেরিয়া বাহিনী।
৫ আগস্ট ১৯৭১, মুক্তিবাহিনী পাকিদের গোপন এক ওয়্যারলেস বার্তা ধরতে সক্ষম হয়। জানা গেল সদরঘাটে বেশ বড় কটা জাহাজে অস্র বোঝাই হচ্ছে। মুক্তিবাহিনীর চর পাঠানো হয় ঢাকায়। খবর সত্য। জাহাজগুলোর গন্তব্য বগুড়া। কাদেরিয়া বাহিনী এই অঞ্চলের বেশিরভাগ পাকি ঘাঁটি গুঁড়িয়ে দিয়েছে এর মধ্যেই। বিশাল এক মুক্তাঞ্চলে পরিণত হয়েছে টাঙ্গাইল ময়মনসিংহ। এই এলাকারই ভুয়াপুর ঘাটের পাশ দিয়েই যাবে জাহাজগুলো। কড়া নজর রাখার নির্দেশ দেয়া হল আঞ্চলিক দপ্তরকে।
৯ আগস্ট, সন্ধ্যা ৭টায় জাহাজ এসে ভীরে ধলেশ্বরির ঘাটে। বিশাল আকারের জাহাজগুলোতে বেশ কটা বড় শহর একেবারে জ্বালিয়ে দেবার মত গোলাবারুদ ছিল। জাহাজের আলো রাতের অন্ধকার ভেঙ্গে শহরের মত আলোকিত করে ফেলে নদীর ঘাট। এসটি রাজন ও ইউএস ইঞ্জিনিয়ারস এলসি-৩ নামের দুটো জাহাজ ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের টার্গেট। স্মর্তব্য যে, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় টাঙ্গাইলের ভূঞাপুর ও কালিহাতী এলাকায় যমুনা-ধলেশ্বরী নদীপথে নজরদারীর দায়িত্ব ছিল কাদেরিয়া বাহিনীর দুর্ধর্ষ কমান্ডার হাবিবুর রহমান বীর বিক্রমের ওপর।
কমান্ডার হাবিবুর রহমান বীর বিক্রম আক্রমনের আগে আরো নিখুঁত পরিকল্পনা করতে চাইলেন। জাহাজগুলোর যতটা কাছে পারা যায় গিয়ে খুঁটিনাটি তথ্য বের করে আনতে হবে। যুদ্ধের মোড় ঘুরিয়ে দিতে সামান্য তথ্যই খুব বড় ভূমিকা রাখতে পারে। বাছাই করা কয়েকজন যোদ্ধাদের নিয়ে জেলের ছদ্মবেশ ধরেন তিনি। বিপদের চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে জাহাজের খুব কাছে যেয়ে মাছ ধরতে শুরু করেন তারা।
এক পর্যায়ে টহল স্পীডবোটের মুখোমুখিও হয় তারা। তরতাজা মুরগি আর চমচমের খোঁজ দেন পাকিদের, এর ফাঁকে দরকারি তথ্যগুলোও কৌশলে জেনে নেন। ভুয়াপুরের দপ্তরে খবর পাঠান তিনি। আরো সাহায্য লাগবে। সামান্য কয়েকজন নিয়ে এই বিশাল বহর ধ্বংস করা অসম্ভব। উত্তরে সাহায্যের বদলে পাওয়া গেল এক রহস্যময় বার্তা, “এই মাত্রা সর্বাধিনায়কের(বঙ্গবীর ওসমানী) কাছ থেকে নির্দেশ এসেছে, সুবিধামতো শুধু আক্রমণ করো, আক্রমণ করা মাত্রই জাহাজের পতন ঘটবে”।
এই বার্তার মর্মদ্ধার করতে না পারলেও ভালো কিছুর ইঙ্গিতই যে দেয়া হয়েছে এ বিষয়ে কারো সন্দেহ ছিল না। ১০ আগস্ট মাটিকাটা গ্রামে মুক্তিযোদ্ধা রেজাউল করিম একটি শক্তিশালী দল নিয়ে পজিশন নেন। বিশেষ দরকার না হলে পাকিস্তানী সেনারা জাহাজ ছেড়ে বের হচ্ছে না।
১০ আগস্ট ১৯৭১, প্রায় সারাদিন জাহাজগুলো স্থির ছিল তবুও কমান্ডার আঘাত হানার নির্দেশ দিলেন না। কমান্ডারের কড়া আদেশ সুবিধা বুঝে প্রথম গুলি তিনি চালাবেন তারপর একসাথে সব অস্র গর্জে উঠবে। ১১ তারিখ মুক্তিবাহিনী তাদের অবস্থান থেকে সরে একটু পেছনে অবস্থান নেয়। কিছুক্ষণ পর খবর আসে জাহাজগুলো উত্তরে সরে যাচ্ছে। শিকার কি হাতছাড়া হয়ে যাবে নাকি। চোখের সামনে দিয়ে জাহাজগুলো চলে যাচ্ছে তবুও কমান্ডার আঘাত হানার নির্দেশ দিচ্ছেন না। একটু পর সবগুলো জাহাজকে পেছনে রেখে বহরের সবথেকে ছোট জাহাজটি সামনে এগোতে থাকে। পানির গভীরতা মাপতে মাপতে সিরাজগঞ্জ এগিয়ে যাচ্ছে জাহাজটি। আরেকটি দিন কেটে গেল, মুক্তিবাহিনীর সদস্যরা আক্রমণ করতে উদগ্রীব হয়ে আছে।
পরদিন, ১১ আগস্ট পাকিদের জাহাজগুলো আবার চলতে শুরু করে, প্রথমে ছোট দুটি জাহাজ ঠিক মুক্তিবাহিনীর সামনে দিয়ে চলে গেল কিন্তু কমান্ডার গুলি চালালেন না। এবার বহরের বড় দুটি জাহাজ মেশিনগানের রেঞ্জের মধ্যে চলে আসে, জাহাজে বেশ আয়েশ করে গল্পে মশগুল পাকি সেনারা। হঠাৎ করেই তাদের খোশ গল্পের ছেদ ঘটালো এক ঝাঁক বুলেট। কমান্ডার হাবিবের মেশিনগান গর্জে উঠেছে, সাথে অন্য সবার বন্দুক এবং মর্টার। বাম পাশে মর্টার নিয়ে পজিশন নিয়েছিলেন রেজাউল করিম, ১২টি মর্টার একেবারে নির্ভুলভাবে লক্ষে আঘাত করার তিনি। ডান পাশে ছিলেন মঞ্জু, প্রায় কুড়িটি মর্টার শেল নিক্ষেপ করেন তিনি। তবে জাহাজের পুরু লোহা ভেদ করা এত সহজ নয়, জাহাজ দুটির যে ক্ষতি হয়েছিল তাতে খুব সহজেই পালিয়ে যেতে পারতো তারা। অবাক হয়ে মুক্তিবাহিনী দেখলো অনেকটা নিয়ন্ত্রনহীনভাবে জাহাজদুটো সামনের চরে গিয়ে আটকে যায়। ততক্ষণে গুলি বন্ধ হয়ে গিয়েছে। কমান্ডার হাবিব জাহাজ দুটো দখলে নিলেন এবং সারেংকে আটক করেন।
