somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

কালা-ফিরিঙ্গীদের কথা ও আমাদের অবস্থান বিষয়ক সমাচার

২৯ শে জুলাই, ২০১২ বিকাল ৫:০৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আমাদের মধ্যে ইতিহাসে অসচেতন এমন অনেকের ধারনা যে, যেহেতু ইংরেজ শাসনামলে স্বজাতীয়দের সঙ্গে ইংরেজদের তেমন বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়নি এবং যেহেতু দুই জাতি একে অন্যের থেকে দুরত্ব বজায় রেখে চলেছে, সেহেতু বাঙালি রক্তে শ্বেতাঙ্গদের কোনোই অবদান নাই বা অকিঞ্চিত। কিন্তু ইতিহাস স্বাক্ষ্য দেয়, এই মন গড়া আন্দাজ ভিত্তিহীন। এইবার আসুন দেখি ইতিহাস কী বলে।

আঠারো শতকের শেষদিকে শ্বেতাঙ্গ শাসন কায়েম হলেও বঙ্গে তাদের আনাগোনা শুরু হয় প্রায় আজ থেকে আড়াই শত বছর আগে থেকে। এই দেশের দক্ষিনাঞ্চলে পর্তুগিজরা একদা রাজত্বও স্থাপন করেছিল। ব্যবসায় পর্তুগিজ, ওলন্দাজ, ফরাসি, ইংরেজ, দিনেমার, আর্মেনিয়ানরা আমাদের প্রতিটি বাজার উৎপাদন ক্ষেত্রে প্রবেশ করেছিল সেই আঠারো শতকেই। গ্রাম বাংলার প্রান্তিক জনপদেই তারা থাকতো এবং সামাজিক সম্পর্কও গড়ে তুলেছিল গ্রামের সাধারন মানুষের সঙ্গেই। এদের অনেকেই গ্রামে বাঙালি রমনীদের বিবাহ করে ঘর সংসার করেছে। দেশি মানে আমাদের বাঙালি মাতাজাত ও শ্বেতাঙ্গ ব্যবসায়ী পিতাজাত থেকে জন্ম নেওয়া সন্তানদেরই বলা হয় ‘কালা-ফিরিঙ্গী’

সেই ১৪৯৮ সাল থেকে ভারত বর্ষে পর্তুগাল বণিক ভাস্কো দ্যা গামা’র আগমনের মধ্য দিয়েই শ্বেতাঙ্গদের এই অঞ্চলে আসা-যাওয়া শুরু। সেই থেকে শুরু করে যত শ্বেতাঙ্গ এদেশে ব্যবসা-বানিজ্যে নিয়োজিত ছিল তার চেয়ে অনেক বেশি শ্বেতাঙ্গ মুগল সরকারের প্রাদেশিক ও কেন্দ্রীয় সেনাবাহিনীতে কর্মরত। মুলত সম্রাট শাহজাহান ও আওরঙ্গজেব এর শাসনামলে সেনাবাহিনীতে শ্বেতাঙ্গদের অনুপ্রবেশ ঘটে ব্যাপকহারে। ভারতীয় দেশি মেয়ে বিয়ে করেছে এমন শ্বেতাঙ্গদের সেনাবাহিনীতে মুগল সরকার দ্রুত পদোন্নতিও দিতো। যে কারনে শ্বেতাঙ্গরা এদেশীয় মেয়ে বিয়ে করতেও উৎসাহিত হতো। পাশাপাশি দেখা গেছে, স্থানীয় ফৌজদারদের সিপাহীদের মধ্যেও বেশির ভাগই ছিল ‘কালা-ফিরিঙ্গী’। এভাবে শ্রেণীগতভাবে এরা প্রাদেশিক, কেন্দ্রীয় এবং স্থানীয় শাসকদের কাছাকাছি থাকায় সে সময়ের সমাজে ফিরিঙ্গিরা তথা ‘কালা-ফিরিঙ্গী’রা খুব সম্মানীত ছিল। সেনাবাহিনী, ব্যবসায়ী তথা বণিক ও নাবিক এই তিন প্রধান স্রোতেই শ্বেতাঙ্গ- বাঙালি শংকরন ঘটায় সমাজের চোখে এরাই ছিল অগ্রগণ্য। তখন এদের সংখ্যা কত ছিল সেই পরিসংখ্যান জানা নাই। তবে এদের সংখ্যার পরিসংখ্যান পাওয়া না গেলেও সে সময়ের ঘটনাপ্রবাহ ও বাস্তবতার নিরিখে আন্দাজ করে বলা যায়, আমাদের দেশে বর্তমানে যাদের গায়ের রঙ, নাক, চোখ, কপাল, চুল, উচ্চতা ইত্যাদি বিষয়ে ইউরোপীয় ছাপ রয়েছে তারা আসলে ঐ ‘কালা-ফিরিঙ্গী’দের বংশধর।

