somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ওরা ভয় পেয়েছে .................

২২ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৪ দুপুর ১:৪৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

সাধু বেশ ধারণ করলেই সাধু হয় না। পাপাচারীরা তাদের উদ্দেশ্য সফল করার জন্য সাধুর বেশ ধারণ করে। উদ্দেশ্য মানুষকে ধোঁকা দিয়ে নিজেদের দুষ্কর্ম সাধন করা। যেমন খুলনার জহির কাগজীর কথাই বলি। ডাকাতি মামলার আসামী সে। ডাকাতি করে পালানোর সময় হাতে নাতে বমাল ধৃত হয় এই জহির। মামলার শুনানীর জন্য ডাকা হলে আসামীর কাঠগড়ায় যে ব্যাক্তি হাজির হলো তাকে দেখে সবাই সচকিত হলো। সবাইর প্রশ্ন এই কি সেই কুখ্যাত ডাকাত জহির ? মাথায় সুন্দর একটি টুপি, মুখে মুখে দাড়ি, পরনে সফেদ পাজামা পাঞ্জাবী, হাতে তসবিহ। লেবাস দেখে মনে হয় এর চেয়ে পরহেজগার মানুষ আর নাই। এরূপ একজন মানুষের বিরুদ্ধে ডাকাতির অভিযোগ(!)? বিস্ময়ের ব্যাপারই বটে। অভিযোগ পড়ে শুনানো হলে সে সুস্পষ্টভাবেই তার বিরুদ্ধে আনীত সকল অভিযোগ অস্বীকার করেছে। নালিশকারীনি কল্পনা রাণী মালাকারকে ডাকা হলো। সাক্ষীর কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে সে হলফ নিলো। তারপর বললো গভীর রাত্রে তার বাড়িতে ডাকাতেরা আসে। ডাকাতদের হাঁক ডাকে তার ঘুম ভাঙে। ভয়ে তারা জরো সরো হয়ে যায়। তার ঘরে দুজন ডাকাত দরজা ভেঙে প্রবেশ করে। একজন ডাকাত তার হাতে আঘাত করে এবং হাত থেকে জোর জবরদস্তি করে সোনার রুলি খুলে নেয়। কান্না কাতর কন্ঠে কল্পনা বলে : ‘ স্যার আমি বাশেঁর খুটি কেটে ব্যাংক বানিয়ে ছিলাম। সেখানে কোন দিন আট আনা, কোনদিন চার আনা করে পয়সা জমাতাম। এভাবে অনেক কষ্ট করে জমানো টাকা দিয়ে আমি হাতের জন্য সোনার রুলি তৈরী করি। সোনার সেই রুলিটি ঐ আসামী আমার হাত থেকে জোর করে খুলে নেয়।’ এই বলে সে আসামী জহিরকে সনাক্ত করলো। আসামী পক্ষ থেকে কল্পনার সম্পর্কে তখন কিছু অশ্লীল কথা বলার উদ্যোগ নিলে বিজ্ঞ বিচারক তা থামিয়ে দেন এবং জিজ্ঞাসা করেন গভীর রাত্রিতে সে কেন ধান ক্ষেতের মধ্য দিয়ে দৌড়াচ্ছিল। সাক্ষীদের সবাই বলেছে জহিরকে বিলের মধ্যে অবস্থিত ধান ক্ষেতের মধ্য থেকে গভীর রাত্রে ধরা হয়েছে। তখন তার পরনে ছিল একটি গেঞ্জি ও লুঙ্গি। লুঙ্গি ছিল মালকোচা মারা। আসামীর মুখে তখন দাড়িও ছিল না। এসব সাক্ষ্য শুনার পর আসামী হয়ে গেলো লা-জওয়াব। আসামীর এলাকায় সন্ধান নিয়ে তদন্তকারী কর্মকর্তা জানতে পেরেছে যে আসামী কখনো নামাজ কালাম পড়ে না, তার মুখে দাড়িও ছিলনা। গ্রেফতার হবার পরেই সে মুসুল্লীর বেশ ধারণ করেছে। বিজ্ঞ বিচারক তাকে দোষী সাব্যস্ত করে সাজা দিলেন।

