হজরত শাহজালালের মাজারে আজও হিন্দুরা যায়, মোম-আগরবাতি জ্বালায়, প্রসাদ গ্রহন করে। আমি নিজেও গিয়েছি সেখানে। মোমবাতি জ্বালিয়েছি, প্রসাদও গ্রহন করেছি। কিন্তু মূল প্রশ্ন হলো হিন্দুরা কেনো সেখানে যায়? বলছি, তার আগে একটা কথা আমরা জানি, সেটা হলো, "জন্মিলে মরিতে হইবে" এটা যেমন সত্য তেমনই সত্য, অত্যাচারী'র পতন হওয়া। আবার আরেকটা কথা আছে, দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে মানুষ সামনে আগানোর চেস্টা করে, এগুলো যুগযুগান্তরে সত্য প্রমানিত হয়ে আসছে। দ্বী-মত করার মতো লোক কোথাও খুঁজে পাওয়া যায়নি। যাহোক প্রসংগ ছিলো, হিন্দুরা কেনো দরবেশ শাহজালালের মাজারে যায়? চলুন একটু ইতিহাসের দিকে ঘুরে আসি। কারো জানা থাকলে, আমার কোথাও ভুল হলে শোধরে দেবেন।
হজরত শাহজালাল গৌড় আগমনের সময়ে, শ্রীহট্রের গৌড় রাজ্যের প্রতাপশালী রাজা ছিলেন "গৌড়-গোবিন্দ" প্রচণ্ড ধর্মবিদ্বেষ ছিলো তার মধ্যে। আর সে কারণেই পতন ছিলো তার অনিবার্য। আর সেই পতন তুরান্বিত করেছিলেন তিনি নিজের কর্মদোষেই!
রাজা গৌড় গোবিন্দের শাসনামলে এদেশে মোসলমান সংখ্যা ছিলোনা বলেই ধরা যায়। তরফে তখন নুরউদ্দীন নামক এক মোসলমান সপরিবারে বাস করতেন। এই নুরউদ্দিনের পরিবার ব্যতীত বুরহানউদ্দিন নামক জনৈক সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি সপরিবারে সিলেটের টুলটিকর নামক স্থানে ছিলেন বলে ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়।
উক্ত বুরহানউদ্দিন একদিন নিজ পুত্রের জন্মোপলক্ষে একটি গরু জবাই করেন। কিন্তু বিধি বাম! দুর্ভাগ্যবশত একটি চিল এসে এক টুকরো মাংস নিয়ে এক ব্রাম্মণের বাড়িতে ফেলে দেয়। এই খবর রাজা গৌড় গোবিন্দের কানে পৌঁছালে, রাজা ক্রুদ্ধ হয়ে বুরহানউদ্দিনের হাত কেটে ফেলেন ও সদ্যজাত শিশুটিকে হত্যা করেন। সেই ঘটনায় বুরহানউদ্দিন প্রতিহিংসা পরায়ণ হয়ে পড়েন। অন্যদিকে তরফ এ (তরফ গৌড় রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত, মতান্তরে গৌড়ের অঙ্গরাজ্য) প্রায় একই রকম আরেকটি ঘটনা ঘটে, কাজী নুরউদ্দীন নামক মুসলমান ভদ্রলোক নিজ পুত্রের বিয়ে উপলক্ষে একটি গরু জবাই করায় তরফের শাসক নুরউদ্দীনকে মৃত্যুদণ্ড দেন। এই দুই ঘটনার পর নুরউদ্দিনের ভাই ও বুরহানউদ্দিন দিল্লী'র তোগল বংশীয় সম্রাট আলাউদ্দিন ফিরোজ শাহ্ এর স্মরনাপন্ন হয়েছিলেন। সম্রাট আলাউদ্দিন সব শুনে তার ভাগিনা সিকান্দার শাহ্ কে গৌড় গোবিন্দের বিরুদ্ধে যুদ্ধে পাঠান। কিন্তু সিকান্দারের সৈনিকরা রাজা গৌড় গোবিন্দের যাদুর প্রভাব আছে বলে তারা ভীত হয়ে যায়। সকলে হয়ে পরে অসুস্থ! গৌড় গোবিন্দের বিরুদ্ধে আর যুদ্ধ করা সম্ভব হলোনা!
