somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ঘনিষ্টতাই কি দূরত্ব আমাদের!

২২ শে ডিসেম্বর, ২০১৪ সন্ধ্যা ৭:৫২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :




Between my finger and my thumb
The squat pen rests.
I’ll dig with it.
---Seamus Heany


১.
সে হাসতে হাসতে বললো: দেখো জবা ফুল এঁকেছি।
আমি বললাম: আবার আঁকো।
সে জানতে চাইলো: কেন?
তাকে বললাম: ফুল হয়েছে নির্ঘাত, তবে জবা ফুল হয়নি। ওই যে পাপড়িগুলো, দেখো, জবা ফুলের মতো হয়নি। আবার আঁকো।
সে কিছুক্ষণ পর আবার ফিরে এলো: এই যে বেলি ফুল এঁকেছি।
আমি না বলে পারলাম না: আবার আঁকো!
সে ফিরে গেলো, এঁকে আনলো আরেকটা ফুল, কিন্তু তার এবারের দাবী ফুলটা গোলাপ।
আর আমি বাধ্য হয়েই বললাম, ফুল-যে আঁকতে পারো তা আমি নিশ্চিত, কিন্তু তুমি তো জবা, বা বেলি বা গোলাপ কোনটাইতো আঁকতে পারলে না। কিন্তু এর কোন একটা বা সবকয়টা আঁতে চাওয়াই তো তোমার চাওয়া, তাই না!

কিন্তু শিশুটির বিরামহীন এই উদ্যম আমাকে মাতিয়ে রাখতো। আর আমার অপেক্ষা দীর্ঘ প্রতীক্ষায় পরিণত হলো। তার মাথা ও হাতের পরিপূর্ণ এক সেতুবন্ধনের প্রতীক্ষায়, ভাবনা ও সামর্থের সাক্ষাতের আশায় সময় বইতে লাগলো।
কিন্তু আমি যদি ওর পিতা হতাম... হতাশা গ্রাস করতো একসময়, কিংবা রেগে যেতাম হয়তো, কিংবা অসীম ধৈর্য্যরে অধিকারীও হয়ে পারতাম। আমিতো শিশুটির বন্ধু! হতাশা বা রাগ আমার অভিধানে তাই লা যায় কখনোই জায়গা পেতো না। মাঝে মাঝে কোন কাজে মগ্ন থাকলে, তা টুটে যায় বলে মৃদু বিরক্ত হয়ে পড়িনি যে তা নয়, তবে তা কোনভাবেই তার প্রতি বন্ধুত্বে এক তিল টান পড়েছে এমন হয়নি কখনো। আর অই মৃদু বিরক্তি আমার চেহারায় ফুটে ওঠে না বলে- সে টেরও পায় না। বা আমার বিরক্তি নিয়ে তার-যে অনুমান সে-সম্পর্কে কখনোই শিশুটি নিশ্চিত হতে পারে না। সে প্রশ্নের উত্তরে আমার মৃদু হাসিটি পুরস্কার হিসেবে পেয়ে যেতো সবসময়েই।


২.
হৃদয় যখন কথা বলে চেহারা তা লুকাতে পারে না।
কিন্তু হৃদয় যখন কথা বলে না- তখন?
তখন কি চেহারা হৃদয়কে লুকিয়ে রাখে না?
রাখে হয়তো।
হয়তো নগ্ন কপটতা তা-ই সহজে ধরা পড়ে না!

এবার এক বন্ধুর কথা বলি, যে দাবী করে, আমার সাথে তার পঁচিশ বছরের ঘনিষ্টতা। দাবী করে, তার প্রতিটি লেখা আমার পড়া। দাবীগুলো সত্যি, অক্ষরে অক্ষরে সত্যি। আর দাবী করে, আমার কোন লেখাই তার পড়া হয়নি, পড়ার সুযোগও হয়নি, আর এমনকি আমিও তাকে কখনো পড়তে দেইনি। এতে ঘনিষ্টতার ছেদ-ভেদ কখনো কোথাও ধরা পড়েনি অবশ্য। আমার এই ব্যাপারটা নাকি আজকাল তার কাছে একটু রহস্যময়ই ঠেকে। আর আমার কাছেও তা রহস্যময় লাগে এখন, যে আমার এতো লেখা পত্রিকায় প্রকাশিত, তা কিভাবে এড়িয়ে যায় তার চোখ দুটি! একটি লেখাও কি সে পড়েনি, নাকি গোপনে সবই পড়েছে? যদি পড়ে থাকে, অনুমান করি কোন লেখাই ভাল লাগেনি তার। তাই বন্ধুর মুখের দিকে তাকিয়ে এই বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ- ‘তোমার কোন লেখাই পড়া হয়নি এখানো’- এই তার স্বীকারোক্তি। তখন ভাবি, আমরা কত-না ঘনিষ্ট! অপরের মুখ ম্লান করে দেয়া ছাড়া যে-শহরে কোন আনন্দ নেই- সে-রকম এক শহরেই জীবনান্দের কথাটা-যে কত মিথ্যে তার প্রমাণ পেতে থাকি আমি বন্ধুর মুখের দিকে চেয়ে; আমার মাথা নুইয়ে আসে- ভালোবাসায়।

বন্ধুত্বের গভীরতা এমনই যে, তার প্রতিটি লেখা আমার পড়া, আর আমার কোন লেখাই তার পড়া নয় অদ্যাবধি। আর আমাদের ঘনিষ্টতার বয়স পচিশ বছর, বই এক তিল কম নয়। অথচ আমি কোন দূরত্বই অনুভব করি না, তার সাথে। আরো সত্যি হলো, সেও। বন্ধুত্বের কোন শর্ত নেই, দায় নেই, জবাবদিহীতা নেই- অকৃত্রিম বন্ধুত্বের লক্ষণগুলো একে একে আমি পঁচিশ বছরে ফুটে উঠতে দেখি আমাদের মাঝখানে- তার এই সত্যনিষ্ট মন্তব্যে- গভীর কৃতজ্ঞবোধ করতে থাকি আমি বন্ধুর প্রতি। আমি বিরবির করি, ওগো বসন্তের দাগভরা মুখ আয়না তোমাকে কী বলে? আমি ভাবি নিস্কলঙ্ক একটা আয়নার সামনে পড়ে এবার আমারই দাগভরা মুখ ওঠলো ফুটে। দেখো আয়নার এই অনুপম ব্যর্থতা, মিথ্যে বলতে শিখলো না আজও সে। সে কি মিথ্যে বলতে জানে না? তাহলে বলি, মিথ্যে বলার ব্যর্থতাই তাকে দিয়ে আজ মিথ্যে বলায়। মেকাআপ করা মুখটির অতলে ডুবে থাকা মুখটি ফুটিয়ে তোলার সাধ্য কি আছে তার!


৩.
তার রাগক্ষোভভালমন্দ,
প্রেমঘৃণাভক্তি,
তার উচ্চাকাক্সক্ষা,
তার পরার্থপরতা
তার কপটতা- সব,
সবই আমার কাছে কী অকপটে স্বীকার করে সে!

