নানুকে নিয়ে ঢাকা ফিরছি, লঞ্চে।
নানু হাঁটতে পারেন না। কুঁচকে যাওয়া চামড়ার ভাঁজে ভাঁজে বয়সের গল্প। নানা মারা গেছেন বছর আটেক হবে। তারপর থেকে নানুর একলা জীবন। লম্বা শুভ্র দাড়ির মানুষটা দেখতে অবিকল লালন ফকির ছিলেন। আম্মা, খালাদের মতে, নানার বয়স হয়েছিল একশ'র কাছাকাছি।
নানুকে জিজ্ঞেস করলাম, 'নানু, নানার কথা মনে পড়ে?'
নানু জবাব দিলেন না। লঞ্চের জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকলেন। শান্ত নদীতে মৃদু ঢেউ। সেই ঢেউয়ের মাথায় জোছনার মেলা।
আমি ডাকলাম, 'ও নানু?'
নানু মুখ ফেরালেন না, তবে শব্দ করলেন, 'হু'।
আমি বললাম, 'আপনার যখন বিয়ে হয়, তখন বয়স কত ছিল?'
নানু মুখ না ফিরিয়েই বললেন, 'মনে নাইরে ভাই। কত আর হইব, ১০ বা ১১'।
আমি বললাম, 'অত অল্প বয়সে বিয়া? তখন নানার বয়স কত ছিল?'
নানু বললেন, 'তোর নানার বয়স আছিল। আমার চাইতে কমসে কম কুড়ি পঁচিশ বছরের বড়'।
আমি বললাম, 'এইটা কিছু হইল? আপনেগো সমস্যা হয় নাই?'
নানু বলল, 'কি সমস্যা?'
আমি হুট করে নানুর এই পাল্টা প্রশ্নের কোন উত্তর খুঁজে পেলাম না। বললাম, 'আপনারা সংসার করছেন কত বছরের?'
নানু বললেন, ষাইট সত্তুর তো হইবই'।
আমি বললাম, 'এত বছর? বিরক্ত লাগে নাই?'
নানু শক্ত গলায় বললেন, 'বিরক্ত লাগব ক্যা?'
আমি নানুর এই পাল্টা প্রশ্নেরও উত্তর দিতে পারলাম না। খানিক মজা করে বললাম, 'বিরক্ত লাগে নাই, না? ঠিকই লাগছে। নানা কইতে সাহস পায় নাই। এখন গিয়া দেখবেন, ঠিকই বেহেস্তে হুর পরী নিয়া ফুর্তি করতেছে'।
নানু মুহূর্তে জানালা থেকে মুখ ফেরালেন। স্থীর পাথুরে চোখে অনেকক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থাকলেন। তারপর হঠাৎ তার সেই স্থীর পাথুরে চোখ জোড়া যেন গলে জল হয়ে গেল। ছলছল জলে ভরে গেল চোখ, তারপর চোখের পাতা, চোখের কোল, তারপর গাল, তারপর চিবুক, তারপর গ্রীবা, তারপর গলা। আমি হতভম্ব চোখে তাকিয়ে রইলাম। নানুর পাশে গিয়ে দুইহাতে কাঁধ চেপে ধরলাম। নানু হঠাৎ জলে ভেজা ভারী গলায় বললেন, 'হুর পরী ক্যা, তারচাইতেও যদি বড় কেউ আসে, সে ফির্যাও তাকাইব না। আমি ছাড়া আর কারও দিকে সে ফির্যাও তাকাইব না। কোন দিন না। কোনদিন তাকাইব না। সে আমার জন্য অপেক্ষা করতেছে, আমিও মরনের অপেক্ষা করতেছি। যত তারাতারি মরতে পারব, তত তারতারি তার সাথে দেখা হইব। সে আমারে ছাড়া কেমনে থাকব! তার একলা একলা অনেক কষ্ট হইতেছে, অনেক কষ্ট'।
আমি প্রবল বিস্ময় নিয়ে বয়সের ভারে ন্যুজ্ব এই বৃদ্ধার দিকে তাকিয়ে রইলাম। তার চোখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। ৭০ বছর, সত্তুরটা বছর কি প্রবল শ্রদ্ধা, ভালোবাসা, আর বিশ্বাস নিয়েই না তিলে তিলে বেড়ে উঠেছিল একটা সম্পর্ক! কি অসম্ভব মমতা আর শক্তি নিয়েই না সেই সম্পর্কটা টিকে গেছে অনন্তে! চির অমরত্বে! এই সম্পর্কের রহস্য কি?
অনন্ত সম্পর্কের এই রহস্য আমরা জানি না, নিশ্চয়ই জানি না। হয়তো জানতে চাইও না। তাইতো, কী অবলীলায়ই না আমরা আমাদের সঙ্গীদের বলে দেই, 'তোমার সাথে আমার হচ্ছে না, একদমই হচ্ছে না...
সো, লেটস ব্রেক আপ!! লেটস গেট ডিভোর্স!!'