somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

অপভ্রংশ

২৮ শে মার্চ, ২০১৫ দুপুর ১:২৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

অপভ্রংশ
রায়ান নূর

কথায় কথায় বাতেন পণ্ডিত জ্ঞান ঝাড়ত―পাতনের তাই নিস্তার নেই ৷
একদিন পাতেন একটি গোলাপ-ফুল তার প্রেমিকাকে গিফ্ট করল ৷ বাতেন পণ্ডিত তা দেখে ফেলল গোপনে ৷ গ্রাম্য এলাকায় ব্যাপারটি লুকোবার কোন পথ ছিলনা ৷
বাতেন বসে বসে সিগারেট টানছে আর আড়-চোখে পাতেনের দিকে তাকাচ্ছে ৷ পাতনের মনে ভয় হল,পাছে যদি তার বাবাকে বাতেন বলে দেয় তবে সুকোমল পিঠ তার কাষ্ঠরূপ ধারণ করবে ৷
কোনক্রমে বাতেনকে যদি মূল-কথাটি বুঝানো যায় তবে ঘটনাটা আড়াল থেকে যায় ৷ তার জন্য প্রয়োজনে পা ধরতে পাতেন কসুর করবেনা,এই ভেবে পাতেন বাতেনের কাছে গেল ৷
‘ তুই যে সিগারেট খাছি এই বয়সেও ,তুই তো তাড়াতাড়ি মরে যাবু ত ৷ ’
‘ ধর,মোর জীবনটা সিগারেট আর তোর যৌবনটা শিশিরের ফোঁটা ৷ ’
‘ তুই এইটা কি কছিস? কিচ্ছু বুঝনু না ৷ ’
‘ মুই মনে হয় কিছুই জানোনা,তুই কি ভাবিচু ?’
‘ তুই কি কি দেখিচু ক দিকি ? ’
‘ তুই মোর সিগারেট খাওয়া নিয়ে জেরা করোচু আর মুই তোর সব জানি যেটা কতইনা---৷ থাক আর কনু না ৷ ’
বাতেন পণ্ডিতের কথায় পাতেন খানিকটা ভয় পেল ৷ একটা একশ টাকার নোট গুজে দিল হাতে ৷
‘তুই যা দেখিচু, সব ভুলে যা ৷’
‘চোখ কি মোর গ্যাসলাইটের আগুন,ফু দিলে নিব্যা যাবে ৷ ’
‘ না যাক, টাকা পাছু যখন ভুলে যাওয়াই লাগবে ৷ ’
‘আচ্চা, আজ না হয় গেনু ৷ কিন্তু কাল কি করমু ৷ ’
‘ সেই ব্যবস্থাও মুই পরে করমু ৷ ’
এভাবে বাতেন পণ্ডিতের পকেট আর পাতেনের দৌঁড় চলে দিনের পর দিন ৷ কেউ কাওকে ছাড় দেওয়ার পাত্র নয় ৷ বাতেন গ্রামের মুরব্বী, কিন্তু টাকা কেউ হাতছাড়া করতে চায় ? সময়ের প্রয়োজনে বিচার-বুদ্ধি, জ্ঞান-বিদ্যাকেও যেকোন কাজে ব্যবহার করার জন্য অনায়াসে জায়েজ করা যায় ৷ মানুষ মাত্রই মানুষ, মহামানব হতে গেলে পীরত্ব থাকতে হয় ৷ পেটের যোগান না লাগলে যে কেউ পীর হিসেবে দাবি করতে পারে তবুও বাইরে সবাই পীরত্ব ফলাইতে কিছুই অবশিষ্ট রাখেনা ৷
নগদ কিছু পেলে বাতেন পণ্ডিতও যে হাতের নাগালে আসে পাতেন এতোদিন পর সে বুঝল ৷ তাই সমাজে বিচার করলে তার ফলাফল শূন্যের কোটায় শেষে পড়বে তাতে কারও সন্দেহ নেই ৷
গ্রামের মানুষ আর যাহোক পণ্ডিতের চোখ এড়িয়ে কখনো চলতে পারে না ৷ যেমন গলা তেমনি সাহস, তাই সহজে কেউ কথায় যুক্তিতে পেরে উঠবে এমন সম্ভবনা নেই বললেই চলে ৷ কারো যে হিম্মত হবেও না তাও এলাকার দুই-পুরুষ জানে ৷
পাতন যে মেয়েকে ফুল দিয়েছিল সে ছিল পাশের গ্রামের এক হিন্দুর নববিবাহিত বউ ৷ স্বামী নেশা করে, কোথায় ঘুরে বেড়ায় তার হদিস নেই ৷ কখনো আখড়ায় চোয়ানি খেয়ে রাস্তায় কিংবা কাদা জমিতে বুম হয়ে পড়ে থাকে ৷ কাদা শরীরে কেউ বাড়ি নিয়ে আসে ৷ একবছর হলো বিয়ে করা তবু নেশা তার যায় নি ৷ চোয়ানির গন্ধ পেলে বাড়ি থাকা তার পক্ষে কষ্টকর ৷
