somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

অনুগল্প- সিদুরে আকা ভালোবাসা

১২ ই এপ্রিল, ২০১৬ রাত ৯:৫৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আশ্বার্য বাবুর বাড়ী যখন পৌছি তখন কনকনে শীতের সকাল। সীতাকুন্ডের নড়ালিয়া। একেবারে সমুদ্রের কাছাকাছি। একচালা টিনের ঘরে এক ছেলে আর মেয়ে রাজলক্ষীকে নিয়ে থাকে। আশ্চর্যবাবুর অতিকায় চিকন বাশের মতো চেহারা, শুকিয়ে গালের মাংসগুলো তার ভেতরে চলে গেছে। আমাকে দেখে তার কোন এক ক্লায়েন্ট মনে করে বলেন, বাবু আপনি আসবেন, সে দোকানদার কানাই আমাকে বলেছে। ঘুমের পরে সকালে হাতে কোন পানি স্পর্শ না করলে হাতের সঠিক গননা করা যায়। তিনি গণক। মানুষের ভাগ্য গণনা করেন। ছেলের বয়স ২২ বছর। এখন সে পুরোদমে নেমেছে এই ব্যবসায়। সকালে ফ্রেশ হয়ে বের হয়েছি। আশ্চর্যবাবু যখন হাতটা বের করতে বললেন, তখন বললাম- বাবু আপনি যাকে ভাবছেন, আমি সে না। আমি উপকুলীয় একটা জরিপ কাজে এসেছি। তিনি মুহুর্তেই যেন কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে গেলেন। বললেন, ও.... আচ্ছা! সাহায্য সহযোগীতা পাওয়া যাবে এই ভেবে অনেকটা সমাদরীয় পরিবেশ তৈরী করতে উঠে তরিঘরি করতে করতে ডাকলেন- ও রাজলক্ষী, রাজলক্ষী......... এই বলে ভেতরে চলে গেলেন।
রাজলক্ষীর নমস্কার টুকু কানে পৌছা মাত্র সামনে চোখ তুলে তাকালাম। একি! এ যেন হৈমন্তী! নাকি বিলাসী! রাজলক্ষীর চিকন লালচে ঠোট, বাকা চাদের ভ্রু আর রেশমী কালো চুল। চোখ খানা কাজল কালো।রাশ ভারী চোখের পাতা। কালো চাদরে ঢাকা শরীরের উপর মুখখানা চাদের মতো জ্বলজ্বল করছে। রাজলক্ষীর বয়স ২৫। গত বছর তিনেক আগে বিয়ের সব ঠিকঠাক ছিলো রাজলক্ষীর। কিন্তু টাকার দেনা-পাওনা না মেটানোতে বিয়ে হয়নি। হিন্দু পরিবারের মেয়েরা যতই সুন্দরী হোক বিয়েতে তাদের প্রচুর খরচা হয়। একখনা জীর্ণ আধা-ভাঙ্গা টুল সামনে এনে এককাপ আদার চা আর একটা বিস্কুট এগিয়ে দিয়ে রাজলক্ষী বললো- নিন । প্রচন্ড ঠান্ডায় চা বিস্কুট পেয়ে ভালই লাগলো। বললাম, এই সমুদ্রের দারিদ্র জনগোষ্ঠীর এই প্রজেক্টের জন্য স্থানীয় একজন সহসঙ্গী লাগবে। যিনি আমার কাজে সহযোগীতা করবেন। তাকে প্রতি মাসে চার