somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গাজীপুর শাইনিং পাথ হাইস্কুলে অতিবাহিত করা যৌবনের উত্তাল সাড়ে ছয়মাস একদিন

২১ শে আগস্ট, ২০১৮ সকাল ৮:২৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


শুনিবে যদি গল্পটি
২০১৮ সালের ফেব্রয়ারি মাসের ১ তারিখ। দিনটি শুক্রবার। আমার মোবাইলে একটি নাম্বার তুলিতেছি। নাম্বারখানি দিয়াছেন "বেস্ট লাইফ ইন্স্যুরেন্স" এর জিয়া স্যার। বীমা কোম্পানিতে আমি যখন কাজ করিব না, আমার প্রতি তাহার অশেষ দয়া হয়। কয়েকটি টিউশনির ব্যবস্থা করিয়া দিতে চাহিয়াছিলেন। কো কারণে সম্ভব হয় নাই। তাই একখানি নাম্বার দিয়াছেন, এইখানে লোক লাগিবে। আশা করা যায় আমার কোনো গতি হইবে। ইহার পূর্বে আমাকে তিনি অন্য একটি এনজিওতে পাঠাইয়াছিলেন। দুর্ভাগ্য আমার, সেইখানে কর্ম খালি নাই।

নাম্বারখানি একটি স্কুলের প্রধান শিক্ষক জনাব ছামাদ মাস্টারের। স্কুলটির নাম "গাজীপুর শাইনিং পাথ হাইস্কুল"। সঙ্কোচের সহিত ফোন দিলাম। ফোন রিসিভ করিতেই লম্বা একখানি সালাম দিয়া জিজ্ঞাসা করিলাম, আপনার স্কুলে ইংলিশের শিক্ষক লাগিবে কি না? উনি হ্যাঁ সূচক উত্তর দিলেন এবং তাহার সঙ্গে সাক্ষাৎ করিতে বলিলেন। কোথায় এবং কীভাবে যাইতে হইবে; সেই ঠিকানাও বলিয়া দিলেন।

একা যাইতে সঙ্কোচ লাগিতেছিল। মেসের রুমমেট ছোটভাই শাহ্ আলমকে লইয়া রওয়ানা দিলাম। আমার বাসস্থান অবসরকূল ছাত্রাবাস হইতে বাহির হইয়া ভাওয়াল কলেজের ছাত্র হোস্টেলের উত্তর পাশ দিয়া কিছুদূর যাইতেই ডানদিকে একটি রাস্তা বাঁকিয়া গিয়াছে। সেই রাস্তা ধরিয়া মিনিট দশেক হাঁটিলেই ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক। মহাসড়ক দিয়া পনেরো-বিশ মিনিট উত্তরে গেলেই বিটিআরসি; এর সম্মুখ দিয়া তিন মিনিট হাঁটিলেই টেকনগপাড়া বাজার। বাজারের নিকটেই স্কুলটি। স্কুলে যাওয়ার আরও একটি সংক্ষিপ্ত রাস্তা আছে অবশ্য। তেলিপাড়ার সম্মুখে দশতলা; এর পাশ দিয়া আট-দশ মিনিট হাঁটিলেই স্কুলে পোঁছা যায়। এই রাস্তাটি আবিস্কার করিতে কয়েকমাস লাগিয়া গিয়াছিল। তদ্দিন বিটিআরসির সম্মুখ দিয়াই হাঁটিয়া যাইতাম।

যেহেতু দিনটি ছিল শুক্রবার। স্কুল বন্ধ। কোচিং চলিতেছিল শুধু। ছামাদ মাস্টার বাহিরে চেয়ার-টেবিল পাতিয়া বসিয়া ছিলেন। শিক্ষকগণ কোচিং করাইতেছিলেন।

আমি আর শাহ্ আলম তাহাকে সালাম দিলাম। তিনি সালাম লইলেন, অতঃপর টুকটাক প্রশ্ন করিলেন। আমার হাতের লেখা পরখ করিলেন। হাতের লেখার লেজেগোবরে অবস্থা দেখিয়া কিছুক্ষণ ওয়াজ-নসিহত করিলেন। অনতিকাল পর বেতনাদি লইয়া কথা বলিলেন। যৎসামান্য বেতন! আমি চাকরি করিব না বলিয়া মনস্থির করিলাম। শুধু বেতন কম; এই কারণে নয়, আমাকে রাখিয়া শাহ্ আলমের সঙ্গেই বেশি কথা পাড়িতেছিলেন তিনি। আমি বেশ বিরক্ত! উঠিতে উদ্যত হইতেই শাহ্ আলম আমাকে থামাইয়া দিল। কারণ, সে জানিত আমি কত অভাবে আছি!