আর আমাকে কত জায়গায় নিয়ে গেছে সে। এমন ভাবে বলছে, আমি যেনো যেতে চাই নাই। নাহ, আমিও গিয়েছি, আনন্দ পেয়েছি, আতঙ্কগ্রস্তও হয়েছি। যেমন তার প্রেমিকার বাড়ির গেটের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে থেকেছি- পাগলাটে প্রেমিকা- তার মাথার-তার অনেকগুলো ছেঁড়া। স্বাভাবিকভাবেই জুতার বাড়ি খাওয়ার তুমুল সম্ভাবনা নিয়েই দুই বন্ধু দাঁড়িয়ে ছিলাম দুপুররোদে! আর সত্যি ছিলো না কি ওই পাগলিটার প্রেম, তার প্রতি? কিন্তু এমনি আচরণ, শত খবরেও সে আর বেরিয়ে এলো না। আমরা শেষপর্যন্ত জুতো খেলাম না দিনদুপুরে রাস্তার উপরে। আশ্চর্য ব্যাপার হলো, তার ওই পাগলি প্রেমিকার পরিবারের কেউই বিয়ে করেনি। আর প্রত্যেকে চুটিয়ে প্রেম করেছে, অথচ আজও তারা প্রত্যেকে এক আশ্চর্য ব্যাচেলর পরিবার, তারা প্রত্যেকে সহোদর, সহোদরা- এই আশ্চর্য বিষয়টি নিয়ে কল্পনা রেশম-লালার মতো বন্ধুটির আপন সত্তা থেকে উদগত হয়ে তাকে জড়িয়ে পাকিয়ে একটা ঝুলন্ত গুটিতে রূপান্তরিত করে, যা থেকে সে একটি মথ হয়ে বেরিয়ে আশার স্বপ্ন দেখতো। কিন্তু ওই মানবিক লালা-লালসার-অন্তরঙ্গ-অকৃত্রিম জাল তাকে আটকে রাখে বহুদিন, জালে আটকা মাছের মতো। শেষ অবধি জালের ফোকর ছিঁড়ে সে একবারেই মুমুর্ষু মাছের মতো ছাড়া পায়। আর ওই প্রেমের তীব্র অন্তরঙ্গ অনুভব সে আঁকতে চাইতো লেখার ভেতরে খুব, অনুভবটি সদভাবে পুস্পিত হোক শব্দমঞ্জরিতে সে কি চাইতো না গভীরতর পিপাসায়! কিন্তু ওই ক্ষয়ে যাওয়া সাধারণ শব্দের আরো ক্ষয়াটে ব্যবহার তার ওই অনুভবকে কোনভাবেই ফুটে উঠতে দিতো না, ভাষার আঁচলে নিপুন কারুকাজের মতো। সে বলতো, জানো না এই শব্দটার ভেতরে আমার কত ইশারা-উদ্বেলতা, কত স্মৃতি-সৌরভ লুকিয়ে রয়েছে। আমি তার মুখের দিকে কিছুক্ষণ বোবা হয়ে তাকিয়ে থাকতাম, বন্ধুর সাথে শব্দেগুলোর অনাত্মীয়তা আবিস্কার করে। শব্দটির গা থেকে সামাজিক প্রতাপ ঝেড়ে সাফতুতরো করে নেয়ার ব্যর্থতা কিভাবে তাকে ব্যর্থ করে দিচ্ছে! শিশুটির কথা মনে পড়লো, আঁকে, আঁকতে থাকে সে; আঁকা হয় অন্য ছবি, অন্যমন। আর কান্ত হয়ে পড়লে একসময় ভাবে, ভাবতে থাকে, আঁকা হয়ে গেছে। আর আমি ভাবতে থাকি- কই অই অনুভব, তার স্মৃতির, তার বাস্তবতার, তার কল্পনার; তার শব্দগুলো, বাক্যগুলো আমাকে-যে সহযোগিতা করতো না! মাঝে মাঝে ভাবতে চাইতাম, কোনো শব্দকে ঘিরে তার চেয়ে আমার অনুভূতি কত বেশি ভোঁতা হয়ে গেছে!


৪.
এক সেন্টিমিটার দূরত্ব মানে
দশ হাজার মাইক্রোমিটার,
কিংবা এক মিটারের
শতভাগের মাত্র একভাগ!

সত্যি হলো, গভীরভাবে তাকে আপন ভাবি, ভাবে সেও। এইতো সেদিনও সে আমার বিপদে পাশে এসে দাঁড়িয়েছে- আর আমি এখনও ঢাকায় আছি- তার কল্যাণেই- সে আমাকে বেশ মোটা অংকের একটা টাকা দিয়ে বিপদ থেকে ৮০ ভাগ উদ্ধার করেছে। শুধু তাই নয়, আমার বিপদ দেখে সে আমার জন্য নিয়ে এসেছে প্রস্তাবনা, টিকে থাকার। সে নিজে চাকরি পছন্দ করে না, যদিও বহুদিন চাকরি তাকেও করতে হয়েছে। আর আমাকেও বলেছে চাকরি না করতে- আর প্রস্তাবনার আলোচনা শেষে আমিও আবিস্কার করেছি, সে আসলে বোঝাতে চেয়েছে- অন্যের অধীনে চাকরিতে মজা নেই, স্বাধীনতা কেড়ে নেয়- তবে বন্ধুর অধীনে করলে তা হয় না। আর আমি যদিও চাকরি করবো, কিন্তু লোকজন জানবে যে, আমি প্রতিষ্ঠানের একজন সত্ত্বাধিকারী। আর কাঁধে করে মালামাল দোকানে দোকানে পৌছে দিতে গিয়ে লোকজনের সাথে দেখা হলে বলবো- এইতো নিজের প্রতিষ্ঠান- তাই একটু কষ্ট করছি আরকি! না হলে লজ্জার ব্যাপার হয়ে দাঁড়াবে নাকি এ কাজ, আমার মতো একজন লোক তার বউয়ের অধীনে চাকরি করবে, এ কথা লোকে জানলে নাকি লজ্জার ব্যাপার হবে, লোকে তাকে মন্দ ভাববে। চাকরি খারাপ, কিন্তু বন্ধুর বউয়ের অধীনে চাকরি করা খারাপ নয়- খারাপ হলো লোকে তা জানলে- আমি বুঝতে পারলাম। আর সে যদি আমার ঘনিষ্ট না হতো, তা কি বলা তার পক্ষে সম্ভব হতো। আমি ভাবি, আমাদের ঘনিষ্টতা আমাদের মাঝে আসলেই কোন কৃত্রিমতার সৃষ্টি করেনি। সত্যিই করে নি, না হলে সেও অন্যদের মতো বন্ধুর বিপদের দিনে দূরে দাঁড়িয়ে থাকতো, আর ভাবতো: ধূর ওকে দিয়ে কিচ্ছু হবে না। আমি ভাগ্যবান, এমন একজনকে আমি পেয়েছি এই নির্বান্ধব শহরে। আরো ভাগ্যবান যে, আমাদের মাঝে কোন ফাঁরাকই নেই।



৫.
সে বলতো, তুমি চলেছো
কোন না কোন কসাইখানার দিকেই!