আসামী কাগুজীর মতো লোকেরা আমাদের মাঝে আছে। বেশভ’ষায় এবং আচার আচরণে অত্যন্ত সজ্জন হলেও প্রকৃত পক্ষে তারা ধোঁকাবাজ। এরূপ বেশধারী তস্করেরা যখন অত্যন্ত সন্তর্পনে দুষ্কর্ম সাধন করতে গিয়ে অকস্মাৎ তার সামনে অপ্রত্যাশিত ভাবে গৃহস্বামীকে দেখতে পায় তখন তারা মানসিক ভারসাম্য ও কান্ডজ্ঞান হারিয়ে ফেলে। তারা কোন কথারই সঠিক জবাব দিতে পারে না। তারা খেই হারিয়ে আবোল তাবোল বকতে থাকে। যার অর্থ তারা নিজেই জানে না। বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে আজ এই পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের মহানায়কদেরকে অসম্মানজনক অভিধায় অভিহিত করা হচ্ছে, কলাম লিখে শুরু হয়েছে খিস্তি খেউরের চর্চা। কিন্তু কেন এই চর্চা শুরু হলো। এসব দেখে শুনেই মনে হলো প্রাগুক্ত কাগুজীর কথা। কাগুজির মতো এরাও খেই হারিয়ে আবোল তাবোল বকছে। ভুলে গেছে নিজেদের অতীত ভ’মিকার কথা, বিস্মৃত হয়েছে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের শিক্ষা।

আমাদের দেশ ও স্বাধীনতা নিয়ে চিন্তা করতে হলে তাকাতে হবে ইতিহাসের পাতায়। বেশী দূর না গেলেও শতবর্ষ আগের থেকেই শুরু করতে হবে। ইংরেজরা ভারতবর্ষে তাদের শাসন নিষ্কন্টক ও স্থায়ী করার জন্য বিভেদ নীতি চালু করে। ভারত বর্ষের হাজার বৎসরেরও অধিককালের ইতিহাসে সাম্প্রদায়িক বিরোধের কোন উদাহরণ নাই। কিন্তু ইংরেজ শাসন আমলে মুসলমানরা অধিকার থেকে বঞ্চিত হতে থাকে। তা সত্বেও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট হয় নাই। ইংরেজদের বিভেদ নীতির বিরুদ্ধে মুসলমানেরা সচেতন হতে থাকে, গড়ে তুলতে থাকে প্রতিরোধ। ১৯০৯ সালের ভারত শাসন আইন ( মর্লি-মিন্টো সংস্কার) এ মুসলমানদের জন্য পৃথক নির্বাচনের প্রস্তাব করা হয়। ইংরেজদের নিয়ন্ত্রণে প্রতিনিধিত্বশীল শাসন ব্যবস্থার কথা বলা হয়। তবে এদেশীয়দের মতামত প্রকাশের সুযোগ তাতে ছিলো না বললেই চলে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শেষে ১৯১৯ সালের ভারত শাসন আইন ( মন্টেগু-চেমসফোর্ড সংস্কার) এ কিছুটা সংস্কার করা হলেও এর অধীনে নির্বাচন করতে মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধি (মহাত্মা গান্ধি), এম এ আনসারী , রাজাগোপালাচারী এবং কে আর আয়েঙ্গার অস্বীকার করেন। এজন্য তাঁদেরকে নির্বাচন বিরোধী (No-Changer) বলে আখ্যায়িত করা হতো। তবে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ, মতিলাল নেহেরু, হাকিম আজমল খাঁ ও ভিটলভাই প্যাটেল আন্দোলনের অংশ হিসাবে নির্বাচনে যাবার পক্ষে মত প্রকাশ করেন। এজন্য তাঁদেরকে নির্বাচনপন্থি (Pro-Changer) বলে অভিহিত করা হতো। দেশবন্ধুর মতে সরকার বিরোধী কর্মকান্ড পরিচালনার সর্বাপেক্ষা উপযুক্ত স্থান আইন পরিষদ। এই আইন পরিষদে বসে যে সব কর্মসূচি পালন করা হবে তার প্রতি ইংগিত দিয়ে দেশবন্ধু বলেন ঃ ক ) মৌলিক অধিকার সমূহের সাংবিধানিক স্বীকৃতি ও নিশ্চয়তা আদায়ের ব্যাপারে সরকারের উপর প্রবল চাপ প্রয়োগ; খ) সরকারের বাজেট-প্রস্তাবসহ সকল প্রকার বিলের বিরোধীতা ; গ) সরকারের প্রত্যেক প্রস্তাবের উপর মূলতবী প্রস্তাব গ্রহন ; ঘ) সরকারের স্বেচ্ছাচার সম্পর্কে জনগণকে অবহিত করার কাজে পরিষদকে ব্যবহার; এবং ঙ) আমলাতন্ত্রের কঠিন প্রাচীর ধূলিসাৎকরণ।

দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ এসব লক্ষ্য সামনে নিয়েই স্বরাজ পার্টি নামে একটি নির্বাচনী দল গঠন করেন। তাঁর সাথে ছিলেন মতিলাল নেহেরু। এই সময়ই হিন্দু মুসলমান সাম্প্রদায়িক সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করে। এ থেকে উত্তরণের জন্য তিনি মুসলমান নেতাদের সাথে ১৯২৩ সালে ‘বাংলা চুক্তি’ (ইবহমড়ষ চধপঃ) সম্পাদন করেন। এতে তাঁকে সহায়তা করেন আবদুল করিম, মুজিবর রহমান, আকরম খান, মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী। এই চুক্তিকে স্বাগত জানান স্যার আবদুর রহিম, এ কে ফজলুল হক , এবং হোসেন শহিদ সোহরাওয়ার্দী। হিন্দু মহাসভার নেতৃবর্গ এর প্রবল বিরোধীতা করেন। এই চুক্তি বানচাল করতে লালা লাজপৎ রায় ও পন্ডিত মদন মোহন মালব্য মুখ্য ভ’মিকা পালন করেন। মহাত্মা গান্ধিও এই চুক্তির ব্যাপারে কোন উৎসাহ দেখান নাই। ফলে এই চুক্তি বাস্তবায়ন কঠিন হয়ে পড়ে। এর ব্যর্থতার কারণে হিন্দু-মুসলিম ঐক্যেও পথ অনেকটা রুদ্ধ হয়ে যায়। ( তথ্য সূত্র : সৈয়দ মকসুদ আলী প্রণীত ‘ রাজনীতি ও রাষ্ট্রচিন্তায় উপমহাদেশ , মওলা ব্রাদার্স কতর্ৃৃক এপ্রিল ২০১২ সালে প্রকাশিত , পৃষ্ঠা ঃ ১১১)।

সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠায় মুহম্মদ আলি জিন্নাহ আত্মনিয়োগ করেন। তাঁকে এজন্য গোপাল কৃষ্ণ গোখলে ‘ হিন্দু মুসলিম মিলনের অগ্রদূত ’ বলে অভিহিত করেন। তিনি কংগ্রেসর সভাপতির দায়িত্বও পালন করেছেন। তার এ মিশন ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। এ কে ফজলুল হক একই সময়ে কংগ্রেসের সাধারন সম্পাদক ও মুসলীম লীদেরও সভাপতি ছিলেন। কংগ্রেসে তাঁর যথাযথ মূল্যায়ন হয়নি। নেতাজী সুভাষ বসু উভয় সম্প্রদায়ের কাছে গ্রহণযোগ্য নেতা ছিলেন। তিনি দ্বিতীয়বার কংগ্রেস সভাপতি নির্বাচিত হবার পর গান্ধিজীর প্রবল বিরোধীতার কারণে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। এসব অভিজ্ঞতার আলোকে ১৯৪০ সালের ২৩ শে মার্চ তারিখে নিখিত ভারত মুসলীম লীগের লাহোর অধিবেশনে এ কে ফজলুল হক সাম্প্রদায়িক সমস্যার সমাধান কল্পে উপমহাদেশ বিভক্তির প্রস্তাব উত্থাপন করেন। এই লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতেই উপমহাদেশের রাজনীতি আবর্তিত হতে থাকে। ১৯৪৭ সালে ১৪ই আগষ্ট তারিখে ইংরেজদের প্রত্যক্ষ শাসনের অবসানের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয় পাকিস্তান। বাংলা ও আসাম হয় বিভক্ত। পূর্ব বাংলা ও আসামের সিলেট নিয়ে গঠিত হয় পাকিস্তানের ‘পূর্ব বাংলা’ প্রদেশ। পাকিস্তানের শাসনতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য গঠিত হয় ‘মূলনীতি কমিটি’। প্রথম ও দ্বিতীয় মূলনীতি কমিটির প্রস্তাব বাংলার জনগণের স্বার্থের অনুক’ল ছিল না।ফলে গঠিত হয় তৃতীয় মূলনীতি কমিটি। পাঞ্জাবীরা সব সময়ই আশংকা করেছে যে সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে বাংলার জনপ্রতিনিধিগণ সিন্ধু, বেলুচিস্তান ও উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের জনগ্রতিনিধিদের সাথে ঐক্যবদ্ধ হয়ে পাকিস্তানে সরকার গঠন করবে। পাঞ্জাবীদের এ কারণে চির দিনই পাকিস্তানে বিরোধী দলে থাকতে হবে। জনসংখার বিবেচনায় বাংলার পরেই ছিল পাঞ্জাবের স্থান। আবার পাঞ্জাব, সিন্ধু, বেলুচিস্তান ও উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের মোট জনসংখ্যা ছিল পূর্ব বাংলা প্রদেশের মোট জনসংখ্যা থেকেও কম। এই সব বাস্তবতার কারণেই সব সময়ই ‘পূর্ব বাংলা’র জনপ্রতিনিধিদের হাতে যাতে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের নেতৃত্ব না যায় সেজন্য পাঞ্জাবীরা নানা প্রকার ষড়যন্ত্র করেছে। তৃতীয় মূলনীতি কমিটির প্রতিবেদন ‘পূর্ব বাংলা’র জনগণের অধিকার ও স্বার্থের সার্বিক অনুক’ল না হলেও এই প্রতিবেদনকে সামনে রেখেই পাকিস্তানের শাসনতন্ত্র প্রণীত ও গৃহীত হয়। এখানে উল্লেখ করা যায় যে পাকিস্তান আমলে ‘পূর্ব বাংলা’ প্রদেশের তিন জন বাসিন্দা খাজা নাজিম উদ্দিন, মুহম্মদ আলী বগুড়া ও হোসেন শহিদ সোহরাওয়ার্দী পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর পদ অলংকৃত করেন। ইনারা তিনজনই ছিলেন উর্দূভাষী। খাজা নাজিম উদ্দিন পাকিস্তানের ‘গভর্নর জেনারেল’ও ছিলেন। ইসকান্দার মির্জা ‘পূর্ব বাংলা’র বাসিন্দা পরিচয়ে পাকিস্তানের ‘গভর্নর জেনারেল’ এর পদে আসীন হয়েছিলেন এবং শাসনতন্ত্র গৃহীত হলে পাকিস্তানের প্রথম প্রেসিডেন্ট পদ অলংকৃত করেন। পূর্ব পাকিস্তানের বাসিন্দা মর্মে তাঁর পরিচিতি নিয়ে বিতর্ক ছিল, শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক তাঁকে পূর্ব পাকিস্তানের বাসিন্দা বলেই সনদ দেন। এর পর পরিচয়ের কারণে উক্ত পদ সমূহে তাঁর পদায়ন আর বাধাগ্রস্ত হয় নাই। ১৯৫৬ সালের শাসনতন্ত্রে ‘পূর্ব বাংলা’ প্রদেশে জনগণের অধিকার ও স্বার্থ পুরোপুরি রক্ষিত না হলেও তা এই প্রদেশের জনগণ রাষ্ট্রীয় সংহতির স্বার্থে মেনে নেয়। ‘পূর্ব বাংলা’ প্রদেশের নতুন নামকরণ করা হয় ‘পূর্ব পাকিস্তান’।