সোসিওলজিস্টরা মানুষের এথনিক কমিউনিটির উপর বিশ্বাসকে দেখেন প্রাইমরডিয়াল লয়ালিটি বা আদিম বিশ্বস্ততা হিসেবে। যেখানে যুক্তি, জ্ঞান বিচারের মুল্য দুর্বল। যুক্তি জ্ঞান বিচারের মুল্য ইউরোপীয় রেনেসাঁ উদ্ভূত বলে মাক্স ভেবার একে র্যাশ্নাল মনে করেন। তিনি দেখান যে, যুক্তিকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে মানুষ ধর্ম নিয়েও প্রশ্ন তৈরি করল। তাকে অযৌক্তিক আখ্যা দিল। ইরাকে চলমান সংকটের মধ্য দিয়ে সোসিওলজিস্টরা প্রাইমরডিয়াল লয়ালিটিকে খুঁজে পেয়েছেন। তারা মনে করেন ইরাক তিনটা মেজর এথনিক এন্টিটিতে বিভক্ত। শিয়া, সুন্নি, কুর্দি। তারা ইসলামের অনুসারি হলেও তাদের প্রাইমরডিয়াল লয়ালিটি বা এথনিক এন্টিটিকে আঁকড়ে আছেন। যেখানে ইসলাম ধর্ম হিসেবে তাদের এই ট্রাইবাল কন্সাসনেসকে দূর করতে পারে নি। কোন কোন সমাজবিজ্ঞানী মনে করেন এটা শুধু ইসলামের বেলায় নয়। সকল ধর্মের ব্যাপারেই একই ধারণা প্রযোজ্য। তারা খ্রিস্ট ধর্মে প্রটেস্টাণ্ট-ক্যাথলিক বিভাজনকে আনেন উদাহরন হিসেবে। ধর্মকে সামাজিক, রাজনৈতিক মতবিরোধ দূর করতে ব্যর্থ প্রমান কিংবা বিরোধ জিইয়ে রাখার ব্যাপারটা এখানে গুরুত্বপুর্ন।
এব্যাপারে প্রগতিশীল ধর্মবেত্তাদের বক্তব্য হল, তারা মনে করেন ইরাকের ব্যাপারটিকে শুধুমাত্র সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকেই বিচার করলে চলবে না। এর একটা রাজনৈতিক দিকও বাকি আছে। এখানে সামাজিক মতবিরোধের ব্যাপারটিকে রাজনীতি দিয়ে বুঝতে হবে। তার সাথে সাথে ধর্মের মূল এসেন্স আসবে আলোচনাকে র্যাস্নাল করতে। যেমন, ইরাকের চলমান সংকটে বিভেদ-বিভাজঙ্কে উস্কে দিয়ে ধর্মের মূল এসেন্সকে এর থেকে আলাদা করা হয়েছে। ইসলাম জাতি ধর্মের বিভাজনকে গুরুত্বহীন বলে মনে করে। ফলে ধর্মের মূল এসেন্সকে বিতারিত করার একটা প্রজেক্ট সংকটের মূল পয়েন্ট হতে বাধ্য। ইসলামের মুল এসেন্স না মানার অর্থ হল সামাজিক মতবিরোধ জিইয়ে রেখে সংকটকে অব্যাহত রাখা। যেখানে রাজনীতি হল বিভেদ বিভাজনের বদৌলতে নিজেদের কায়েমি স্বার্থ হাসিল। রাজনীতির ময়দানে নিজেদের শক্তিশালী হিসেবে হাজির রাখা। ফলে ধর্মের মূল এসেন্সকে এখানে দায়ী করা যায় না। বলা যায় ধর্মের খোলস নিয়ে ধর্মকে এর সাথে সংযুক্ত করে সুযোগ গ্রহন করা। ফলে সহজেই ধর্মকে আক্রমন করার পথ খুঁজে পাওয়া যায়। কিন্তু ইসলাম এর সাথে যায় না। ইসলাম কোন ট্রাইবাল ধর্ম হিসেবে চিহ্নিত হতেও চায় না। এদিক দিয়ে ইসলাম স্বতন্ত্র। এর সাথে ইসলামের সারসত্তা জড়িত। ফলে আমি আপনি যতই খোলস নিয়ে টানাটানি করি লাভ নেই। কারন সারসত্তা এটা সমর্থন দেয় না।