নিচু বর্ণের মেয়ে হলেও সুপর্ণা অনেক সুন্দরী তাই পাতেন সহজেই কব্জা করে ভুলিয়ে ভালিয়ে ৷ গ্রামের সহজ-সরল সুন্দরী মেয়েরা সহজেই যে কারো কাম্য হয়ে উঠবে পাতেন জানতো না ৷ কিন্তু জৈবিক তাড়না পাতেনের মতো গ্রামের ছেলেদের বয়স্কাল অবধি জ্বালিয়ে বেড়ায় তা কেউ সহজে স্বীকার করে না ৷
হিন্দু মেয়েরা অনেক সচেতন তাই নিজ স্বামী ছাড়া কারো প্রলোভনে পা দেবে বিশেষ করে নিচু বংশের মেয়েরা তা বাতেন পণ্ডিতের বোধে কখনো আসে না ৷ কেননা তাদের মধ্যে তালাকপ্রথা কিংবা ঘর ভাঙা বাতেন কখনো দেখি এত বয়সেও ৷ ওরা এতো ধর্মপরায়ণ তা মুসলমান মেয়েদের চেয়ে শতগুন ৷ একথায় নিশ্চিত হলেও ভয় দেখিয়ে কিংবা একটু চোখে চোখে রেখে বাতেন তার পকেট শান্ত করে সবকিছু দেখে এড়িয়ে যায় ৷ যতই বুদ্ধি থাকুক কারো চোখের ভাষা সহজে সবাই বুঝতে পারে না ৷ সেদিন পাতেনের চেহারায় বাতেনও বোঝে নি ৷
একদিন দুপুর বেলা পাতেন আর সুপর্নার বটতলায় বসে হেসে হেসে কথা বলা দেখে ফেলে শিহাব ৷ সে কথাটা কাওকে বলার মানুষ পায়না, সাহসও হয়না ভয়ে পাছে যদি তার বিপদ হয় ৷ তাই কাওকে না বলে সোজা বাতেনকেই বলে ৷ বাতেন একটু খোলামনের, হাসি-তামাসা করে বালকসুলভ তাই যে কোন তরুনই কথা বলার সঙ্গী হিসেবে বাতেনকে প্রথম বেছে নেয় ৷ তাই অকপটে বলে ফেলে,
‘ ভাই,মুই তোক একটা গোপন কতা কমু ৷’
‘ ক, শোনো,কি হছে? ’
‘ পাতেন হারামজাদা তো লেবাসুর বৌয়ের সাথে দারুন ভাব জমাচে ৷ ’
‘ এ আবার গোপন কতা হলো রে ৷ পারলে তুইও জমা যা ৷ ’
‘ কি কছো তুই ? এনা ভালো করে বুঝবু তো ব্যাপারটা ৷ ’
‘ মুই যা কওঁ ভেবে চিন্তেই কওঁ ৷ ’
‘ তুই তো দেখিস নি ৷ মানসে দেখলে কবে কি? না, কয়েও দেখি বোকা হনো ৷ ’
‘ কোন মানুষ , নাম ক,,, ত ৷ ’
‘ ধরো তোমরাই ৷ ’
‘কিচ্ছু না ৷ ও হলো হিন্দুমেয়ে ৷ মুসলমান হলে তো বিয়ে দিতাম কিন্তু এটা তো কিচ্ছু করা যাবে না ৷ খামোখা এলা লিয়ে মাথা ভারি করার দরকার নাই তোর , সব ঠিক হয়ে যাবে ৷ ’
এভাবে অনেকের চোখ ফাঁকি দিয়ে চলে যায় মাস ৷ অভাবের দিনে বাতেন পণ্ডিত কিছুটা টাকা মাঝে মাঝে বিশেষ সময়ে পায় তাই সব হেসে উড়ে দেয়, আরো বেশি টাকা পাবার জন্য কড়া নজর রাখে কখনো ৷ সমাজের অন্যতম একজন মুরব্বী কিন্তু ধনশালী নয় ৷ তারও একটা সংসার আছে,দুটি সন্তান আছে ৷ সবাই তাকে এলাকায় সম্মান করে ৷ বিপদে আপদে জ্ঞানবুদ্ধি দিয়ে সাহায্য করে কিন্তু টাকার কাছে এ ব্যাপারটা তার কাছে এখন ছেলেখেলা মামুলি ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে ৷ কেউ কিছু পাতেনের সম্বন্ধে বললে সে হেসে উড়িয়ে দেয় আর বিচারের প্রশ্নও তোলে না ৷ ব্যাপারটা কেবল একবার উথলে উঠলে নিভে যায় চিরতরে ৷ কেউ আর কিছুই দেখেনা ,জানেনা ৷ সবকিছুই স্বাভাবিক এমনকি পাতেনও ৷

