চারতলার ফ্লাটের দখিনের বারান্দায় গ্রিল চেপে দাঁড়িয়ে আছে শাহরিয়ার।তাকিয়ে আছে বাইরে ,অনেক দূরে!শহরের উঁচুনিচু দালান ,ব্যস্ত রাস্তায় ছুটাছুটি করা গাড়ি-রিক্সা,গাছ,মানুষ এসব কিছুতেই তার দৃষ্টি আটকে নেই।আবার বিশাল আকাশে মেঘের আবেশ কিংবা ডানা মেলে হাওয়ায় ভেসে থাকা কয়েকটা চিলও তার নজর কাড়তে পারেনি।শাহরিয়ার কেবল তাকিয়েই আছে বাইরে।তার দৃষ্টি শুণ্য!মাথা ফাঁকা!কতোক্ষণ এভাবে সে তাকিয়ে থাকে ,তা সে নিজেও জানে না!তবে অনেক্ষণ যে থাকে ,ঊর্মি,র কথায় বুঝা যায়!
ঊর্মি!
চমকে উঠে শাহরিয়ার।ওকে তো টয়লেটে বসিয়ে এসেছিল সে ।একা একা তো নড়তেই পারবে না !কতোক্ষণ যে হয়ে গেছে ,শাহরিয়ার তো টেরও পায় নি ।ছুটে গিয়ে বাথরুমের
দরজায় টোকা দেয় সে ।
"ঊর্মি ,তোমার কি শেষ ?"
"হ্যাঁ !" আর্তনাদের মতো শোনায় ঊর্মির কন্ঠস্বর ।
দরজা খুলে ঊর্মিকে পরিষ্কার করে পাঁজকোলা করে নিয়ে আসে শাহরিয়ার ।খুব সাবধানে আলতো করে বিছানায় শুইয়ে দেয় ।
"তুমি এতো দেরী করলে কেন ?আমি এক ঘন্টা ধরে তোমাকে ডাকছিলাম !"
"তুমি ডাকলেই আমাকে আসতে হবে নাকি ?আমার কোনো কাজ নাই !" খেঁকিয়ে ওঠে শাহরিয়ার ।তার মন মেজাজ খারাপ ।জীবনের উপর বিতৃষ্ণা এসে গেছে ।এভাবে আর কতো !
বছর সাতেক আগে ঊর্মিকে বিয়ে করেছিলো শাহরিয়ার ।ঊর্মি মাইক্রোবায়োলজিস্ট আর শাহরিয়ার আর্কিটেক্ট ।বিয়ের আগে জানাশোনা ছিল ,তবে প্রেম নয় ।বিয়ের পর খুব সুখেই ছিল তারা ।একজন আরেকজনের প্রেমে রীতিমত হাবুডুবু খেতো ।অসম্ভব ভালোবাসতো পরস্পরকে ।বছর খানেক পর একদিন ঊর্মি একা বাসায় সিলিং ফ্যান পরিষ্কার করছিলো ।চেয়ারের উপর টুল রেখে সেটার উপর দাঁড়িয়ে ছিলো নাগাল পাওয়ার জন্য ।হঠাত্ করে ভারসাম্য হারিয়ে চেয়ার টুল সহ ভীষণ বেকায়দায় উল্টে পড়ে যায় !অজ্ঞান হয়ে একা ফ্লাটে পড়ে থাকে ।সন্ধ্যায় শাহরিয়ার বাসায় এসে দরজা ভেঙে ঢুকে ঊর্মিকে হাসপাতাল নিয়ে যায় ।রিপোর্টে দেখা যায় ঊর্মির স্পাইনাল কর্ড ড্যামেজ হয়ে গেছে!সেই থেকে প্যারালাইজড!
শাহরিয়ারেরও যুদ্ধ শুরু !বিছানা থেকে একা একা উঠতেই পারে না ঊর্মি ।খাওয়া দাওয়া থেকে শুরু করে গোসল,এমনকি টয়লেট পর্যন্ত অন্যের সহযোগিতা ছাড়া করতে পারে না ।প্রথম প্রথম ঊর্মির আত্মীয় বা শাহরিয়ারের আত্মীয়রা সহযোগীতা করলেও ,পরে আর করা হয়ে উঠেনি ।সবারই নিজের জীবন ,সংসার রয়েছে ।ঊর্মির সবকিছুই শাহরিয়ারকে করে দিতে হয় ।সারাদিন অফিস করে ক্লান্ত হয়ে এসে বাকি সময় প্যারালাইজড স্ত্রীর সেবা করতে হয় ।প্রথম প্রথম হাসিমুখেই সব করতো ।কিন্তু যতোদিন যাচ্ছে ,তার মধ্যে হতাশা বাড়ছে ।ছয় বছর ধরে একজন সম্পূর্ণ অচল মানুষকে বয়ে নিতে হচ্ছে ।তার কোনো সন্তান নেই এবং হবেও না !ঊর্মির সন্তান ধারণের ক্ষমতা নষ্ট হয়ে গেছে ।
ইদানিং অল্পতেই মেজাজ হারায় শাহরিয়ার ।মাঝেমাঝে গালাগালিও করে ঊর্মিকে !একদিন চড়ও মেরেছিল ।অথচ ,বাসর রাতে যখন ঊর্মির লজ্জায় টকটকে লাল হওয়া মায়াবী মুখটা দেখেছিল ,তার মনে হয়েছিল ,এই মেয়ের জন্য সে সারাজীবন যে কোনো কষ্ট করতেই রাজী ।অথচ,এ ক 'বছরেই তার ভালোবাসার অবস্থা দেখে সে নিজেই মাঝে মাঝে অবাক হয় !আবেগ আর বাস্তবতা আসলেই সম্পূর্ণ ভিন্ন ব্যপার !