ইরাকের এই সংকট শুধুমাত্র ইরাকের তা বলা যায় না। এর সাথে সমগ্র মধ্যপ্রাচ্যের আঞ্চলিক রাজনীতিও জড়িত। আঞ্চলিক রাজনীতির ব্যাপারটা আবার শুধু আঞ্চলিক থাকেনি। এখানে আমেরিকাও জড়িত। ইরাকের এই সংকট আমেরিকাকে প্রবেশের রাস্তা করে দিচ্ছে। ইরাকের এই বিভেদ বিভাজনের যুদ্ধে ইসরায়েলের জন্যেও ইতিবাচক বার্তা এনে দিচ্ছে
ইরাকের এই সংকটে সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলোর জন্য সম্ভাব্য সুবিধাগুলো হলঃ
০০০/ ইরাকের এই পরিস্থিতির ফলে সাম্রাজ্যবাদী ইসরায়েলের বসতি স্থাপন ও সন্ত্রাসী কর্মকান্ড আড়াল হচ্ছে। পশ্চিম তীরে ৩ জন ইসরায়েলই কিশোর নিখোঁজ হওয়ায় ইসরায়েলী পুলিশ এ পর্যন্ত ৩৬১ জনকে ধরে নিয়ে নির্যাতন করছে। কমপক্ষে ৪ জন ফিলিস্তিনিকে হত্যা করেছে। ফিলিস্তিনের ভূখণ্ডে অবৈধ বসতি স্থাপন পুরোদমে চলছে। কিন্তু এবিষয়গুলো গুরুত্ব পাচ্ছে না।
০০০/ ইরাকের এই সঙ্কটাবস্থা রাষ্ট্রটিকে ভাঙ্গনের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। ফলে দুর্বল হচ্ছে মুসলিম রাষ্ট্রগুলো। ভেঙ্গে যাছে তাদের সীমানা। এর আগে যেমন সৌদি ভেঙ্গে তৈরি হয়েছিল বাহারাইন, দুবাই, ইয়েমেন, ওমান। মধ্যপ্রাচ্যের মানচিত্রে ছোট ছোট দেশগুলোর উৎপত্তি ঘটছে। মধ্যপ্রাচ্যে মুসলিম দেশগুলো ভেঙ্গে যাওয়ার অর্থ হচ্ছে ইসরায়েল বিরোধী বড় রাষ্ট্রের অনুপস্থিতি। ফলে লাভবান হচ্ছে ইসরায়েল।
০০০/ মধ্যপ্রাচ্যে মুসলিম দেশগুলোতে মুসলিম-মুসলিম বিভেদ অব্যাহত থাকলে সবচেয়ে নিরাপদ থাকবে ইসরায়েল। কারন এই রাষ্ট্রটি ফিলিস্তিনিদের উপর হত্যা, নির্যাতন, নিপীড়ন, অবৈধ ভূমি দখল করে টিকে আছে। মুসলিমরা নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্বে লিপ্ত থাকলে ফিলিস্তিনের ব্যাপারে কথা বলার সময় পাবে না। সেটাই এখন ঘটছে। ফলে মুসলিম দেসগুল দুর্বল হওয়ার প্রেক্ষিতে ইসরায়েল বিরোধী ফ্রন্টগুল দুর্বল হয়ে যাচ্ছে।
০০০/ মধ্যপ্রাচ্যের এই সমস্যাকে কেন্দ্র করে সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলো শান্তি প্রতিষ্ঠার নামে দেশগুলোতে প্রবেশ করে। যেমন, ইরাকে ২০০৩ সালে মার্কিন হামলার কারনে ইরাকের তেল থেকে শুরু করে সবধরনের সম্পদ লুটের রাস্তা পরিস্কার করা হয়েছে। বহুজাতিক কোম্পানি গুলো সেখান থেকে সম্পদ নিজ দেশে পাচার করছে। এসবই হয়েছিল শান্তি প্রতিষ্ঠার নামে।
০০০/ পাশ্চাত্য মুসলমানদের মধ্যে যুদ্ধ বাধিয়ে তার অস্ত্র ব্যবসাকেও রমরমা করে তুলেছে। ফ্রান্স এখন অতীতের চেয়ে চার গুণ বেশি অস্ত্র রপ্তানি করছে এবং কোনো কোনো আরব দেশ তেলের বিনিময়ে অস্ত্র কিনে সেই অস্ত্রকে ইসরাইলের বিরুদ্ধে ব্যবহার না করে মুসলমানদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করছে। ফলে মুসলিম-মুসলিম সংঘাত পাশ্চাত্য ও ইসরায়েলকেই নিরাপদ ও শক্তিশালী করছে।