তবে মজার ব্যাপার হলো, বর্তমানে কেউই ‘কালা-ফিরিঙ্গী’দের বংশধর বা উত্তরসুরী বলে দাবি করেনা। বর্তমানে অগ্রগণ্য শ্রেণী সগৌরবে বলছে যে, তাদের পূর্বপুরুষরা এসেছে আরব, ইরান, আফগানিস্তান, কাশ্মির, মথুরা ও গয়া থেকে। অথচ ইতিহাস বলে এই সব স্থান থেকে কেবল ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে কিছু মানুষ এসেছিল এবং তাদের সংখ্যা অতিশয় নগণ্য ছিল। তারপরেও বর্তমানের প্রায় সকলেই কিভাবে তাদেরই বংশধর হয় এটি বুঝা দুষ্কর! তবে হ্যা, কিছু মানুষের পূর্বপুরুষ অবশ্যই আরব, ইরান, আফগানিস্তান ইত্যাদি দেশ থেকে এসেছিল। কিন্তু এখন এদের সংখ্যা এত বেশি হওয়ার কথা নয়। যেভাবে সকলেই বলছে!

অপরদিকে যে বিশাল জনসমষ্টি ইউরোপের বিভিন্ন দেশ থেকে এসেছে, ব্যবসা, চাকুরী ও বিয়ে করে এদেশে স্থায়ী বসত গড়েছে এবং তাদের বংশধর বৃদ্ধি হয়েছে তারা কোথায় গেলো বা এখন কারা তাদের উত্তরসুরী সেটাও বুঝা দুষ্কর! তাই দেখা যাচ্ছে, পর্তুগাল, হল্যান্ড, ফ্রান্স, ব্রিটেন সহ অপরাপর ইউরোপীয় দেশগুলো থেকে যারা এসেছিল তাদেরকে বর্তমানের কেউই তাদের পূর্বপুরুষ বলে স্বীকার করেনা। ভাব চক্করে মনে হয়, কোনোকালে ইউরোপ থেকে কেউই আসেনি বা এখানে এসে চাকুরী, বিয়ে সংসার এগুলোও করেনি! এই অস্বীকার করার কারন হিসেবে গবেষকগন বলে থাকেন, এই কারনটি এন্থ্রপোলজিক্যাল এবং রাজনৈতিক। ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় দেখা যায়, এদেশীয় ও ইউরোপীয়দের মধ্যে সহাবস্থানের অবসান ঘটতে শুরু করে ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধে ইংরেজদের জয়লাভ থেকে পুরোদমে ইংরেজ উপনিবেশিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর থেকেই। উনিশ শতকের প্রথম থেকেই ইংরেজ শাসক শ্রেণীর প্রতি এদেশীয়দের অনীহা এবং ঘৃণার ভাব দেখা যায়। গত শতাব্দীর প্রথম থেকেই শুরু হয় ইংরেজদের বিরুদ্ধে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন। অবশ্য সমগ্র এশীয় দেশগুলোতেই তখন নিজস্ব ভাষা ও সাংস্কৃতিক চেতনার জাগরনে জাতীয়তাবাদী রাজনীতির সুচনা ঘটে। যার বিধর্মী, যাদের প্রতি রয়েছে সকল সাধারনের ঘৃণা এবং যাদের উৎখাতের জন্য চলছে সংগ্রাম তাদেরকে কোনো পরিবারই তাদের পূর্বপুরুষ বলে স্বীকার করা নিতান্তই বোকামী মনে করেই এখন আর কাউকে স্বীকার করানো অসম্ভব। যাহোক, এভাবেই ক্রমশ ইংরেজ এবং তাদের এদেশীয় দোসরেরা শত্রুতে পরিণত হতে থাকে। ফলে এভাবেই শত বছর ধরে বেড়ে ও গড়ে উঠা ইউরোপীয় শ্বেতাঙ্গদের প্রভাব নিন্মমুখী হতে থাকে। অথবা সেই সব শ্বেতাঙ্গ যারা এদেশেই বিয়ে সংসার করে থিতু হয়েছিল তারা ধীরে ধীরে লোকচক্ষুর অন্তরালে যেতে থাকে। তাদের বংশধর যাদের ‘কালা-ফিরিঙ্গী’ বলা হয় তারাও ক্রমাগত স্থান পরিবর্তন করে নতুবা নিজেদের আসল পরিচয় চেপে গিয়ে এদেশীয় মূল ধারার সঙ্গে মিশে যায়।