আমরা কথা বলিতে বলিতে আরও এক প্রার্থী হাজির। মাহমুদুল নাম। তাহাকেও পরীক্ষা করা হইল। তাহার হাতের লেখা অবশ্য ভালো ছিল, আমার মতো এত কথা তাহাকে শুনিতে হয় নাই। যাহা হউক, মাহমুদুল এবং আমি- দুইজনকেই বাছাই করা হইল। পরবর্তী দিন হইতেই যোগদান করিতে হইবে।

পরবর্তী দিন সকাল আটটায় স্কুলে পৌঁছিলাম। সালমা নামের জনৈকা ম্যাডাম সদ্য নিয়োগপ্রাপ্ত আমাকে পঞ্চম শ্রেণিতে পাঠাইয়া দিলেন। ততক্ষণে প্রধান শিক্ষক আসিয়া পড়িয়াছেন। শিক্ষার্থীদিগকে কী করিয়া পড়া মুখস্ত করাইতে হইবে; সেই সবক দিলেন। তিন-চার বছর পড়ানোর অভিজ্ঞতা আমার আছে; হঠাৎ এমন অনভিপ্রেত ঘটনা আমায় বিস্মিত করিল। পরবর্তীতে কী ঘটে, তাহা দেখিবার প্রতিক্ষায় রহিলাম।

প্রাথমিকভাবে আমাকে ৩য়, ৪র্থ, ৬ষ্ঠ ও ৭ম শ্রেণির ক্লাস দেওয়া হইল। ক্লাস করাইতে লাগিলাম। প্রধান শিক্ষক হঠাৎ হঠাৎ ক্লাসে ঢোকে বয়ান দেন, আমার ভালো লাগে না। বিশেষ করিয়া মুখস্তবিদ্যা- এসব কোনো কালেই আমার ধাঁতে ছিল না।

ইহার মধ্যে প্রধান শিক্ষক আমাকে অফিসকক্ষে ডাকিয়া পাঠাইলেন, ভর্ৎসনা করিলেন। আমি যে তাহার নিয়মকানুন পছন্দ করিতেছি না, তিনি কী করিয়া যেন বুঝিতে পারিলেন। আমাকে লোভী, ঠান্ডা মাথার বেয়াদব বলাসহ এমন সব কথা কহিলেন, আমি কোনোকালেই শুনি নাই। পরবর্তীতে জানিয়াছিলাম শিক্ষকদের ধরিয়া রাখিবার জন্য নানান সময় তিনি নানান রুপ ধরেন।

চাকরিটি আমার জরুরি ছিল। কারণ, আমার পঁচিশ হাজার টাকা ঋণ হইয়া গিয়াছিল। থাকা-খাওয়ার টাকা-পয়সা ছিল না। যে করিয়াই হোক আমাকে টিকিয়া থাকিতেই হইবে, মাথা গরম করিলে চলিবে না।

স্কুলের বেতন অল্প; বলিলাম, কোচিং এর ব্যবস্থা করিয়া দিন। অষ্টম শ্রেণির সকালের কোচিং দেওয়া হইল, একসময় বিকেলের কোচিংও দেওয়া হইল। আপাতত নিশ্চিন্ত হইলাম ঋণ শোধ করিতে পারিব, থাকা-খাওয়ার আর কষ্ট থাকিবে না।

পৌনে এক ঘণ্টা হাঁটিয়া স্কুলে আসিতে হয়। দুপুরে খাওয়া বা বিশ্রামের সুযোগ নাই। প্রধান শিক্ষক পিয়ন রেজ্জাক মামার সঙ্গে ব্যবস্থা করিতে বলিলেন। তাহা আর করিতে হয় নাই। ছোটন নামের জনৈক স্যার, যিনি অষ্টম-নবম-দশম শ্রেণিতে ইংরেজি পড়ান; তিনি আগাইয়া আসিলেন। তাহার ঐখানে আপাতত দুপুরের খাওয়া ও বিশ্রাম চলিল। ছোটন স্যার আমার জেলা ময়মনসিংহেরই লোক, তাহার বাড়ি মুক্তাগাছায়। আমাকে তিনি অশেষভাবে ঋণী করিয়াছেন, দুঃসময়ে পাশে দাঁড়াইয়াছেন।