সে বলতো, ছাগলগুলো কোথায় যাচ্ছে জানে না। মনে হতো সে বলতে চাইছে, ওইযে ছাগলটা, যে রোজ ঘাস খেতে তার মনিবের সাথে মাঠে বেরিয়ে পড়ে, আজও মনিবের হাতে যার গলার রশিটা ধরা, দেখতে পাচ্ছে, মনিব তাকে নিয়ে পরিচিত পথের বাইরে এই এখন পা বাড়িয়েছে। বাঁশঝাড়ের নিচ দিয়ে যে পথ, সে পথ দিয়ে ছাগলটা এগিয়ে যায়, তার গায়ে বাঁশঝাড়ের আলোছায়া খেলা করে। মানিবের পেছন পেছন গ্রামটা পেরিয়ে যাচ্ছে সে, বারবার থেমে পড়ছে এই অচেনা পথে এসে, আশংকায়। ফের মনিবকে পাশে দেখতে পেয়ে এগোচ্ছে। যেনো অনিশ্চিত এক আশায়। একসময় বাজারে পৌছে যায় তারা।
বাজারে আরো অনেক ছাগলের ভীড়ে নিজেকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে অবাক হয়ে যায়, এতো ছাগল একসাথে সে দেখেনি আগে। আরো অবাক হয় ভেবে- তাদের কাউকেই আগে কখনো দেখেনি। আর অচেনা এক লোকের হাতে তার মনিব তার গলায় বাধা রশিটা তুলে দিয়ে চলে গেলো একসময়। ছাগলটা দেখতে পেলো অচেনা এক লোক তার গলার রশিটা ধরে আছে। সে অনেক ছাগলে ভীড়ে আরো একটা একা ছাগল হয়ে পড়ে। চেঁচাতে থাকে সে, আশংকায় আর আতঙ্কে। একসময় দেখতে পায় সে একা নয়, চেঁচাচ্ছে আরো অনেকে, আরো অনেক ছাগল তার পাশে, আর সবারই রশি ওই অচেনা লোকটার হাতেই। আর এমন দৃশ্য এমন ঘটনা তাদের জীবনে ঘটে নি আগে কখনো। একে অপরের কাছে অচেনা এতোগুলো ছাগল দেখতে পায়, এক অচেনা লোক তাদের গলা রশি পাকিয়ে নিয়ে হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছে। বিস্ময় কিছুক্ষণ তাদের স্তব্ধ করে রাখে। আর একটা চেঁচিয়ে ওঠার সাথে সাথে সবাই ফের চেঁচিয়ে ওঠে। এরপর থেমে যায় আবার। আতঙ্কে দুশ্চিন্তায় সবারই পেছনে লেজটা নড়তে থাকে। তবে তারা একে অপরের মুখের দিকে চেয়ে ওই অচেনা আতঙ্ককে স্পষ্ট করে চিনতে পারে না।
একসময় তাদের রশিতে টান পড়ে। জোরেসুরে সবাই চেঁচিয়ে উঠে আবার। কেউই সামনে এগোতে চায় না। রশি আরো টানটান হয়, আর আশ্চর্য পেছনে আচমকা একটা কাটার কঞ্চি হামলে পড়ে, কামড়ে দেয়, একগুচ্ছ কাটা মাংসে গেঁথে যায় সরাসরি। এই আঘাত সরাসরি আত্মায় গিয়ে আর্তনাদ করে উঠে। এক জোর সম্মিলিত চিত্কারের ভেতর তারা চলা শুরু করে, চেঁচায় আর চেঁচায়- অচেনা লোক আর অচেনা পথ ধরে বাধ্য হয়ে চলতে চলতে। একসময় অচেনা এক শহরে উঠে আসে ওরা। এতো আংশকায় এতো পথ হেঁটে ট্রাকে করে ছুটে এসে আরো কয়েকটা শহর পেরিয়ে নতুন আরেকটা শহরে আবার হাঁটে আর চেঁচায়।
মধ্যরাত তখন। মধ্যরাতে বয়ে চলেছে চমত্কার বসন্ত বাতাস বইছে। ওই বাতাসে শহরের টুকরো টাকরা কাগজ, রঙিনমোড়ক তখন এদিক ওদিক গড়ায়। আর হলুদ আলোগুলো ছাগলগুলোর ছায়াকে তাদের সামনের একেকবার বিশাল দীর্ঘ আর অদ্ভুত আকৃতির করে তোলে- যেনো কোন দরবেশের ঢিলেঢালা শতচ্ছিন্ন কালো এক জোব্বা রাস্তায় খিঁচড়ে চলেছে তাদের সামনে দিয়ে। আবার ছায়াগুলো তাদের দিকে গুটিয়ে আসতে আসতে পেছনের দিকে ক্রমে বাড়তে থাকে, বড়ো হতে থাকে, আর পেছনে সেই দরবেশী জোব্বাটি আবার ফুটে উঠে। এভাবে হলুদ আলো ছাড়ানো লেম্পপোস্ট একটার পর একটা পেরিয়ে এগিয়ে যায় তারা। তবে তারা পেছনের এই দৃশ্য দেখতে পায় না, শুধু চেঁচিয়ে চলে অজানা আশংকায়। আর অনুভব করে, আত্মার ভেতর থেকে বিদ্রোহ শেষ পর্যন্ত কাটাভরা ডালে আঘাত খেয়ে তীব্র আর্তনাদের অধিক কিছুই হয়ে উঠতে পারে না। অচেনা লোক আর অচেনা পথ তাদের কোথায় নিয়ে যায় তারা কল্পনাও করতে পারে না। কল্পনাও করতে পারে না, এক কৃষ্ণবিবরের মতো রাতের দীর্ঘ কালো রাস্তা তাদের টেনে নিয়ে চলেছে সরাসরি ধারালো ঝরঝরে এক চাকুর নিচে- যার এক পোছে মুক্তি ও মৃত্যু একসাথে ফিনিক-বিজলির মতো দেখা দেয়। তাদের ভাবনায় কসাইখানার কোন ছবি নেই। কিন্তু যখন ওই ছবিটি সামনে আসে তখন পরিচিত মনিবটি আর কোথাও নেই। এমনকি পথ বেয়ে টেনে আনার সেই লোকটিও পাশে নেই। আরেক নতুন লোক। হাতে চকচকে চাকু। কিন্তু কেন তা- শুধু আবিস্কার হয় তখনই, যখন তাকে চাকুটির নিচে এরই মধ্যে শোয়ানো হয়ে গেছে।
হয়তো ছাগল নিয়ে দুএকটা শব্দ বারবারই বলতে চাইতো আমার বন্ধুটি, মাঝরাতে ঢাকা শহরের কোন না কোন পিচঢালা প্রশস্ত পথের মাঝেখানে দাঁড়িয়ে, আমার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে থেকে- আর আমি এভাবেই কল্পনা করতে চাইতাম প্রতিটা ধাপ, তার ভাঙাচুরা দুএকটা কথার ভেতর থেকে তার অনুভূতিটি খুঁজে নিতে চেয়ে। আমি ভাবতাম- এ তার ভেতরে চলমান এক অন্তগর্ত সন্ত্রাস, যার রূপকল্প বাইরের জগতে সে খুঁজে পেয়েছে, তা যতো স্থুলই হোক না কেন। আর এ গল্পের ভেতের আত্মনিয়ন্ত্রহীনতা আর তা ফিরে পাওয়ার ব্যর্থতা আর অমোঘ মৃত্যু ভয় জড়িয়ে আছে। আর সে বলতো, না না, এ হলো মানুষের অস্তিত্বের অন্ধকার, মানুষ বস্তুকে যেমন ভালবাসে, তেমনি ভালবাসার বস্তুকে অস্তিত্বের স্বার্থেই চাকুর নিচে প্রায়ই চালান করে দিতে বাধ্য হয়। আমার গা শিউড়ে উঠতো। সে হাসতো। বলতো, তুমি এখনো এতো নিস্পাপ রয়ে গেছো। রেগে গিয়ে বখনো কখনো এ কথার সাথে যোগ করতো, কবে বুঝতে শিখবে! আমি তার দিকে তাকিয়ে থাকতাম। সে বলতো, তুমি চলেছো কোন না কোন কসাইখানার দিকেই! আমি বলতাম, হা মৃত্যুর দিকে যেতে পারো না বলেই, বাধ্য হয়ে চলেছো কোনো না কোনো কসাইখানার দিকেই! বলে একটু হাসতাম!
আমি অপেক্ষা করতাম, সে তা লিখে উঠুক তো দেখি। আমার চোখে ভাসতে থাকে কসাইখানার দিকে এগিয়ে চলা ছাগলের দল আর তাদের আর্তচিত্কার, যারা জানে না কোথায় ছুটে চলেছে এই মাঝারাতে, সোডিয়াম আলোর নিচ দিয়ে, অচেনা এক শহরের ভেতরে।
সে আমাকে পাঠক হিসেবে চায়। আর আমি অপেক্ষায় থাকি একদিন সে ফুটিয়ে তুলবে এসব, তার অন্ধকার উপচানো ভাষায়- হাজার ওয়াট বালবের নিচে চামড়া ছড়ানো ছাগলের মতো যা অতিদৃশ্যমান হয়ে দৃশ্য-বিজলি হয়ে উঠবে।


৬.
কেউ কেউ বলতো-
ওর স্বভাবটাই এমন!

বন্ধুটির বাসায় কেউ যেতে পারে না- কারণ সে বিশ্বাস করতে পারে না কাউকে, তাছাড়া তারও রয়েছে ভীষণ ছুঁত-কাতরতা। আর আমিই নাকি শুধু তার বাসায় গিয়েছি, আর সে শুধু নাকি আমাকে বাসায় নিয়ে যাওয়ার মতো মনে করে। তার বেডরুম, ডাইনিংরুম পর্যন্ত। সত্যি আমি তা বিশ্বেসও করি। আর সারাদিন সে ঘর পরিষ্কার করে, চাদরটা ঝাড়ে, এক কণা ধুলিও সে সইতে পারে না। নিজের নখগুলো খুটে খুটে ঝলমলে করে। কোনকিছু স্পর্শ করতে গেলেই স্পর্শের আগে একবার, পরে একবার হাত ধোয় সে। জীবাণুতে তার ভীষণ ভয়। একবার এক আধ-ন্যাংটো পাগলিকে দেখে তার ভাল লেগে যায়। সে তার জন্য জামা কেনে। তারপর প্রস্তাব করে তার সাথে থাকবে কিনা। পাগলিটা রাজি হয়। তারপর সে ডেটল কিনে, সাবান কিনে। বাসায় ফিরে যায়। আর নিজ হাতে পাগলিটাকে স্নান করায়। নতুন জামাকাপড় কিনে এনে পড়ায়। তাকে খাওয়ায়। ঘুমানোর জায়গা দেয়। তাকে সুস্থ করে। তারপর অনুুরোধ করে তারে শরীর সঙ্গী হতে। পাগলিটা খুশি হয়। সঙ্গী হয়। তাকে খাওয়ায়, ঘুমাতে দেয়, তারপর বিদায় দেয়। পাগলি কোথায় চলে যায়- সে আর জানতে পারে না। সে সবই আমাকে বলে। সে বলে আশ্চর্য কী জানো, পাগলিটা একবারও থেকে যেতে চায়নি! দেখো আমি এর চেয়ে বেশিই করতে চাই, এর চেয়ে বেশিই ভালবাসতে চাই, কিন্তু সমাজ তোমাকে এর চেয়ে বেশি করতে দেবে না। চরিত্রহীন এক শহরে সবাই যখন চরিত্র বাঁচাতে ব্যাকুল, তখনও কিছুই সে লুকায় নি আমার কাছে। সে আমার ঘনিষ্ট নয়তো কী হতে পারে আর?


৭.
মগডালে দাঁড়িয়ে কবিতা পড়া
আমাদের ভালবাসার সমানই ছিল উঁচু
কবিতা ঠিক ততটা উচু ছিল না-যে!

