somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

চিম্বুকের চূড়ায় একদিন

২৬ শে সেপ্টেম্বর, ২০০৬ রাত ১:১৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

ছোটবেলায় শুনেছিলাম পাহাড়ের উপরে উঠলে নাকি মেঘ ধরা যায়! সাদা-কালো মেঘেরা দল বেঁধে যেন ছুঁয়ে যায় অভিযাত্রীর দেহমন। দূর সীমানায় যেখানে আকাশ আর মেঘেরা মিলে মিশে একাকার হয় সেখানে যেন মন কাকে খুঁজে বেড়ায়। অথচ সে যে কোথায়..আর ..আমি..এলোমেলো ভাবনাগুলো মনে ভিড় করে, স্বপ্নেরা মনে বুনে জাল। সেই স্বপ্নের ডানায় ভর করে কতবার যে পাহাড়ে উঠেছি তার হিসেব নেই, তবে সেদিন সত্যিই পাহাড়ে উঠেছিলাম-একদম চূড়ায়-চিম্বুকের চূড়ায়।
সেদিন ছিল 5 সেপ্টেম্বর, মঙ্গলবার। সকাল ছয়টার দিকে আমাদের বাস চট্টগ্রামের কাপ্তাই রোডের পাহাড়ি পথ ধরে চিম্বুকের পথে ছুটে চলল। রাস্তায় প্রচন্ড বাঁক। কখনো ডানে, কখনো বায়ে এঁকেবেঁকে আমাদের বাস যতই সামনের দিকে এগুচ্ছিল ততই রাঙামাটির পাহাড় আমাদের কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠছিল। রাঙামাটি ঢোকার পরে বুঝলাম কাকে বলে পাহাড়ি রাস্তা! রাস্তায় উঁচুনিচু অংশের অভাব নেই। প্রায়ই ইউ-টার্নের চেয়েও বেশি বাঁক। অভিজ্ঞ ড্রাইভার ছাড়া এ পথে যে কারোর জন্যই অপো করছে পদে পদে মৃতু্য। একটু অসতর্ক হলেই গড়িয়ে পড়তে হতে পারে কয়েকশ ফুট নিচে।
একসময় রাঙামাটি পার হয়ে আমাদের বাস ঢুকে পড়ল বান্দরবানের চড়াই উৎড়াই সড়কে। প্রকৃতির বিচিত্র রূপে বিমোহিত না হয়ে পারা যায় না। কখনো একপাশে উঁচু পাহাড়, অন্যপাশে গভীর খাদ। কখনো বা দু'পাহাড়ের মাঝ দিয়ে সরু রাস্তা। জানা-অজানা নানান গাছের সারি সবুজ কার্পেটের মত পাহাড়ের শরীর জড়িয়ে আছে। দূরে বয়ে যায় সরু ছোট নদী। মাঝে মধ্যে দু'একজন পাহাড়ি তরুণী চোখে পড়ল। ওদের ছবি তুলতে চাইলেই মুখ ঘুড়িয়ে নেয়।
বান্দরবানে পেঁৗছে জানলাম ওখান থেকে চিম্বুকের দূরত্ব আরও 25 কিলোমিটার। যাবার বাহন হচ্ছে চার স্ট্রোকের জিপ। লোকে বলে 'চান্দের গাড়ি'। স্থানীয় অধিবাসীরাও এ পথে এ গাড়িই ব্যবহার করে। এই পাহাড়ি পথে এছাড়া অন্য কোন যানবাহন চলাচল করে না। শেষে একসময় 'চান্দের গাড়ি' তে চড়ে 'চান্দের' দেশে রওয়ানা হলাম।
এখানকার পাহাড়ি রাস্তা আরও ভয়াবহ। গাড়ির নিয়মিত ওঠানামায় মনে হচ্ছিল এই পাহাড়ে উঠছি, পরমুহূর্তেই আবার নিচে হারিয়ে যাচ্ছি। গাড়ির হেলপার আব্দুর রহমানের কাছ থেকে জানলাম এখানকার নানান বিচিত্র তথ্য। পাহাড়িদের মধ্যে বুম উপজাতির লোকদের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। এছাড়াও আছে ত্রিপুরা, চাকমা, মুরং, হাজং ইত্যাদি। সবচেয়ে সুন্দর হচ্ছে ত্রিপুরা মেয়েরা। বেশি আত্মকেন্দ্রিক হচ্ছে মুরংরা। কিন্তু সবচেয়ে স্মার্ট হচ্ছে বুমরা। গায়ে কাটা দেয়ার মত আরেকটি তথ্য জানলাম রহমানের কাছ থেকে-সন্ধার পর এখানে কারো আসা নিষেধ। 'শান্তিবাহিনী'র উপদ্রব বেড়ে যায়। আগে এখানে অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায় করাটা নিত্যদিনের ব্যাপার ছিল। তবে অপহৃতের জীবনের কোন গ্যারন্টি ছিল না। এখনো নাকি মাঝে মধ্যে এমন ঘটনা ঘটে। সিদ্ধান্ত নিলাম সন্ধার আগেই এখান থেকে চলে যেত হবে।