মুক্তিযোদ্ধারা অবাক বিস্ময়ে আবিষ্কার করলেন যে, গোলাবারুদের অভাবে তারা ঠিকমত যুদ্ধ করতে পারছেন না সেই আধুনিক অস্ত্র গোলাবারুদে ঠাসা জাহাজটি। অন্যটি ছিল তেলের ট্যাংকার যাতে ১ লাখ ৮০ হাজার গ্যালন ডিজেল ছিল। অস্ত্র ছাড়াও জাহাজের রান্নাঘর ভর্তি মুরগির মাংস এবং প্রচুর উপাদেয় খাদ্য।
ঘণ্টাখানেকের মধ্যে শুরু হল অস্ত্র নামানো। আশেপাশের গ্রাম থেকে সব মানুষজন ছুটে আসে। যাদের শারীরিক সক্ষমতা আছে তারা মুক্তিবাহিনীর সাথে অস্ত্র নামানোর কাজে হাত দিল। আটক সারেংয়ের কাছ জানা গেল পাকিরা বারবার সাহায্য চেয়ে ওয়্যারলেসে বার্তা পাঠাচ্ছিল। যে কোন সময় পাল্টা আঘাত হানতে পারে তারা। রাত ১০ টায় কমান্ডার নির্দেশ দিলেন জাহাজ জ্বালিয়ে দিতে হবে। জাহাজে তখনও প্রচুর অস্ত্র। নিরাপদ দূরত্ব থেকে বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে জাহাজে আগুন ধরানো হয়। ৩০ কিলোমিটার দূর থেকে দেখা যায় আগুনের লেলিহান শিখা।
সেই ভয়াল বিস্ফোরণ শুধুমাত্র যেন জাহাজই নয় পাকি বাহিনীর মনোবলকে একেবারে ভেঙ্গে চুরমার করে দেয়। তেলের ট্যাংকারটির মালিক ছিল পাবনার কুখ্যাত মুসলিম লীগ নেতা মতিনের। রাজাকারদের দম্ভও সম্পূর্ণভাবে ধূলিসাৎ হয় আগুনের ফুলকিতে। এরপর আঞ্চলিক ক্যাম্পে স্বয়ং কাদের সিদ্দিকী এসে হাজির হয়েছেন। আটক সারেংকে হাজির করা হয় তার সামনে। “ওয়েল ডান, মোস্তফা” বলে সারেংকে বুকে জড়িয়ে ধরেন কাদের সিদ্দিকী। এবার উন্মোচিত হল সেই রহস্যময়ী বার্তার।
গোলাম মোস্তফা চট্টগ্রামের বাসিন্দা। ২৫শে মার্চ তার আত্মীয়দের খুন করে পাক বাহিনী। চালনা বন্দরে কর্মরত গোলাম মোস্তফাকে নজরবন্দী করা হয় তাকে। পরে তাকে অনেকটা জোর করেই জাহাজে কাজ দেয়া হয়। মাতৃভূমির মুক্তির ঘ্রাণে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেবার পরিকল্পনা করেন তিনি। কিন্তু তার এক বন্ধুর পরামর্শে পাকিদের সাথে থেকেই বড় রকম ক্ষতি করার ছক কাটেন তিনি। মুক্তিবাহিনীর সাথে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ ছিল তার, আক্রমণের পুরো ছকই জানতেন তিনি। এ জন্যই আক্রমণ শুরু পরপরই তিনি জাহাজ থামিয়ে দেন।
মুক্তিবাহিনীর হাতে এতো বিপুল পরিমাণ অস্ত্র(পাকিদের হিসাব মতেই ২১ কোটি টাকা; বর্তমানে প্রায় ২৭৩ কোটি টাকা) হারিয়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর আঁতে এতোটাই ঘা লেগেছিল যে তারা এই অঞ্চলে আবার নতুন করে অভিযান শুরু করে। উল্লেখ্য যে, পাকিদের এই অভিযানে নেতৃত্ব দিয়েছিল নিয়াজী স্বয়ং। কিন্তু কাদেরিয়া বাহিনী পাকিদের লুট করা অস্ত্র দিয়েই পাকিদের সফলভাবে প্রতিহত করে। অন্যায় যুদ্ধে ভাগ্যও সহায়তা করে না ইতিহাস আরেকবার প্রমাণ করে দিল।
★★ কুড়ি বছর আগে ১৯৯৮ সালের ২৭ ডিসেম্বর 'জাহাজমারা হাবিব' হিসেবে খ্যাত, কিংবদন্তী মুক্তিযোদ্ধা হাবিবুর রহমান বীর প্রতীক হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে ইন্তেকাল করেন। আমরা তাঁর চিরশান্তি প্রার্থনা করছি।
★★★★★লেখকঃসারতাজ আলীম (জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়,অর্থনীতি বিভাগ)
★★কৃতজ্ঞতাঃ “মুক্তিযুদ্ধের সেরা লড়াই” এবং ভুয়াপুর উপজেলার ওয়েবসাইট
★★ছবিটি বীর মুক্তিযোদ্ধা মরহুম হাবিবুর রহমান বীর প্রতীকের।

সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে জানুয়ারি, ২০১৮ সকাল ১১:৫৪
৬টি মন্তব্য ৫টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আপনি কি পথখাবার খান? তাহলে এই লেখাটি আপনার জন্য

লিখেছেন মিশু মিলন, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১০:৩৪

আগে যখন মাঝে মাঝে বিকেল-সন্ধ্যায় বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিতাম, তখন খাবার নিয়ে আমার জন্য ওরা বেশ বিড়ম্বনায় পড়ত। আমি পথখাবার খাই না। ফলে সোরওয়ার্দী উদ্যানে আড্ডা দিতে দিতে ক্ষিধে পেলে... ...বাকিটুকু পড়ুন

কষ্ট থেকে আত্মরক্ষা করতে চাই

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৯



দেহটা মনের সাথে দৌড়ে পারে না
মন উড়ে চলে যায় বহু দূর স্থানে
ক্লান্ত দেহ পড়ে থাকে বিশ্রামে
একরাশ হতাশায় মন দেহে ফিরে।

সময়ের চাকা ঘুরতে থাকে অবিরত
কি অর্জন হলো হিসাব... ...বাকিটুকু পড়ুন

রম্য : মদ্যপান !

লিখেছেন গেছো দাদা, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৫৩

প্রখ্যাত শায়র মীর্জা গালিব একদিন তাঁর বোতল নিয়ে মসজিদে বসে মদ্যপান করছিলেন। বেশ মৌতাতে রয়েছেন তিনি। এদিকে মুসল্লিদের নজরে পড়েছে এই ঘটনা। তখন মুসল্লীরা রে রে করে এসে তাকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

= নিরস জীবনের প্রতিচ্ছবি=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৪১



এখন সময় নেই আর ভালোবাসার
ব্যস্ততার ঘাড়ে পা ঝুলিয়ে নিথর বসেছি,
চাইলেও ফেরত আসা যাবে না এখানে
সময় অল্প, গুছাতে হবে জমে যাওয়া কাজ।

বাতাসে সময় কুঁড়িয়েছি মুঠো ভরে
অবসরের বুকে শুয়ে বসে... ...বাকিটুকু পড়ুন

Instrumentation & Control (INC) সাবজেক্ট বাংলাদেশে নেই

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৫৫




শিক্ষা ব্যবস্থার মান যে বাংলাদেশে এক্কেবারেই খারাপ তা বলার কোনো সুযোগ নেই। সারাদিন শিক্ষার মান নিয়ে চেঁচামেচি করলেও বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরাই বিশ্বের অনেক উন্নত দেশে সার্ভিস দিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×