হাজার টাকা দেওয়া হবে। রাজলক্ষী বললো, তা কি কাজ করতে হবে। বললাম, বাড়ী বাড়ী গিয়ে তাদের সাথে কথোপকথোন। বলল, আমি কি পারব, স্যার। তুমি মেয়ে মানুষ! তাছাড়া পরিবারের সম্মতি ছাড়া তো হবেনা। ভেতরে গিয়ে বাবা-মা কে রাজি করালো রাজলক্ষী। এরপর আশ্চর্য্যবাবু অতিকায় উতসাহের সহিত অনেকটা হাতে তুলে দেওয়ার মতো করে বললেন, বাবু আমার অর্থাভাবে মেয়েটার বিয়ে হয়নি। যদি বাবু কৃপা করে ওকে একটু কাজ দেন তবে ভগবানের মঙ্গল হয়।
রাজলক্ষীকে প্রজেক্টের কাজে নিলাম।প্রজেক্টের কাজে রাজলক্ষীর সহযোগীতা খুবই ভালো। কাজ শেষে রিপোর্ট ও এসাইনমেন্ট গুলো সবই শিখে দেওয়ার পর নিজে নিজেই করে ফেলেছে। বিকেলে অফিসে কাজগুলো দেখে বললাম, তুমি তো এ প্রজেক্টের সব কাজ পারো। কাল থেকে বাড়ী বাড়ী গিয়ে জড়িপের কাজটা তুমি শেষ করবে।
শুধু বললো, আমি একা।
পরদিন একাই চলে গেল রাজলক্ষী। জরিপ শেষে ফিরলো অফিসে। দেখছি রাজলক্ষীর মনটা খুব খারাপ।
বললাম, কি হয়েছে তোমার। কোন উত্তর দিলনা। পরে বললো, সমুদ্রপারের কিছু লোক ফেরার পথে পিছু নিয়েছিলো। বুঝতে পারলাম, ওকে একা পাঠানো ঠিক হয়নি। বললাম, কাল থেকে আমিও যাবো।
এ সপ্তাহের মধ্যেই কিছু রিপোর্ট পাঠাতে হবে। তাই পরদিন সমস্ত কাজ শেষ করতে দুপুর গড়িয়ে গেল। শেষ অংশ ছিলো সন্দীপের কিছু জায়গা। বললাম, সন্দীপ গিয়ে কি আজ ফিরতে পাবো? বললো, যেতে একঘন্টা লাগবে। আসতে পারবো তবে সন্ধা হবে। তাড়াতাড়ি বাশবাড়ীয়া ঘাটে গিয়ে সন্দীপের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলাম। ঘাটে নেমে ঘাটের কাছে একটা হোটেলে দুজনে দুপুরের খাবার খেলাম। হোটেলে কিছু বাজে লোক শুধু রাজলক্ষীর দিকে তাকাচ্ছিলো। বিষয়টা খারাপ লাগছিলো, তাই তাড়াতাড়ি চলে আসলাম। এরপর এলাকাটা একে একে জরিপ করলাম। বাড়ী বাড়ী গিয়ে ক্লান্ত হয়ে গেছি। সমুদ্রের পাড়ের বেশীরভাগ মানুষ বাড়ীতে থাকেনা। তাই অনেক সময় লাগলো। প্রায় সন্ধা ঘনিয়ে আসছে। এবার যেতে হবে। ঘাটে এসে দেখি নৌকা বা কোন বোট নেই। শুধু দুটো মাছ ধরার নৌকা ঘাটে বাধা। এবার কি হবে!? আমরা ঘাট বরাবর দুজনে দাড়িয়ে আছি। কিছু লোক আমাদের দিকে আসছে।দেখে রাজলক্ষী আমার থেকে একটু দুরে