আমরা সে বছর সেই দিনটিতে সকাল নয়টার দিকে বেরিয়ে পড়ি। যে বছর যে দিনটাতে হিনি নোবেল পেয়েছেন বলে খবর পাই আমরা। আরামবাগ ফকিরাপুল থেকে বেরিয়ে চলে যাই- শাহবাগের রমনা পার্কে। দেখি কয়েকটা কলেজগামী মেয়ে সকালের রোদে খিলখিল করে হাসছে আর বন্ধুর সাথে আড্ডা দিচ্ছে। সে বলে, আড্ডা না প্রেম- তুমি কোন দুনিয়ায় বাস করো। আমি টের পাই, আমি এই দুনিয়ার কেউ না। আমরা রমনা পেরিয়ে সাহরোয়ার্দি পার্ক পেরিয়ে ধীরে টিএসসি হয়ে ঢাকা মেডিক্যাল হয়ে একময় রিকশায় নবাবপুর রোড দিয়ে চলে যাই সদরঘাটে। মেঘে আধো-ঢাকা আকাশের নিচে ব্রহ্মপুত্র নদ ধীরে বইছে। আমরা এর পাড়ে বসে গল্প করি। লঞ্চ আসে যায়। নৌকাগুলো ইঞ্জিনের শব্দ তুলে ছুটে যাচ্ছে পূব থেকে পশ্চিমে, আর পশ্চিম থেকে পূবে। দুজনেই বসে পড়ি। তার প্রেগনেন্ট-ভাব ফিরে আসে। সে থমকে থাকে, কিছুক্ষণ শব্দহীন। সামনের চলন্ত বস্তু প্রাণী মানুষ কিছুই দেখতে পাচ্ছে না। তার পকেট থেকে কলম বোরোয়। সে সাদা কাগজ কিপে সাটা একটা রাইটিংবোর্ডে লিখতে থাকে। আমি অপেক্ষা করি। লেখা শেষ হয় একসময়।

একটা জেটিতে গিয়ে বসি আমরা। নদীর পানিতে হাঁটু ডোবাই। ময়লা পানি। তাই পা তুলে ফেলি। বাতাস ভেজা পায়ে কেমন ঠান্ডা অনুভব ছড়িয়ে দেয়। অনেক মাঝি আর কুলি কাজ করে চলেছে। তাদেরকে দেখি আমরা। তারা একটা মেয়ের মাথে মশকরা করা শুরু করে। বোঝা গেলো, তাকে তারা সবাই তাদের শয্যায় পেয়েছে। তাই তার প্রতি সবই খোলামেলাভাবে উচ্চারিত হচ্ছে। একজন জোরেসুরে একটা ঠাট্টা করলো। মেয়েটি অপমানিত বোধ করলো না, বরং হাসলো। তারপর বললো, যতো বড়াই করো শ্যাম, আধইঞ্চি তোর এক ইঞ্চিও হবে না। এ কথা শুনে সবাই হাহা হিহি করে লুটিয়ে পড়লো। আর আমি অনুমান করলাম। সে হয়তো তার কাছে আজও যায় নি। তাই তাকে অপমান করা, বাধ্য করা। সেখান থেকে আমরা ফিরতে লাগলাম।

আমরা সকালেই জেনেছিলাম, একজন কবিতায় নোবেল পেয়েছেন। নাম সিমাস হিনী। আমরা একথাও জানতে পারি- কবি যখন এ সংবাদ পায়, তখন সে এক সমুদ্র তীরে গাছের উপর বসে চারপাশের শোভা দেখছিলেন। আর অবাক হই একজন বুড়ো এই বয়সে গাছের কাঁধে বসে প্রকৃতির শোভা দেখতে পারে ভেবে। আমাদের দেশেতো একজন তরুণ হয়ে উঠার সাথে সাথেই গাছে উঠা ভুলে যায়। বুড়ো হবার আগেই বুড়ো হয়ে যায়। আমার বন্ধুটি ঠিক করলো গাছের মগডালে উঠে তার কবিতা শোনাবে আমাকে। তো তার সদ্য লেখা কবিতা সাথে নিয়ে সেই সদরঘাট থেকে ফিরে আসি আবার শাহবাগে- সাহরোয়াদি পার্কে। পার্কের মাঝখানে তালপকুরের পাড়ে একটা জামগাছে আমরা চড়ি। আর মগডালের দিকে উঠি, মাটি থেকে প্রায় ত্রিশপয়ত্রিশ ফুট উপরে হাওয়ায় আমার বন্ধুটি কবিতা পাঠ করতে থাকে। দেখি বিকেলের সূর্য হেলে পড়েছে পশ্চিম আকাশে- আর একটু পড়েই তার মুখ লাল হয়ে উঠবে। সে পড়তে থাকে। আমি শুনি। আমি বলি- কি বোঝাতে চেয়েছো? সে তার দাবী জানাতে থাকে। আর আমি টের পাই তার দাবীর সাথে তার লেখার ভাষা, তার ব্যবহৃত শব্দের কী বিপুল দূরত্ব। তাকে বলি, আবার লেখ- সে আবার লেখে, আর আমি তাকে লেখার অর্থটি কী দাঁড়িয়েছে তা বলি। আর সে বলতে থাকে, না আমি তা বোঝাইনি, আমি আসলে এই বুঝিয়েছি। আমি বলি, তাহলে ওইযে শব্দটা ওটা বদলাতে হবে। ওইযে দৃশ্যকল্পটা ওটা ঠিক তোমার দাবীকৃত বক্তব্যের সাথে খাপ খায় না, ইত্যাতি ইত্যাদি। তার খসড়া কবিতা থেকে কত ধরনেরই না সম্ভাব্য অর্থ দাঁড় করিয়েছি- বন্ধুটির দাবীকৃত অর্থের বাইরে ছিটকে পড়েছি বারবার। ভাবতে থাকি, নিজের লেখা নিয়ে সে বিস্ময়ের গহনে চুপটি মেরে থাকলেও ওসব লেখায় এক ফোঁটা বিস্ময় কিংবা বুদ্ধিবৃত্তির সাক্ষাত আমি কেন কখনোই পাইনি। এটা কি তার প্রতি অমনোযোগ, তা প্রতি প্রেমের অভাব? কিংবা তাকে কি খুব ঈর্ষা করি, নাকি তাকে আসলে দূরে ঠেলতে চাই না!
কিন্তু তার ওই যে বিহ্বলতা, ওই যে বিস্ময়, যা ভাষায় এখানো আসেনি, তাতো মিথ্য নয়, বরং কত সত্যি। আমি আসলে ভাবি, সেই প্রকৃত বিস্ময়ের দেখা পেয়েছে, বারবার। কারণ বিস্ময় তো তাই যা বাকহীনতাকে ভাষায় নয় ভঙ্গিতে ফুটিয়ে তোলে, ভাষার অভাবে যে ভঙ্গি ফুটে উঠে মানুষের চেহারায়। তাকে সৌভাগ্যবান মনে হয় আমার। খুব সৌভাগ্যবান। ভাবি লেখকরা আসলে সত্যিকার অর্থে বিস্ময়ের দেখা পায় না, কারণ তাদেরও ভাষিক দক্ষতা, ওই দক্ষতাই বলে দেয়, তিনি আসলে বিস্মত হতে পারেননি, তাই তার ভাবনা থমকে পড়েনি। বিস্ময় তা-ই যেখানে ব্যক্তির ভাবনা থমকে যায়। শিক্ষা-ও অভিজ্ঞতা পরিধি ফেটে যায়। ভাবনা থমকে যাওয়া মানে ভাষায় টান পড়া। ভাষায় না কুলানো। তো লেখকরা বিস্মিত হলেও আমার বন্ধুর মতো ব্যাকুল হতো, চুপটি মেরে যেতো এবং তা ফুটিয়ে তুলতে ব্যর্থ হতো। লেখক হতে পারতো না। আর ভাবনা যাদের চলমান, মানে ভাষা যাদের চলমান, তারা আসলে নিজের অভিজ্ঞতা আর ভাবনার আর জানাশোনার জগত যেখানে থমকে পড়ে সেই বিন্দুতে পৌছাতে পারেন না বলেই লিখেন, লিখে যেতে পারেন, সেখানে পৌছার আশায়। আমার বন্ধুটি আসলে নিস্তব্ধতার দেখা পায়, দেখা পায় আমি ভাবি, তার বিস্ময়কে ভাষায় দেখতে না পেয়ে। কিন্তু এসব কথা তাকে কী করে বলি, সেতো বন্ধু আমার! আর আমার অন্য বন্ধুরাতো লেখক নয় কেউ, তাকে তাই অনেক বেশিই পছন্দ করি আমি, আমারও উন্মাদনার এই ‘সমাজমূল্যহীন’ কর্মকাণ্ডের উত্সাহদাতা এই বন্ধুটি।
কিন্তু বন্ধুটি তার দাবী করা অর্থের সপক্ষে তার লেখাটি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। দাঁড়িয়ে থাকে গাছের মগডালে, নাজুক ডালটিতে। আমার মনে হতে থাকে: কেন সে পেঁচাকে কোকিল বলে চালাতে চায়। কেন বসন্তকে বর্ষা দিয়ে বোঝাতে চায়। কেন সে মহিষকে কুকুর দিয়ে বোঝাতে চায়। সবই তার কাছে প্রতীক হয়ে উঠে। সে সবকিছু ঘুরিয়ে বলতে চায়, সরাসরি বলায় আপত্তি তার, অর্থ নাকি সীমিত হয়ে পড়ে! তাই সবকিছুই একে অপরের বদলি হয়ে উঠে আর সেই প্রতীক আর বদলি- খাটা নামের অরণ্যে খেই হারিয়ে ফেলি আমি- আর কত কথা বলি আমরা- ভাল লাগা মন্দ লাগা বা উত্কৃষ্ট নিকৃষ্ট বা অন্যকারো কবিতার সঙ্গে তুলনার বিষয়ে নয়, শুধু লেখকের দাবীর সপক্ষে ভাষার বিশ্বস্ততার খোঁজে এক সময় কান্ত হয়ে পড়ি, মৌনতার মাছে আমি আশ্রয় নিই। কিন্তু কই সে বিশ্বস্ততা? বাস্পীভূত হয়েছে কি তা, আর আমিও কেন তা টের পাই না? আমি বিস্ময়শূণ্যতার চাপে আমি বিস্মিত হয়ে পড়ি, স্তব্ধবাক শব্দবন্ধটির গর্তে পড়ে যাই।

কেউ যদি ভুলেও ভাবে, তার ব্যর্থতায় আমার আনন্দ হয়, কী বিপুল ভুলই না বুঝবে আমাকে, বন্ধুর ব্যর্থতায় আমিও বিপুলভাবে ব্যর্থ হয়ে পড়ি; কষ্ট পাই। কারণ, আমিও কি সবার মতো চাই না, একটা সফল অস্তিত্বের সঙ্গ?


