somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

চিকিৎসার মাধ্যমে কি একজন সমকামী ব্যক্তিকে বিষমকামী ব্যক্তিতে পরিবর্তন করা যায়?

০৮ ই নভেম্বর, ২০১৭ সন্ধ্যা ৭:৪৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

দেশের উত্তরাঞ্চলের বিভাগীয় শহর রংপুরের সদ্য কৈশোর পেরিয়ে আসা ১৮ বছর বয়সী সাদমান ইমাম দেশের সর্বোচ্চ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া হাসি খুশিতে ভড়া এক প্রাণবন্ত তরুন। শারীরিকভাবে পুরুষ মানুষের বৈশিষ্ট্য বহন করলেও মানসিকভাবে যে কিনা মেয়ে মানুষকে ধারণ করে। শিশুকাল থেকে তাঁর ছেলেদের চেয়ে মেয়েদের সাথে বেশি মিশতে ইচ্ছে করে। তাঁর প্রতিবেশি ছেলে বন্ধুরা যখন বাড়ির বাহিরে ছুটাছুটি খেলাধুলায় মত্ত্ব, তখন সে তাঁর প্রতিবেশি মেয়েশিশুদের সাথে তথাকথিত পুতুলের বিয়ে খেলা নিয়ে ব্যস্ত। তাঁর কেন জানি মায়ের মত করে সর্বদা বউ সাঁজতে ইচ্ছে করে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাঠ চুকিয়ে উচ্চবিদ্যালয়ে পড়াকালীন সময়ে যখন তাঁর ছেলে বন্ধুরা মেয়েদের প্রতি বিভিন্নরকম আকর্ষন অনুভবের কথা আলোচনা করত তখন সে তারই বিদ্যালয়ের বড় ভাইদের প্রতি ভাললাগা অনুভব করত। এভাবে উচ্চবিদ্যালয় পাঠ শেষে কলেজে অধ্যয়নের সময় সে মেয়েদের পরিবর্তে ছেলেদের প্রতি ভাললাগা আর ভালবাসার বিষয়টি স্পষ্টভাবে বুঝতে পারে। বুঝতে পারে যে সে শারীরিকভাবে পুরুষের দেহ ধারণ করলেও মানসিকভাবে সে নারী বৈশিষ্ট্য ধারণ করছে। লজ্জায় বিষয়টি নিয়ে সে কারো কাছে আলোচনা করার সাহস পায় না।

পুরুষ দেহে নারী মানসিকতা ধারণ করায় এবং তা কারো সাথে শেয়ার করতে না পারায় প্রথম প্রথম সে মানসিকভাবে খুব বিষন্নতায় ভুগত এবং অতিরিক্ত দুঃশ্চিন্তা করত। ফলে এক সময় সে শারীরিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ে। মাথায় প্রচন্ড যন্ত্রনার সাথে মাঝে মাঝে সে অচেতন হয়ে পড়তে থাকে। চিকিৎসার জন্য সে রংপুর শহরের একটি স্বনামধন্য প্রাইভেট ক্লিনিকের একজন স্বনামধন্য চিকিৎসকের নিকট স্বরনাপন্ন হন। সিটিস্কানসহ প্রয়োজনীয় পরীক্ষা নিরীক্ষান্তে তেমন জটিল কোন অসুখের অস্তিত্ত্ব না পেয়ে একসময় তাঁর ব্যক্তিগত ইতিহাস জানতে গিয়ে পুরুষ হওয়া স্বত্তেও নিজের মধ্যে নারীর মানসিক বৈশিষ্ট্য ধারণের বিষয়টি উক্ত চিকিৎসক অবগত হন এবং তিনি তাকে চিকিৎসার মাধ্যমে পুরুষ দেহে নারী মানসিক বৈশিষ্ট্য ধারণের বিষয়টি পরিবর্তনের মাধ্যমে নিরাময়ের পরামর্শ প্রদান করেন। এজন্য তিনি ব্যবস্থাপত্র হিসাবে তাকে বিভিন্ন স্টেরয়েড জাতীয় ঔষধ প্রদান করেন এবং তাকে হরমোন থেরাপি গ্রহণের ব্যবস্থাপত্র প্রদান করেন।

শুধু সাদমান ইমাম নয়, আমাদের দেশে এরকম ঘটনা প্রতিনিয়ত বহু সমকামী ব্যক্তির ক্ষেত্রে ঘটে চলেছে। চিকিৎসার মাধ্যমে সমকামী ব্যক্তির যৌন প্রবৃত্তি পরিবর্তন করা যায় এমন অসম্ভব এবং অবৈজ্ঞানিক তত্ত্ব প্রচার করে এখনো অনেক সমকামী ব্যক্তিকে তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে বিভিন্ন ঔষধ সেবন সহ বিভিন্ন প্রকার থেরাপি নিতে বাধ্য করা হচ্ছে। এমনকি বিপরীত লিঙ্গের নারী পুরুষ সাথে জোরপূর্বক যৌন সহবাসে বাধ্য করা বা বিপরীত লিঙ্গের নারী পূরুষের দ্বারা ধর্ষন করা সহ ইচ্ছার বিরুদ্ধে জোরপূর্বক বিবাহ দেয়ার মত ঘটনা অহরহ ঘটে চলেছে। যা সমকামী ব্যক্তিদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর মারাত্বকভাবে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। ফলশ্রুতিতে অনেক সময় তারা আত্বহত্যার মত চরম পথ বেঁছে নিচ্ছে।