‘ সংখ্যাসাম্য নীতি’ অনুসারে জাতীয় পরিষদে পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তানের সদস্য সংখ্যা সমান থাকলেও কেন্দ্রীয় সরকারের চাকুরী , সেনা বাহিনী, উন্নয়ন বাজেট ইত্যাদি ক্ষেত্রে পূর্ব পাকিস্তান ছিল পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পিছিয়ে। এর কোন সুরাহা হয় নাই। হোসেন শহিদ সোহরাওয়ার্দী বলে ছিলেন পূর্ব পাকিস্তান ৯৮% স্বায়ত্বশাসন পেয়ে গেছে। পশ্চিম পাকিস্তানীদের বৈরী মনোভাবের কারণে তাঁর কাছে পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতার কথা বলা হলে তিনি জবাব দিয়েছিলেন তা করতে গেলে রক্তের গঙ্গা বয়ে যাবে। এই অবস্থার ঘোর পাকেই ঘূর্ণিত হচ্ছিল পাকিস্তানের রাজনীতি। পদে পদে বঞ্চিত হচ্ছিল পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ। এই সব বিষয় বিবেচনা করেই তিনজন ছাত্র নেতা সিরাজুল আলম খান , কাজী আরেফ আহমেদ ও আবদুর রাজ্জাক গড়ে তোলেন গোপন সংগঠন , যা বর্তমানে নিউক্লিয়াস নামে পরিচিতি লাভ করেছে। এই ‘নিউক্লিয়াস’ই ‘শিক্ষা আন্দোলন-১৯৬২’, ‘৬-দফা আন্দোলন-১৯৬৬’, ‘১১-দফা আন্দোলন-১৯৬৯’ গড়ে তোলে এবং সফলতার শীর্ষে পৌছে। এই নিউক্লিয়াসই জনগণকে উপলব্ধি করাতে সক্ষম হয় যে পাকিস্তান রাষ্ট্র কাঠামোর মধ্যে বাংলার মানুষের মুক্তি নাই।এই কাঠামোর মধ্যে ‘পূর্ব পাকিস্তান’ যত দিন থাকবে ততদিন বাঙালী জনগণ পাকিস্তানের দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হিসাবেই থাকবে। সে কারণেই নিউক্লিয়াসের উদ্যোগে গড়ে উঠে ‘জয় বাংলা বাহিনী’ বা বি এল এফ (ইবহমড়ষ খরনবৎধঃরড়হ ঋড়ৎপব). এবং মুজিব বাহিনী। সমস্ত আপোষকামিতায় লাথি মেরে এরা মুক্তিযুদ্ধের সূচনা করে এবং যৌক্তিক পরিণতির দিকে নিয়ে যায়। ‘নিউক্লিয়াস’ শুধু মুক্তি যুদ্ধ করেই দায়িত্ব শেষ করে নাই। সুখি সম্বৃদ্ধ স্বাধীন দেশ গড়ে তোলার দিক নির্দেশনাও তারা দেয়। তাই স্বাধীনতা উত্তর কালে তারা আওয়াজ তোলে মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণকারী সমস্ত দল ও শক্তিকে নিয়ে ‘জাতীয় বিপ্লবী সরকার’ গঠন করার। এসব দাবী উপেক্ষিত হয়, উপহাস করে এদেরকে বলা হয় ‘দুধের বাচ্চা’ ‘নাক টিপলে দুধ বের হয়’। আজ ইতিহাসের স্বাভাবিক ধারায় প্রমাণিত হয়েছে দলীয় ( তিন বৎসরের মাথায় এক দলীয়) সরকার কায়েম করে, উপনিবেশিক আমলের আইন কানুন বজায় রেখে, সেই আমলাতন্ত্র বহাল রেখে যে শাসন ব্যবস্থা চালু করা হয়েছিল তা জনগণের ভাগ্যের কোন কল্যাণ সাধন করতে পারে নাই। সেদিনে নিউক্লিয়াস প্রস্তাবিত ‘জাতীয় বিপ্লবী সরকার’ গঠন করে স্বাধীন দেশের উপযোগী আইন কানুন প্রণয়ন করে দেশ করার কর্মসূচী প্রত্যাখ্যান করে যে বিষবৃক্ষ সেদিন রোপিত হয়েছিল তার ফলশ্রুতিতেই আজ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ব্যক্তি ও পরিবারতন্ত্র। জনগণের সমস্যা নিয়ে রাজণ্যবর্গ কোন আলাপ আলোচনা পরামর্শ করেন না, দেশের সম্পদ ব্যবহার নিয়ে কোন আলোচনাও তারা করেন না। বলা হয়ে থাকে বাংলাদেশ অমিত সম্পদের দেশ। সারা বিশ্বে খনিজ সম্পদের যে মজুদ আছে, শুধু মাত্র বাংলাদেশেই তার সমপরিমাণ খনিজ সম্পদ মজুত আছে। এ কারণেই বাংলাদেশের প্রতি প্রভাবশালী দেশগুলো এতো আগ্রহী। তারা আমাদের বিভেদ ও অপশাসনের সুযোগ নিয়ে নিজেরা লাভবান হতে চায়। তাতে এদেশের শ্রমজীবী কর্মজীবী পেশাজীবী জনগণ চিরদিনের জন্য বিদেশীদের সেবা দাসে পরিণত হবে। কতিপয় ব্যক্তি ও পরিবার অবশ্য বিদেশীদের স্বার্থ পাহারা দিয়ে সম্পদশালী হলেও ব্যাপক সংখ্যক জনগণ হবে দুর্দশা ও দুর্ভোগের শিকার। এর আলামত অবশ্য এখনই দেখা দিতে শুরু করেছে। তাই সুশাসন কায়েম এবং জনগণের ঐক্য গড়ে তোলার মধ্যেই নিহিত আছে বাংলার শ্রমজীবী কর্মজীবী পেশাজীবী জনগণের মুক্তি। এই মুক্তির পথ দেখিয়েছেন স্বাধীনতার রূপকার সিরাজুল আলম খান। দুই কক্ষ বিশিষ্ট আইন সভা গঠন, দেশকে নয়টি প্রদেশে বিভক্ত করে প্রাদেশিক সরকার গঠন, প্রত্যেক প্রদেশে হাইকোর্ট বেঞ্চ স্থাপন, জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিল গঠনের প্রস্তাবসহ ১৪ দফা কর্মসূচী ঘোষণা করেছেন তিনি। একই দাবী সম্বলিত ১০ দফা কর্মসূচী গ্রহণ করেছে স্বাধীনতার পতাকা উত্তোলনকারী আ স ম আবদুর রবের নেতৃত্বাধীন জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল ( জে এস ডি )। এই বিষয়গুলোই আজ দেশের সচেতন নাগরিক সমাজের বিবেচনা ও আলোচনার বিষয়বস্তু। এতে প্রমাদ গুনছে এতোদিনে শাসনকারী রাজন্যবর্গ। এদের রাজনৈতিক কোন কর্মসূচী নাই, তাদের এই রাজনৈতিক দেউলিয়াপনার কারণে তারা একে অন্যকে গালি গালাজ আর খিস্তি খেউর করে নিজেরা টিকে থাকতে চাচ্ছে ক্ষমতায়। এদের কাছ থেকে সুবিধাভোগী এবং সুবিধা প্রত্যাশী প্রচার মাধ্যম বান্ধব বুদ্ধিজীবী মহল ‘টক শো’ ‘টক শো’ খেলার মাধ্যমে জনগণকে বুদ্ধিবৃত্তিক বিনোদন দিয়ে চলছে। এতে সাধারন মানুষের দুর্ভোগের অবসান হয় না। তারা খুজঁছে বিকল্প রাজনৈতিক অবলম্বন। তারা বুঝতে শিখেছে ‘নিউক্লিয়াসে’র কর্মসূচী ও নির্দেশনাই ছিল নতুন স্বাধীন দেশ গড়ার একমাত্র পথ। বর্তমানে খান সাহেবের ১৪-দফা ও জে এস ডির ১০ দফা কর্মসূচীর মধ্যেই রয়েছে সুশাসন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে জনগণের মুক্তির পথ। এই কর্মসূচী বাস্তবায়নের মধ্যেই বিলুপ্ত হয়ে যাবে স্বৈর শাসনের জটাজাল। শ্রমজীবী , কর্মজীবী, পেশাজীবী জনগণের এই চেতার কারণেই রাজনৈতিক দেউলিয়াগ্রস্থ রাজণ্যবর্গ অবাধ ভোটাধিকারের ভিত্তিতে নির্বাচনে ভয় পাচ্ছে। তাদের এই ভীতিজনক পরিস্থিতিতে দাম বেড়েছে ভাড়াটে লেখকদের। অশীতিপর বার্ধক্যের কারণে যাদের ভীমরতিতে পেয়ে বসেছে এবং আগে কি বলেছে আর এখন কি বলছে তা মনে রাখতে পারে না তারা আজ মাঠে নেমেছে স্বাধীনতার রূপকার সিরাজুল আলম খানের সমালোচনায়। ১৪ দফা কর্মসূচীর সাথে তুলনা মূলক সমালোচনা নয়, এদের লেখা খিস্তি খেউরে পূর্ণ। কর্মসূচীর তুলনামূলক সমালোচনা করতে গেলে এদের বুদ্ধিবৃত্তিক দারিদ্রতা প্রকাশিত হয়ে যাবে তাই গালিগালাজই এদের ভরসা। আবদুল গাফফার চৌধুরী মুক্তি যুদ্ধ কালীন সময়কে ‘নিরুদ্দিষ্ট নয় মাস’ বলে উল্লেখ করে বই লিখেছেন। ১৯৭০ সালে বঙ্গবন্ধু ও বাঙালীর বাঁচার দাবী ৬-দফার বিরুদ্ধে ‘দৈনিক ইত্তেফাক’, দৈনিক পূর্বদেশ’ সহ বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় কলামের পর কলাম লিখেছেন। ২০০১ সালের পর শেখ হাসিনার বিরুদ্ধেও তিনি লিখতে কসুর করেন নাই। তাই তাঁর লেখা নিয়ে কিইবা বলা যায় ! দেশের জনগণ তার অসভ্য গালিগালাজপূর্ণ লেখায় বিভ্রান্ত হবে না। সবশেষে হযরত মুহম্মদ (সাঃ আঃ) এর সময়ের একটি ঘটনা বলেই শেষ করি।

