ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর শাসনামলে, ১৯৮৪ সালে শিখ ধর্মালবম্বীদের পবিত্র স্থান পাঞ্জাব প্রদেশের অমৃতসরে অবস্থিত স্বর্ণ মন্দিরে "ব্লু স্টার" নামক সেনা অভিযান চালানো হয় । অভিযোগ ছিলো স্বাধীনতাকামীরা সেখানে আশ্রয় নিয়েছে । উল্লেখ্য, সে সময় শিখরা খালিস্তান নামের একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দাবি করছিলো । স্বাধীনতাকামীদের নির্মূল করতেই মূলত চালানো হয়েছিলো সেই সেনা অভিযান ( শিখ ধর্ম নির্মূল করতে নয়) । সেই অভিযানে মন্দিরের বেশ ক্ষয়-ক্ষতি হয়, কয়েকজন ভারতীয় সেনা, শিখ ধর্মীয় নেতা জর্নাইল সিং ভিন্দানওয়াল সহ অনেকেই নিহত হন (অপারেশেন ব্লু স্টারের পরিকল্পনা করেছিলেন তৎকালীন ভারতীয় সেনা প্রধান জেনারেল এএস বিদ্যা । ১৯৮৬ সালে তিনি পুনেতে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন) । এই ঘটনায় শিখরা ইন্দিরা গান্ধীর ওপর চরমভাবে ক্ষ্রিপ্ত হয়, তাঁর বিরুদ্ধে জনরোষ দাঁনা বেঁধে উঠে । এর ফলস্রুতিতেই ঐ বছরই নিজের দুজন শিখ দেহরক্ষীর গুলিতে ইন্দিরা নিহত হন ।
পাকিস্তানের সাবেক রাষ্ট্রপতি পারভেজ মোশাররফ এর সময়ে, ২০০৭ সালের জুন মাসে পাকিস্তানের ইসলামাবাদে অবস্থিত লাল মসজিদে সেনা অভিযান চালানো হয়েছিলো । অভিযোগ ছিলো জঙ্গীরা সেখানে আশ্রয় নিয়েছে । জঙ্গি নির্মূল করতেই সেনা অভিযান (ইসলাম ধ্বংস করতে নয়) চালানো হয় । সেনা অভিযানে ১১ জন সৈন্য, মসজিদের ইমাম আবদুল রশিদ গাজী সহ ১০৩ জন জঙ্গি নিহত হয়, যারা পাকিস্তানে শরিয়া আইন চালুর দাবিতে লাল মসজিদ ও তৎ সংলগ্ন এলাকা অবরোধ করে রেখেছিলো । মসজিদের সাথে একটা মাদ্রাসা রয়েছে । মাদ্রাসার ছাত্র ছাত্রীদের জন্য দুটো ছাত্রাবাস জঙ্গী তৎপরতার কেন্দ্র হিসেবে পরিচালিত হয়ে আসছিলো । মাদ্রাসার বেশীরভাগ ছাত্র ছিলো পাকিস্তানের উত্তর পশ্চিম ফ্রন্টিয়ার প্রদেশের অধিবাসী, যেখান থেকে সীমানা পার হয়ে আফগানিস্তানে তালেবানদের তত্পরতা চালানোর অভিযোগ ছিলো । ইন্দিরা গান্ধীর মত করুণ পরিণতি ভোগ করতে হয়নি পারভেজ মোশাররফকে অবশ্য । পাকিস্তানের কট্টর মুসলমানরা ক্ষুব্ধ হলেও তাঁকে প্রাণে মারতে পারেনি । অবশ্য তাঁর বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে; এখনো চলছে ।
ঘটনার সূত্রপাত নির্মাণাধীন একটা মসজিদকে নিয়ে । সেখানকার হিন্দুরা দাবি করেছে জায়গাটা নাকি বেদখল করে মসজিদ নির্মাণ করা হচ্ছে । হিন্দুদের পাশাপাশি জনৈক পুলিশ অফিসার সেখানে মুসলমানদের নামাজ পড়তে বাধা দিয়েছে! তারপর সারাদেশে রব উঠলো ধর্ম গেলো, ধর্ম গেলো; দেশটা হিন্দুদের দখলে চলে গেলো । তৌহিদী জনতা দ্বীন বাঁচাতে জান-প্রাণ দিতে মরিয়া! খবরে পড়লাম কক্সবাজারে এক কাজী বিয়ে পড়ায়নি, কারণ, বর বিশেষ এক রাজনৈতিক দলের সমর্থক । যে দলটার হাতে ইসলাম নাকি নিরাপদ নয় । জঙ্গীদমনে দেশব্যাপী যে অভিযান চালানো হয়, দেশের বৃহদাংশ মানুষের এতে সায় ছিলোনা । জঙ্গীদমন করার নাম করে নাকি ইসলাম ধ্বংস করা হচ্ছে । আসলেই কি তাই?