প্রধান শিক্ষক সকলের সঙ্গেই রূঢ় ব্যবহার করেন। সবাইকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করেই বোধহয় আনন্দ পান। আমার উপরও অত্যাচারের খড়গ নামিয়া আসিল। আমি নবম-দশমে পড়াইতে পারিব কী না, আমি গ্রামার জানি কী না; বহুবার বলা হইয়াছে। আমি বিবিএ-এমবিএ করা- সুতরাং ইংলিশে সমস্যা হওয়া কথা না। আমি একাধিক স্কুলে পড়াইয়াছিও। তারপরও আমার কী অপরাধ বুঝিতে পারিলাম না? নিজের মতো পড়ানো কি অপরাধ? মুখস্ত বিদ্যার বিরোধিতা করা কি অপরাধ? পড়ালেখা সম্পন্ন হওয়া কি অপরাধ? বুঝিতে পারিলাম না কিছু! অভিজ্ঞতা-শিক্ষা-দীক্ষার কি এক-পয়সারও দাম নাই তাহার নিকট? ছোটন স্যারও একদিন জিজ্ঞাসা করিলেন, নবম-দশমে পড়াইতে পারিব কী না!

হঠাতই ছোটন স্যারের ময়মনসিংহে একটা প্রজেক্ট এ চাকরি হইল। সপ্তাহে দুইদিন ক্লাস করাইতে পারিবেন না; এইবার বুঝিতে পারিলাম আমাকে এত পরীক্ষা-নিরীক্ষার মানে কী! কপাল খুলিয়া গেল বোধহয়। আমি নবম-দশমে ক্লাস করানো শুরু করিলাম। স্কুলে আমার প্রভাব বাড়িয়া গেল, যদ্যাপি আমি সবসময় সাধারণই থাকিতে চাহিয়াছি।

অষ্টম শ্রেণির ছেলেরা ভালো প্রশ্ন করে, আমি উত্তর দিই। উত্তর মনঃপুত না হলে রিঅ্যাক্ট করে। কী অদ্ভুত! আমি বোধহয় সব চাইতে বেশি ভালোবাসিয়াছিলাম সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থীদিগকে; ইহার প্রতিদান তাহারা আমাকে কাঁদাইয়া দিয়াছে। নবমের শিক্ষার্থীদিগকেও ভালোবাসিয়াছিলাম, তাহারাও অশ্রুজলেই প্রতিদান দিয়াছে।

আমি দশম শ্রেণির মেয়েদিগকে কখনোই ভুলিব না। বিশেষ করিয়া শামসুন্নাহার, স্মৃতি, আরজু, মেহেরুন, ইরা, লাবণ্য, নাসরিন, মাহমুদা, রিমি, রীমা, দীপ্তি সহ আরও অনেককে। ছেলেরা তো সংখ্যায় পাঁচজন ছিলঃ শান্ত, হৃদয়, শরিফ, ওমর ফারুক, জাকির, মিদুলকেও ভুলিব না। বোধকরি তাহারাও আমাকে ভুলিবে না। ভালোবাসার শিকড় কখনও উপড়ায় না।

তিনজনকে লইয়া বেশি ঠাট্টা-তামাশা করিয়াছি; ইহারা হইলঃ ইরা, মাহমুদা ও দীপ্তি। একজনের প্রেমেও পড়িয়া গিয়াছিলাম বোধহয়। বিষয়টি যদিও লজ্জার! আসলে বাস্তবতা কী, মানুষ যাহাকে বেশি অবমূল্যায়ন করে, একসময় তাহার কথাই বেশি ভাবে। এই যেমন আমি একজনকে বারংবার ভাবিতেছি। তাহার কথা ভাবিতে ভাবিতে আমার দিবস-রজনী কাটিতে চাহে না। ছেলেদের মধ্যে শরিফকে বেশি কথা শুনাইয়াছি, ভর্ৎসনা করিয়াছি। ক্লাসে বড্ড প্রাণোচ্ছ্বল ছিল ছেলেটি।