ইরি ধানগাঁরা পূর্ব-পরবর্তী সময়কালে পাতেন একটা ডিপোর ড্রাইভারি করে জমিতে পানি দেওয়ার জন্য ৷ এটা তার একটা বড় ব্যবসা বলা চলে অনেক টাকা কামাই করে পাতেন এই ডিপোতে ৷ প্রায় দুইশো একর জমি এই ডিপোর অধীনে ৷
সেই ঘটনার কারণে বাতেনও বিনামুল্যে পানি পায় ৷ পাতেন তাকে টাকার কথা কিছু বলে না ৷ তিন বিঘা জমির বারোশ টাকা তার বাঁচে ৷ যে খরচ তাতে জমি দিয়ে বাতেনের পোষায় না ৷ দুই ছেলেমেয়ের লেখাপড়া,প্রাইভেট খরচ এসব দিতেই সব কিছু যায় কেবল ভাতের চালটুকু কিনতে হয় না, এতেই স্বস্তি ৷ দুই মৌসুমের ধানে কত টাকাই বা পকেটে আসে ? কৃষকের অবস্থা নুন আনতে পান্তা ফুরানো ছাড়া কিছু নয় ৷
বাতেন গায়ের মোড়ল আর পাতেন উঠতি যুবক ৷ পাতেন টাকা কামায় করে ভালো ৷ ডিপো চালায়,একটা পুকুর দেখাশুনা করে ৷ পাতেনের প্রভাব এলাকায় কিছুটা থাকলেও বাতেনের গলায় আর যুক্তিতে সে নিতান্তই তেলাপোকা ৷
রাতের বেলা ডিপোতেই থাকে পাতেন,সাথে থাকে আর দুই লাইনম্যান ৷ দুই লাইনম্যান মাঝরাতে বাড়ি চলে আসে কখনো ৷ শীত করে তাই লাইনম্যানরা ডিপোতে থাকেনা ৷ এলাকাজুড়ে চোর-ডাকাত বেশি তাই পাতেনকে থাকতে হয় ৷ বারবার তাগাদা দেয়ার পরেও লাইনম্যান থাকে না ৷ এইতো গতবার ট্রান্সফরমার সহ এক কিলো লম্বা তিন লাইনের সিলভার তারগুলো খাম্বা থেকে ডাকাতি করে নিয়ে যায় বড় ডাকাতের দল ৷ পাতেন কিছুই করতে পারে নি শুধু চেয়ে চেয়ে দেখা ছাড়া ৷ পালিয়ে গিয়েছিল তাই প্রাণে বেঁচেছে নয়তো কবরে এতোদিন ঘাস উঠতো ৷
পাতেনের নিজের ঘর-সংসার নেই তাই অবস্থা গড়ে নিচ্ছে বিয়ে-শাদী করার তাগিদে ৷ আর্থিক অবস্থা ভালো না হলে এযুগে বড়লোকের কোন মেয়ে কপালে জুটবে না ৷ আর গ্রামের দুটো মানুষ তাকে পাত্তাও দিবেনা ৷ তাছাড়া আড়ালে-আবডালে চারগ্রামের মেয়েদের সাথে ছলাকলা যে করে না তা সে অস্বীকার করতে পারে না, গ্রাম বলে কথা ৷

ধীরেন বুড়ো ডিপো থেকে দুরে একটা খাঁড়িতে খল্সানি ফেলে মাছ ধরে প্রতিদিন ৷ এ জমির আইল কেটে গিয়ে অন্য জমির আইল কাটে সব পানি খাঁড়িতে নেমে দেয় কখনো যদি দুই চারটা মাছ তাতে আসে ৷ এতে বড়ই বিরক্ত হয় পাতেন ৷ জমিওয়ালারা লাইনম্যান কে মিছেমিছি আইল কাটার জন্য চরম গালমন্দ করে ৷ ধানগাছগুলোর জন্য তাই পানির খরচা বেশি হয় ৷
একদিন গরুর ঘাস কাটছিল ধীরেন ৷ পাতেন রেগেমেগে আসলো ৷ ধীরেন মাথা নিচু করে কাস্তে দিয়ে ড্রেনের ধারের ঘাস কেটেই যাচ্ছে ৷ বুড়োকে আজ শায়েস্তা করা দরকার তার,অনেক জ্বালায় তাকে ৷
‘ অই বুড়া, বারবার মানা করার পর আল কাটিস ক্যা ৷ পানি কি তোর বাপের ডিপ থেক্কে দেয়? ’
‘ হ বাপু,সেদিন দেখনু জমিটার পানি বেশি হছে, আল ডুবে যাছে তাই কাটে দিছিনু ৷’
‘ খবরদার আর কাটপু না আল ৷ এটাই কিন্তু মোর শেষ কতা,হু ৷ ’
‘হবে হোনি ৷ হামি আর না হয় আল কাটমো না ৷ পরে কিন্তু বাপু দোষ দেওয়া পারবিন না ৷ ’
‘ যদি আবার ইঙ্কা করে কাটিস তো এই কুদাল দেখিছি ? তোর গলাও কাটমু ৷ ’
‘ হচে, হচে ৷ অতো রাগ করা হয় চেঙরা মানসের ৷ বসো দুটা গল্প করি আইচিন যখন ৷ ’
‘ক , তোর নাতির বলে বিয়া দিছু ৷ ’
‘ তুই জানিস না আবার,একবছর হয়ে গেলো রে ৷ ’
‘ তোর নাতি কটে আছে এখন ৷ ব্যাটারা এখন ভাত-কাপর দেয় তোক ? ’
‘না রে ৷ ওর নিজের সংসারই চলে না , হামাক আবার কি দিবে? ইঙ্কা করেই চলি দেখোছু ত ৷ মাছ মারি,এটা গাই আছে তাছাড়া একলা এটা মানুষ হামি ৷ আর কিচ্ছু লাগে না হামার, দিন ভালোয় চলে যায় ৷ ’
‘অ তাই , ভালোই তো ৷ নাতি বৌ তো সুন্দরই পাছু ৷ ’
‘ অই সুন্দর আর কদ্দিন থাকবে বাপু ? আকাল পড়লে ক্ষেতে শেষে নামাই লাগবে ৷ হামার মতো কালোই হবে ৷ হামার বৌও সুন্দর আছেলো আগে,পরে কালেই হছে ৷ ’
‘কদ্দিন হলো তোর বৌ মরা ৷ ’
‘ হামার বয়স এখন সত্তর বছর ৷ তাহলে বিশবছর আগে মরছে ৷ কি এটা ক্যান্সার বলে হছেলো তখন ৷ ’
‘ আজ তা’লে থাক, পরে তোর সাথে গল্প করমু ৷ মোর অনেক কাম আছে এখন ৷ দোকান থেকে সার নিয়ে আসে ভিওঁত সার দেয়া লাগবে ৷ ’
‘যা তা’লে ৷ ’
চরার উপর দিয়ে পাতেন যাওয়ার সময় সুপর্নাকে বকরী চড়াতে দেখে ইশারায় ডাকে তাকে ৷ সুপর্ণা চলে আসে একটা মুচকি হাসি দিয়ে ৷ পাতেনও মুখ টিপে একটু হাসে ৷ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে তার দিকে ৷ তারপর পাতেন বলে,
‘তোমার ভাতার কটে আছে এখন ? ’
‘দুদিন হল, ঘাস লেলাতে হামার বাপের বাড়ি গেছে দল নিয়ে ৷ ’
‘ তা’লে একলাই আছিন হ ? ’
‘একলা থাকমো না তো দোকলা থাকমো বারে? ’
‘সন্ধ্যায় ডিপে আসো,গপ্প করমো ৷ তোমার সাথে কথা আছে ৷ ’
কিছু না বলে সুপর্ণা চলে যায় হয়তো লজ্জা পেয়েছে ৷ পাতেন সোজা দোকানে গিয়ে সার নিয়ে আসে জমিতে সার ছেটায় ৷ আর বৈকালবেলা দুই লাইনম্যানকে ছুটি দেয় আজ হাটের দিন বলে ৷
হাটের দিনে পুরো মাঠ প্রায় খালি হয়ে গেছে ৷ সবাই তরিতরকারি কেনার জন্য বৈকালবেলা হাটে যায় আর রাত হলেই ঘরে ফেরে ৷ বাতেনও হাটে গেছে আজ ৷
সন্ধ্যার সময় সূর্য লাল হয়ে গেছে ডুবতে বেশি সময় নাই ৷ কিছুক্ষণ পরই হয়তো অবশিষ্ট লাভাও কালোমেঘে বিলীন হয়ে যাবে আর অমাবস্যার অন্ধকারে ছেয়ে যাবে পুরো এলাকা ৷ তখনও অল্প একটু করে ঝিরিঝিরি বাতাস বইছে তাই একটু ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা ভাব ৷
সুপর্না আসে, তার মনের গতিবিধি কারও বোধগম্য সহজে হয় না ৷ কি একটা ভাষা চোখেমুখে দৃষ্টিগোচর হয় তা বর্ণনার অতীত ৷ কত সহজ-সরল আর হাসিমুখ,রাগের কোনও ছায়া নেই চোখে ৷ ঐদিক দিয়ে বকরী নিয়ে বাড়ী যাওয়ার সময় পাতেনের ডাকে ডিপোর দিকে এগিয়ে যায়,কিছুদূর গিয়ে আবার ফিরে আসে ৷ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর ডিপোর ঘরে যায় ডিপোর দরজা তখন বন্ধ হয় ৷ ততক্ষণে চারদিক অন্ধকারে ছেয়ে গেছে,সূর্য ডুবে গেছে ৷ বাতাস বন্ধ হয়ে গেছে ৷ আকাশে তখন মেঘ করছিল,কিছুক্ষণ পরই বৃষ্টি শুরু হয় ৷ সেই বৃষ্টি সারারাত থেমে থেমে চলে ৷
সকালে ঝলমলে রোদ উঠেছে ৷ আকাশে সাদা সাদা মেঘ নীল আকাশ ধরে উড়ে বেড়াচ্ছে তুলোর মতো ৷ তখনও বাতেন ঘুমিয়ে আছে , বয়স হয়ে যাচ্ছে তার ৷ তাই সকালবেলার সূর্য দেখার ইচ্ছে আগের মতো নেই ৷