চিম্বুকের রাস্তাটা ভারি অদ্ভুত মনে হল-ঘুরে ঘুরে উপরে উঠে যাওয়া। দূর থেকে মেঘের মধ্যে চূড়া দেখা যাচ্ছিল। বেশ রোমাঞ্চ অনুভব করছিলাম আর একটু পরেই আমি মেঘের মধ্যে হারিয়ে যাব! শুনেছি মেঘের মধ্যে বিদু্যতের কণা থাকে। ওগুলো আবার শক্ করবে নাতো! হাস্যকর চিন্তায় যখন বুদ হয়েছিলাম তখন হঠাৎ নিচে চোখ যেতেই বুক কেঁপে উঠল। ওরে বাবা মাটি থেকে আমরা কত উপরে! নিচের বাড়িঘর, গাছপালাকে বিন্দুর মত মনে হচ্ছিল। একবার যদি গাড়ির ব্রেক ফেল করে তাহলে একমুহূর্তেই হাজার ফুট নিচে পড়ে যেতে হবে। বেশিণ নিচের দিকে তাকিয়ে থাকতে পারলাম না। মাথাটা কেমন যেন ঘুরে উঠল। দূরে দেখলাম কলা গাছে এককাদি কলা পেকে ঝুলে আছে। মন থেকে ভয় দূর করার জন্য শেষে ওটার দিকে তাকিয়ে থাকলাম।
চিম্বুকের চূড়ায় উঠে নিজেরই বিশ্বাস হচ্ছিল না যে আমি এখন মাটি থেকে 3772 ফুট উপরে আছি। দূরে কেমন যেন ধোঁয়া ধোঁয়া ধোঁয়াশা। ওখানকার একজনকে জিজ্ঞেস করলাম-এত উপরে ধোঁয়া কেন? লোকটা বলল, ধোঁয়া নয় মেঘ। আপনিও মেঘের মধ্যে আছেন! দূর থেকে এ জায়গাও ধোঁয়া ধোঁয়া দেখায়।
দূরে দেখলাম কেওকারাডাং, বাংলাদেশের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ। শুনলাম ওটার উপরেও নাকি ওঠা যায়। বাহন সেই চান্দের গাড়ি। তবে গাড়ি চিম্বুকের মত পুরো পথ আসতে পারে না। কতকটা পথ হেঁটে যেতে হয়।
চিম্বুকের চূড়ায় থাকার জন্য রেস্ট হাউজ আছে। পুলিশ পাহারা আছে। আর আছে একটা বড় টেলিফোন্ টাওয়ার। দেখলাম এক যুগল এখানে বেড়াতে এসেছে। দেখেই মনে হয় নববিবাহিত দম্পতি। ওদের হাত ধরাধরি করে হাঁটাচলা, তন্ময় হয়ে পাহাড় দেখা, ছবি তোলা-দেখতে দেখতে কেমন যেন হয়ে গিয়েছিলাম। একটু উদাস, হয়ত বা বিষণ্ন। গাছে দেখলাম জোড়া শালিক। এত উপরে শালিক এলো কোত্থেকে?
বিস্ময়কর হলেও সত্য যে অত উচুঁতেও একটা মোবাইল কোম্পানির নেটওয়ার্ক ছিল। অনেকেই মোবাইল বের করে নানান জায়গায় কল দিচ্ছিল-'হ্যালো, ইতু জানো আমি এখন কোথায়? একদম পাহাড়ের মাথায়!' 'সালমা তুমি এখানে থাকলে খুব ভাল হত!' 'আই মিস ইউ জান!' সবার দেখাদেখি মোবাইলটা বের করলাম। একটা নম্বরও বের করলাম-দেব নাকি কল! নাহ থাক! অন্যের বউকে কল দিয়ে কি লাভ!
ঘন্টাখানেক চিম্বুকের চূড়ায় থেকে আমরা ফেরার পথ ধরলাম।
(এ লেখাটা গত বুধবার প্রথম আলোতে ছাপা হয়েছিল। কেউ কেউ হয়ত পড়ে থাকবেন। যারা পড়েননি। তাদের জন্যই ব্লগে দিলাম।)
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে ডিসেম্বর, ১৯৬৯ সন্ধ্যা ৭:০০
১০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