দুইবেলা কোচিং, একবেলা ক্লাস- আমি হাঁপাইয়া উঠিয়াছিলাম। রাত্রি নয়টায় যখন মেসের উদ্দেশে রওয়ানা দিতাম, শরীর চলিত না। টলিতে টলিতে পথ চলিতাম (শেষদিকে অবশ্য শাহ্ আলম সঙ্গ দিত; সে তেলিপাড়ায় একটি স্কুলে চাকরি লইয়াছিল)। মনে হইত রাস্তায়ই ঘুমাইয়া যাই।

একসময় বুঝিতে পারিলাম মেস পাল্টাইতে হইবে। রুমমেট তৌহিদ ও শাহ্ আলমের সাথে পরামর্শ করিয়া মেস পাল্টানোর সিদ্ধান্ত নিই। নূতন আবাসস্থল হয় তেলিপাড়া কাউন্সিলরের অফিসের নিকটেই। ঐখান থেকেই স্কুলে যাতায়াত করিতে থাকি। তাহারও কয়েকমাস পর আগস্ট মাসের শেষেরদিকে স্কুলটি ছাড়িয়া দিই। কারণ, হিসাবে জানাই আমি গুরুতর অসুস্থ।

চলবে

৫ ভাদ্র ১৪২৫ বঙ্গাব্দ
ভালুকা, ময়মনসিংহ।
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই নভেম্বর, ২০২৩ দুপুর ১:৫১
১৪টি মন্তব্য ১৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছিঁচকাঁদুনে ছেলে আর চোখ মোছানো মেয়ে...

লিখেছেন খায়রুল আহসান, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:০৯

ছিঁচকাঁদুনে ছেলে আর চোখ মোছানো মেয়ে,
পড়তো তারা প্লে গ্রুপে এক প্রিপারেটরি স্কুলে।
রোজ সকালে মা তাদের বিছানা থেকে তুলে,
টেনে টুনে রেডি করাতেন মহা হুলস্থূলে।

মেয়ের মুখে থাকতো হাসি, ছেলের চোখে... ...বাকিটুকু পড়ুন

হার জিত চ্যাপ্টার ৩০

লিখেছেন স্প্যানকড, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



তোমার হুটহাট
চলে আসার অপেক্ষায় থাকি
কি যে এক ছটফটানি
তোমার ফিরে আসা
যেন প্রিয় কারো সনে
কোথাও ঘুরতে যাবার মতো আনন্দ
বারবার ঘড়ি দেখা
বারবার অস্থির হতে হতে
ঘুম ছুটে... ...বাকিটুকু পড়ুন

জীবনাস্ত

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৪৪



ভোরবেলা তুমি নিশ্চুপ হয়ে গেলে একদম,
তোমার বাম হাত আমার গলায় পেঁচিয়ে নেই,
ভাবলাম,তুমি অতিনিদ্রায় আচ্ছন্ন ,
কিন্তু এমন তো কখনো হয়নি
তুমি বরফ জমা নিথর হয়ে আছ ,
আমি... ...বাকিটুকু পড়ুন

যে দেশে সকাল শুরু হয় দুর্ঘটনার খবর দেখে

লিখেছেন এম ডি মুসা, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:১১

প্রতি মিনিটে দুর্ঘটনার খবর দেখে অভ্যস্ত। প্রতিনিয়ত বন্যা জলোচ্ছ্বাস আসে না, প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনার খবর আসে। আগে খুব ভোরে হকার এসে বাসায় পত্রিকা দিয়ে যেত। বর্তমানেও প্রচলিত আছে তবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

জেনে নিন আপনি স্বাভাবিক মানুষ নাকি সাইকো?

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:১৮


আপনার কি কারো ভালো সহ্য হয়না? আপনার পোস্ট কেউ পড়েনা কিন্তু আরিফ আর হুসাইন এর পোস্ট সবাই পড়ে তাই বলে আরিফ ভাইকে হিংসা হয়?কেউ একজন মানুষকে হাসাতে পারে, মানুষ তাকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×