০০০/ সৌদি আরব, সিরিয়া, ইরাক, লিবিয়াসহ মধ্যপ্রাচ্যের পাঁচটি দেশ ভেঙে ১৪টি দেশে পরিণত করার নতুন এক পরিকল্পনা নিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে হইচই শুরু হয়েছিল গত বছর। শীর্ষ আমেরিকান দৈনিক নিউ ইয়র্ক টাইমসে ২০০১৩ সালের সেপ্টেম্বরে এক সংখ্যায় বিখ্যাত মার্কিন সাংবাদিক রবিন রাইট এ ব্যাপারে বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরেন। সম্ভাব্য সুত্র বলছে তারই মিশন চলছে ইরাকে।
০০০/ ২০০৬ সালে একবার আমেরিকান ডিফেন্স জার্নালে র্যাল্ফ পিটার পুরো মধ্যপ্রাচ্যকে বিভাজনের একটি পরিকল্পনা প্রকাশ করেছিলেন। মার্কিন সেনাবাহিনীর মধ্যপর্যায়ের সাবেক কর্মকর্তার এ লেখা নিয়েও তখন ঝড় ওঠে। দু’টি লেখার পটভূমি খুঁজতে গেলে এর সাথে সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যায় আশির দশকে ইসরাইলের নেয়া স্ট্র্যাটেজিক ইনোন পরিকল্পনার। এ পরিকল্পনায় বলা হয়েছিল ইসরাইলের তার নিজস্ব নিরাপত্তার স্বার্থে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোকে ছোট ছোট রাষ্ট্রে বিভাজন করে ইসরাইলের ওপর নির্ভরশীল করে ফেলতে চায়। একইভাবে ইরাক বিভাজনের কথাও বলেছেন রাইট। তার বক্তব্য অনুসারে ইরাকের উত্তর-পশ্চিমাংশ সুন্নি ইরাক এবং দণি পূর্বাংশ হবে শিয়া ইরাক। কুর্দি অংশটি অন্য কুর্দি এলাকার সাথে মিলতে পারে অথবা হতে পারে স্বাধীন। এটিকে ইসরাইলিরা প্রতিবেশী দেশগুলোকে বিভাজন করে দুর্বল এবং তেলআবিবের ওপর নির্ভরশীল করে তোলার কৌশল বাস্তবায়ন করছে। রবিন রাইটের লেখায় তারই সুপ্ত ইঙ্গিত পাওয়া যায়।
বিভেদ বিভাজনের রাজনীতিই সুযোগ গ্রহনের নীতি। সেখানে বিভেদকে ইনপুট করা হয়। নিজের প্রভাব বিস্তারকে, নিজের আধিপত্যকে সেখানে জারি রাখা হয়। ফলে শত্রুপক্ষ সহজেই নিজেকে প্রভাবশালী, শক্তিশালী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত রাখতে পারে। একটা গল্প দিয়ে শেষ করবো। ইতিহাস অনেক বড় কাজে আসে। তবে শর্ত হলো আমরা যেন ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিই।
ইতিহাসের বইয়ে হয়তো অনেকেই পড়েছেন, একবার হালাকু খান বাগদাদে হামলা করেছিলেন। হাজার হাজার মুসলমানকে হত্যার পর তাদের মাথার খুলি দিয়ে মিনার বানিয়েছিলেন। হালাকু খান যখন বাগদাদে হামলা করেন তখন মুসলমানরা খুবই অপ্রয়োজনীয় বিষয় নিয়ে বিতর্কে লিপ্ত ছিল। তারা বাইরের শত্রুর সঙ্গে মোকাবেলা করার পরিবর্তে পরস্পরকে কাফের সাব্যস্ত করায় ব্যস্ত ছিল। কিন্তু শত্রুরা যখন হামলা করে বসল তখন এটা দেখেনি তাদের মধ্যে কে কাফের আর কে মুসলমান। কুফুরির ফতোয়া ও গাদ্দারির অপবাদ আজ মুসলমানদের খেলনার বস্তুতে পরিণত হয়েছে। আল্লামা ইকবাল যথার্থ বলেছেন, “এই জাতির লাভ-ক্ষতি একই; সবার নবীও এক; দ্বীন-ঈমানও এক; কাবা-বায়তুল্লাহ ও স্রষ্টা সবই এক; কতই না ভালো হতো যদি সব মুসলমানও এক হতো!”