এখন প্রশ্ন হলো চিকিৎসার মাধমে কি একজন ব্যক্তির যৌন প্রবৃত্তি পরিবর্তন করা সম্ভব বা চিকিৎসার মাধমে কি একজন সমকামী ব্যক্তিকে বিষমকামী ব্যক্তিতে রুপান্তর করা যায়? উপরোল্লেখিত বিষয়টির উত্তর পেতে হলে আমাদের প্রথমেই জানতে হবে যে সমকামিতা কি এবং সমকামিতা কোন অসুখ বা মনোবিকার নাকি একজন মানুষের স্বাভাবিক যৌন প্রবৃত্তি?

সমকামিতা হলো মানুষের (অন্য প্রানীর ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য) এমন একটি যৌন প্রবৃত্তি যার ফলে একজন পুরুষ বা মহিলা সমলিঙ্গের প্রতি ভালবাসা, প্রেম বা জৈবিকভাবে আকর্ষণ বোধ করে। আর যেসব পুরুষ বা মহিলা সমলিঙ্গের প্রতি উল্লেখিত আকর্ষন বোধ করে তারা সমকামী। সমকামীদের মধ্যে বিভিন্ন ধরণ রয়েছে এবং বিভিন্ন নামে আখ্যায়িত করা হয়, ইংবেজীতে যাদের একত্রে এলজিবিটি বলা হয়। যেসব নারী শুধুমাত্র নারীর প্রতি শারীরিক ও মানসিক ভাবে আকর্ষন বোধ করে তাদের লেসবিয়ান, যেসব পুরুষ শুধুমাত্র পুরুষের প্রতি শারীরিক ও মানসিকভাবে আকর্ষন বোধ করে তাদের গে, যেসব নারী বা পুরুষ নারী ও পুরুষ উভয়ের প্রতি শারীরিক ও মানসিকভাবে আকর্ষন বোধ করে তারা বাইসেক্সুয়াল বা উভকামী এবং যেসব নারী বা পুরুষ লিঙ্গ পরিবর্তন করে বা সঠিক লিঙ্গ নির্ধারণ সম্ভব হয়নি তাদের ট্রান্সজেন্ডার বা রুপান্তরকামী বলা হয়।

যৌন প্রবৃত্তি মানুষের সহজাত বা আচরণগত দু’ প্রকারের প্রবৃত্তি হতে পারে। ঠিক তেমনি সমকামিতা বা সমলিঙ্গের প্রতি শারীরিক ও মানসিকভাবে আকর্ষন বোধ করাও মানুষের সহজাত বা আচরণগত উভয় প্রকার প্রবৃত্তি হতে পারে। আচরণগত যৌনপ্রবৃত্তি পরিবর্তনশীল হলেও থেরাপী বা ঔষধ যাই প্রয়োগ করা হোক না কেন জন্মগত যৌন প্রবৃত্তি কোনভাবেই পরিবর্তন করা সম্ভব নয়। যদিও সমকামিতার কারণ সম্পর্কে সর্বজন স্বীকৃত একক কোন সিদ্ধান্ত এখনো পাওয়া যায়নি, তারপরও মানব জীনের গঠন এবং মানুষের মস্তিষ্কের হাইপোথ্যালাস নামক একটি অংশের মাধ্যমে সমকামিতা বা সমলিঙ্গের প্রতি শারীরিক ও মানসিকভাবে আকর্ষন বোধ করা অনেকাংশে নিয়ন্ত্রিত হয় বলে বৈজ্ঞানিক গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে।

বিংশ্ব শতাব্দীর শেষভাগের আগ পর্যন্ত সমকামিতাকে মানসিক রোগ বলে বিবেচনা করা হলেও বিজ্ঞানের সর্বাধুনিক গবেষণায় তা সর্বস্বীকৃতভাবে একক সত্য বলে প্রমানিত হয়নি। তাইত ১৯৭৩ সালে আমেরিকান সাইকোলজিক্যাল এ্যাসোসিয়েশন সমাকামীতা কোন রোগ নয় বলে ঘোষনা দেয় এবং ১৯৮১ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা তাদের মানসিক রোগের তালিকা থেকে সমকামিতাকে বাদ দিয়েছে। বিজ্ঞানীরা আজ মেনে নিয়েছে যে সমকামীতা প্রকৃতি জগতের এক বাস্তবতা। ইহা কোন মানসিক রোগ বা জেনেটিক ডিফেক্ট নয়।