সরে গিয়ে আরালে হলো। ১০-১২ জন লোক আমার সামনে এসে চোখ পাকিয়ে আছে। দেখি রাজলক্ষী এসে আমার পেছনে। শুধু ওদের কাছে থেকে শুনলাম-হুগ্গো কে? আমি বলার আগেই রাজলক্ষী বললো- ও আমার স্বামী। ওর কথা শুনে অবাক হলাম। সবাই চলে গেল। আমি রাজলক্ষীর দিকে তাকালাম। দেখি কপালে সিদুর। বললাম, একি তুমি এটা কখন পড়লে। বিপদ হতে পারে বলেই সাথে করে এনেছিলাম। বললো, আপনি জানেন না এখানকার মানুষরা খুব খারাপ। আপনার সাথে আমার কোন সম্পর্ক নাই জানলে আপনার খুব বিপদ হতো। এখানকার মানুষেরা পর নারীর সাথে কাউকে দেখলে তাকে বেদমপ্রহার করে। তারপরেও ওরা আবার আসতে পারে। এর আগেই আমাদের এখান থেকে যেতে হবে। কিন্তু কোন উপায় কি! কিছুক্ষণ পর দেখি এক জেলে আসছে। বললো আপনার কি সীতাকুন্ড থেকে আসছেন? বললাম হ্যা। বললো, ওইখানে আপনাদের নিয়ে কথা হইতেছে। আপনার এখানে থাইকেন না। বললাম, আমাদের একটু পার করার ব্যবস্থা করবেন? উনি কিছুক্ষন চিন্তা করলেন। বললেন, আপনারা আমার ঐ মাছধরা নৌকার মধ্যে গিয়ে বসেন। আমরা দুজন গিয়ে বসলাম। মাঝি বৈঠা নিয়ে এলো। নৌকা ছেড়ে দিলো। আমরা দুজন ভেতরে চুপ করে বসে আছি। প্রচন্ড ভয় লাগছে। কোথায় নৌকা যাচ্ছে বুঝতে পারলাম না। প্রায় ঘন্টাখানেক পর মাঝি বললো, নামেন। বললাম, এটা কোথায়। বললো, আপনারা এখনও এপাড়েই আছেন। ঘাট থেকে অনেকদুরে এটা। এখানে আমার বোনের বাড়ী আছে। আজ রাত আপনাদের এখানেই থাকতে হবে। কাল ছাড়া যাবার পথ নেই। আবার ওরা আপনাদের খুজতে পারে। আপনাদের রেখে আমাকে যেতে হবে। না হলে ওরা বুঝবে আপনারা এখানে আছেন। মাঝি পেছনে পেছনে সমুদ্র পাড়ের কোন পথে এলাম বুঝলাম না। শুধু ভয় আর উতকন্ঠা নিয়ে আমি আর রাজলক্ষী চললাম। আধাঘন্টা পরে থামলাম। দেখি একচালা ঘরে কুপির আলো জ্বলছে। মাঝির ডাকে ঘর থেকে বেরিয়ে এলো এক মহিলা। মাঝি আমাদের বাইরে রেখে ভেতরে যেতে যেতে বললো, আপনারা একটু দাড়ান। কিছুক্ষন পর তার বোন সহ দুজনে বের হলো। মহিলাটি বললো, এই পাশের ঘরে আসেন। একটা কুপি নিয়ে আমাদের ভেতরে নিয়ে গেল। বললো আপনারা শুইয়া পড়েন। কোন কথাবার্তা বইলেন না। এখানকার মানুষ ভালো না। কেউ টের পাইলে অসুবিধা হইবো।সকাল হইলে আর কোন অসুবিধা নাই। এই বলে উনি কুপি নিয়ে দরজাটা বন্ধ করে চলে গেলেন।
ভয় আর উতকন্ঠায় আমি আর রাজলক্ষী শুয়ে আছি। শীতের তীব্রতা। একটা পাতলা জীর্ণ ময়লা কাথা গায়ে। ভাবনার অতলে যেতে যেতে কত সময় অতিবাহিত হয়েছে জানিনা। একবার পাশ ফিরে রাজলক্ষীর দিকে হাত বাড়ালাম। দেখি শীতে সে কাপছে। আমি কাথাটা দু-স্তর করে শুধু ওর গায়ে দিলাম। ও দেখে আস্তে করে বললো, আমার সমস্যা নেই, আপনার খুব কষ্ট হচ্ছে। বললাম না, ঠিক আছি। আমি রাতটা ঠিক পার করে নিতে পারবো। রাজলক্ষী মানলো না। কাথাটা আমার গাযে দিলো। আমি বুঝলাম সে মানবেনা। বললাম, নাও তুমিও নাও। রাত গভীর। কারো চোখে ঘুম নেই। হঠাত বেড়ার কাছে কিছু চলে যাওয়ার একটা শব্দ হলো। ভয়ে রাজলক্ষী আমকে জড়িয়ে ধরলো। ওর নি:শ্বাসের উপর আমার নিশ্বাস। ওর নি:শ্বাসের মৌমিত ঘ্রান দুর করলো ভেতরের সব ভয়। ওকে শক্ত করে ধরলাম। আমার আহবানেই প্রকাশিত হলো তার লুকানো মনের উথালপাথাল ঢেউ। মন ভাসিয়ে চললাম তার রঙিল হাওয়ায়। প্রকৃতির কনকনে ঠান্ডা হেরে গেছে ভালবাসার সীমারেখার কাছে। দুজনের উন্মাদনায় কখন নিরাবরন হয়েছিলো জানিনা। আগুনের উত্তাপ থামার পর শরীরে ঠান্ডার অনুভুতি আবার জড়িয়ে রাখলো দুজনকে। তখন শুধু কানে এটুকু শুনলাম, এ আমার সিদুরের প্রাপ্তি; এ আমার সিদুরে আকা ভালবাসা।
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই এপ্রিল, ২০১৬ রাত ১০:০১
৫টি মন্তব্য ৫টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

