somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যঃ বাঁশ নাচানী

১২ ই মে, ২০১৮ রাত ৯:৫১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


বাঁশ নাচানীর এই দৃশ্য দেখে আমার মনে পড়ে গেলো ২৪/২৫ বছর আগের গ্রাম-বাংলার ঐতিহ্যবাহী সামাজিক অনুষ্ঠানাদির কথা। আমাদের এলাকায় দঃ ফোর্ডনগর (মধ্য খণ্ড) মফা ফকিরের বাড়ি,পার্শবর্তী এলাকা জব্বার ফকিরের বাড়ি চর দূর্গাপুর, জয়মন্টপ, সিংগাইর এবং ফোর্ডনগর ফকিরপাড়া আমার চাচা শানাল ফকিরের বাড়ি এই বাঁশ নাচানীর পর্ব শুরু হতো মাঘীপূর্ণীমার কয়েকদিন আগ থেকে।


৭ হাত বা ২২ হাত দৈর্ঘের কাঁচা বাঁশ কেটে লাল, সাদা, কালো,হলুদ ইত্যাদি রঙের কাপড় পরানো হতো বাঁশের গায়ে। এবং বাঁশের আগায় রঙ-বেরঙের জরির মালা পরানো হতো। বাঁশের ছোপ থেকে বাঁশ কেটে তাকে দুধ-জলে গোসল দিয়ে কাপড় পরানো হতো বাদ্য-বাজনা বাজিয়ে। বাজতো তখন করুন সুরে সানাইয়ের পাগল করা সুর। ফোর্ডনগর কলম ফকিরের মাজারের পাশে এই বাঁশ গুলো সাজিয়ে রাখতেন শানাল ফকিরের বাড়িতে উঠানো বাঁশ। তখন আমার বয়স ১৪/১৫। যেদিন বাঁশ কাটা হতো সেদিন রাতে আর ঘুম হতো না উৎসুক পাড়া প্রতিবেশীদের। রাতে একত্রিত হতাম সবাই। এবং অধিক রাত পর্যন্ত ধামাইল অনুষ্ঠান দেখে ফেরা হতো যার যার বাড়িতে। এরপর কয়েকদিন পর্যন্ত পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে বাঁশ নাচানী হতো।


যে বাড়িতে বাঁশ নাচানো হতো তারা বাদ্যবাজনার আওয়াজ শোনতেই আগে থেকেই দুয়ারের মাঝখানে একটি পাত্রে পানি রেখে দিতেন। তাতে কিছু কাঁচা দুধ ঢেলে দেয়া হতো। প্রথমে বাঁশগুলো সেই পাত্রে দাঁড় করিয়ে ভিজানো হতো বাঁশের গোড়া। এরপর এক এক করে বাঁশগুলো পাত্র থেকে উঠিয়ে গোলাকৃতিতে নৃত্য শুরু হতো ঢাক, ঢোল, কাশা, সানাইন বাজিয়ে। এই ঘূর্ণায়মান নৃত্যের মাঝে কয়েক মিনিটে সৃষ্টি হতো এক ভাবের আবেশ। মুহুমুহু হয়ে যেতেন সবাই ভাবাবেগে। বাঁশ নিয়ে যারা নৃত্য করতেন তাদের মাঝে কেউ কেউ ঢোল ও সানাইয়ের করুন সুরের মূর্ছণায় জ্ঞান হারিয়ে ফেলতেন কিছুক্ষণের জন্য। তখন তাদেরকে সরিয়ে নিয়ে মাথায় পানি ঢেলে হুশ ফিরিয়ে আনা হতো। এভাবে সারাদিন পাড়ায় পাড়ায় বাঁশ নাচিয়ে তারা সংগ্রহ করতেন চাল, ডাল, তরিতরকারি, মুরগ ইত্যাদি দ্রব্য। কেউ কেউ মেলা উপলক্ষে মানত করতেন খাসি, মুরগ ইত্যাদি। আরেকটি বিষয় ছিলো এই মেলায়- কেউ কেউ বিভিন্ন রোগ মু্ক্তির জন্য মানত হিসেবে ওজন করতেন। ওজন করানো বিষয়টা হলো- যদি কেউ ওজন মানত করতেন তাকে তার ওজনের সমপরিমান দ্রব্যাদি (চাল,ডাল,মুরগ,খাসি- যার যার সামর্থ অনুযায়ী) দিয়ে পাল্লায় ওজন করানো হতো। এবং সেই জিনিসগুলো মেলায় নিয়ে আসতেন।