৮.

Between the conception
And the creation
Between the emotion
And the response
Falls the shadow
---T. S. Eliot

লেখকের ঘনিষ্ট হলে, আর লেখকের চাওয়া জানা থাকলে কখনো কখনো লেখাটি লেখকের চাওয়ার সাথে কী বিপুল দূরত্বকে সামনে ধরে রাখে, তাও জানতে হয়। সেই সামুদ্রিক দূরত্বকে জয় করতে চেয়েছি আমি- লেখকের কলমের ভেতর দিয়ে- কিন্তু দূরত্ব কমে না- কমতে চায় না। কাককে পেঁচা বলে চালালে, আমিও পেঁচাকে যেমন পাই না তেমনি কাককেও পাই না। কারণ সেতো শুধু পাখিটাই বোঝাতে পেরেছে, আহা পাখিটিও কি ঠিকঠাক হয়েছে? ঠিকঠাক পাখি বলে কি কিছু আছে? এমন একটা প্রশ্নের পেছনে আর্কেপটেরক্সকে দাঁড় করিয়ে বন্ধুর লেখাটির বৈধতা নির্মাণও করতে চেয়েছি নিজের কাছে- একটা আর্কেওপটেরিক্সশূন্য পৃথিবীতে আমি ওইসব আর্কেওপটেরিক্সে হাঁপিয়ে ওঠি- আলোচনা থামিয়ে দেই। বলি, ঠিক আছে মেনে নিলাম। এর বিপরীতে, আসলে দুজন লেখকের মত কখনোই এক হওয়ার নয়, বলে বন্ধুটি অতৃপ্তি নিয়ে চলে যায়। আমি ভাবি, তাহলে আমরা একে অপরের পাঠক হবোই বা কিভাবে?
কিছু সিনিয়র লেখক (কবি নয়, গল্পকার নয়, প্রবন্ধকার নয়, রম্য লেখক নয়, সাংবাদিক নয়) তার সেসব লেখা বই আকারে বের হলে তার লেখার প্রসংশা করেছে। তার আত্মবিশ্বাস বাড়িয়ে দিয়েছে। একে একে দশপনেরটা বইও বেরিয়ে গেছে তার। আর তার সব বই নিজের খরচে বের করা।
আর আমার একটাও না। আমার প্রকাশকও নেই, টাকাও নেই। আর আমি সারাবছর তার পকেটের টাকায় রিকশায় শাহবাগ আসা যাওয়া করি। সে আমাকে খুব ভালবাসে, সে আমি নিশ্চিত। আর আমিও তাকে অনেক পছন্দ করি এতেও সন্দেহ নেই। কিন্তু ঘনিষ্টতা এই শব্দটার মাঝেও আমি অন্তরঙ্গতা আর বিশ্বস্ততা টের পাই না। আর তার শব্দের খেল আর প্রতীকের প্রতাপ আমাকে সবসময়েই বলে গেছে, লাভ নেই। তবু আমি আশা ছাড়িনি, আজও। এইতো সেদিন তার পা-ুলিপি দিয়ে গেলো আমাকে।
আমি তাকে অনেক কবিতা দেগে দিলাম। এগুলো মনে হলো, এক ধরনের সরলতা নিয়ে সহজতা নিয়ে স্পষ্টতার কাছাকাছি একটা কিছু। তো বললাম টিক না দেয়া কবিতাগুলো যেনো সে না ছাপে। কিন্তু সেগুলোকে সে নিজের মতো ঘষে মেঝে ছেপেছে। আর স্পষ্টতা প্রত্যাশী লেখার পাশে ওইসব লেখা যেনো অরণ্যসঙ্কুল হয়ে আছে। আমার খারাপ লাগে। কিন্তু লেখকের স্বাধীনতা-ওখানেতো কিছুই বলার নেই। আমি নিজেও তা সহ্য করবো না।
আর তার পত্রিকাও আমাকে দেয়। সে তার পত্রিকার সম্পাদক মালিক, তাই সে আমাকে উপহার দিতে পারে। আমি তার লেখা আজও পড়ি। আর ভাললাগা না লাগার উপর তো আমারও জোর নেই। তাই ভাল না লাগা নিয়ে কখনো কিছু বলি না। ভাললাগা নিয়েই বলতে আমরা যেখানে কৃপণ, সেখানে ভাল না লাগা নিয়ে অরবতাই একমাত্র পথ। আর আমার ভাল না লাগলেও অন্যদের যে ভাললাগছে সে কথা কি অস্বীকার করা যাবে- তারা যেই হোক না কেন- তাও অমূল্য- এই ভালগার কুপ উপচানো সমাজে। সে কি তার টের পায় না, পায়, কিন্তু সে তার পত্রিকাটি আমাকে ঠিকই উপহার দেয়, এ তার বন্ধুত্বেরই মহত্ দিক। তো আমরা ঘনিষ্ট বলেই আমাদের কিছুই লুকোছাপা নেই। কিছুতেই জোরাজুরিও নেই।
কিন্তু ঘনিষ্টতা শব্দটি কি এক পাক্ষিক যখন আমরা লিখি। আর প্রকাশ করি। আর তার চোখের সামনেই পত্রিকাগুলো পড়ে থাকে, যেখানে আমার লেখা ছাপা আছে। আমার লেখা মুদ্রিত পত্রিকাগুলোর সম্পাদক আমি নই। তাই তাকে দিই না আমি। তাই কি সে আজও আমার লেখা একটাও পড়েনি। এই যে অবস্থা এটি আর কখনোই কাটবে না। ভয় পাই ভাবতে- তার কোন লেখাই আমার হৃদয়ে দাগ কাটেনি বলেই কি তাকে বন্ধু হিসেবে কোথাও এক তিল ফাঁক না রাখলেও ঠিকই কোনএকভাবে দুই গোলার্ধ দূরত্ব রেখে দিয়েছি আমি তার সাথে। আমি একটি লেখাও তাকে কখনো পড়ে শোনাই নি, তার দাবীটিতো আর কেউ না জানলেও আমিতো জানি, যে মিথ্যে নয়। আর সে এখন অনেক বইয়ের জনক আর সব বই সে আমাকে উপহার দিয়েছে। সে সাহিত্য সম্পাদক। তার পত্রিকাগুলোও আমাকে উপহার দিয়েছে আর তাদের অনেকগুলো সংখ্যাই বেশ দামী। আমি তাকে কিছু মূল্য পরিশোধের চেষ্টা করতে গিয়েছি, এ কারণে যে, আমিতো আসলে এসব ফ্রি পাওয়ার যোগ্য না। কিন্তু সে চেষ্টায় বন্ধুত্বের ধমকে পড়ে শুধু বিব্রত হয়েছি। আমরা ঘনিষ্ট বন্ধু। কিন্তু আমি কি তাকে লেখক মনে করি? কিংবা সে কি মনে করে তাকে আমি লেখক বলবো? হয়তো সে আশা করে না। কিন্তু সে ওই দাবীটি আদায় করে নিতে চায়, যেকোন ভাবে? এই চাওয়াটা ইতিবাচক। কিন্তু আমি তাকেতো লেখকই মনে করি, সেই শুরুর দিন থেকে। কিন্তু কবি না, গদ্যকার না, গল্পকার না, সম্পাদক না, রম্যলেখক না... ইত্যাদি ইত্যাদি। এর ওই একটিই কারণ, সত্যি সত্যি, ঘনিষ্টতা- সেখানে বন্ধু হিসেবে আমি জেনে গেছি তার প্রতিটি লেখার ভাষার সাথে তার চাওয়ার তার আকাক্সক্ষার আন্তঃনাক্ষত্রিক দূরত্ব। না কি, লেখকদের আসলে এমনই ঘটে, একটা বলতে হয়ে যায় আরেক? আত্মনিয়ন্ত্রণহীনতা, আর ভাষার বিশ্বাসঘাতকতা মিলে কারো ইচ্ছের সমাধি হয়ে উঠে যখন কোন লেখা তখন তাকেই কি আমি লেখা বলবো? কিংবা এরপরও এই সমাধিক্ষেত্র যখন মুদ্রিত হয়ে কারো না কারো কিংবা অজস্ত্র না বলি, বেশ কিছু পাঠকের ভাললাগাটুক আদায় করে নেয়, হতে পারে একতিল, আর এসবই ছেপে বেরুলে বই হিসেবে কেউ না কেউ যখন এই বইয়ের পক্ষে কলম ধরে ভাললেগেছে বলে, তখন আমি ওই বাস্তবতাকে কিভাবে অস্বীকার করবো? সে কারো না কারো কাছে নিশ্চয় লেখকের অধিক, কবি, গল্পকার কিংবা প্রাবন্ধিক। আর সে আমার বন্ধু। আমি চাই সে আমার বন্ধ থাক সারাজীবন। কারণ, নির্বান্ধব শহরে এর চেয়ে সেরা উপহার আর হয় না। আমিও মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়েছি, অন্তত একজনের কাছে কোনভাবেই লেখক হওয়া যাবে না। এবং কবি, বা গদ্যকারতো নয়ই। আর এর আগে এ বিষয়টা আমি হয়তো অচেতনভাবেই পালন করে এসেছি। পার্থক্য এটুকুই।

৯.
আবার শৈল্পিকতা, ছি ছি!