কাজের মেয়েটা আজ এক সপ্তাহ ধরে অসুস্থ ।কাজে আসছে না ।সব কাজ শাহরিয়ারকেই করতে হচ্ছে ।অফিসেও খুব ব্যস্ততা ।দুটো প্রজেক্ট এক সাথে চলছে,অডিটও হচ্ছে !মাথা খারাপ অবস্থা !বাসায় এসে আবার রান্নাবান্না করা ,ঊর্মির দেখাশোনা - রীতিমত হাঁপিয়ে উঠেছে শাহরিয়ার ।
আজ শুক্রবার ।সারাদিন বাসাতেই থাকতে পারছে ।তবে ঊর্মির শরীরটা আজ একটু বেশি খারাপ ।সকাল থেকে ঊর্মির পেট খারাপ।এই নিয়ে চারবার টয়লেটে নিতে হয়েছে।এখন একটু গা গরমও মনে হলো।ডাক্তারকে ফোন দিতে হবে।
গোসল করিয়ে দুপুরের খাবার ঊর্মিকে খাইয়ে দেয় শাহরিয়ার।গত ছয় বছর ধরেই নিজ হাতে খাইয়ে দিচ্ছে।খাওয়ানো শেষ করে বিছানায় আবার শুইয়ে দিলো।
-তুমি একটু বসবে আমার পাশে?
-কেন?
-এমনিতেই!
-আমার অনেক কাজ আছে।প্রজেক্টের ডিজাইন এখনো বাকি!তুমি শুয়ে থাকো!
-একটু বসো না ,প্লিজ!
শাহরিয়ার বিরক্ত হয়ে বসলো।
-আমার হাতটা একটু ধরো!
-কেন?কি হয়েছে?
-একটু ধরো না!
শাহরিয়ার ঊর্মির হাত ধরলো!
-আমার খুব ভালো লাগছে!
-ন্যাকামি করো না !তোমার দু হাত ই প্যারালাইজড !তোমার অনুভূতি হবে কিভাবে ?
-তুমি যে আমার পাশে বসে আমার হাত ধরেছো এটা ভেবেই আমার ভালো লাগছে ।
-ওকে !এখন উঠছি !
-শাহরিয়ার,একটু বসো !আজ চৌদ্দ ফেব্রুয়ারী,মনে আছে ?আমাদের সেভেনথ ম্যারেজ এনিভার্সারি !
-তো?কি করবো ?কেক এনে হাত তালি দিয়ে কাটবো ?
-না !তুমি একটু বসে আমার দিকে তাকিয়ে একটু হেসে কথা বলো !গত ছয় বছর তুমি আমার দিকে তাকিয়ে হাসো নি !মিথ্যে করে হলেও একটু হাসো ,শাহরিয়ার !"
গলা ধরে আসে ঊর্মির !
-ছয় বছর?
-হ্যাঁ !তোমার প্রতি আমার কোনো ক্ষোভ নেই !তুমি আমার জন্য যা করছো ,তার প্রতিদান আমার পক্ষে দেয়া সম্ভব নয়!কিন্তু ,গত ছয় বছর ধরে তোমার মুখে হাসি নেই।এই বছর গুলোতে তুমি আমার দিকে তাকিয়ে একবারও হাসিমুখে কথা বলোনি ,ভালোবাসার চোখে তাকাও নি ।আমি একা একা সারাদিন এই খাটে পড়ে থাকি।ছোট্ট জানালা দিয়ে আকাশ দেখে দিন কাটে।কিন্তু আমি প্রতিটি ক্ষণ শুধু প্রতীক্ষায় থাকি তোমার এক চিলতে হাসি দেখবো বলে ।
ঊর্মির চোখের কোণ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ে!
-জানো শাহরিয়ার!আমি তোমার হাসিমাখা চেহারার বাস্তব রূপ ভুলেই গেছি ।একদম যেন না ভুলি,তাই তোমার হাসিমাখা একটা ছবিটা বালিশের নিচে রেখে দিয়েছি।কিন্তু ,আমার হাত প্যারালাইজড থাকায় আমি সেটা বের করে দেখতে পারি না ।কাজের মেয়েটা থাকলে ওকে বলি ছবিটা আমার চোখের সামনে মেলে ধরার জন্য !তোমার মনে সুখ নেই ,জানি ।তবুও,একটিবার তুমি আমার দিকে তাকিয়ে একটু ক্ষণের জন্য হাসো ,শাহরিয়ার,প্লিজ,প্লিজ।
শাহরিয়ার চুপচাপ বসে থাকে !ছয় বছর সে ঊর্মির সাথে ,তার এতো প্রিয় মানুষটার সাথে হেসে কথা বলে নি !এতোটা বছর মরা লাশের মতো সারা পৃথিবী থেকে আলাদা হয়ে ঊর্মি এখানে পড়েছিলো ।তার একটু ভাল ব্যবহার ই ছিলো মেয়েটার এক চিলতে আনন্দ!জীবনের নির্মমতায় এতোটা পাথর হয়ে গেছে শাহরিয়ার!
মাথা নিচু করে ঊর্মির কপালে একটা চুমু খায় সে!তার চোখ থেকে এক ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়ে ঊর্মির কপালে!