যেদিন মেলা শেষ, সেদিন বিকেলে ফকির বাড়িতে রান্নার আয়োজন করা হতো সব কিছু মিশিয়ে খিচুড়ি। আমরা অনেক অপেক্ষার পর বন্ধুদের নিয়ে কলার পাতা বিছিয়ে একসাথে আনন্দ উপভোগ করে খিচুড়ি খেতাম। ওই রাতেই বাঁশগুলো নদীতে ডুবিয়ে ফেলা হতো। সেই রাতটিই ছিলো মাঘীপূর্ণীমার রাত। ফোর্ডনগর খেয়াঘাটে তখন খেয়া পাড়াপাড় শেষ। রাত তখন প্রায় ১১টা বা সাড়ে ১১টা। নদীতে বাঁশগুলো ডুবিয়ে ফেলার আগে শেষ ধামাইল শুরু হতো খেয়াঘাটে। ধামাইল হলো বাঁশ নিয়ে গোলাকৃতি নৃত্য। বাজবে বাঁশির করুন সুর, বাজবে বিরহী বাদ্যবাজনা। একবার সামনের দিকে একবার পিছনের দিকে এভাবেই বাঁশ হাতে নিয়ে চলবে অনেকক্ষণ পর্যন্ত গোলাকৃতির নৃত্য। একেই বলা হয় ধামাইল। এভাবে মধ্য রাতে বাঁশগুলো বংশী নদীতে ডুবিয়ে সবাই গোসল করে ফিরে আসতেন বাড়িতে। এই ছিলো আমার দেখা বাঁশ নাচানী পর্ব যা এখন চোখেই পড়ে না বললে চলে। এ প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের কাছে এই দৃশ্য আনকুড়া, অচেনা। শুধু যে বাঁশ নাচানী পর্ব হতো তাই নয়। আমি দেখেছি আমাদের গ্রামে শীতের সময় জারি গানের আসর বসতো। তখনকার প্রখ্যাত বয়াতীদের মধ্যে খৈইমুদ্দিন, আবুল সরকার, রশিদ সরকার, তরব আলী বয়াতী, আলেয়া বেগম, মধু বয়াতী (মমতাজের বাবা) তাদের পালা গানই চলতো পাড়ায় পাড়ায়। তখন মমতাজ বেগম ছোট। তার বাবার সাথে যেতেন বিভিন্ন গানের অনুষ্ঠানে। দেখেছি যাত্রাপর্ব, নৌকা বাইচ, লাঠি খেলা, গাশ্‌শি,বেদের নাচ। বেদের নাচ একটি মজার অনুষ্ঠান। এটা সম্ভবত বৈশাখের মাঝে হতো। হঠাত করে মধ্য রাতে একদল লোক হরেক রঙ্গের পোষাক ও সাজে সেজেগোছে হুড়হুড় করে ঢুকে পড়তো বাড়িতে। হারমনিয়াম, খোল ইত্যাদি বাজিয়ে গান ধরতো – আমার সংগে দুই জন বাইদানী… এই দলে গান করতেন আমাদের হিন্দুপাড়ার সন্তুষ, জিতেন্দ্রর ছেলে দূর্গা আরো ছিলেন হরিপদ, স্বপন, রতন প্রমুখ। এসব সামাজিক অনুষ্ঠানের মাঝে থাকতো না হিন্দু-মুসলমানের বাঁধ-বাঁধা। এভাবেই মিলেমিশে উপভোগ করতাম গ্রাম-বাংলার ঐতিহ্যবাহী পর্বগুলো।
বাঁশ নাচানীর ভিডিও দৃশ্য
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই মে, ২০১৮ রাত ৯:৫৩
৪টি মন্তব্য ৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছিঁচকাঁদুনে ছেলে আর চোখ মোছানো মেয়ে...

লিখেছেন খায়রুল আহসান, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:০৯

ছিঁচকাঁদুনে ছেলে আর চোখ মোছানো মেয়ে,
পড়তো তারা প্লে গ্রুপে এক প্রিপারেটরি স্কুলে।
রোজ সকালে মা তাদের বিছানা থেকে তুলে,
টেনে টুনে রেডি করাতেন মহা হুলস্থূলে।

মেয়ের মুখে থাকতো হাসি, ছেলের চোখে... ...বাকিটুকু পড়ুন

অহমিকা পাগলা

লিখেছেন আলমগীর সরকার লিটন, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১৪


এক আবেগ অনুভূতি আর
উপলব্ধির গন্ধ নিলো না
কি পাষাণ ধর্মলয় মানুষ;
আশপাশ কবর দেখে না
কি মাটির প্রণয় ভাবে না-
এই হলো বাস্তবতা আর
আবেগ, তাই না শুধু বাতাস
গায়ে লাগে না, মন জুড়ায় না;
বলো... ...বাকিটুকু পড়ুন

হার জিত চ্যাপ্টার ৩০

লিখেছেন স্প্যানকড, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩




তোমার হুটহাট
চলে আসার অপেক্ষায় থাকি
কি যে এক ছটফটানি
তোমার ফিরে আসা
যেন প্রিয় কারো সনে
কোথাও ঘুরতে যাবার মতো আনন্দ
বারবার ঘড়ি দেখা
বারবার অস্থির হতে হতে
ঘুম ছুটে... ...বাকিটুকু পড়ুন

জীবনাস্ত

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৪৪



ভোরবেলা তুমি নিশ্চুপ হয়ে গেলে একদম,
তোমার বাম হাত আমার গলায় পেঁচিয়ে নেই,
ভাবলাম,তুমি অতিনিদ্রায় আচ্ছন্ন ,
কিন্তু এমন তো কখনো হয়নি
তুমি বরফ জমা নিথর হয়ে আছ ,
আমি... ...বাকিটুকু পড়ুন

যে দেশে সকাল শুরু হয় দুর্ঘটনার খবর দেখে

লিখেছেন এম ডি মুসা, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:১১

প্রতি মিনিটে দুর্ঘটনার খবর দেখে অভ্যস্ত। প্রতিনিয়ত বন্যা জলোচ্ছ্বাস আসে না, প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনার খবর আসে। আগে খুব ভোরে হকার এসে বাসায় পত্রিকা দিয়ে যেত। বর্তমানেও প্রচলিত আছে তবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×