আমার বন্ধুটি আমার আরও কয়েক বন্ধুকে জানালো, পঁচিশ বছর ধরে আমার কাছে সে একজন কবি, তার প্রতিটি কবিতাই আমার পড়া। অথচ আজও আমার কোন কবিতাই তার পড়া হয়নি। আমি মনে মনে বলি, আমিও আমার বন্ধুর এতো লেখা পড়লাম, একটা কবিতাও তবু পড়া হলো না আজও, অবশ্য প্রতিটি লেখার পেছনে তার দাবীর সাপেক্ষেই কেবল এ কথা বলা হচ্ছে। তবে আশা ছাড়িনি আজও, আগামিতে পড়ার সুযোগ পাবো নিশ্চয়, হয়তো তা হবে কোন কবিতা। এই হলো আমাদের ঘনিষ্টতা, বিশ্বস্ততা। একে অপরকে চেনা। মজার কথা, দুএকটা আমার মতে কবিতা হলেও, সেগুলো তার চোখে আবার কবিতা নয়! আর কবি হতেই হবে কেন, লেখক হওয়া কি যথেষ্ট নয়, আর লেখা যদি শৈল্পিক হয়ে উঠে, তাইতো যথেষ্ট। আ-বার- শৈল্পিক! ওই চিরবিতর্কিত বিষয়- ছি, ছি!


১০.
দৃশ্যের সাদৃশ্যতাকে
আমরা
মর্মের সাদৃশ্যতা ভেবেছিলাম!

আমরা তখনো সিমাস হিনি পড়িনি, কিন্তু তার নোবেল পাওয়া আমাদের অনুপ্রাণিত করেছিলো। এমনকি হীনিকে গাছে বসে অবসর কাটাতে শুনে আমার বন্ধুটিও গাছে উঠে কবিতা পড়তে চেয়েছিলো। আর আমিও কি ওই কবিতা শুনি নি, এই ঢাকা শহরে? যেখানে গাছই এক দুর্লভ ব্যাপার, সেখানে আবার গাছেও উঠে কবিতা পড়ার মতো আরো দুর্লভ একটি ঘটনা ঘটায়, দূরের এক গ্রাম থেকে আসা এই লেখক বন্ধুটি! কিন্তু কেন এতোদিনেও তার কোন কবিতাই পড়ার সুযোগ হলো না আমার! একে বন্ধুত্বের দুর্ভাগ্য ছাড়া কী বলতে পারি আমি। আমরা এই ঢাকা শহরে সিমাস হীনির মতো আচরণ করেছিলাম, তাকে পড়িনি, তাকে বুঝিনি, তার সাথে আমরা একটা মিল তৈরি করেছিলাম মাত্র। আমরা হীনির প্রেম, দ্রোহ আর কবিতার নাগাল চাইনি সেদিন। টেক্সেট-দুলর্ভতায় সম্ভবও ছিলো না এতো দ্রুত তাকে বুঝে ওঠা। আর যে গোপন কথাটি বলতে নেইÑ আমরা দুজনইতো ইংরেজি জানি না। শুধু দুএকটা অনুদিত কবিতা হয়তো পড়ে থাকতে পারি আমরা। তাই আন্তঃমহাদেশীয় দূরত্বতো এই সাদৃশ্যময় কর্মকা-ে কমে-আসার কথা ছিলো নাÑ আমরা তা বুঝতে চাইনি, বা পারিনি, ঘনিষ্টতার রূপ ধরে দূরত্ব নিজের পরিচয় জানান দিয়ে গেলো আমাদের মাঝে। বন্ধুত্ব বুঝি এভাবেই পূর্ণতা পায়, এই দুরত্বের ধাঁধায়! আমার এক আলোচনায় বন্ধুটি তার নাম না-থাকায় আবিস্কার করেছে এক বিস্ময়, আমার অন্য বন্ধুদের সামনে। বিস্ময়ই আবিস্কারের কথা নয় কি? আমিও কপটতা করি কিভাবে, সে যে বন্ধুরই প্রতি সম্মান!
আমি মনে মনে বলি, কপটতা এমন এক নগ্ন বিষয়- যদি এর ভেতর দিয়ে হৃদয় কথা বলে ওঠে, এর মুখেমুখি হয়েও এমন ভান করি যেনো আমরা এর মুখোমুখি হইনি। না, তা হতে পারে না।
তাই তার কথা শুনে আমি মৃদু হেসেছি, এর অধিক কোন শব্দ বা নীরবতা আমি ব্যয় করিনি। কারণ বন্ধুতো, বন্ধুত্বের জন্য আমিও একটু অসত্ই থাকি না। আমার অন্য বন্ধুরা কি তার লেখা পড়েনি? কিংবা হয়তো তাকে পড়ে নিবে প্রয়োজন হলে। আমি ততদিন অসত্ই থাকি। আর বন্ধু দেখুক আমাদের বন্ধুত্ব কী চমত্কার- একে অপরের মুখ ম্লান করে দেয়ার বাইরেও কিছু সম্পর্ক আজও আছে- তার নামই হয়তো বন্ধুত্ব। আর অন্যদের যদি তার লেখা ভালোও লাগে, তবে তা তার যেমন জিত্, আমারও।


১১.
আমাদের ঘনিষ্ঠ কথাগুলো
দূরত্ব আবিস্কার কর শুধু!

আর আমাদের মাঝে কোন ফারাক যে ছিলো না- আজও অকপটে আমরা একে অপরের কাছে তা নিয়ে কত কথা বলি- সত্যনিষ্ট হয়ে। বন্ধুত্ব রক্ষার খাতিরে আমি বন্ধুর কাছ থেকে লুকিয়ে রাখি প্রেম, দ্রোহ আর লেখালেখি!- কোন ফাঁরাক নেই আজও আমাদের মাঝে! আমার বন্ধুটি বুঝতে চাইলো না- সবই লেখা, কিন্তু সবই কবিতা, বা গল্প বা প্রবন্ধ নয়! আর এসব শ্রেণীকরণের বাইরেও কত কিছুই না শৈল্পিক হতে পারে।
- ভেবে বিস্মিত হই, তুমি কি কখনোই প্রেমে পড়ো নি? কই কখনো বললে না তো আমাকে।
- (মৃদু হাসি)...
- আচ্ছা, তোমার কি কখনো যৌনতেষ্টা পায় না, কী আচর্য কখনোই তোমাকে ছটফটও করতে দেখিনি।
- (মৃদু হাসি)...
- তোমার কোথাও বেড়াতে যেতে ইচ্ছে করে নাÑ কোথাও বেড়াতে যাওয়ার কথাওতো কখনো তুমি আমাকে বলো নি।
- (মৃদু হাসি)...
- যতোবারই আমাদের দেখা হই, তুমি কখনো কেন কথা শুরু করো না।
- (মৃদু হাসি)
- তুমি কখনোই কেন আমাকে ডেকে নিয়ে ঘুরতে বের হও না, তোমার কি কখনোই ইচ্ছে হয়নি একবার আমাকে খুঁজে বের করতে?
- (মৃদু হাসি)...
- আমি তোমাকে ডাকলে তুমি কখনোই না বলো নি। সত্যিই ছুটে এসেছো। আশ্চর্য এটাও।
- (মৃদু হাসি)...
- তোমার উপর কত অভিযোগ দিলাম, কই তুমি তো একবারও আমার সম্পর্কে কোন অভিযোগ করলে না।
- (মৃদু হাসি)...
- তুমি কখনো কিছুতে আনন্দিত হয়েছো এমন কিছুওতো আমাকে নিজ থেকে কখনো জানাও নি।
- (মৃদু হাসি)...
এভাবে আমার বন্ধুটি তার বিস্ময়ের তালিকা দীর্ঘ করতে থাকে। আর আমিও মৃদু হাসার বাইরে যেতে পারি না। কারণ, বন্ধুত্ব!