বাতেন পণ্ডিতকে অনেকদিন থেকে আর তোয়াক্কা করে না পাতেন ৷ বাতেনও নাক গলায় না ওসবে, তারও কাজ আছে―মানুষের পিছে লেগে থেকে তার লাভ কি ? টাকাও চায় না আর,কিছু বলেও না তাকে―যে যার মতো চলে ৷ বাতেন ভাবে ওসব চেঙরামী পাতেনের ছেড়ে গেছে কাজের চাপে ৷ সুন্দরী মেয়ে দেখলে ওরকম একটু আধটুক ভাব জমাতে সবাই চায় ৷ তারও দোষ ছিল আগে ৷ এই বয়সে সবারই এক দোষ-ই থাকে বিরক্ত করে কি লাভ? তামাশা তো সবসময় চলে না ,যখন কাজের সময়
পাতেন অনেক ভালো হয়ে গেছে, কেউ তার সম্বন্ধে তাকে কিছু বলেও না ৷ সবকিছুই স্বাভাবিক চলছে,এতটুকু বিভ্রাট নেই কোথাও ৷
লেবাসুর অবস্থা পরিবর্তন খানিকটা হয়েছে কাজের চাপে ৷ টাকা যখন আসছে তখন পরিবারেও কোন ঝামেলা নেই ৷ কিন্তু চোয়ানীর খবর পেলে মাথা বিগড়ে যায় তার ৷ সোজা সেখানে ছোটে তারপর পেয়ালাকে পেয়ালা ৷ তারপর মুখে যবনিমিশাল ভাষায় রাস্তা চলে,‘চোয়ানী ইস দিলমে, তো বাপু বহুত খোশ আতি ৷’ নেশার কোন পরিবর্তন হয় নি তার ৷ কেউ কাজের সময় গায়ে পড়ে চোয়ানী বানাবে তার সময়ও নেই ৷ চোয়ানীর আসর তাই ঘন ঘন না হয়ে এই সময়কালে অনেক কমে গেছে ৷ এ পাড়ায় এমন কোন হিন্দু পুরুষ নেই যে চোয়ানী খায় না ৷ সকলেই খায়,কেউ বেশি বা কেউ কম ৷ ওটাই প্রথা হয়ে গেছে একরকম ৷