একদিন নবী করিম (সাঃ আঃ) সাহাবাদের নিয়ে বসে ছিলেন। এমন সময় সেখানে আসলো আবু জেহেল। সে এসেই নবীজী(সাঃ আঃ) এর চেহারা মুবারক নিয়ে অনেক বাজে কথা বললো এবং নিকৃষ্ট প্রাণীর চেহারার সাথে তুলনা করলো। সাহাবাগণ এসব শুনে যারপর নাই ক্ষিপ্ত হলো আবু জেহেলের প্রতি কিন্তু নবীজী(সাঃ আঃ)র সম্মতির অভাবে কিছুই বলতে পারলো না। আবু জেহেলের কথা শুনে নবীজী (সাঃ আঃ) মৃদু হাসলেন। আবু জেহেল চলে গেলো। সাহাবীদের মুখ ভার। কিছুক্ষণ পর হযরত আলি (রাঃ) সেখানে আসলেন। সাহাদের মুখ ভার দেখে তিনি কারণ জানতে চাইলেন। সব শুনে তিনি নবীজী (সাঃ আঃ) এর চেহার উত্তম বর্ণনা দিলেন। এবারও নবীজী (সাঃ আঃ) আগের মতোই মৃদু হাসলেন। তখন সাহাবাগণ কৌতুহলী হয়ে নবীজী (সাঃ আঃ)র এই আচরণের কারণ জানতে চাইলেন। নবীজী (সাঃ আঃ) উত্তরে সাহাবাদের বললেঃ এসব বক্তব্যে আমার চেহারার কোন হের ফের হবে না। রোজ কিয়ামতের দিনে যার চেহারা যেমন হবে , সে বর্ণনাই তারা আমাদের সামনে নিজ নিজ মুখে বর্ণনা করে গেলো।