১২.

জীবনকে যারা
ব্যাকরণের মতো চেয়েছে
আমরা
তাদের কেউ নই

পার্কের ভেতরে এসে দাঁড়াই আমরা। দুপুর তিনটা। নীরবতা চারদিকে। আমাদের কাছ থেকে একটু দূরে দুজন লোক ঘাসের উপর শুয়ে আছে। ডালের পাতার ছায়া তার শরীরের উপরে কাঁপতে থাকে। তাদের শার্ট তাদের পাশে ভাঁজ করে রাখা। তারা নিজেদের কোন জগতের ভেতরে সময়কে অতিক্রম করছে আমরা কখনোই জানতে পারবো না। বলতে চাইলাম। কিন্তু বলা হলো না। না বলাই ভালো হলো। আমার ভাবনা ভেঙে পড়লো না। অনাহত রইলো, নিজের গভীরে। বললেই, বন্ধুর ভিন্নমত তাকে খান খান করে দেবে। আমি কি রোমান্টিক মনের নই! যে বাস্তবতার আঘাত সইতে চাই না, তাই নিজের ভাবনাকে নিজের ভেতরে লুকিয়ে রাখে?

- তুমি কি আস্তিক?
- নীরবতা
- তুমি কি নাস্তিক?
- নীরবতা
- তুমি কী?
- নীরবতা!
- তুমি কি ডান?
- নীরবতা
- তুমি কি বাম?
- নীরবতা
- তুমি কি?
- নীরবতা।

বলতে চেয়েছিলাম, আমি মানুষ, আমার নীরবতাকে মেনে নাও। তাকে আমি বলতে পারি না। এসব প্রশ্ন জরুরি নিশ্চয়। তবে আরো জরুরি, পৃথিবীর সমস্ত মানুষ এক সাথে কখনো এক বিশ্বাসে স্থির হয়নি আজও। আর ভবিষ্যতে হবে কি না, জানি না- আশা রাখি হবে। বা না হলেও, এসব প্রশ্নে মানুষের একটা অধিকারও হরণ করা চলবে না। অতীতে হরণ করা হয়েছে। আজ হচ্ছে। তাই বলে ভবিষ্যতেও হবে- এমন ব্শ্বিাসের ভেতর কেবল হতাশাই আছে। মানুষ তার আশা ও হতাশার চেয়ে বড়ো।

বন্ধুটি কেমন চুপ করে থাকে।

- এই সব প্রশ্নে আজ চারপাশে কেবল আঘাত। চারপাশে এসব প্রশ্নের উত্তরের বিপুল অপব্যহার।
- তুমি কি আঘাতের মুখোমুখি হতে চাও না।
- সময় আমাকে মুখোমুখি করছে। আর সত্য হলো, আমরা সবময়েই এসবের মুখোমুখি, এবং ন্যাংটো হয়ে আছি।
সে চুপ করে থাকে।
- আমরা এসব প্রশ্ন আবিস্কার করেছি অস্তিত্বকে সহজ ও সহনীয় করতে, কিন্তু এখন আমরা এসব প্রশ্নের শিকারে পরিণত হয়েছি। এসব প্রশ্ন ফাঁদমুক্তির চাবি হিসেবে একদিন জন্মেছিলো আমাদের মনে। আর আজ এসব প্রশ্নই ফাঁদ নির্মাণ করছে আবার।
সে চুপ করে থাকে।
- আমার কথা কখনোই নির্ভুল নয়।
সে চুপ করে থাকে।
- আমার নীরবতাও কখনো নির্ভুল নয়।
সে চুপ করে থাকে।

একটা কাক ডেকে উঠে। দুপুরের নীরবতা তীব্র হয় পার্কের ভেতরে। আর পাশের রাস্তা দিয়ে ছুটে যাওয়া গাড়ির শব্দ আমাদের কাছে এই পার্কের গভীরে শব্দ বলেই গণ্য হয় না। আবার আমরা হাঁটি, হাঁটতে থাকি।
বলতে পারিনি, দেখো আজ নতুন করে আরেকটা নীরবতার পরিধি জেগে উঠছে আমাদের মাঝে, তা কি আমাদের জন্য সহনীয় হবে? আমরা হাঁটি, চুপচাপ হাঁটতে থাকি, পার্কের ভেতরে পাক খাই। নীরবতার ভেতর আমাকে দুভাগ করে একভাগকে অন্তর-বন্ধু বানাই, আরেকভাগ আমি হই, আর কথা বলি, চুপকথা দেশ তৈরি করি।
- আসলে আমরা ব্যাকরণ বই-ই কোনদিন খুলে দেখিনি।
- আসলে আমরা ব্যাকরণের চেয়েও অধম
- আসলে আমরা আমাদের অজ্ঞাতে ব্যাকরণের কারাগারেই নিস্পিষ্ট হয়েছি
- আসলে ব্যাকরণ আর জেনেটিক্স আর বহুমতের ঘূর্ণীতে শেষাবধি জীবন কী কেমন হওয়া উচিত তা বোঝার আগেই ফুরিয়ে যাচ্ছি আমরা।
- জীবন কী বা কেমন হওয়া উচিত- এ প্রশ্নই এক অর্থে হারাকিরি।
- জীবন কী বা কেমন হওয়া উচিত- এ প্রশ্নটি জীবন নয়, জীবনের ভেতর থেকে উৎসারিত একটি প্রশ্নমাত্র, যাকে এড়াতে পারি না আমরা
- এসব প্রশ্নই জীবনের অনিবার্য উচ্চারণ আর জীবনের সাথে অনিবার্য বিচ্চিন্নতাকে আর অবিচ্ছিন্নতার পিপাসাকে উস্কে আমাদের কতশতভাগে ভাগ করে রেখেছে
- এসব প্রশ্নই জীবনকে জীবনের পথে পাওয়ার ক্ষেত্রে বাধা
- এসব প্রশ্নই সৃষ্টি করেছে আমাদের চারপাশে নিñিদ্র কারাগার
- অথচ কারাগারকে বাগান ভাবতে চেয়েছি আমরা কতবার
- আর ছিদ্রে চুইয়ে আসা আলোকে ভেবেছি বুঝি সমাধান
- অথচ দেয়াল স্বচ্ছ হলেই কি যায় আসে আমাদের, সেতো দেয়ালই
- আমরাও বাকরণদাস আমাদের অজ্ঞাতে
- আমরা ব্যাকণের কেউ নই
- নাহ কেউ নই
- আমরা অন্ধকারের কেউ নই
- আমরা অন্ধাকরেই আছি
- আমরা আলোর কেউ নই
- আমাদের মুখ ঝলসে দিচ্ছি তীব্র আলো
আমরা হাঁটি পার্কের ভেতরে দুপুরের রোদ আমাদের, মাথার উপর এসে পড়ে। আমার চুলের গোড়ায় ঘামের বিন্দুগলি গড়িয়ে চিকুর বেয়ে গাল ছাড়িয়ে টপ করে শার্টের ভেতরে গলে যায়। জুলফি আর বুকের লোম লোনা হয়ে উঠে। আমাদের মাথার উপর গাছের নগ্ন ডালের ছায়া কালো-কঙ্কালের মতো হেঁটে যায়। বন্ধুকে আচমকা বলিÑ জানো আমার এক বন্ধু প্রেমের অভাবে আত্মহত্যা করেছে।
- এমনিতো ঘটে।
- জানো সে ছিলো বহুগামী
- এমনওতো হয়
- জানো সেছিলো এডিক্ট
- তা হতেই পারে
- ধারণা, প্রেমের সংকটের কারণেই
- জানো আমার এক বন্ধু প্রাক্তন প্রেমিকাকে খুন করে ফেলেছে
- এমনতো ঘটেই
- জানো, মেয়েটার তিনটা বাচ্চা
- জানো, আমার এক বান্ধবীর বাবা তার প্রেমিককে মেরে পুঙ্গু করে দিয়েছে
- এমনতো ঘটেই
- মজার ব্যাপার কি জানো, ওই বাবাও কিন্তু নিজেই প্রেম করে বিয়ে করেছে, আর সেও শ্বশুড়ের মার খেয়েছে
- এসবই খুব সাধারণ ঘটনা।
- কেন এসব সাধারণ ঘটনা হবে
- তুমি এখনো কোন পৃথিবীতে আছো। এতো কাঁচা রয়ে গেছো এখনও তুমি। তুমি নতান্তই একটি শিশু।
- আমি চুপ করে থাকি
আমরা হাঁটি। হাঁটতে থাকি পার্কের ভেতরে। আর দেখতে পাই, এক বেঞ্চিতে বসা দুটো অসম বয়েসী মানুষ কী নিবিড় হয়ে আছে। মেয়েটি বয়েসে অনেক ছোট লোকটির তুলনায়। আমরা হাটি, পাক খাই, কেন পাক খাই? জানি না কি? সে কি জীবন নয়? বন্ধুটিকে, মজার ব্যাপার, আমি কোনদিন গান গাইতে শুনিনি- অথচ কী পাগলের মতোই যৌনতা আর কবিতার পেছনে ছুটে যায়- যৌনতা মিটে কিন্তু কবিতার স্বাদ পেলেও, কবিতা ফলানোর পিপাসা সে আরেক বিস্ময়, মাঝে মাঝে মনে হয়, সে এক শামুক যার সমস্ত সংবেদন তীব্র হতে হতে ভেতরে সেধিঁয়ে গেছে, আর নির্জনতা পেলেও যা খোলস ছেড়ে আর বাইরে আসে না। সে কি একাই দায়ী এ দুর্ভোগ নির্মাণে।
- জানো না, সব বলা যাবে না।
- কেন?
- বললে, কেউ মেনে নেবে না, না হয় বলবে পাগল। জীবন খুবই মায়াবী আর নিষ্ঠুর।
- আমি চুপ করে থাকি
আমরা পার্কের ভেতরে হাঁটি। আর হাটতে থাকি। একসময় চা খেতে বাইরে আসি। দোকানের বেঞ্চিতে বসে ভাবি, অন্যান্য দিনের মতো আবারও সন্ধ্যা হয়ে এলো।


১৩.