পাতেন ডিপোর মোটর বন্ধ করে ঘরে বসে আছে ৷ সুপর্না এলো ৷ চোখে-মুখে বিষাদের ছায়া রাগের সাথে মিশে যেন রক্তবর্ণ ধারণ করেছে ৷ হাসিমুখ হয়ে গেছে বিবর্ণ ৷ কেমন একটা রিক্ত ভাব ফুটে উঠেছে চেহারায় ৷ জগতের কোন ভয় যেন তাকে স্পর্শ করে না, কোন সৌন্দর্য তাকে বিমোহিত করেনা ৷ কোন কথা যেন তাকে নাড়া দেয় না ৷ এসেই বলল,
‘ কি করবিন তুমি এখন? ’
‘ কি কবা চাচ্ছিন? ’
‘ হামাক কদ্দিন বিয়ে করবিন? ’
‘ তোমাক বিয়ে?’
‘ হ্যাঁ ’
‘ করমো না, হামি মুসলমান আর তুমি হিন্দু ৷ ’
‘ তা’লে ক্যান কছিলেন হামাক মুসলমান বানায়ে বিয়ে করবেন? ’
‘ এমনি কওয়া লাগে কইছি ,কথার কথা এটা ৷’
‘ সবাক কয়ে দেয়া লাগবে, বিচার দেমো কিন্তুক?
‘ দেও,তোমার জাত যাবে ৷ হামার কিচ্ছু হবে না ৷’
‘তা’লে মিছা কথাগুলা কইছিলিন সে-ই দিন ? ’
‘ধুর পাগলি,মুসলমান আর হিন্দুতে বিয়ে হলে মানুষ কি কবে ? ’
‘ কেন তা’লে হামার ইঙ্কারা সর্বনাশ করলিন ? দুইমাস বয়স হলো , কি করমো আমি এখন? ’
‘ মর গিয়ে, অ’টা ব্যাপার নয় ৷ ঝামেলা করিস না, বাড়িত যা ৷ ’
চারদিন পর খাঁড়ির পাশে একটা লাশ পাওয়া যায় ৷ প্রথম দেখে লাশটি এ পাড়ার এক বুড়ো ৷ পাড়াজুড়ে হুলস্থুল পড়ে যায় ৷ লেবাসুর বৌ ফুরাডান খেয়ে মরে পড়ে আছে খাঁড়িতে ৷ এখান থেকেই এই গল্পের সমাপ্তি হয় ৷ নিচু জাতের বলে কেবল মুখে আগুন দিয়ে একটি ঠিলা রেখে কবরস্থ করা হয় তাকে ৷
গ্রামগুলো মুহূর্তে শান্ত হয়ে যায়, কোলাহল থেমে যায় ৷ আবার আগের মতোই সব চলতে লাগে কেবল একজন ছাড়া ৷ মনে হয় পৃথিবীতে কিছু একটা খোঁয়া গেছে হঠাৎ করে ৷ প্রতিদিন একটা মেয়ে সকালবেলা সূর্য লাল হয়ে ওঠার সময় এই চরায় আসতো বকরী নিয়ে আর খুঁটা গেঁরে রেখে যেতো, দুপুরে মাথার উপর টগবগে সূর্যের রোদে মাথায় কাপর দিয়ে একবার বকরী নিতে আসতো ৷ সূর্য কিছুটা হেলে গেলে বকরী চরায় নিয়ে আসতো আবার সন্ধ্যা হলে যখন সূর্য লাল হয়ে ডুববে ডুববে তখন বকরী নিয়ে যেতো ৷ আজ সূর্য লাভা মিলিয়ে গেলো প্রতীক্ষায় প্রতীক্ষায় তবু চরাতে এখনও এলোনা কেউ , কেবল একবিন্দু শূন্যতা নিয়ে অস্ত গেল সে-ই সূর্য ৷