প্রতিশোধ নিতে না পেরে বুরহানউদ্দিন দেশত্যাগ করে মদিনায় চলে যেতে চাইলেন। কিন্তু ঘটনাক্রমে তখন প্রসিদ্ধ দরবেশ হজরত শাহজালালের সঙ্গে দেখা হয়ে যায়। বুরহানউদ্দিন সমস্ত কিছু তাকে জানালেন। শাহ্জালাল তাকে আশ্বস্ত করলেন। বুরহানউদ্দিন শাহজালাল'কে নিয়ে সিলেট অভিমুখে পথ চললেন। তারপর অনেক বাধাবিপত্তি পেরোনোর পর বিনাযুদ্ধে রাজা গৌড় গোবিন্দের পতন ঘটলো। গৌড় গোবিন্দ ভয়ে পালিয়ে গেলেন। অত্যাচারী'র মনের ভেতরে মৃত্যুভয় থাকে, যা বাহীরে দেখা যায় না। আর সেই মৃত্যুভয়ের কারণেই গৌড় গোবিন্দ সিংহাসন ছেড়ে পালিয়ে গেলেন। শ্রীহট্র মুক্ত হলো একজন অত্যাচারী রাজার করতল থেকে।
নুরউদ্দীন ও বুরহানউদ্দিনের সাথে এরকম নৃশংস ঘটনা না ঘটালে গৌড় গোবিন্দের পতন হওয়ার কোনো কারণ ছিলোনা। অত্যাচারীর পতন হওয়া যে অনিবার্য! সে মিত্যে হয় কী করে? ওরা নিজের ধর্মমতে গরু জবাই করবে না অন্যকিছু করবে এ নিয়ে গৌড় গোবিন্দের হস্তক্ষেপ করার প্রয়োজন ছিলোনা, কিন্তু তিনি তা নৃসিংহ ভাবে করে নিজের পতন ডেকে আনলেন। ঠিক এই কাজটাই এখন ভারতীয় নীতিনির্ধারকরা করছেন! একজন মুসলমান তার ধর্ম মেনে যদি গরু জবাই করে থাকে তাহলে অন্য ধর্মাবলম্বীর সমস্যা কোথায়? তারা কেনো এটাকে পাপ মনে করবে! পাপই যদি হয়ে থাকে তাহলে যে তা করছে তারই হবে, অন্যদের মাথা মোড়ানোর কী আছে!
এটা কী জাতিবিদ্বেষ হয়ে গেলোনা! গৌড় গোবিন্দ পতন ইতিহাসের যে পুনরাবৃত্তি হবেনা তার গ্যারান্টি কী আছে! ধর্মবিদ্বেষ থেকে যে অসন্তোষের সৃস্টি হয় তা থেকে বেরুনো সত্যিই কঠিন। যদিও সে দেশের লেখক বুদ্ধিজীবী দের কেউ কেউ নিজে গোমাংস ভক্ষণ করে পতিক্রিয়া দেখিয়েছেন।
শ্রীহট্রে গৌড় গোবিন্দের পতনের পর শাহজালাল একনিষ্ঠভাবে ধর্ম প্রচার করতে শুরু করলেন। হিন্দু সম্প্রদায়ের দলিত ও নিম্নস্তরের মানুষেরা, যারা রাজা গৌড় গোবিন্দ ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন ব্রাম্মণদের দ্বারা ধর্মীয় নির্যাতনের শিকার তারা শাহজালালের আহ্বানে আকৃষ্ট হয়ে ব্যাপকভাবে সারা দেয়। এবং হিন্দু সমাজ তাদেরকে জাতিচ্যুত করলে তারা মুসলমান ধর্ম গ্রহন করে। আর যারা মুসলমান ধর্ম গ্রহন করেনি, তাদেরও অনেকেই শাহজালাল'কে ভালবাসে। আবার শাহজালাল হিন্দু দেবতার উপর অত্যাচার করেননি বলেই হিন্দুগণ তাকে সম্মান করে থাকেন। শাহজালালের দরগা আজও তাই হিন্দু, মুসলিম সকলের নিকটই মান্য। সকলেই দরগায় যায়, মোম-আগরবাতি জ্বালায়, প্রসাদ গ্রহন করে।।
তথ্যাদিঃ শ্রীহট্রের ইতিবৃত্ত।
প্রকাশকালঃ ১৯১০ খৃস্টাব্দ। ব্লগার যাদব সুত্রধর অন্য নিক নিয়া বিভিন্ন ব্লগে লিখেন, তবে সামহোয়্যারইনে সম্ভবত তিনি লিখেন না, ওনার অনুমতিক্রমে ফেজবুক থেকে আমি কপিপেষ্ট করলাম।
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে জুলাই, ২০১৬ দুপুর ১:১৯