জীবনকে
দেখতে হলে
চাই
হাজার একটা
চশমা।

বন্ধু আমার মাঝে খুজে বেড়িয়েছে একজন বোদ্ধ রসিক পাঠক, যার সন্ধান সে পায়নি অন্যকোথাও, আর পায়নি আমার মাঝেও। আর আমি খুজে বেড়িয়েছি তার মাঝে আমি যা হতে পারিনি, সেই বন্ধুটিকে। আমাকে সে পাঠকযোগ্যতায় উত্তীর্ণ করতে চেয়েছে, আমি তাকে লেখক যোগ্যতায়। তার চিন্তা অনুযায়ী। সে আমার মাঝে তার অভাবটুকুর সন্ধান করেছে, আর আমিও তার মাঝে আমার অভাবটুকুর দেখা পেতে চেয়েছি। আর ব্যর্থ হয়েছি দুজনেই। তার মাঝে যে পাগলামিটা, তা-ই আমার অভাব। তার মাঝে যে শান্ত বোধি তার লেখাকে বোঝতে চেষ্টা করে -তাই তার অভাব। কিন্তু দুজনের অভাবটুকুর বিনিময়ে কেমন ব্যর্থ হয়ে গেছি আমরা।
জীবনকে দেখতে হলে চাই হাজার একটা চশমা। আর আমারতো নেই একটাও। সিমাস হীনি একটা চশমা পেয়েছিলেন, আর কী আশ্চর্য অহংকার ফুটে উঠেছিলো তার ঘোষণায়। Between my finger and my thumb/The squat pen rests./I’ll dig with it.
আর আমার বন্ধুর আছে হয়তো একটা, আমি যার সন্ধান পাইনি, তার কোন লেখায়, কিন্তু যখন গভীর অনুভব নিয়ে চোখ বুজে মগ্ন হয় কাগজে কলমে, আমি অপেক্ষায় থাকি হয়তো একটা চশমা এবার তৈরি হবে, সে আশা জলাঞ্জলি হলে ভাবি, কী থাকে আর আমার! এমন পাগলামি না থাকলে, অনুভব করি, আমার পক্ষে এমনকি লেখক হওয়াও সম্ভব নয়- তা সত্য হোক বা মিথ্যে হোক।
এমন একটা শিশু বন্ধু থাকাও কমভাগ্যের কথা না এই বন্ধু-দুর্লভ শহরে- যে বন্ধনহীনতার আনন্দ আনে প্রাণে। কারণ আমি তার ভাষার বাইরের ওই বাসনাটুকু ওই সৌরভটুকু ওই বাস্তবতাটুকুর দেখা হয়তো একদিন পাবো, ভাষার জালে সোনালি রুপালি মাছের মতো লাফাতে থাকবে সেই ফসলগুলো- আমি জানি আনন্দ বঞ্চিত হবো না সেদিন। আর না ধরা পড়লে কি বন্ধুত্ব মিথ্যে হয়ে যাবে? যেতে পারে। তবু একে অপরের মুখের দিকে তাকিয়ে যেনো সেদিনও হেসে উঠতে পারি আমরা, আমাদের ব্যর্থতায়।


১৪.
শিশুটি বড়ো হলে কী হতো, একটু!
বুড়োদের মতো সেও
নিজের ভেতর একটা শিশুকে পেতো!

তো শিশুটি একদিন দাবী করেছে, তোমার তো একটা ছবিও দেখিনি। তোমার ছবি না দেখে কি করে বলি, তোমার আঁকা হয় কিনা। আমি হাসি। ঠিকই বলেছে। আমিতো কখনোই তার কাছে আমার কোন ছবি নিয়ে যাই নি। তাছাড়া আমি তার কাছে কি আঁকিয়ে হতে চেয়েছি? চাইনি। সে শিশু বলে তার কাছে আকিয়ে হতে চাইনি, তা কিন্তু নয়, তার কাছে আমার আকিয়ে হওয়ার কথা মনে কখনো আসেনি। আমি শুধু বলি, তুমি যেদিন পাখির বদলে শালিক কাক কোকিল আকতে পারবে- সেদিন আমার আনন্দটা অনেক বেড়ে যাবে। সে দিন শুধু বন্ধু না বলে বলবো, আমার একজন আকিয়ে ছোট্ট বন্ধু আছে! বঝুলে? আর অধিক গর্বিত হবো! শিশুটি বুঝতে চাইলে না তা। আমি বললাম, তুমি যেহেতু আমার একটা ছবিও দেখোনি, অতএব আমি যে তোমার কাছে আকিয়ে নই এ কোনভাবেই মিথ্যে নয়। আমার ব্যর্থতাও অস্বীকারের নয়। কিংবা তুমি কেন কখনো ভাবছো না শালিক ময়না টিয়া গোলাপ জবা না একে শুধু ফুল শুধু পাখিই তোমার জন্য যথেষ্ট নয়? কিংবা আরো কিছু। তোমার অন্তরঙ্গ হলো না তোমার আকা- এই কষ্ট থাকলো তোমার। কিন্তু তাকে বলতে পারি নি তা। কিংবা শিশু এমন কঠিন কথা কি বুঝবে?
বারবার শিশুটির দাবী অনুযায়ী তার চাওয়াটিকে আমি পরবর্তি ছবির দিকেই ঠেলে দিয়েছি। আর আমার অপেক্ষা দীর্ঘ প্রতীক্ষায় পরিণত হয়... কারণ, কারণ আমরাও এই কান্নাকাটির বাইরে যেতে চেয়েছিলাম।


১৫.
This is the way the world ends
This is the way the world ends
This is the way the world ends
Not with a bang but with a whimper.
---T. S. Eliot

কী অনুপম ব্যর্থতা নিয়ে আমিও দাঁড়িয়ে রয়েছি বন্ধুটির মতোই... দুজনের দুরকম মুখ সময়ের হাত ধীরে এক করে দেবে হয়তো, আর তারপর হয়তো শূন্যই করে দেবে, তবে তাকে কখনোই কি বিস্মৃত হওয়া বলা যাবে? আমরাতো স্মৃতিযোগ্যই হয়ে উঠিনি, কখনো!
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

অন্যায় অত্যাচার ও অনিয়মের দেশ, শেখ হাসিনার বাংলাদেশ

লিখেছেন রাজীব নুর, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৪:৪০



'অন্যায় অত্যাচার ও অনিয়মের দেশ, শেখ হাসিনার বাংলাদেশ'।
হাহাকার ভরা কথাটা আমার নয়, একজন পথচারীর। পথচারীর দুই হাত ভরতি বাজার। কিন্ত সে ফুটপাত দিয়ে হাটতে পারছে না। মানুষের... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সাংঘাতিক উস্কানি মুলক আচরন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৪



কি সাঙ্ঘাতিক উস্কানিমুলক আচরন আমাদের রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর । নাহ আমি তার এই আচরনে ক্ষুব্ধ । ...বাকিটুকু পড়ুন

একটি ছবি ব্লগ ও ছবির মতো সুন্দর চট্টগ্রাম।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৮:৩৮


এটি উন্নত বিশ্বের কোন দেশ বা কোন বিদেশী মেয়ের ছবি নয় - ছবিতে চট্টগ্রামের কাপ্তাই সংলগ্ন রাঙামাটির পাহাড়ি প্রকৃতির একটি ছবি।

ব্লগার চাঁদগাজী আমাকে মাঝে মাঝে বলেন চট্টগ্রাম ও... ...বাকিটুকু পড়ুন

দ্য অরিজিনস অফ পলিটিক্যাল জোকস

লিখেছেন শেরজা তপন, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১১:১৯


রাজনৈতিক আলোচনা - এমন কিছু যা অনেকেই আন্তরিকভাবে ঘৃণা করেন বা এবং কিছু মানুষ এই ব্যাপারে একেবারেই উদাসীন। ধর্ম, যৌন, পড়াশুনা, যুদ্ধ, রোগ বালাই, বাজার দর থেকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×