চুরি করাটা প্রফেসরদেরই ভালো মানায়

লিখেছেন হাসান মাহবুব, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৫৩


অত্র অঞ্চলে প্রতিটা সিভিতে আপনারা একটা কথা লেখা দেখবেন, যে আবেদনকারী ব্যক্তির বিশেষ গুণ হলো “সততা ও কঠোর পরিশ্রম”। এর মানে তারা বুঝাতে চায় যে তারা টাকা পয়সা চুরি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শিব নারায়ণ দাস নামটাতেই কি আমাদের অ্যালার্জি?

লিখেছেন ...নিপুণ কথন..., ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৫:৫৭


অভিমান কতোটা প্রকট হয় দেখেছিলাম শিবনারায়ণ দাসের কাছে গিয়ে।
.
গত বছরের জুন মাসের শুরুর দিকের কথা। এক সকালে হঠাৎ মনে হলো যদি জাতীয় পতাকার নকশাকার শিবনারায়ণ দাসের সঙ্গে দেখা করা সম্ভব... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঘুষের ধর্ম নাই

লিখেছেন প্রামানিক, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:৫৫


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

মুসলমানে শুকর খায় না
হিন্দু খায় না গাই
সবাই মিলেই সুদ, ঘুষ খায়
সেথায় বিভেদ নাই।

হিন্দু বলে জয় শ্র্রীরাম
মুসলিম আল্লাহ রসুল
হারাম খেয়েই ধর্ম করে
অন্যের ধরে ভুল।

পানি বললে জাত থাকে না
ঘুষ... ...বাকিটুকু পড়ুন

প্রতি মাসে সামু-ব্লগে ভিজিটর কত? মার্চ ২০২৪ Update

লিখেছেন জে.এস. সাব্বির, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:০৮

মার্চ ২০২৪ সালে আমাদের প্রিয় সামু ব্লগে ভিজিটর সংখ্যা কত ছিল? জানতে হলে চোখ রাখুন-

গত ৬ মাসের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ভিউ ছিল জানুয়ারি মাসে। ওই মাসে সর্বমোট ভিজিট ছিল ১৬... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইরান-ইজরায়েল দ্বৈরথঃ পানি কতোদূর গড়াবে??

লিখেছেন ভুয়া মফিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:২৬



সারা বিশ্বের খবরাখবর যারা রাখে, তাদের সবাই মোটামুটি জানে যে গত পহেলা এপ্রিল ইজরায়েল ইরানকে ''এপ্রিল ফুল'' দিবসের উপহার দেয়ার নিমিত্তে সিরিয়ায় অবস্থিত ইরানের কনস্যুলেট ভবনে বিমান হামলা চালায়।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×