লেখকঃ সাবেক জেলা ও দায়রা জজ। বর্তমানে এ্যাডভোকেট বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট , হাইকোর্ট বিভাগ , ঢাকা এবং বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে আইনের অধ্যাপক।
[email protected]
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

মানুষের জন্য নিয়ম নয়, নিয়মের জন্য মানুষ?

লিখেছেন রূপক বিধৌত সাধু, ১৭ ই এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৫:৪৭



কুমিল্লা থেকে বাসযোগে (রূপান্তর পরিবহণ) ঢাকায় আসছিলাম। সাইনবোর্ড এলাকায় আসার পর ট্রাফিক পুলিশ গাড়ি আটকালেন। ঘটনা কী জানতে চাইলে বললেন, আপনাদের অন্য গাড়িতে তুলে দেওয়া হবে। আপনারা নামুন।

এটা তো... ...বাকিটুকু পড়ুন

একটা গাছ কাঠ হলো, কার কী তাতে আসে গেলো!

লিখেছেন নয়ন বড়ুয়া, ১৭ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:০৬



ছবিঃ একটি ফেসবুক পেইজ থেকে

একটা গাছ আমাকে যতটা আগলে রাখতে চাই, ভালো রাখতে চাই, আমি ততটা সেই গাছের জন্য কিছুই করতে পারিনা...
তাকে কেউ হত্যা করতে চাইলে বাঁধাও দিতে পারিনা...
অথচ... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। কালবৈশাখী

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৭ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:২৪



গত পরশু এমনটি ঘটেছিল , আজও ঘটলো । ৩৮ / ৩৯ সে, গরমে পুড়ে বিকেলে হটাৎ কালবৈশাখী রুদ্র বেশে হানা দিল । খুশি হলাম বেদম । রূপনগর... ...বাকিটুকু পড়ুন

একজন খাঁটি ব্যবসায়ী ও তার গ্রাহক ভিক্ষুকের গল্প!

লিখেছেন শেরজা তপন, ১৭ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:০৪


ভারতের রাজস্থানী ও মাড়ওয়ার সম্প্রদায়ের লোকজনকে মূলত মাড়ওয়ারি বলে আমরা জানি। এরা মূলত ভারতবর্ষের সবচাইতে সফল ব্যবসায়িক সম্প্রদায়- মাড়ওয়ারি ব্যবসায়ীরা ঐতিহাসিকভাবে অভ্যাসগতভাবে পরিযায়ী। বাংলাদেশ-ভারত নেপাল পাকিস্তান থেকে শুরু করে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছিঁচকাঁদুনে ছেলে আর চোখ মোছানো মেয়ে...

লিখেছেন খায়রুল আহসান, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:০৯

ছিঁচকাঁদুনে ছেলে আর চোখ মোছানো মেয়ে,
পড়তো তারা প্লে গ্রুপে এক প্রিপারেটরি স্কুলে।
রোজ সকালে মা তাদের বিছানা থেকে তুলে,
টেনে টুনে রেডি করাতেন মহা হুলস্থূলে।

মেয়ের মুখে থাকতো হাসি, ছেলের চোখে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×