তাঁরপরও বর্তমানে আমাদের দেশের শিক্ষিত অশিক্ষিত অধিকাংশ মানুষই মনে করেন যে, সমকামিতা একটি মানসিক রোগ এবং চিকিৎসার মাধ্যমে তা নিরাময় করা সম্ভব। আমরা যদি রোগের সংজ্ঞার সাথে তুলনা করি তাহলে দেখব যে সমকামীতা শরীরে কোন ব্যথা বা বেদনার সৃষ্টি করে না বা শরীরের কোণ কার্যক্রম বিনষ্ট করে না, ফলে সমকামীতা আলৌ কোন রোগ নয়, ইহা একটি স্বাভাবিক যৌন প্রবৃত্তি। আর স্বাভাবিক যৌন প্রবৃত্তি কোন রোগ নয়, যা চিকিৎসার মাধ্যমে নিরাময় করা যায়।

উন্নত বিশ্বের কোন আধুনিক চিকিৎসকই এখন আর সমকামীতাকে রোগ বা বিকৃতি বলে চিহ্নিত না করলেও রংপুরের উল্লেখিত সেই লাইসেন্সধারী চিকিৎসকের মত চিকিৎসকরা আজো সমকামীতাকে রোগ হিসাবে চিহ্নিত করে চিকিৎসার মাধ্যমে নিরাময় করার অপপ্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে। শুধু চিকিৎসকই নয়, কিছু কিছু তথাকথিত উচ্চশিক্ষিত আইনজীবী, শিক্ষক ও অন্যান্য সম্মানজনক পেশায় নিয়োজিত ব্যক্তিবর্গও বিজ্ঞানের সমকামীতা সম্পর্কে সর্বাধুনিক আপডেট সম্পর্কে অবগত না হয়ে বা অবগত হয়েও তা মেনে নেয়ার মানসিকতা না থাকায় সমকামিতাকে মনোবিকার বলে চিহ্নিত করে চিকিৎসার মাধ্যমে সংশোধনের অপপ্রয়াস ও অপপ্রচার চালিয়ে যাচ্ছে। যা সত্যই চরম হতাশাজনক এবং সমকামিতাকে সংশোধনের চেষ্টা করাটা মনোসামাজিক কুসংস্কার ছাড়া আর কিছুই নয়।

তাই, রাস্ট্রের একজন সচেতন নাগরিক হিসাবে আসুন সমকামীদের যৌনপ্রবৃত্তি পরিবর্তনের অসম্ভব ও অবৈজ্ঞানিক চেষ্টা না করে সবায় মিলে তাদের সমঅধিকার ও সমসুযোগ প্রদানের মাধ্যমে এ সমাজে মানুষের মত হয়ে বেঁচে থাকার নিশ্চয়তা প্রদান করি এবং তাদের ঘৃনা না করে আপন করে লই।
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই নভেম্বর, ২০১৭ সন্ধ্যা ৭:৪৩
৭টি মন্তব্য ৭টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

কুড়ি শব্দের গল্প

লিখেছেন করুণাধারা, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:১৭



জলে ভাসা পদ্ম আমি
কোরা বাংলায় ঘোষণা দিলাম, "বিদায় সামু" !
কিন্তু সামু সিগারেটের নেশার মতো, ছাড়া যায় না! আমি কি সত্যি যাবো? নো... নেভার!

সানমুন
চিলেকোঠার জানালায় পূর্ণিমার চাঁদ। ঘুমন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

ধর্ম ও বিজ্ঞান

লিখেছেন এমএলজি, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৪:২৪

করোনার (COVID) শুরুর দিকে আমি দেশবাসীর কাছে উদাত্ত আহবান জানিয়ে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম, যা শেয়ার হয়েছিল প্রায় ৩ হাজারবার। জীবন বাঁচাতে মরিয়া পাঠকবৃন্দ আশা করেছিলেন এ পোস্ট শেয়ারে কেউ একজন... ...বাকিটুকু পড়ুন

তালগোল

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৩৫


তু‌মি যাও চ‌লে
আ‌মি যাই গ‌লে
চ‌লে যায় ঋতু, শীত গ্রীষ্ম বর্ষা
রাত ফু‌রা‌লেই দি‌নের আ‌লোয় ফর্সা
ঘু‌রেঘু‌রে ফি‌রে‌তো আ‌সে, আ‌সে‌তো ফি‌রে
তু‌মি চ‌লে যাও, তু‌মি চ‌লে যাও, আমা‌কে ঘি‌রে
জড়ায়ে মোহ বাতা‌সে ম‌দির ঘ্রাণ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

মা

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৩


মায়াবী রাতের চাঁদনী আলো
কিছুই যে আর লাগে না ভালো,
হারিয়ে গেছে মনের আলো
আধার ঘেরা এই মনটা কালো,
মা যেদিন তুই চলে গেলি , আমায় রেখে ওই অন্য পারে।

অন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

কপি করা পোস্ট নিজের নামে চালিয়েও অস্বীকার করলো ব্লগার গেছে দাদা।

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:১৮



একটা পোস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ আগে থেকেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। পোস্টটিতে মদ্য পান নিয়ে কবি মির্জা গালিব, কবি আল্লামা ইকবাল, কবি আহমদ ফারাজ, কবি ওয়াসি এবং কবি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×