ছোটবেলার কত কিছু মানুষ ভুলে যায়! পরে বড়দের কাছে শুনলে কেমন অবাক লাগে! চোখ গোল গোল করে তাকিয়ে মনে হয়, 'হুট! এইগুলা আমি জীবনেও করি নাই!' আমি পলিথিন কে বলতাম 'পলিঙ্গি ব্যাগ'। বড় চাচীকে বলতাম ‘মাক্কো’। মা থেকে মাক্কো। বড় চাচীকে এই মাক্কো বলার কথা আমার মনে আছে। মনে নেই আমার এক খালার কথা। আমার মায়ের চাচাতো বোন। তাকে আমি খালাম্মা না ডেকে ডাকতাম 'কানা মা'। কানা মা'র সাথে আমার দেখা নেই কুঁড়ি বছরেরও বেশি। তার স্মৃতি আমি ভুলে গেছি। এবার ঈদে নানু বাড়ি গেলাম। বাড়ীতে নানু ছাড়া আর কেউ থাকেন না। সেখানে বৃদ্ধ এক নারী কলপারের ভেজা মাটিতে দাঁড়িয়ে পা টিপেটিপে শান বাঁধানো চাতালে উঠতে চেষ্টা করছিলেন। আমি খানিক স্থীর হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। ভেজা মাটি থেকে কলের শান বাঁধানো চাতালে ওঠা এমন শক্ত কোন কাজ না। বৃদ্ধ হলেও না। কিন্তু উনি এমন করছেন কেন? উনি শেষ অবধি সেই চাতালে উঠলেন। এখন কলের হাতল খুঁজে পাচ্ছেন না। হাতলের আশেপাশে কাঁপা হাতে বাতাসে খুঁজে বেড়াচ্ছেন। আমি ধীর পায়ে উনার পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম, বললাম, আপনি চোখে দেখেন না?’
উনি বললেন, ‘কেডা তুমি?’
আমি নাম বললাম, উনি বললেন, ‘তুমি আলেয়ার (আমার মায়ের নাম আলো, উনারা বলেন আলেয়া) পোলা?’
আমি বললাম, ‘হু, আপনি আমারে চেনেন?’
উনি সে কথার জবাব দিলেন না। বললেন, ‘তুমি একটু আমার হাত ধইরা নিচে খাড়া করাওতো বাজান’।
আমি উনাকে নিচে দাঁড়া করালাম। উনি বললেন, ‘একটু নিচু হইয়া তোমার গলাটা আমার মুখের কাছে আনো’।
আমি অবাক হয়ে খানিক তাকিয়ে থাকলাম। তারপর নিচু হয়ে উনার মুখের কাছে গলা নিলাম। উনি আমার ঘাড়ের ভেতর নাক ডুবিয়ে দীর্ঘ নিঃশ্বাস নিলেন। দীর্ঘ। বুক ভরে নিঃশ্বাস নিলেন। তারপর বললেন, ‘ছোডকালে তুমি আমার সাথে ছাড়া ঘুমাইতা না, আমি ভাত না খাওয়াইলে খাইতা না। ঢেঁকীতে তখন আমরা আউশ ধানের চাউল দিয়া চিড়া কুটতাম। সারা রাইত ধইরা চিড়া কুটতাম। সেই চিঁড়ার ঘ্রাণে সাড়া গাঁও মৌমৌ করত। কি সোন্দর ঘ্রাণ। আমার খালি মনে হইত তোমার শরিলে সেই চিঁড়ার ঘ্রাণ থাকে। সারাদিন আমি খালি তোমার শরিলের ঘ্রাণ নিতাম। বুঝছ বাজান?’
আমি বুঝলাম কি না জানি না। বিড়বিড় করে বললাম, ‘এখনও কি আমার গায়ে সেই ঘ্রাণ আছে?’
উনি বললেন, ‘এই ঘ্রাণতো গায়ে থাকে না বাজান, এই ঘ্রাণ থাকে মনে। আমি এহনো সেই ঘ্রাণই পাইলাম বাজান। সেই চিঁড়া কোটার সুবাস। অন্যরা পাইব কি না জানি না। আমি পাইছি বাজান’।
আমি কোন কথা বললাম না। অদ্ভুত চোখ নিয়ে অপলক তাকিয়ে রইলাম। তিনি হঠাৎ ফিসফিস করে বললেন, ‘তুমি আমারে কি বলতা জানো?’
আমি বললাম, ‘না’।
তিনি খানিক থেমে, দীর্ঘ সময় নিয়ে বললেন, ‘তুমি আমারে কোনদিন খালাম্মা বলতা না। তুমি আমারে বলতা, কানা মা। দেখছ, এখন আমি সত্য সত্যই তোমার কানা মা। তোমার কানা মা এহন আর চোখে দেখে না’।
কি বলব আমি? আমি কোন কথা খুঁজে পেলাম না। আমার ইচ্ছে হচ্ছিল মানুষটাকে আমি শক্ত করে বুকের ভেতর জড়িয়ে ধরি। কিন্তু কোন এক জড়তায়, দ্বিধায়, দূরত্বে আমি তা করতে পারলাম না।
কারণ, আমি আমার কানা মা’কে মনে রাখি নি।
-----------------------------------------------------
কানা মা/ সাদাত হোসাইন