আওয়ামীলীগ ক্ষমতায় আসার পর বিভিন্ন ধরণের উদ্ভট সংগঠনের জন্ম হয়েছে । যেমনঃ আওয়ামী পর্যটন লীগ, আওয়ামী মুক্তিযোদ্ধা প্রজন্ম লীগ, আওয়ামী নরসুন্দর লীগ, ওলামালীগ (আরও অনেক; এ মুহুর্তে মনে আসছেনা) । এই সংগঠনগুলো বিভিন্ন জায়গায় বঙ্গবন্ধু কিংবা শেখ হাসিনার ছবি টাঙিয়ে অফিস খুলেছে । যেন তাদের মত মুজিবপ্রেমী, হাসিনাপ্রেমী আর নেই । এই সংগঠনগুলোর উদ্দেশ্য কী সকলেরই তা জানা আছে । শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিদের নাম ভাঙিয়ে জায়গা দখল করা, চাঁদাবাজি করা; লুটপাট করা । উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ কী কারণে জানিনা এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছেনা । তারা কি জানেনা এদের কারণে তাদের কতো ক্ষতি হচ্ছে?
দেশের আনাচে কানাচে মসজিদ, অলিতে গলিতে মসজিদ । ইদানীং লক্ষ্য করছি পারিবারিক মসজিদও তৈরি হচ্ছে দেদারসে । এত এত মসজিদের কাজটা কী? এমন বহু মসজিদ স্বচক্ষে দেখেছি শুক্রবার এলে কিছু লোক হয়, বাকী সময় এক কাতার লোকও হয়না । আবার এমন মসজিদও আছে সন্ধ্যার আজান দেওয়ার লোকও থাকেনা ।
বিভিন্ন সরকারের সময় নেতানেত্রীদের নাম ভাঙিয়ে যেমন জায়গা-জমি দখল করা হয়, মসজিদের নাম করে প্রতিবছরই বহু জায়গা-জমি দখল করা হয় । ধর্মান্ধ জনতা কি এগুলো বোঝেনা? আল্লাহ্ কি তাদের বলেছে জায়গা দখল করো, মসজিদ বানাও? ইসলাম কী তাদের এই বার্তা দিয়েছে? এদের দায়ভার ইসলাম কেন নেবে? ইসলামের নাম করে খুন করা, ধর্মান্তর করা কি ইসলাম সমর্থন করে? দুধের মাছিরা যেমন দলের জন্য ক্ষতিকর, এসব সুবিধাবাদী দখলবাজ ধার্মিকরাও ধর্মের জন্য ক্ষতিকর! এদের কি বর্জন করা উচিত না?
ভারতে যখন হিন্দু মৌলবাদীরা মাথাচাড়া দিয়ে উঠে, বাঙালি মুসলমানরা তার প্রতিবাদ করে; আবার বাংলাদেশে যখন মুসলমান মৌলবাদীরা মাথাচাড়া দিয়ে উঠে, ভারতের হিন্দুরা প্রতিবাদ করে । অদ্ভূত ব্যাপার হচ্ছে, বাংলাদেশে হিন্দুরা অত্যাচারিত হলে বাঙালি মুসলমান চুপ; আবার ভারতে মুসলমানরা অত্যাচারিত হলে সেখানকার হিন্দুরা চুপ (মায়ানমারের কথাও বলা যেতে পারে) । একমাত্র ব্যতিক্রম সেক্যুলাররা; তারা মোটামুটি সবক্ষেত্রেই প্রতিবাদ করেন । এখানে একটা মজার ব্যাপার হচ্ছে, বাংলাদেশের মুসলমানরা এদেশের সেক্যুলারদের পছন্দ করেনা, কিন্তু ভারতের সেক্যুলারদের পছন্দ করে । কারণ, তারা মুসলমানদের পক্ষে কথা বলে । আবার ভারতের হিন্দুরা তাদের দেশের সেক্যুলারদের পছন্দ করেনা, কিন্তু বাংলাদেশের সেক্যুলারদের পছন্দ করে । কারণ, এরা হিন্দুদের পক্ষে কথা বলে ।
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা জুলাই, ২০১৭ দুপুর ২:১৯