বর্তমান আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতায় বলা যায়, এই অঞ্চলে লাখো লাখো পরিবারে শ্বেতাঙ্গদের রক্ত প্রবাহিত হলেও সামাজিকভাবে এর প্রভাব স্বীকৃত নয়। তাই আমাদের দেশের অনেক পরিবার ইরানী, তুরানী, আরব বংশোদ্ভুত বলে গর্ব করলেও ইউরোপীয় বংশোদ্ভুত বলে কেউ গর্ব তো দুরের কথা স্বীকারই করেনা।

কিন্তু ইতিহাসের অমোঘ সত্য হলো, যদি কোনো কালে আমাদের বর্তমান আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক ধারার পতন ঘটে এবং সেই ইউরোপীয় ধারার প্রবর্তন হয় তাহলে হয়ত দেখা যাবে অনেকেই তাদের অতীত খুজে বের করে নিজেদের কালা-ফিরিঙ্গী বা ইউরোপীয় বংশোদ্ভুত বা ‘কালা-ফিরিঙ্গী’দের উত্তরসুরী বলে স্বীকারতো করবেই উপরন্তু সকল্কে স্বীকার করতে বাধ্যও করবে। তখন তাদের আর আনন্দের সীমা থাকবে না। যদিও সেটা আপাতভাবে অসম্ভব।

বি.দ্রঃ এই লেখাটি মুলত অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম, শেখ আবুল ফজল আল্লামী, স্যার যদুনাথ সরকার, অধ্যাপক ড.এম এ রহিম এবং হোসেনউদ্দীন হোসেন প্রমুখ মহর্ষিগনের বিভিন্ন প্রবন্ধ ও গ্রন্থের সহায়তায় রচিত হয়েছে। তাদের প্রতি শ্রদ্ধা।
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে জুলাই, ২০১২ বিকাল ৫:০৮
৭টি মন্তব্য ৭টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

গণতন্ত্র আর বাক-স্বাধীনতার আলাপসালাপ

লিখেছেন অনিকেত বৈরাগী তূর্য্য , ২৭ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৪:২৩


একাত্তর সালে আওয়ামী লীগের লোকজন আর হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা ছিল পাকবাহিনীর প্রধান টার্গেট। যদিও সর্বস্তরের মানুষের ওপর নিপীড়ন অব্যাহত ছিল। গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছিল। মুক্তিযোদ্ধা আর তাদের পরিবারের... ...বাকিটুকু পড়ুন

কাফের কুফফারদের দেশে বাস করা হারাম।

লিখেছেন মঞ্জুর চৌধুরী, ২৭ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৯:১৩

ফেসবুকে বাঙালিদের মধ্যে ইদানিং নতুন এক ফতোয়া চালু হয়েছে, এবং তা হচ্ছে "দাওয়াতের নিয়্যত ছাড়া কাফের কুফফারদের দেশে বাস করা হারাম।"
সমস্যা হচ্ছে বাঙালি ফতোয়া শুনেই লাফাতে শুরু করে, এবং কোন... ...বাকিটুকু পড়ুন

স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে মুক্তিযোদ্ধাদের মুমিনী চেহারা ও পোশাক দেখে শান্তি পেলাম

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৭ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৯:৫৮



স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে স্টেজে উঠেছেন বত্রিশ মুক্তিযোদ্ধা তাঁদের চব্বিশ জনের দাঁড়ি, টুপি ও পাজামা-পাঞ্জাবী ছিলো। এমন দৃশ্য দেখে আত্মায় খুব শান্তি পেলাম। মনে হলো আমাদের মুক্তিযোদ্ধা আমাদের মুমিনদের... ...বাকিটুকু পড়ুন

দু'টো মানচিত্র এঁকে, দু'টো দেশের মাঝে বিঁধে আছে অনুভূতিগুলোর ব্যবচ্ছেদ

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১২:৩৪


মিস ইউনিভার্স একটি আন্তর্জাতিক সুন্দরী প্রতিযোগিতার নাম। এই প্রতিযোগিতায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সুন্দরীরা অংশগ্রহণ করলেও কখনোই সৌদি কোন নারী অংশ গ্রহন করেন নি। তবে এবার রেকর্ড ভঙ্গ করলেন সৌদি... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমাদের দুই টাকার জ্ঞানী বনাম তিনশো মিলিয়নের জ্ঞানী!

লিখেছেন সাহাদাত উদরাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ২:৫৯

বিশ্বের নামীদামী অমুসলিমদের মুসলিম হয়ে যাওয়াটা আমার কাছে তেমন কোন বিষয় মনে হত না বা বলা চলে এদের নিয়ে আমার কোন আগ্রহ ছিল না। কিন্তু আজ অষ্ট্রেলিয়ার বিখ্যাত ডিজাইনার মিঃ... ...বাকিটুকু পড়ুন

×