জীবনের গল্প

লিখেছেন ঢাকার লোক, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:৩৫

মাত্র মাস দুই আগে আমার এক আত্মীয়ের সাথে দেখা আমার এক বোনের বাড়ি। তার স্ত্রী মারা গেছেন তার সপ্তাহ দুই আগে। মক্কায় উমরাহ করতে গিয়ে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

অভিমান

লিখেছেন জিনাত নাজিয়া, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১০:১২

" অভিমান "

তোমার ঠোঁটে বোল শিখেছি
তুমি আমার মা, কেমন করে
ভুলছ আমায় বলতে
পারিনা। এমন করে চলে
গেলে, ফিরে ও এলেনা। হয়তো
তোমার সুখেই কাটছে দিন,
আমায় ভাবছ না।

আমি এখন সাগর... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমার কিছু ভুল!

লিখেছেন মোঃ খালিদ সাইফুল্লাহ্‌, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১:৪৮

১। ফ্লাস্কে চা থাকে। চা খেতে টেবিলে চলে গেলাম। কাপে দুধ-চিনি নিয়ে পাশে থাকা ফ্লাস্ক না নিয়ে জগ নিয়ে পানি ঢেলে দিলাম। ভাবছিলাম এখন কি করতে হবে? হুঁশ ফিরে এল।... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাংলাদেশের লোকসংস্কৃতিঃ ব্যাঙের বিয়েতে নামবে বৃষ্টি ...

লিখেছেন অপু তানভীর, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:০০



অনেক দিন আগে একটা গল্প পড়েছিলাম। গল্পটা ছিল অনেক এই রকম যে চারিদিকে প্রচন্ড গরম। বৃষ্টির নাম নিশানা নেই। ফসলের মাঠ পানি নেই খাল বিল শুকিয়ে যাচ্ছে। এমন... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাংলাদেশি ভাবনা ও একটা সত্য ঘটনা

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১০:১৭


আমার জীবনের একাংশ জুড়ে আছে; আমি চলচ্চিত্রাভিনেতা। বাংলাদেশেই প্রায় ৩০০-র মত ছবিতে অভিনয় করেছি। আমি খুব বেছে বেছে ভাল গল্পের ভাল ছবিতে কাজ করার চেষ্টা করতাম। বাংলাদেশের প্রায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

×