রায়ান নূর
বাংলাভাষা ও সাহিত্য,
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ৷

০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছিঁচকাঁদুনে ছেলে আর চোখ মোছানো মেয়ে...

লিখেছেন খায়রুল আহসান, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:০৯

ছিঁচকাঁদুনে ছেলে আর চোখ মোছানো মেয়ে,
পড়তো তারা প্লে গ্রুপে এক প্রিপারেটরি স্কুলে।
রোজ সকালে মা তাদের বিছানা থেকে তুলে,
টেনে টুনে রেডি করাতেন মহা হুলস্থূলে।

মেয়ের মুখে থাকতো হাসি, ছেলের চোখে... ...বাকিটুকু পড়ুন

হার জিত চ্যাপ্টার ৩০

লিখেছেন স্প্যানকড, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



তোমার হুটহাট
চলে আসার অপেক্ষায় থাকি
কি যে এক ছটফটানি
তোমার ফিরে আসা
যেন প্রিয় কারো সনে
কোথাও ঘুরতে যাবার মতো আনন্দ
বারবার ঘড়ি দেখা
বারবার অস্থির হতে হতে
ঘুম ছুটে... ...বাকিটুকু পড়ুন

জীবনাস্ত

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৪৪



ভোরবেলা তুমি নিশ্চুপ হয়ে গেলে একদম,
তোমার বাম হাত আমার গলায় পেঁচিয়ে নেই,
ভাবলাম,তুমি অতিনিদ্রায় আচ্ছন্ন ,
কিন্তু এমন তো কখনো হয়নি
তুমি বরফ জমা নিথর হয়ে আছ ,
আমি... ...বাকিটুকু পড়ুন

যে দেশে সকাল শুরু হয় দুর্ঘটনার খবর দেখে

লিখেছেন এম ডি মুসা, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:১১

প্রতি মিনিটে দুর্ঘটনার খবর দেখে অভ্যস্ত। প্রতিনিয়ত বন্যা জলোচ্ছ্বাস আসে না, প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনার খবর আসে। আগে খুব ভোরে হকার এসে বাসায় পত্রিকা দিয়ে যেত। বর্তমানেও প্রচলিত আছে তবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

জেনে নিন আপনি স্বাভাবিক মানুষ নাকি সাইকো?

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:১৮


আপনার কি কারো ভালো সহ্য হয়না? আপনার পোস্ট কেউ পড়েনা কিন্তু আরিফ আর হুসাইন এর পোস্ট সবাই পড়ে তাই বলে আরিফ ভাইকে হিংসা হয়?কেউ একজন মানুষকে হাসাতে পারে, মানুষ তাকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×